ভারতের ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’ ও চীন নীতি by জগন্নাথ পান্ডা
ভারত
স্বপ্ন দেখে একটি ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’। এখানে থাকবে অংশীদারিত্বের আঞ্চলিক
নেতৃত্ব। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেখানে বড় ও ছোট শক্তিগুলোর থাকবে
সমান অবস্থান। এই মডেলটা এমন নীতির ওপর ভিত্তি করে যে, এশিয়ায় চীনের উত্থান
আঞ্চলিক শক্তি কাঠামোকে ভারসাম্যহীন করে দিচ্ছে এবং ভারতের কৌশলগত পছন্দের
ক্ষতি করছে। চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সংযুক্তি বৃদ্ধির
মেকানিজম নয়াদিল্লিকে বেইজিংয়ের সঙ্গে আরো উন্মুক্ত করেছে যখন, তখন আধিপত্য
বিস্তারে চীনের কৌশলের বিষয়ে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ভারতের ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’ দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমত, বৈশ্বিক শাসনে অধিকতর সমতা, বহুত্ববাদ ও প্রতিনিধিত্বমূলক করার লক্ষ্য ভারতের। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার কারণে কাঠামোগত সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করছে বেইজিং।
তাই বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়া বিষয়ক এসব পরিষদে, প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে, চীনের সঙ্গে সম শক্তি অর্জন করা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য। বৈশ্বিক পর্যায়ে এশিয়ায় জাপানের সঙ্গে, জার্মানি ও ব্রাজিলের সঙ্গে জি-৪ এর সঙ্গে নয়া দিল্লির জোট তার বহুত্ববাদী প্রবণতার প্রতিফলন ঘটায়।
দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের ভূমিকা অবশ্যই এশিয়ার ছোট ও বড় শক্তিগুলোর থাকতে হবে। আসিয়ানকেন্দ্রিক কৌশলের প্রতি ভারতের সমর্থন এটাই নিশ্চিত করে যে, তারা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতিকরণের বিষয়ে পরামর্শ বিষয়ক মেকানিজমকে গুরুত্ব দেয়, যেমনটি রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ থেকে করে।
আঞ্চলিকভাবে, মাল্টিপোলার এশিয়া বা বহুত্বপন্থি এশিয়া ভারতের সমুদ্র অঞ্চলকে শক্তিশালী করবে। ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধপূর্ণ কোনো নৌ অঞ্চল নেই। কিন্তু ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথভাবে তেল অনুসন্ধান কাজে যোগ দেয়া সহ দক্ষিণ চীন সাগরে ভারতের বাণিজ্যিক উপস্থিতিতে বিরক্ত চীন। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা উপকূলে বার বার চীনের সাবমেরিনের দুঃসাহসিক অভিযানে বেশ অস্বস্তিতে আছে ভারত। নৌপথের সঙ্গে যুক্ত সিল্ক রোডের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে নৌবিষয়ক অবকাঠামো নির্মাণ করছে বেইজিং। এতে ভ্রু উত্থাপন করা হচ্ছে।
একটি ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’র বিষয়কে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হলো গণতান্ত্রিক, আইনভিত্তিক বিষয়; যা নৌচলাচলে স্বাধীনতা দেবে এবং তার বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজন। বেইজিংয়ের ‘গ্রে-জোন’ কৌশল দৃশ্যত এতটাই ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষতিকর যে, বহু দেশের পক্ষেই তাদেরকে একা চ্যালেঞ্জ জানানো কঠিন হবে। এ অঞ্চলে চীন যেভাবে তার ক্ষমতার বিস্তার করছে তাতে ভারসাম্যতা আনার জন্য অধিকতর ‘অবাধ, মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণমুলক ইন্দো-প্যাসিফিক’ ঐক্যমত হবে সমন্বিত প্রচেষ্টা।
ভারতের বহুত্ববাদের দিকে ধাবিত হওয়ার তৃতীয় স্তম্ভটি হলো বর্জনের পরিবর্তে সবার অংশগ্রহণমূলক। ‘মাল্টিপোলারিটি’তে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহিঃশক্তিকে স্থান করে দেয় আঞ্চলিক নিরাপত্তা নির্মাণে অবদান রাখতে। এশিয়ার তিনটি বড় শক্তি ভারত, চীন ও জাপানের মধ্যে অংশীদারিত্বের নেতৃত্ব স্থাপনে আঞ্চলিক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনে এটা অনুমোদন দেয় ভারতকে। নয়া দিল্লির দিক থেকে, যদি এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দেয়া হয়, তাহলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘এশিয়া ফর এশিয়ানস’ প্রস্তাবনা থেকে যাবে একমাত্র উপায়। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া হয়ে উঠবে চীন আধিপত্যের অঞ্চল।
ভারত দৃশ্যত এমনটা মনে করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে পুরোপুরি অনুমোদন না দিলেও সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে তারা হয়ে উঠবে শক্তিশালী অংশীদার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম ২+২ সংলাপের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত স্বাক্ষর করেছে ‘কমিউনিকেশনস, কমপ্যাটিবিলিটি, সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট’ নামের চুক্তি। যদি ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত ‘সিভিল নিউক্লিয়ার এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করাকে নতুন করে সূচনা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ২০১৬ সালের ‘লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’ এবং ‘কমিউনিকেশনস, কমপ্যাটিবিলিটি, সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট’ ওই ধারাকে আরো বেশি শক্তিশালী করবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি দিয়ে, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অনাগ্রহিতাকে বোঝায় না। নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের পররাষ্ট্রনীতি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে লালন অব্যাহত রাখবে। ভারত বুঝতে পেরেছে যে, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে চীনের অসন্তোষের করণীয় কমই আছে। তবে বেশি করণীয় আছে আন্তর্জাতিক অবকাঠামোতে, যেমন ব্রেটন উডস ইন্সটিটিউশনে। প্রেসিডেন্ট শির অধীনে চীনের পররাষ্ট্রনীতি কতটা সংস্কারবাদ হিসেবে দৃশ্যমান তা কোনো ব্যাপারই নয়। তবে প্রাথমিকভাবে আইএমএফ, ডব্লিউটিও এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব-আধিপত্যই প্রাথমিকভাবে বেইজিংয়ের অসন্তুটির বিষয়।
কম পশ্চিমা আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চীন অব্যাহতভাবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান অনুমোদন করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে ভারত। প্রাথমিকভাবে ব্রেটন উডস ইন্সটিটিউটকে সংস্কারে চাপ প্রয়োগে চীনের সঙ্গে তারা কাজ করছে। নয়া দিল্লির প্রভাবকে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করেছে বেইজিং। তারা নয়া দিল্লিকে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের পূর্ণাঙ্গ সদস্য করেছে। এশিয়ান ইনফ্রাকস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে ভারতকে।
অন্য কথায়, আঞ্চলিক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনকে মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে চীনের কাছে পৌঁছাতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী করবে একটি ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’। বহুত্বপন্থি নীতির এই কাঠামো ভারতকে উন্নততর অবস্থানে যেতে সহায়তা করবে। চীন সমর্থিত বা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ইন্সটিটিউশনগুলোর ভিতরে বা বাইরে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ না করলেও ভারত সুবিধা পাবে।
চীন সমর্থিত বহুজাতিক সংস্থা যেমন এআইআইবি, এনডিবি এবং এসসিও’কে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। এআইআইবির দ্বিতীয় বৃহৎ অংশীদার হিসেবে নয়া দিল্লি সব সময় এটাকে এশিয়ার বহুদেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখছে সব সময়। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবকাঠামো খাতে সুবিধা দেবে। তাই এআইআইবি’তে ভারতের যোগ দেয়াকে দেখা হয় একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে, যেখানে বহুদেশীয় প্রতিষ্ঠানে তারা পায় প্রশাসনিক বৃহত্তর ভূমিকা।
পক্ষান্তরে, সব সময়ই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিষয়ে শক্তিশালী আপত্তি ভারতের। সংযুক্তির উদ্যোগ হিসেবে বিআরআই-এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ভারত। তারা বলেছে, এমন পদক্ষেপ অবশ্যই হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন, উন্মুক্ত, স্বচ্ছতা ও সমতার ভিত্তিতে। বিআরআই-এর চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে ভারত দেখে থাকে কৌশলগত বিরাট একটি অন্তরায় হিসেবে। কারণ, এক্ষেত্রে ভারতের ভূখন্ডের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়ে যে স্পর্শকাতরতা আছে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারতের দৃষ্টিতে এআইআইবি এবং বিআরআইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো সার্বজনীন অংশগ্রহণ ও একতরফাপন্থি আদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি, লিঙ্ক ওয়েস্ট পলিসি, কানেক্ট সেন্ট্রাল এশিয়া পলিসি ও সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন (এএজিএআর)-এর মাধ্যমে এশিয়াজুড়ে কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতে রয়েছে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এটা তাদেরকে ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’কে আলিঙ্গন করতে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেখানে আঞ্চলিক সম্পর্কে বৃহত্তর ভূমিকা আছে নয়াদিল্লির। চীনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে, চীনের উত্থানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ভারতের সুরক্ষা ও উত্থান সমৃদ্ধ হবে।
(জগন্নাথ পান্ডা একজন রিসার্চ ফেলো। তিনি নয়া দিল্লিতে ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের ইস্ট এশিয়া বিষয়ক সেন্টার কো-অর্ডিনেটর। রুটলেজ স্টাডিজ অন থিংক এশিয়ার সিরিজ এডিটরও তিনি। আইডিএসএ’র ২০তম এশিয়ান সিকিউরিটি কনফারেন্সের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। তার এ লেখাটির বিস্তৃত প্রকাশিত হয়েছে ইস্ট এশিয়া ফোরাম কোয়ার্টারলি’তে)
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ভারতের ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’ দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমত, বৈশ্বিক শাসনে অধিকতর সমতা, বহুত্ববাদ ও প্রতিনিধিত্বমূলক করার লক্ষ্য ভারতের। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার কারণে কাঠামোগত সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করছে বেইজিং।
তাই বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়া বিষয়ক এসব পরিষদে, প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে, চীনের সঙ্গে সম শক্তি অর্জন করা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য। বৈশ্বিক পর্যায়ে এশিয়ায় জাপানের সঙ্গে, জার্মানি ও ব্রাজিলের সঙ্গে জি-৪ এর সঙ্গে নয়া দিল্লির জোট তার বহুত্ববাদী প্রবণতার প্রতিফলন ঘটায়।
দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের ভূমিকা অবশ্যই এশিয়ার ছোট ও বড় শক্তিগুলোর থাকতে হবে। আসিয়ানকেন্দ্রিক কৌশলের প্রতি ভারতের সমর্থন এটাই নিশ্চিত করে যে, তারা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতিকরণের বিষয়ে পরামর্শ বিষয়ক মেকানিজমকে গুরুত্ব দেয়, যেমনটি রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ থেকে করে।
আঞ্চলিকভাবে, মাল্টিপোলার এশিয়া বা বহুত্বপন্থি এশিয়া ভারতের সমুদ্র অঞ্চলকে শক্তিশালী করবে। ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধপূর্ণ কোনো নৌ অঞ্চল নেই। কিন্তু ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথভাবে তেল অনুসন্ধান কাজে যোগ দেয়া সহ দক্ষিণ চীন সাগরে ভারতের বাণিজ্যিক উপস্থিতিতে বিরক্ত চীন। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা উপকূলে বার বার চীনের সাবমেরিনের দুঃসাহসিক অভিযানে বেশ অস্বস্তিতে আছে ভারত। নৌপথের সঙ্গে যুক্ত সিল্ক রোডের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে নৌবিষয়ক অবকাঠামো নির্মাণ করছে বেইজিং। এতে ভ্রু উত্থাপন করা হচ্ছে।
একটি ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’র বিষয়কে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হলো গণতান্ত্রিক, আইনভিত্তিক বিষয়; যা নৌচলাচলে স্বাধীনতা দেবে এবং তার বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজন। বেইজিংয়ের ‘গ্রে-জোন’ কৌশল দৃশ্যত এতটাই ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষতিকর যে, বহু দেশের পক্ষেই তাদেরকে একা চ্যালেঞ্জ জানানো কঠিন হবে। এ অঞ্চলে চীন যেভাবে তার ক্ষমতার বিস্তার করছে তাতে ভারসাম্যতা আনার জন্য অধিকতর ‘অবাধ, মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণমুলক ইন্দো-প্যাসিফিক’ ঐক্যমত হবে সমন্বিত প্রচেষ্টা।
ভারতের বহুত্ববাদের দিকে ধাবিত হওয়ার তৃতীয় স্তম্ভটি হলো বর্জনের পরিবর্তে সবার অংশগ্রহণমূলক। ‘মাল্টিপোলারিটি’তে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহিঃশক্তিকে স্থান করে দেয় আঞ্চলিক নিরাপত্তা নির্মাণে অবদান রাখতে। এশিয়ার তিনটি বড় শক্তি ভারত, চীন ও জাপানের মধ্যে অংশীদারিত্বের নেতৃত্ব স্থাপনে আঞ্চলিক একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনে এটা অনুমোদন দেয় ভারতকে। নয়া দিল্লির দিক থেকে, যদি এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দেয়া হয়, তাহলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘এশিয়া ফর এশিয়ানস’ প্রস্তাবনা থেকে যাবে একমাত্র উপায়। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া হয়ে উঠবে চীন আধিপত্যের অঞ্চল।
ভারত দৃশ্যত এমনটা মনে করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে পুরোপুরি অনুমোদন না দিলেও সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে তারা হয়ে উঠবে শক্তিশালী অংশীদার। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম ২+২ সংলাপের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত স্বাক্ষর করেছে ‘কমিউনিকেশনস, কমপ্যাটিবিলিটি, সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট’ নামের চুক্তি। যদি ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত ‘সিভিল নিউক্লিয়ার এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করাকে নতুন করে সূচনা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ২০১৬ সালের ‘লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’ এবং ‘কমিউনিকেশনস, কমপ্যাটিবিলিটি, সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট’ ওই ধারাকে আরো বেশি শক্তিশালী করবে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি দিয়ে, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অনাগ্রহিতাকে বোঝায় না। নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের পররাষ্ট্রনীতি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে লালন অব্যাহত রাখবে। ভারত বুঝতে পেরেছে যে, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে চীনের অসন্তোষের করণীয় কমই আছে। তবে বেশি করণীয় আছে আন্তর্জাতিক অবকাঠামোতে, যেমন ব্রেটন উডস ইন্সটিটিউশনে। প্রেসিডেন্ট শির অধীনে চীনের পররাষ্ট্রনীতি কতটা সংস্কারবাদ হিসেবে দৃশ্যমান তা কোনো ব্যাপারই নয়। তবে প্রাথমিকভাবে আইএমএফ, ডব্লিউটিও এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব-আধিপত্যই প্রাথমিকভাবে বেইজিংয়ের অসন্তুটির বিষয়।
কম পশ্চিমা আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চীন অব্যাহতভাবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান অনুমোদন করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে ভারত। প্রাথমিকভাবে ব্রেটন উডস ইন্সটিটিউটকে সংস্কারে চাপ প্রয়োগে চীনের সঙ্গে তারা কাজ করছে। নয়া দিল্লির প্রভাবকে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করেছে বেইজিং। তারা নয়া দিল্লিকে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের পূর্ণাঙ্গ সদস্য করেছে। এশিয়ান ইনফ্রাকস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে ভারতকে।
অন্য কথায়, আঞ্চলিক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনকে মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে চীনের কাছে পৌঁছাতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী করবে একটি ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’। বহুত্বপন্থি নীতির এই কাঠামো ভারতকে উন্নততর অবস্থানে যেতে সহায়তা করবে। চীন সমর্থিত বা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ইন্সটিটিউশনগুলোর ভিতরে বা বাইরে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ না করলেও ভারত সুবিধা পাবে।
চীন সমর্থিত বহুজাতিক সংস্থা যেমন এআইআইবি, এনডিবি এবং এসসিও’কে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। এআইআইবির দ্বিতীয় বৃহৎ অংশীদার হিসেবে নয়া দিল্লি সব সময় এটাকে এশিয়ার বহুদেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখছে সব সময়। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবকাঠামো খাতে সুবিধা দেবে। তাই এআইআইবি’তে ভারতের যোগ দেয়াকে দেখা হয় একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে, যেখানে বহুদেশীয় প্রতিষ্ঠানে তারা পায় প্রশাসনিক বৃহত্তর ভূমিকা।
পক্ষান্তরে, সব সময়ই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিষয়ে শক্তিশালী আপত্তি ভারতের। সংযুক্তির উদ্যোগ হিসেবে বিআরআই-এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ভারত। তারা বলেছে, এমন পদক্ষেপ অবশ্যই হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন, উন্মুক্ত, স্বচ্ছতা ও সমতার ভিত্তিতে। বিআরআই-এর চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে ভারত দেখে থাকে কৌশলগত বিরাট একটি অন্তরায় হিসেবে। কারণ, এক্ষেত্রে ভারতের ভূখন্ডের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়ে যে স্পর্শকাতরতা আছে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারতের দৃষ্টিতে এআইআইবি এবং বিআরআইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো সার্বজনীন অংশগ্রহণ ও একতরফাপন্থি আদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি, লিঙ্ক ওয়েস্ট পলিসি, কানেক্ট সেন্ট্রাল এশিয়া পলিসি ও সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন (এএজিএআর)-এর মাধ্যমে এশিয়াজুড়ে কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতে রয়েছে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এটা তাদেরকে ‘মাল্টিপোলার এশিয়া’কে আলিঙ্গন করতে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেখানে আঞ্চলিক সম্পর্কে বৃহত্তর ভূমিকা আছে নয়াদিল্লির। চীনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে, চীনের উত্থানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ভারতের সুরক্ষা ও উত্থান সমৃদ্ধ হবে।
(জগন্নাথ পান্ডা একজন রিসার্চ ফেলো। তিনি নয়া দিল্লিতে ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের ইস্ট এশিয়া বিষয়ক সেন্টার কো-অর্ডিনেটর। রুটলেজ স্টাডিজ অন থিংক এশিয়ার সিরিজ এডিটরও তিনি। আইডিএসএ’র ২০তম এশিয়ান সিকিউরিটি কনফারেন্সের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। তার এ লেখাটির বিস্তৃত প্রকাশিত হয়েছে ইস্ট এশিয়া ফোরাম কোয়ার্টারলি’তে)
No comments