ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ, নৈরাজ্য: সকালের ট্রেন রাতে, সড়কে দিন পার by শুভ্র দেব
রাজধানীর
কল্যাণপুর থেকে শুক্রবার রাত একটায় নাটোরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন কাজী আল
আমিন। বাসে করে সাধারণত সেখানে যেতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। কিন্তু আল
আমিনের ঈদযাত্রা প্রায় ২৪ ঘণ্টার কাছে গিয়ে ঠেকেছে। শুধু আল আমিন নন, এভাবে
চার ঘণ্টার রাস্তা ২০ থেকে ২৪ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েছেন লাখো মানুষ। শেষ
মুহূর্তে ঈদযাত্রায় এমন দুর্ভোগ, আর ভাড়া-নৈরাজ্য সহ্য করতে হয়েছে লাখো
মানুষকে। ট্রেনে অনেকটা নজিরবিহীন শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। সকালের ট্রেন ঘোষণা
দিয়ে রাতে ছাড়া হয়। এতে দুর্ভোগে পড়ে হাজার হাজার যাত্রী।
কোন কোন ট্রেন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা দেরি করে ছেড়েছে। দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে ফেরী ঘাটেও। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সড়ক পথে কোন যানজট নেই তবে ধীর গতি আছে। রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু সেতুতে শুক্রবার ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে।
সরজমিন গতকাল সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলপথের সবকটি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ট্রেন ছেড়ে গেছে। এর আগে শুক্রবার খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ট্রেন সাড়ে নয় ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি করে ছেড়েছে। এমনকি ওই দিন ছেড়ে যাওয়া কোন ট্রেনই গতকাল বেলা ১২টা পর্যন্ত এসে ঢাকা পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছে কমলাপুর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া খুলনাগামী একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে সবকটি ট্রেন বিলম্বে ছেড়ে গেছে। তাই গন্তব্য পৌঁছে ফের ছেড়ে আসতে এসব ট্রেনের সময় লাগছে।
কমলাপুর রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীগামী ধুমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ছয়টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি আনুমানিক আড়াইটা নাগাদ ছেড়ে যাওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। খুলনাগামী ধুমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ৬ টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময়। কিন্তু ট্রেনটি ছাড়ার সম্ভ্যাব্য সময় ধরা হয় ১টা ৩০ মিনিটে। চিলাহাটগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল আটটায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলে ৯ ঘন্টা বিলম্বে ৪টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে যাবে বলে সময় নির্ধারণ করা হয়। রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস সকাল ৯টার পরিবর্তে ১২ ঘন্টা বিলম্বে রাত ৯টায় ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সময় ধরা হয়। লালমনিরহাটগামী লালমনি-ঈদ স্পেশাল-৫ ট্রেনটি সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা বিলম্বে রাত সাড়ে ১০টায় ছেড়ে যাবে বলে আশা করছেন রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ ট্রেনটি ছাড়ার নির্ধারিত সময় ছিল ৯টা ১৫ মিনিটে। এভাবে পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিটি ট্রেনই বিলম্বে ছেড়ে গেছে। আবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অনেক ট্রেনের সময়ই নির্ধারণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
রংপুর এক্সপ্রেসে রংপুরগামী যাত্রী আলী আহমেদ বলেন, ট্রেনে উঠতে ঠেলাঠেলি হবে দেখে সকাল ৭টায় স্টেশন এসেছি। এখন বাজে দুপুর ২টা। কিন্তু ট্রেনে উঠাতো দুরের কথা ট্রেনই এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। কখন আসবে তার সঠিক সময় জানি না। একই ট্রেনের যাত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মৃত্তিকা বলেন, কত সময় অপেক্ষা করা যায়। প্রচণ্ড গরম, তার ওপর আবার এত ঘণ্টা অপেক্ষা। ট্রেন আসলেও আশা করতে পারি ট্রেন ছেড়ে যাবে। কিন্তু এখনও ট্রেন আসেনি। চিলাহাটীগামী নীল সাগর ট্রেনের যাত্রী শিহাব সরকার বলেন, ৬ ঘণ্টা ধরে প্ল্যাটফর্মেই অবস্থান করছি। গরমের মধ্যে বসতে বসতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। কখন ট্রেন আসবে কে জানে। বাড়ি ফেরার সব মজা ট্রেনের জন্য ম্লাণ হয়ে যাচ্ছে।
তবে স্টেশন কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন, শুধুমাত্র পশ্চিমাঞ্চল রেলপথ ছাড়া অন্য পথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, ঢাকা থেকে গতকাল ৫৬টি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলে কোনো ট্রেনই সময়মত ছেড়ে যেতে পারেনি। কারণ শুক্রবার বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্তে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় এবং ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করায় এমন সমস্যা হচ্ছে। ঈদের আগে আর শিডিউল ঠিক হবেনা বলেও জানিয়েছেন আমিনুল হক।
এদিকে সড়পথে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করেছে। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের সড়কে দীর্ঘ যানজট ও ধীরগতির কারণে উত্তর,পশ্চিম ও দক্ষিণবঙ্গের বাসের শিডিউলে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছে। শুক্রবার রাতে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বাস ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত এসব বাস গন্তব্য পৌঁছাতে পারেনি। আর ফের ঢাকা এসে যাত্রী নিয়ে যাবার কোন খবরই নাই। গতকাল শ্যামলী, হানিফ, এসআর, আলহামলা, আগমণী, দেশ, সালমাসহ আরও বেশ কয়েকটি বাসের কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে এসব কাউন্টারে বসে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন।
কল্যাণপুরের শ্যামলী বাস কাউন্টারে নাফিসা আক্তার নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, শুনেছি রাতে যে বাসগুলো ছেড়ে গেছে সেগুলো এখনও পৌঁছায়নি। ওই বাসগুলো ফেরৎ এলে আমাদের যাবার সৌভাগ্য হবে। তিনি বলেন, বড়দের জন্য কোনো সমস্যা নাই। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। হানিফ কাউন্টারে রাশেদ মাহমুদ বলেন, প্রতিবারই এমন হয়। এবারের ঈদে একটু বেশিই হচ্ছে ভোগান্তি। জানিনা কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলোক কিভাবে মূল্যায়ণ করবে। শুক্রবার থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বঙ্গবন্ধু সেতুর টাঙ্গাইল অংশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এই সেতু থেকে ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর গাড়িগুলো উত্তরবঙ্গের দিকে যেতে বেগ পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খানা-খন্দ আর বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ এলাকায় গাড়ির চাপ বেশি থাকায় এ জট তৈরি হয়েছে। তবে অন্যান্য সড়কের তুলনায় ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তেমন কোনো যানজট নেই। শুক্রবার ভুলতা ফ্লাইওভার খোলে দেয়ার পর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চাপ কমে যায়। এদিকে শিমুলিয়া-কাঁঠালিয়া ফেরি ঘাটে যানবাহনের চাপ বাড়ায় সেখানেও যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৫০০/৬০০ যানবাহন সেখানে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছেন, গত কয়েকদিন বৈরি আবহাওয়া ছিল। তাই যাত্রীদের আনাগোনা কম ছিল। আবহাওয়া কিছুটা ভাল ও ঈদ কাছাকাছি চলে আসাতে যানবাহনের চাপ বাড়ছে। যাত্রীবাহী ও ঘরমুখো মানুষের অতিরিক্ত চাপ মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে। এই ঘাটে ছোট-বড় যানবাহনের চাপ প্রায় ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছে। তাই ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। শুক্রবার রাতের আটকা পড়া বাসগুলো শনিবার দুপুরে গিয়ে ফেরির দেখা পেয়েছে।
ঈদ যাত্রায় নৈরাজ্য চলছে: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
সড়কপথে অব্যবস্থাপনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে ঈদে ঘরমুখী মানুষদের। ফিটনেসবিহীন ট্রাকে পশু বহন, ফিটনেসবিহীন বাসে যাত্রী পরিবহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। রেলপথে টিকিট কালোবাজারি, ছাদে যাত্রী ও শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ঘরমুখী যাত্রীরা। নৌপথে চলছে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। ফেরিঘাটগুলোয় বসে থাকতে হচ্ছে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা। আর আকাশপথে ৪ থেকে ৫ গুণ বাড়তি দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ঈদযাত্রা নিয়ে এসব অভিযোগ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘হয়রানিমুক্ত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিশ্চিত করুন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তার কারণে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। পথে পথে পশুবাহী ট্রাক থামিয়ে পুলিশ ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি চলছে। এসব চাঁদাবাজিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে কৃত্রিম যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌ-রুটে ফেরিতে পার হতে ৮ থেকে ১২ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। দুর্ভোগ মাথায় করে প্রতিটি লঞ্চে ধারণক্ষমতার প্রায় তিন থেকে চার গুণ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, সব পথে ভাড়া ডাকাতি চলছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে সীমিত পরিসরে সড়ক, নৌ ও রেলপথে মনিটরিং টিমের কার্যক্রম থাকলেও আকাশপথে ভাড়াসংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম নেই। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলসহ ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী প্রতিটি রুটে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ভাড়া বেশি আদায় করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ভোলা, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা রুটে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, এই ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি ৫ লাখ যাত্রী অন্য জেলায় যাতায়াত করবে। আর দেশব্যাপী এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত করবে আরও ৩ কোটি ৫০ লাখ যাত্রী। এবারের ঈদযাত্রার ১২ দিনে ৪ কোটি ৫৫ লাখ যাত্রী ২৭ কোটি যাত্রাবহরের সঙ্গে থাকবে।
কোন কোন ট্রেন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা দেরি করে ছেড়েছে। দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে ফেরী ঘাটেও। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সড়ক পথে কোন যানজট নেই তবে ধীর গতি আছে। রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু সেতুতে শুক্রবার ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে।
সরজমিন গতকাল সকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলপথের সবকটি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ট্রেন ছেড়ে গেছে। এর আগে শুক্রবার খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ট্রেন সাড়ে নয় ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি করে ছেড়েছে। এমনকি ওই দিন ছেড়ে যাওয়া কোন ট্রেনই গতকাল বেলা ১২টা পর্যন্ত এসে ঢাকা পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছে কমলাপুর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া খুলনাগামী একটি ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে সবকটি ট্রেন বিলম্বে ছেড়ে গেছে। তাই গন্তব্য পৌঁছে ফের ছেড়ে আসতে এসব ট্রেনের সময় লাগছে।
কমলাপুর রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীগামী ধুমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ছয়টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি আনুমানিক আড়াইটা নাগাদ ছেড়ে যাওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়। খুলনাগামী ধুমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ৬ টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময়। কিন্তু ট্রেনটি ছাড়ার সম্ভ্যাব্য সময় ধরা হয় ১টা ৩০ মিনিটে। চিলাহাটগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল আটটায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলে ৯ ঘন্টা বিলম্বে ৪টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে যাবে বলে সময় নির্ধারণ করা হয়। রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস সকাল ৯টার পরিবর্তে ১২ ঘন্টা বিলম্বে রাত ৯টায় ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সময় ধরা হয়। লালমনিরহাটগামী লালমনি-ঈদ স্পেশাল-৫ ট্রেনটি সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা বিলম্বে রাত সাড়ে ১০টায় ছেড়ে যাবে বলে আশা করছেন রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ ট্রেনটি ছাড়ার নির্ধারিত সময় ছিল ৯টা ১৫ মিনিটে। এভাবে পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিটি ট্রেনই বিলম্বে ছেড়ে গেছে। আবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অনেক ট্রেনের সময়ই নির্ধারণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
রংপুর এক্সপ্রেসে রংপুরগামী যাত্রী আলী আহমেদ বলেন, ট্রেনে উঠতে ঠেলাঠেলি হবে দেখে সকাল ৭টায় স্টেশন এসেছি। এখন বাজে দুপুর ২টা। কিন্তু ট্রেনে উঠাতো দুরের কথা ট্রেনই এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। কখন আসবে তার সঠিক সময় জানি না। একই ট্রেনের যাত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মৃত্তিকা বলেন, কত সময় অপেক্ষা করা যায়। প্রচণ্ড গরম, তার ওপর আবার এত ঘণ্টা অপেক্ষা। ট্রেন আসলেও আশা করতে পারি ট্রেন ছেড়ে যাবে। কিন্তু এখনও ট্রেন আসেনি। চিলাহাটীগামী নীল সাগর ট্রেনের যাত্রী শিহাব সরকার বলেন, ৬ ঘণ্টা ধরে প্ল্যাটফর্মেই অবস্থান করছি। গরমের মধ্যে বসতে বসতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। কখন ট্রেন আসবে কে জানে। বাড়ি ফেরার সব মজা ট্রেনের জন্য ম্লাণ হয়ে যাচ্ছে।
তবে স্টেশন কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন, শুধুমাত্র পশ্চিমাঞ্চল রেলপথ ছাড়া অন্য পথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, ঢাকা থেকে গতকাল ৫৬টি ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলে কোনো ট্রেনই সময়মত ছেড়ে যেতে পারেনি। কারণ শুক্রবার বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্তে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় এবং ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করায় এমন সমস্যা হচ্ছে। ঈদের আগে আর শিডিউল ঠিক হবেনা বলেও জানিয়েছেন আমিনুল হক।
এদিকে সড়পথে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করেছে। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের সড়কে দীর্ঘ যানজট ও ধীরগতির কারণে উত্তর,পশ্চিম ও দক্ষিণবঙ্গের বাসের শিডিউলে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছে। শুক্রবার রাতে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বাস ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গেছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত এসব বাস গন্তব্য পৌঁছাতে পারেনি। আর ফের ঢাকা এসে যাত্রী নিয়ে যাবার কোন খবরই নাই। গতকাল শ্যামলী, হানিফ, এসআর, আলহামলা, আগমণী, দেশ, সালমাসহ আরও বেশ কয়েকটি বাসের কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে এসব কাউন্টারে বসে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন।
কল্যাণপুরের শ্যামলী বাস কাউন্টারে নাফিসা আক্তার নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, শুনেছি রাতে যে বাসগুলো ছেড়ে গেছে সেগুলো এখনও পৌঁছায়নি। ওই বাসগুলো ফেরৎ এলে আমাদের যাবার সৌভাগ্য হবে। তিনি বলেন, বড়দের জন্য কোনো সমস্যা নাই। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। হানিফ কাউন্টারে রাশেদ মাহমুদ বলেন, প্রতিবারই এমন হয়। এবারের ঈদে একটু বেশিই হচ্ছে ভোগান্তি। জানিনা কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলোক কিভাবে মূল্যায়ণ করবে। শুক্রবার থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বঙ্গবন্ধু সেতুর টাঙ্গাইল অংশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এই সেতু থেকে ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর গাড়িগুলো উত্তরবঙ্গের দিকে যেতে বেগ পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খানা-খন্দ আর বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ এলাকায় গাড়ির চাপ বেশি থাকায় এ জট তৈরি হয়েছে। তবে অন্যান্য সড়কের তুলনায় ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তেমন কোনো যানজট নেই। শুক্রবার ভুলতা ফ্লাইওভার খোলে দেয়ার পর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চাপ কমে যায়। এদিকে শিমুলিয়া-কাঁঠালিয়া ফেরি ঘাটে যানবাহনের চাপ বাড়ায় সেখানেও যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৫০০/৬০০ যানবাহন সেখানে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছেন, গত কয়েকদিন বৈরি আবহাওয়া ছিল। তাই যাত্রীদের আনাগোনা কম ছিল। আবহাওয়া কিছুটা ভাল ও ঈদ কাছাকাছি চলে আসাতে যানবাহনের চাপ বাড়ছে। যাত্রীবাহী ও ঘরমুখো মানুষের অতিরিক্ত চাপ মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে। এই ঘাটে ছোট-বড় যানবাহনের চাপ প্রায় ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করেছে। তাই ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। শুক্রবার রাতের আটকা পড়া বাসগুলো শনিবার দুপুরে গিয়ে ফেরির দেখা পেয়েছে।
ঈদ যাত্রায় নৈরাজ্য চলছে: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
সড়কপথে অব্যবস্থাপনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে ঈদে ঘরমুখী মানুষদের। ফিটনেসবিহীন ট্রাকে পশু বহন, ফিটনেসবিহীন বাসে যাত্রী পরিবহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। রেলপথে টিকিট কালোবাজারি, ছাদে যাত্রী ও শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ঘরমুখী যাত্রীরা। নৌপথে চলছে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। ফেরিঘাটগুলোয় বসে থাকতে হচ্ছে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা। আর আকাশপথে ৪ থেকে ৫ গুণ বাড়তি দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ঈদযাত্রা নিয়ে এসব অভিযোগ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘হয়রানিমুক্ত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিশ্চিত করুন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তার কারণে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। পথে পথে পশুবাহী ট্রাক থামিয়ে পুলিশ ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি চলছে। এসব চাঁদাবাজিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে কৃত্রিম যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌ-রুটে ফেরিতে পার হতে ৮ থেকে ১২ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। দুর্ভোগ মাথায় করে প্রতিটি লঞ্চে ধারণক্ষমতার প্রায় তিন থেকে চার গুণ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, সব পথে ভাড়া ডাকাতি চলছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে সীমিত পরিসরে সড়ক, নৌ ও রেলপথে মনিটরিং টিমের কার্যক্রম থাকলেও আকাশপথে ভাড়াসংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম নেই। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলসহ ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী প্রতিটি রুটে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ভাড়া বেশি আদায় করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে ভোলা, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা রুটে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, এই ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি ৫ লাখ যাত্রী অন্য জেলায় যাতায়াত করবে। আর দেশব্যাপী এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত করবে আরও ৩ কোটি ৫০ লাখ যাত্রী। এবারের ঈদযাত্রার ১২ দিনে ৪ কোটি ৫৫ লাখ যাত্রী ২৭ কোটি যাত্রাবহরের সঙ্গে থাকবে।
No comments