বৃটিশ রাজনীতিতে যেন ঘূর্ণিঝড়
ব্রেক্সিট
ইস্যুতে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। এ ইস্যুতে
একে একে তিনজন প্রভাবশালী মন্ত্রী পদত্যাগ করার পর তার ভাগ্য ঝুলছে। ফলে
ব্রেক্সিট ইস্যুতে বৃটিশ রাজনীতিতে শুধু ঝড় বললে ভুল হয়, বলা যায় ঘূর্ণিঝড়
বইছে। যারা সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন তারা আর কেউ নন ব্রেক্সিট বিষয়ক
মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন ও ব্রেক্সিট বিষয়ক
প্রতিমন্ত্রী স্টিভ বেকার। ওদিকে পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অবৈতনিক
পার্লামেন্টারিয়ান সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ক্রিস গ্রিন। তিনিও তার
এ পদ থেকে সরে গেছেন। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন
তেরেসা মে। তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। এমন খবর
দিয়েছে অনলাইন স্কাই নিউজ ও বিবিসি। রোববার আকস্মিক বা নাটকীয়ভাবে পদত্যাগ
করেন ডেভিড ডেভিস। তখন বলা হয়, তাকে অনুসরণ করে আরো কয়েকজন মন্ত্রী বা এমপি
পদত্যাগ করতে পারেন। এরপর পরই খবর আসে স্টিভ বেকারও পদত্যাগ করেছেন। তবে
সোমবার দিনশেষে সবচেয়ে বড় আঘাতটি হানেন ওই এলোমেলো চুলের বরিস জনসন। তিনি
লন্ডনের সাবেক মেয়র এবং বৃটেনের রাজনীতিতে এ সময়ে বেশ প্রভাবশালী নেতা। এতে
প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র ভাগ্য সরল দোলকের মতো দুলছে। যেকোনো সময় যেকোনো
দশায় চলে যেতে পারে তা। বরিস জনসন পদত্যাগ করার আধা ঘণ্টারও একটু বেশি পরে
তেরেসা মে এমপিদের মুখোমুখি হন। তাকে এমপিরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। তবে
প্রধানমন্ত্রী তার পারফরমেন্সের পক্ষেই কথা বলেন। তিনি জানান দেন, গত
সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনকে বের করে আনার বিষয়ে যে
চুক্তি অনুমোদন করেছে সেটাই সর্বোত্তম অগ্রবর্তী অবস্থা। হাউজ অব কমন্সে
তিনি অবিলম্বে নেতৃত্ব সংকটে বা নেতৃত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়তে পারেন এমন
আশঙ্কা-উদ্বেগ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেও তেরেসা মে নিজের দলের ব্যাকবেঞ্চার
এমপিদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তার লড়াকু কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি তার
এমপিদের বলেন, তাদের সমর্থন তার প্রয়োজন। তা নাহলে বিরোধী লেবার দলের নেতা
জেরেমি করবিন ক্ষমতার দিকে হাত বাড়াবেন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং
স্ট্রিট থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ক্ষমতা থেকে উৎখাতের যেকোনো চেষ্টার
বিরুদ্ধে লড়াই করবেন তেরেসা মে। সরকার ‘মেল্টডাউন’ বা গলে যাওয়ার মতো কথাও
বলা হয়। এমন আশঙ্কাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তবে বরিস জনসন পদত্যাগ করায়
যেন একটি ‘বোমা’ বিস্ফোরণ হয়েছে রাজনীতিতে। তার স্থানে বসানো হয়েছে জেরেমি
হান্টকে। বিবিসি লিখেছে, বৃটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের প্রশ্নকে
কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এক ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংকট এখন এক নতুন মাত্রা
পেয়েছে। না-আঁচড়ানো এলোমেলো সোনালি চুলের বরিস জনসন লন্ডনের সাবেক মেয়র,
বৃটিশ রাজনীতির এক জনপ্রিয় এবং বর্ণাঢ্য চরিত্র। যার চটকদার কথা এবং
বিচিত্র কর্মকাণ্ড প্রায় সময়ই সংবাদপত্রে খবর হয়। বৃটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন
ত্যাগের প্রশ্নে যখন গণভোট হয়েছিল- তখন এই বরিস জনসনই ছিলেন ইইউ ত্যাগের
সমর্থক শিবিরের প্রধান নেতা। ২০১৬ সালের ওই গণভোটে ইইউ ত্যাগের পক্ষে
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পড়ে। এর পর সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন
পদত্যাগ করেন, এবং তেরেসা মে নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে বরিস জনসনকে তার
পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন। তেরেসা মে নতুন ব্রেক্সিট বিষয়ক পরিকল্পনা প্রকাশ
করার পর থেকেই তার কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ
সৃষ্টি হয়। বলা হয়, বরিস জনসন এবং তার অনুগামীরা ইইউ থেকে বৃটেনের প্রায়
সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের পক্ষে, যাতে ইউরোপ থেকে অবাধ অভিবাসন এবং বৃটেনের ওপর
ব্রাসেলসের কর্তৃত্ব বন্ধ হয়। এদের বলা হয় ‘হার্ড বেক্সিট’ গ্রুপ। আর অন্য
পক্ষকে বলা হয় ‘সফট ব্রেক্সিট’ পক্ষ- এরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার বিরোধী,
তারা চান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থেকে বৃটেন যে সুবিধাগুলো পায় সেগুলো অব্যাহত
রাখতে- যাতে তাদের ভাষায় বৃটেনে কর্মসংস্থান এবং ইইউ-বৃটেন ব্যবসা-বাণিজ্য
ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাই গণভোটের পর থেকেই বৃটেনে এ বিতর্ক চলছে যে বৃটেন
ইউরোপ থেকে কতটুকু আলাদা হবে এবং কীভাবে তার বাস্তবায়ন হবে। বৃটেন
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ করবে ২০১৯ সালের ২৯শে মার্চ। এখন তেরেসা মে
ব্রেক্সিটের যে পরিকল্পনা দিয়েছেন তার সমালোচনা করে কড়া ব্রেক্সিটপন্থিরা
বলছেন, এতে ইউরোপকে খুব সহজে অনেক বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে। এর পর প্রথম
পদত্যাগ করেন ব্রেক্সিটমন্ত্রী ডেভিড ডেভিস। তার কথা, এ পরিকল্পনায় তিনি
বিশ্বাস করেন না, তাই এর পক্ষ নিয়ে ব্রাসেলসের সঙ্গে ব্রেক্সিটের আলোচনায়
নেতৃত্ব দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরই পদত্যাগ করেন
ব্রেক্সিটের পক্ষের মূল নেতা বরিস জনসন- যিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও তেরেসা
মে’র ব্রেক্সিট পরিকল্পনার সমালোচনা করে চলেছিলেন, কিন্তু সরকার ছেড়ে যান
নি। বিবিসির বিশ্লেষক লরা কুয়েন্সবার্গ বলছেন, বরিস জনসনের বিদায়ের মধ্য
দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে এক অপ্রস্তুত এবং কঠিন অবস্থায় পড়ে গেছেন,
এবং এটা এখন পূর্ণাঙ্গ সংকটে পরিণত হয়েছে। তিনি বলছেন, এর ফলে হয়তো কড়া
ব্রেক্সিটপন্থি শিবির থেকে মিসেস মে’র নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ আসতে
পারে। তাকে এই বার্তা দেয়া হয়েছে যে, তিনি তার পরিকল্পনা ত্যাগ না করলে
একের পর এক মন্ত্রী পদত্যাগ করবেন। বিরোধীদল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি
করবিন বলেছেন, মি. জনসন এবং মি ডেভিস সরকারের ডুবন্ত জাহাজ থেকে নেমে
গেছেন, এবং মিসেস মে তার দলে ঐক্য আছে বলে যে বিভ্রম তৈরি করে রেখেছিলেন-
তা ভেঙে পড়েছে। এরকম সংকটের মধ্যে তেরেসা মে কীভাবে তার সরকারকে টিকিয়ে
রাখেন এটাই এখন দেখার বিষয়।
No comments