মোবাইলে কমছে আয়ু! by হাফিজ মুহাম্মদ
হাতের
মুঠোয় বিশ্ব। ছোট্ট একটি যন্ত্র। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকেও টেনে
আনছে কথা। দু’পাশের দুটি যন্ত্রের মাধ্যমে একে অপরকে পারছেন দেখতে। যেন একই
টেবিলে বসা দু’জন। সময় এবং দূরত্ব দুটোই এখন ঠুনকো। এটি মোবাইল ফোন। এগার
ডিজিটের একটি নাম্বারই বদলে দিয়েছে জীবন চিত্র আর হয়ে উঠেছে জীবনের জন্য
অপরিহার্য। কিন্তু এ অপরিহার্য হয়ে উঠা যন্ত্রটির রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তা
মানবদেহের নানা ক্ষতি ডেকে আনে। যার অন্যতম একটি হলো- মানুষের আয়ু কমে
যাওয়া। শুধু তাই নয়, এর ক্ষতিকর প্রভাবে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধ্বংসেও রাখছে নেতিবাচক ভূমিকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
মোবাইল ফোনের তেজস্ক্রিয়তায় গর্ভবতীদের জন্য ডেকে আনছে বিপদ। মারাত্মক
ক্ষতি করছে শিশুদের। তাদের কোমল মন আর দেহ বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে অজান্তেই।
এত কিছুর পরও বিজ্ঞানের যুগে দিন দিন মানুষ আঁকড়ে ধরছে যন্ত্রকে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের সক্রিয় সংযোগ বা সিম সংখ্যা ১৪ কোটি ৭ লাখ। একই সময় মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৯২ লাখ। মোবাইল ফোনের উপকারিতা আর অপকারিতা নানা সময়ে হয়েছে বাকযুদ্ধ। তার মধ্যে অপকারিতার আলোচনা কমই আসে। মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে দেশে দেশে। নানা পরামর্শ দেয়া হয়েছে এ যন্ত্রের ব্যবহারকারী ও অংশীদারিদের। তেজস্ক্রিয়তা কমিয়ে আনতে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। বিভিন্ন সময় তাদের সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে। মানব দেহে ক্ষতি করে যন্ত্রটি থেকে নির্গত বিকিরণ। আর পরিবেশের ক্ষতি করে সিগন্যাল টাওয়ারের আল্টাভায়োলেট রশ্মি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রেডিয়েশন নিয়মিত পরিমাপ এবং মনিটর করা হলেও বাংলাদেশে এমনটা করা হয়নি কখনো। এমনকি আমাদের দেশে কত শতাংশ রেডিয়েশন প্রবাহিত হয় তাও জানা নেই। যে যার মতো করে মোবাইল টাওয়ার বসাচ্ছে। নিজেরাই আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। ফলাফল কেউ কখনো জানতে পায় না। বাংলাদেশ টেলিকমিনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) পরিবেশ ও মানব দেহের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে বাঁচতে অপারেটর সংস্থাগুলোকে ক্ষতিকর বিকিরণ বা ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য কমিয়ে আনতে বলেছে। সেই সঙ্গে মোবাইল ফোনের সকল ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানির সময় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এসব কেউ মানছে না। মোবাইল ফোনের বিকিরণের নেতিবাচক প্রভাবে আমাদের চার পাশ যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে তা উঠে এসেছে বিভিন্ন দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায়।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনে মোবাইল ফোনের বিকিরণ প্রবাহ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ একটি গাইড লাইন প্রকাশ করেছে। যেখানে মোবাইল ফোন থেকে কখন সবচেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়ায় ক্ষতি হয় এবং কিভাবে এ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় তা বলা হয়েছে।
এ গাইডলাইনে ক্যালিফোর্নিয়ার জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার কোরেন স্মিথের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ঘুমানোর সময় মাথার কাছে মোবাইল ফোন রাখা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় মাথা থেকে অন্তত এক হাত দূরে মোবাইল ফোন রাখার কথা বলা হয়েছে। গাইডলাইনে বলা হয়, যখন মোবাইল ফোনের সিগন্যাল দুর্বল দেখতে পাচ্ছেন, তখনই এটা মানব দেহের সব থেকে বেশি ক্ষতি করে। আর এ সময় ফোন ব্যবহার বিপজ্জনক। অডিও এবং ভিডিও ডাউনলোড কমিয়ে আনতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাহলে এসব ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এ গাইড লাইনে তিনি রাতে ঘুমানোর সময় এ যন্ত্রটি ব্যবহারে বারণ করেছেন। শুধু ফোনের রেডিয়েশনই নয় অন্ধকারে ফোনের আলো চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে। আর কথা বলতে গিয়ে যেন কখনো হেডফোন খুলতে ভুল না হয় সে বিষয়টিও বলা হয়েছে। এ গবেষণার প্রেক্ষিতে ডাক্তাররা বলেছেন, স্মার্টফোন বেশি ব্যবহার করলে ব্রেন টিউমার হতে পারে। পুরুষদের বীর্যের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে। যার প্রভাবে মাথাব্যথা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং শ্রবণ শক্তি হারাতে পারেন ব্যবহারকারীরা।
একাধারে কয়েক ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে চোখের জ্যোতি কমছে। যুক্তরাজ্যের একদল চক্ষু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য হতে পারে। এত করে ‘মাযোপিয়া’ বা ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে রেখে ব্যবহার করা হয় ফোন। অনেকের ক্ষেত্রে তা ১৮ সেন্টিমিটারেরও কম। চোখের কাছে রেখে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যা হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা মুঠোফোন দীর্ঘক্ষণ ধরে চোখে না রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর এ যন্ত্রটি ব্যবহারে বয়সের বিষয়টিও তারা বিবেচনায় রেখেছেন। বর্তমানে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব পড়েছে তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। যার ফলে তাদের চোখের জ্যোতি হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করেন চক্ষু বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাতে মুঠোফোনে রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি নিবন্ধন প্রকাশ করেছে। সেখানে আমেরিকান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ বলেছে, তারা ইঁদুরের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণার ফলাফলে পুরুষ এবং মহিলা ইঁদুরের ক্ষতির দিকটা তুলে ধরেছেন। একইভাবে মানুষের শরীরেও এমন ক্ষতি করে বলে তারা জানিয়েছেন। দীর্ঘদিনের এ পরীক্ষায় মুঠোফোনের রেডিও তরঙ্গ এবং তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতি চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলেও তারা জানান। জাতীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক এ গবেষণার ফলাফলে প্রাণীর ওপর কয়েকটি ক্ষতিকর বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ গবেষণা টিমের সিনিয়র বিজ্ঞানী জন বাউচার বলেছেন, রেডিয়েশনে ব্রেইন টিউমারের উচ্চ মাত্রায় ঝুঁকি রয়েছে, ডিএনএ টিস্যুর ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং একটা গ্রুপের ওজন কমে যায়। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব।
এ ছাড়াও এ গবেষণায় মানুষের মস্তিষ্কে রেডিয়েশন ঝুঁকি দেখায়। আর ক্যানসার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্র হিসেবে ‘মানুষের কার্সিনোজেনিক’ উল্লেখ করেছেন। এনআইএইচের নতুন গবেষণায় আরো দেখানো হয়েছে, তারা যে প্রাণীর উপর গবেষণা চালিয়েছে তাদের লিভার, মস্তিষ্ক, প্রোস্টেট এবং অগ্ন্যাশয় সমস্যা দেখেছেন। তবে এটা রেডিয়েশন সমস্যা কিনা তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
এফডিএর সেন্টার ফর ডিভাইসস অ্যান্ড রেডিয়োলজিক্যাল হেলথের পরিচালক জাফরি ??শুরিন উল্লেখ করেছেন, গবেষণায় অস্বাভাবিক ফলাফল পাওয়া গেছে এবং তাদের দল তাদের মূল্যায়ন অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তিনি যা বলেছেন সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে। তবে এজেন্সি বিশ্বাস করে না মুঠোফোন বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট মানুষের মধ্যে প্রতিকূল স্বাস্থ্যে যে প্রভাব রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) চিহ্নিত করেছে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রভাবে ব্রেইন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, তারা ৩১ জন স্বাস্থ্য সচেতন নারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করেছে। তারা এ সময় দেখেছে এ নারীরা থ্রি-জি মোবাইল ব্যবহার করে একটানা ১৫ মিনিট ধরে কথা বলেছে। এ সময় তাদের ব্রেইন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক কর্ম থেকে পরিবর্তন ঘটেছে। আর এটার কারণ একমাত্র রেডিয়েশন। এটা ছিল স্বাভাবিক কথা বলার প্রক্রিয়া থেকে বেশি। এটা শুধু মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে নয়। এটা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, টাওয়ার ও গ্রিড স্টেশনও একই ধরনের ক্ষতি করে।
ভারতের উঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ওম গান্ধী বলেছেন, মোবাইল তেজস্ক্রিয়তা বিভিন্ন বয়সের মানুষের ওপর বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তিনি একটি চার্টে দেখিয়েছেন পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের সব থেকে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাপরে ১০ বছরের শিশুর, সর্বশেষ বয়স্কদের ওপর এ ক্ষতিটা তুলনামূলক কম হয়।
বিভিন্ন দেশের একাধিক গবেষণার তাৎপর্য পর্যালোচনা করে ডাক্তাররা দেখেছেন, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে বিকিরণ রশ্মির তেজস্ক্রিয়তার ফলে বিভিন্ন রোগ-ভোগে মানুষের আয়ু কমে এসেছে। আগের থেকে কম দীর্ঘায়ু হচ্ছেন মানুষ।
সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা মোবাইল রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাবের ওপর একটি নিবন্ধনে বলেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে শিশুদের মস্তিষ্কে মোবাইল রেডিয়েশন প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি ক্ষতি করে। তাদের মানুষিক ক্ষতির তালিকাটিও বেশ চিন্তার। বেশি সময় ধরে মোবাইলে গেইম খেলা, চ্যাটিং করা ও ভিডিও দেখার ফলে বাচ্চারা কথা বলাও ভুলে যাচ্ছে। তাদের বন্ধু তৈরি হচ্ছে না। অনেক লোকের মাঝে থেকেও বলার জন্য কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
আনন্দবাজারের আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, ভারতের টেলিকম মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু মোবাইল নয়, জনবসতির মধ্যে বসানো টাওয়ারগুলো যে পরিমাণ বিকিরণ ছড়াচ্ছে তার কুপ্রভাব পড়েছে মানুষের মস্তিষ্কে ও হৃদযন্ত্রে। অবসাদ, ঘুমের ব্যাঘাত, ঝিমুনি ভাব বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোসংযোগে সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ, হজমের ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমনকি মোবাইল ব্যবহার না করেও বিকিরণের শিকার হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতীরা। জীব জগৎও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন পরিমাপের জন্য হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছিল। বিটিআরসি তখন একটি কমিটি করে দিয়েছিল। কিন্তু সে কমিটি আজ পর্যন্ত আর রিপোর্ট দেয়নি। গত তিনবছর আগে রিট হলেও তাদের কাজের আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। কমিটি কয়েকটি মিটিং করেই চুপসে গেছে। একটি টাওয়ারের বিটিএসে কয়টি অ্যান্টিনা বসাতে পারবে আমাদের দেশে তার কোনো নির্দেশনা নেই। এমনকি তারা এ টাওয়ার থেকে কত রেডিয়েশন প্রবাহিত করে তা মাপা হয় না। বিশ্বের অনেক দেশে মোবাইল টাওয়ারে কি পরিমাণ রেডিয়েশন প্রবাহিত হয় তা নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। বছরে দুই থেকে তিনবার এটা করা হয়। আর আমাদের দেশে একবারও করা হয় না। এ পর্যন্ত দেখাই হয়নি যে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার থেকে কি পরিমাণ রেডিয়েশন নির্গত হচ্ছে। আমাদের মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো নাকি নিজেরাই পরীক্ষা করে। তারা পরীক্ষা করলে তো তাদের ব্যবসার কথাই বিবেচনা করবে। কিন্তু এ থেকে কত রেডিয়েশন নির্গত হয় তা তারা প্রকাশ করে না। প্রত্যেকটা বিটিএস মাপা উচিত এবং স্টান্ডার্ড মান অনুযায়ী তাদের সনদ দেয়া দরকার তিনি মনে করেন। আর এজন্য কোনো নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলে তাদের সনদ নিয়েই বিটিএস বসাতে হতো অপারেটর কোম্পানিকে।
বুয়েটের এ অধ্যাপক আরো বলেন, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর রেডিয়েশন পরীক্ষা করে তা প্রবাহের একটা স্টান্ডার্ড মাত্রা বেঁধে দিতে হবে। তা না হলে এমন ক্ষতি তারা করেই যাবে। আমরা দেখতে পাই একটি টাওয়ারে বিটিএসে যেখানে দুইটা কিংবা তিনটা অ্যান্টিনা বসানোর কথা সেখানে দ্বিগুণ বা তিনগুণ অ্যান্টিনা বসিয়ে মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশন প্রবাহিত করা হচ্ছে। আগে যেখানে দুইটা অ্যান্টিনা ছিল সে একই টাওয়ারে আরো দুই তিনটি বসানো হচ্ছে। এতে করে একই স্থানে ভয়ানক রেডিয়েশন প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ এগুলো কিছুদূর পরে পরে টাওয়ার বসিয়ে করতে পারতো। কোম্পানিগুলো ব্যয় সংকোচন করে মানুষ এবং পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। মোবাইলের অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার ফলে মানুষের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। প্রথমে স্কিনে সমস্যা দেখা দেয় তারপরে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। রেডিয়েশন সব থেকে বেশি ক্ষতি করে গর্ভবতী মায়ের এবং শিশুদের। এ সমস্যা দীর্ঘদিন পরেও দেখা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া বলেন, মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের ক্ষতিটা দীর্ঘমেয়াদি। আমরা এটা বুঝতে চাই না। একটা বাচ্চার যখন বয়স ৫/৭ বছর তখন সে রেডিয়েশনের প্রভাবে আক্রান্ত হলেও এটার লক্ষণ ২৫/৩০ বছরে গিয়ে দেখা দিবে। এজন্য এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করি না। বিশ্বের সব বিখ্যাত মেডিকেল জার্নালে রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরেছে। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনে মানুষ বিভিন্ন রোগভোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। যার ফলে মানুষের আয়ুর ওপর একটা বিশাল প্রভাব পড়ছে বলেও তিনি জানান। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে একই জায়গায় একাধিক কোম্পানির টাওয়ার বসানো। যেখানে একটি টাওয়ারে অতিরিক্ত অ্যান্টিনা বসানো হয় সেখানে একাধিক টাওয়ার থেকে কত মাত্রায় রেডিয়েশন নির্গত তা হয় ভাবাও কঠিন। এটা বন্ধ করে একটি টাওয়ারে তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. এনায়েত করিম বলেন, মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে মানবদেহে নানা ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিয়েছে। ব্রেইন ক্যানসার, ক্যানসার, টিউমার, দৃষ্টি বৈকল্যসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবে এটা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু এর মারাত্মক প্রভাব আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। এজন্য রেডিয়েশনের প্রবাহের একটা সঠিক মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। আমাদের দেশে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো যেভাবে এক জায়গায় একাধিক টাওয়ার বসিয়ে রেডিয়েশন প্রবাহ করেছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের সক্রিয় সংযোগ বা সিম সংখ্যা ১৪ কোটি ৭ লাখ। একই সময় মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৯২ লাখ। মোবাইল ফোনের উপকারিতা আর অপকারিতা নানা সময়ে হয়েছে বাকযুদ্ধ। তার মধ্যে অপকারিতার আলোচনা কমই আসে। মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে দেশে দেশে। নানা পরামর্শ দেয়া হয়েছে এ যন্ত্রের ব্যবহারকারী ও অংশীদারিদের। তেজস্ক্রিয়তা কমিয়ে আনতে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। বিভিন্ন সময় তাদের সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে। মানব দেহে ক্ষতি করে যন্ত্রটি থেকে নির্গত বিকিরণ। আর পরিবেশের ক্ষতি করে সিগন্যাল টাওয়ারের আল্টাভায়োলেট রশ্মি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রেডিয়েশন নিয়মিত পরিমাপ এবং মনিটর করা হলেও বাংলাদেশে এমনটা করা হয়নি কখনো। এমনকি আমাদের দেশে কত শতাংশ রেডিয়েশন প্রবাহিত হয় তাও জানা নেই। যে যার মতো করে মোবাইল টাওয়ার বসাচ্ছে। নিজেরাই আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। ফলাফল কেউ কখনো জানতে পায় না। বাংলাদেশ টেলিকমিনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) পরিবেশ ও মানব দেহের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে বাঁচতে অপারেটর সংস্থাগুলোকে ক্ষতিকর বিকিরণ বা ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য কমিয়ে আনতে বলেছে। সেই সঙ্গে মোবাইল ফোনের সকল ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানির সময় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এসব কেউ মানছে না। মোবাইল ফোনের বিকিরণের নেতিবাচক প্রভাবে আমাদের চার পাশ যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে তা উঠে এসেছে বিভিন্ন দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায়।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনে মোবাইল ফোনের বিকিরণ প্রবাহ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ একটি গাইড লাইন প্রকাশ করেছে। যেখানে মোবাইল ফোন থেকে কখন সবচেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়ায় ক্ষতি হয় এবং কিভাবে এ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় তা বলা হয়েছে।
এ গাইডলাইনে ক্যালিফোর্নিয়ার জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার কোরেন স্মিথের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ঘুমানোর সময় মাথার কাছে মোবাইল ফোন রাখা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় মাথা থেকে অন্তত এক হাত দূরে মোবাইল ফোন রাখার কথা বলা হয়েছে। গাইডলাইনে বলা হয়, যখন মোবাইল ফোনের সিগন্যাল দুর্বল দেখতে পাচ্ছেন, তখনই এটা মানব দেহের সব থেকে বেশি ক্ষতি করে। আর এ সময় ফোন ব্যবহার বিপজ্জনক। অডিও এবং ভিডিও ডাউনলোড কমিয়ে আনতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাহলে এসব ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। এ গাইড লাইনে তিনি রাতে ঘুমানোর সময় এ যন্ত্রটি ব্যবহারে বারণ করেছেন। শুধু ফোনের রেডিয়েশনই নয় অন্ধকারে ফোনের আলো চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে। আর কথা বলতে গিয়ে যেন কখনো হেডফোন খুলতে ভুল না হয় সে বিষয়টিও বলা হয়েছে। এ গবেষণার প্রেক্ষিতে ডাক্তাররা বলেছেন, স্মার্টফোন বেশি ব্যবহার করলে ব্রেন টিউমার হতে পারে। পুরুষদের বীর্যের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে। যার প্রভাবে মাথাব্যথা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং শ্রবণ শক্তি হারাতে পারেন ব্যবহারকারীরা।
একাধারে কয়েক ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে চোখের জ্যোতি কমছে। যুক্তরাজ্যের একদল চক্ষু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য হতে পারে। এত করে ‘মাযোপিয়া’ বা ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে রেখে ব্যবহার করা হয় ফোন। অনেকের ক্ষেত্রে তা ১৮ সেন্টিমিটারেরও কম। চোখের কাছে রেখে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যা হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা মুঠোফোন দীর্ঘক্ষণ ধরে চোখে না রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর এ যন্ত্রটি ব্যবহারে বয়সের বিষয়টিও তারা বিবেচনায় রেখেছেন। বর্তমানে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব পড়েছে তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। যার ফলে তাদের চোখের জ্যোতি হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করেন চক্ষু বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাতে মুঠোফোনে রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি নিবন্ধন প্রকাশ করেছে। সেখানে আমেরিকান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ বলেছে, তারা ইঁদুরের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণার ফলাফলে পুরুষ এবং মহিলা ইঁদুরের ক্ষতির দিকটা তুলে ধরেছেন। একইভাবে মানুষের শরীরেও এমন ক্ষতি করে বলে তারা জানিয়েছেন। দীর্ঘদিনের এ পরীক্ষায় মুঠোফোনের রেডিও তরঙ্গ এবং তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতি চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলেও তারা জানান। জাতীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক এ গবেষণার ফলাফলে প্রাণীর ওপর কয়েকটি ক্ষতিকর বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ গবেষণা টিমের সিনিয়র বিজ্ঞানী জন বাউচার বলেছেন, রেডিয়েশনে ব্রেইন টিউমারের উচ্চ মাত্রায় ঝুঁকি রয়েছে, ডিএনএ টিস্যুর ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং একটা গ্রুপের ওজন কমে যায়। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব।
এ ছাড়াও এ গবেষণায় মানুষের মস্তিষ্কে রেডিয়েশন ঝুঁকি দেখায়। আর ক্যানসার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্র হিসেবে ‘মানুষের কার্সিনোজেনিক’ উল্লেখ করেছেন। এনআইএইচের নতুন গবেষণায় আরো দেখানো হয়েছে, তারা যে প্রাণীর উপর গবেষণা চালিয়েছে তাদের লিভার, মস্তিষ্ক, প্রোস্টেট এবং অগ্ন্যাশয় সমস্যা দেখেছেন। তবে এটা রেডিয়েশন সমস্যা কিনা তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
এফডিএর সেন্টার ফর ডিভাইসস অ্যান্ড রেডিয়োলজিক্যাল হেলথের পরিচালক জাফরি ??শুরিন উল্লেখ করেছেন, গবেষণায় অস্বাভাবিক ফলাফল পাওয়া গেছে এবং তাদের দল তাদের মূল্যায়ন অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তিনি যা বলেছেন সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে। তবে এজেন্সি বিশ্বাস করে না মুঠোফোন বিকিরণ দ্বারা সৃষ্ট মানুষের মধ্যে প্রতিকূল স্বাস্থ্যে যে প্রভাব রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) চিহ্নিত করেছে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রভাবে ব্রেইন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, তারা ৩১ জন স্বাস্থ্য সচেতন নারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করেছে। তারা এ সময় দেখেছে এ নারীরা থ্রি-জি মোবাইল ব্যবহার করে একটানা ১৫ মিনিট ধরে কথা বলেছে। এ সময় তাদের ব্রেইন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক কর্ম থেকে পরিবর্তন ঘটেছে। আর এটার কারণ একমাত্র রেডিয়েশন। এটা ছিল স্বাভাবিক কথা বলার প্রক্রিয়া থেকে বেশি। এটা শুধু মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে নয়। এটা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, টাওয়ার ও গ্রিড স্টেশনও একই ধরনের ক্ষতি করে।
ভারতের উঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ওম গান্ধী বলেছেন, মোবাইল তেজস্ক্রিয়তা বিভিন্ন বয়সের মানুষের ওপর বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তিনি একটি চার্টে দেখিয়েছেন পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের সব থেকে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাপরে ১০ বছরের শিশুর, সর্বশেষ বয়স্কদের ওপর এ ক্ষতিটা তুলনামূলক কম হয়।
বিভিন্ন দেশের একাধিক গবেষণার তাৎপর্য পর্যালোচনা করে ডাক্তাররা দেখেছেন, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে বিকিরণ রশ্মির তেজস্ক্রিয়তার ফলে বিভিন্ন রোগ-ভোগে মানুষের আয়ু কমে এসেছে। আগের থেকে কম দীর্ঘায়ু হচ্ছেন মানুষ।
সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা মোবাইল রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাবের ওপর একটি নিবন্ধনে বলেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে শিশুদের মস্তিষ্কে মোবাইল রেডিয়েশন প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি ক্ষতি করে। তাদের মানুষিক ক্ষতির তালিকাটিও বেশ চিন্তার। বেশি সময় ধরে মোবাইলে গেইম খেলা, চ্যাটিং করা ও ভিডিও দেখার ফলে বাচ্চারা কথা বলাও ভুলে যাচ্ছে। তাদের বন্ধু তৈরি হচ্ছে না। অনেক লোকের মাঝে থেকেও বলার জন্য কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
আনন্দবাজারের আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, ভারতের টেলিকম মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু মোবাইল নয়, জনবসতির মধ্যে বসানো টাওয়ারগুলো যে পরিমাণ বিকিরণ ছড়াচ্ছে তার কুপ্রভাব পড়েছে মানুষের মস্তিষ্কে ও হৃদযন্ত্রে। অবসাদ, ঘুমের ব্যাঘাত, ঝিমুনি ভাব বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোসংযোগে সমস্যা, স্মৃতিশক্তি লোপ, হজমের ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমনকি মোবাইল ব্যবহার না করেও বিকিরণের শিকার হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতীরা। জীব জগৎও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকছে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন পরিমাপের জন্য হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছিল। বিটিআরসি তখন একটি কমিটি করে দিয়েছিল। কিন্তু সে কমিটি আজ পর্যন্ত আর রিপোর্ট দেয়নি। গত তিনবছর আগে রিট হলেও তাদের কাজের আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। কমিটি কয়েকটি মিটিং করেই চুপসে গেছে। একটি টাওয়ারের বিটিএসে কয়টি অ্যান্টিনা বসাতে পারবে আমাদের দেশে তার কোনো নির্দেশনা নেই। এমনকি তারা এ টাওয়ার থেকে কত রেডিয়েশন প্রবাহিত করে তা মাপা হয় না। বিশ্বের অনেক দেশে মোবাইল টাওয়ারে কি পরিমাণ রেডিয়েশন প্রবাহিত হয় তা নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। বছরে দুই থেকে তিনবার এটা করা হয়। আর আমাদের দেশে একবারও করা হয় না। এ পর্যন্ত দেখাই হয়নি যে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার থেকে কি পরিমাণ রেডিয়েশন নির্গত হচ্ছে। আমাদের মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো নাকি নিজেরাই পরীক্ষা করে। তারা পরীক্ষা করলে তো তাদের ব্যবসার কথাই বিবেচনা করবে। কিন্তু এ থেকে কত রেডিয়েশন নির্গত হয় তা তারা প্রকাশ করে না। প্রত্যেকটা বিটিএস মাপা উচিত এবং স্টান্ডার্ড মান অনুযায়ী তাদের সনদ দেয়া দরকার তিনি মনে করেন। আর এজন্য কোনো নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলে তাদের সনদ নিয়েই বিটিএস বসাতে হতো অপারেটর কোম্পানিকে।
বুয়েটের এ অধ্যাপক আরো বলেন, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর রেডিয়েশন পরীক্ষা করে তা প্রবাহের একটা স্টান্ডার্ড মাত্রা বেঁধে দিতে হবে। তা না হলে এমন ক্ষতি তারা করেই যাবে। আমরা দেখতে পাই একটি টাওয়ারে বিটিএসে যেখানে দুইটা কিংবা তিনটা অ্যান্টিনা বসানোর কথা সেখানে দ্বিগুণ বা তিনগুণ অ্যান্টিনা বসিয়ে মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশন প্রবাহিত করা হচ্ছে। আগে যেখানে দুইটা অ্যান্টিনা ছিল সে একই টাওয়ারে আরো দুই তিনটি বসানো হচ্ছে। এতে করে একই স্থানে ভয়ানক রেডিয়েশন প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ এগুলো কিছুদূর পরে পরে টাওয়ার বসিয়ে করতে পারতো। কোম্পানিগুলো ব্যয় সংকোচন করে মানুষ এবং পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। মোবাইলের অতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তার ফলে মানুষের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। প্রথমে স্কিনে সমস্যা দেখা দেয় তারপরে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। রেডিয়েশন সব থেকে বেশি ক্ষতি করে গর্ভবতী মায়ের এবং শিশুদের। এ সমস্যা দীর্ঘদিন পরেও দেখা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া বলেন, মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের ক্ষতিটা দীর্ঘমেয়াদি। আমরা এটা বুঝতে চাই না। একটা বাচ্চার যখন বয়স ৫/৭ বছর তখন সে রেডিয়েশনের প্রভাবে আক্রান্ত হলেও এটার লক্ষণ ২৫/৩০ বছরে গিয়ে দেখা দিবে। এজন্য এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করি না। বিশ্বের সব বিখ্যাত মেডিকেল জার্নালে রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরেছে। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনে মানুষ বিভিন্ন রোগভোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। যার ফলে মানুষের আয়ুর ওপর একটা বিশাল প্রভাব পড়ছে বলেও তিনি জানান। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে একই জায়গায় একাধিক কোম্পানির টাওয়ার বসানো। যেখানে একটি টাওয়ারে অতিরিক্ত অ্যান্টিনা বসানো হয় সেখানে একাধিক টাওয়ার থেকে কত মাত্রায় রেডিয়েশন নির্গত তা হয় ভাবাও কঠিন। এটা বন্ধ করে একটি টাওয়ারে তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. এনায়েত করিম বলেন, মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে মানবদেহে নানা ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিয়েছে। ব্রেইন ক্যানসার, ক্যানসার, টিউমার, দৃষ্টি বৈকল্যসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবে এটা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু এর মারাত্মক প্রভাব আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। এজন্য রেডিয়েশনের প্রবাহের একটা সঠিক মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। আমাদের দেশে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো যেভাবে এক জায়গায় একাধিক টাওয়ার বসিয়ে রেডিয়েশন প্রবাহ করেছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।
No comments