১৮ রুটে পাচার হচ্ছে নারী ও শিশু by রুদ্র মিজান
আন্তর্জাতিক
নারী পাচার চক্রের নজর বাংলাদেশে। গরিব, অসহায়, ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী ও
শিশুদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। পরে তাদের
বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন যৌনপল্লীতে। মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন বাসায় যৌন
কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের। সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী
দেশ ভারতে। এ ছাড়াও রয়েছে সৌদি আরব, দুবাই, জর্ডান, লেবানন, মালয়েশিয়া।
সম্প্রতি চীনেও পাচার হচ্ছে নারী। মহিলা আইনজীবী পরিষদ, বিজিবি ও গোয়েন্দা
সূত্রে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।
সূত্রমতে, নারী ও শিশু পাচারে অন্তত ১৮টি রুট ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। প্রতিবছরই ২০ থেকে ২৫ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি নারী-শিশু পাচার হচ্ছে ভারতে। যদিও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের তথ্যানুসারে বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে বিভিন্ন দেশে ৪০ থেকে ৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়। ভারতের প্রায় প্রতিটি যৌন পল্লীতে রয়েছে বাংলাদেশি নারী। পাচারের পর থেকে শুরু তাদের বন্দি জীবন। স্বজন ও পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ। যৌনপল্লী ঘিরে সার্বক্ষণিক পাহারাদার। বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। পাচারকারীরা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্ত পার করে নিয়ে যায় ভারতে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনই পাচারকালে সীমান্তে আটক হচ্ছে নারী ও শিশু। অনেক ক্ষেত্রেই পাচারকারী থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত মাসে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে ১৫২ বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিজিবি। গত বছরে পাচারকালে ২৪১ জনকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১৫২ জন নারী ৮৯ জন শিশু। কিন্তু পাচারকারীদের আটক করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা, হায়দরাবাদ, মুম্বই, গোয়া, পুনে, কেরালা, দামান ও তামিলনাড়ুসহ বিভিন্ন প্রদেশের যৌনপল্লীতে বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের বিক্রি করে দিচ্ছে চক্র। ভারত থেকে ফেরা নির্যাতিত এক নারী জানান, তিনি স্বামী পরিত্যক্তা। থাকতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী। সেখানেই পরিচয় মিরাজ হোসেন কবির নামক যুবকের সঙ্গে। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কবির তাকে ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। হায়দরাবাদের নেরেডমিটের শ্রী কলোনির ১৩৫ নম্বর বাড়িতে বন্দি রাখা হয়েছিল তাকে। মারধর করে যৌনকাজে বাধ্য করা হয়। সেখান থেকে বাংলাদেশি এক খদ্দেরের সহযোগিতায় গত বছরের শেষের দিকে পালিয়ে এসেছেন এই নারী। ওই চক্রের হাতেই অর্ধশত বাংলাদেশি নারী বন্দি আছেন বলে দাবি করেন তিনি।
যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার শাঁকারা, ভোমরা, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ, কক্সবাজার, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের ছয়টি রুটসহ অন্তত ১৮টি রুট দিয়ে আশঙ্কাজনক হারে পাচার হচ্ছে নারী শিশু। সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। সীমান্তে টাকার বিনিময়ে নারী পাচারকারীদের সহযোগিতা করে এক শ্রেণির দালাল। বিজিবির অতিরিক্ত মহা-পরিচালক (অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান বলেন, ৪০ থেকে ৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচারের তথ্যটি সঠিক না। তবে পাচার হচ্ছে। পাচার ঠেকাতে বিজিবি অত্যন্ত তৎপর। প্রায়ই পাচারকালে নারী ও শিশুদের উদ্ধার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। সূত্রমতে, ঢাকায় শতাধিক এজেন্সি রয়েছে বিদেশে বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি করার নামে মূলত নারীদের পাচার করে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে মামলা।
সূত্রমতে, পাচারকারীদের মূল হোতারা থাকে দেশের বাইরে। দেশীয় দালাল ও সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমেই পাচার করা হয় নারীদের। আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারীদের সমন্বয়কদের একজন মানিকগঞ্জের হাজীনগরের কোহিনূর আলম। সৌদি আরব, দুবাই, জর্ডান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে কোহিনূর। দেশে রয়েছে তার শতাধিক দালাল। জর্ডানের আম্মানে আল রাইস রাবিয়া নামে একটি ট্রাস্ট রয়েছে। এর মাধ্যমে সিরিয়া ও লেবাননে পাঠানো হয় নারীদের। সিরিয়ার দামেস্কে আলমাহমুদ ও মজিদ, লেবাননের বৈরুতে ওমর ও আমিরসহ অনেক পাচারকারী রয়েছে। যারা নারীদের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে বন্দি করে রাখে। পরবর্তীতে মারধর করে, জোর করে যৌনকাজে বাধ্য করা হয়।
নারী পাচারে এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে চীনের নাম। ভিন্ন কৌশলে চীনে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি নারী। এক্ষত্রে সাধারণত টার্গেট করা হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে। পাহাড়ি নারীদের সঙ্গে চীনের নারীদের বেশ মিল থাকার কারণেই তাদের টার্গেট করা হয়। এ নারীদের উন্নত জীবন-যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হয়। চীনে ধানাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় তাদের। কলগার্ল হিসেবে কাজ করানো হয়। নাইটক্লাব, হোটেল ও বাসা তাদের কর্মস্থল। কোনো কোনো নারীকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিচ্ছেন চীনারা। এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও চীন এবং কোরিয়ার কিছু দালালের মাধ্যমে চক্র গড়ে উঠেছে ঢাকায়। চক্রের হোতাদের অন্যতম জোয়ান নামক কোরিয়ান নাগরিক। মাসে একাধিকবার ব্যবসার নামে বাংলাদেশ, চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারতসত বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে জোয়ান। প্রায়ই অবস্থান করে ঢাকার উত্তরায়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিটি দেশেই রয়েছে এই চক্রের সদস্যরা। ঢাকায় রয়েছে অফিস ও ফ্ল্যাটবাসা। এখান থেকেই সারা দেশে কার্যক্রম চালানো হয়। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে রয়েছে কমিশনভিত্তিক এজেন্ট। এজেন্টদের বেশির ভাগই নারী। তাদের মধ্যে একজন লিপি বেগম। উত্তরার-১৪ নম্বর সেক্টরের বাসায় থাকতেন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এই নারী। কোরিয়ান নাগরিক জোয়ানের অন্যতম সহযোগী লিপিকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে লিপি জানিয়েছে, পাচার হওয়া নারীদের মধ্যে অন্তত সাত জন রয়েছে চীনের বেইজিংয়ে। তাদের বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিযে চীনে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় দালালরা। পরবর্তীতে জোয়ানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। জোয়ান তাদের বিভিন্ন এঙ্গেলের ছবি ও প্রোফাইল সংগ্রহ করে চীনে পাঠায়। প্রোফাইলে তাদের উচ্চতা, গায়ের রং থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য উল্লেখ করা থাকে। সাধারণত সুন্দরী কম বয়সী নারীদের বাছাই করা হয়। বাছাইকৃত নারীকে ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় উত্তরার ওই বাসায়।
চীনে বৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় তাদের। বিয়েটা শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে জানিয়ে এতে রাজি করানো হয়। এই চক্রেরই সদস্য চীনা নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পাসপোর্ট, ভিসা প্রস্তুত করা হয়। এসব বিষয়ে ওই নারীর পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরিচয় হওয়া থেকে দূরে থাকেন হোতারা। এমনকি নিজের প্রকৃত নাম, পরিচয়ও গোপন রাখতেন স্থানীয় দালালদের কাছে। বাছাইকৃত নারীদের চীনে নিয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় অন্য জীবন। লিপির কথানাসুারে, চীনে নিয়ে কৌশলে তাদের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানো হয়। কেউ এতে রাজি না হলে খাবার বন্ধ রেখে শাস্তি দেয়া হয়। মারধর করা হয়। ধর্ষণ করা হয়। এভাবেই একসময় এ মেয়েরা যৌনকর্মে জড়িত হতে বাধ্য হয়।
লিপির দেয়া তথ্যানুসারে, ঢাকার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও বিউটি পার্লারে কর্মরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের টার্গেট করে এগুচ্ছিল তারা। চীনে ভালো চাকরির প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল বেশ কয়েক জনকে। এর মধ্যেই অভিযান চালায় ডিবি। প্রতিজন নারী সংগ্রহের জন্য কমিশন হিসেবে অর্ধলক্ষ টাকা দেয়া হতো দালালদের। উত্তরা থেকে এই চক্রের সদস্য জোয়ান, আসাফুন নাহার লিপি ও আব্দুর রশিদকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। উদ্ধার করা হয়েছে সুর্বণ চাকমা নামে এক নারীকে। এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী ও মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, পাচার হওয়া নারীদের ৮০ ভাগই নানা ঝুঁকিতে থাকে। তারা দরিদ্র, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, বাল্যবিবাহের শিকার। এসব দুর্বলতার সুযোগে আন্তর্জাতিক চক্রের নজর বাংলাদেশে। নানা ভুল তথ্য, প্রলোভন দেখিয়ে অসচেতনতার সুযোগে পাচার করা হচ্ছে নারী ও শিশুদের। স্থলপথে অন্তত ১৮টি রুটে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়। পাচারের পরিসংখ্যান জানা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তবে নারী ও শিশু উদ্ধারসহ নানা আলামত থেকে ধারণা করছি বছরে ২০-২৫ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বৈধপথে গিয়ে পাচারের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে নারী ও শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।
সূত্রমতে, নারী ও শিশু পাচারে অন্তত ১৮টি রুট ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। প্রতিবছরই ২০ থেকে ২৫ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি নারী-শিশু পাচার হচ্ছে ভারতে। যদিও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের তথ্যানুসারে বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে বিভিন্ন দেশে ৪০ থেকে ৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়। ভারতের প্রায় প্রতিটি যৌন পল্লীতে রয়েছে বাংলাদেশি নারী। পাচারের পর থেকে শুরু তাদের বন্দি জীবন। স্বজন ও পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ। যৌনপল্লী ঘিরে সার্বক্ষণিক পাহারাদার। বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। পাচারকারীরা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্ত পার করে নিয়ে যায় ভারতে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনই পাচারকালে সীমান্তে আটক হচ্ছে নারী ও শিশু। অনেক ক্ষেত্রেই পাচারকারী থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত মাসে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে ১৫২ বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিজিবি। গত বছরে পাচারকালে ২৪১ জনকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১৫২ জন নারী ৮৯ জন শিশু। কিন্তু পাচারকারীদের আটক করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা, হায়দরাবাদ, মুম্বই, গোয়া, পুনে, কেরালা, দামান ও তামিলনাড়ুসহ বিভিন্ন প্রদেশের যৌনপল্লীতে বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের বিক্রি করে দিচ্ছে চক্র। ভারত থেকে ফেরা নির্যাতিত এক নারী জানান, তিনি স্বামী পরিত্যক্তা। থাকতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী। সেখানেই পরিচয় মিরাজ হোসেন কবির নামক যুবকের সঙ্গে। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কবির তাকে ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। হায়দরাবাদের নেরেডমিটের শ্রী কলোনির ১৩৫ নম্বর বাড়িতে বন্দি রাখা হয়েছিল তাকে। মারধর করে যৌনকাজে বাধ্য করা হয়। সেখান থেকে বাংলাদেশি এক খদ্দেরের সহযোগিতায় গত বছরের শেষের দিকে পালিয়ে এসেছেন এই নারী। ওই চক্রের হাতেই অর্ধশত বাংলাদেশি নারী বন্দি আছেন বলে দাবি করেন তিনি।
যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার শাঁকারা, ভোমরা, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ, কক্সবাজার, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের ছয়টি রুটসহ অন্তত ১৮টি রুট দিয়ে আশঙ্কাজনক হারে পাচার হচ্ছে নারী শিশু। সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। সীমান্তে টাকার বিনিময়ে নারী পাচারকারীদের সহযোগিতা করে এক শ্রেণির দালাল। বিজিবির অতিরিক্ত মহা-পরিচালক (অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান বলেন, ৪০ থেকে ৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচারের তথ্যটি সঠিক না। তবে পাচার হচ্ছে। পাচার ঠেকাতে বিজিবি অত্যন্ত তৎপর। প্রায়ই পাচারকালে নারী ও শিশুদের উদ্ধার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। সূত্রমতে, ঢাকায় শতাধিক এজেন্সি রয়েছে বিদেশে বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি করার নামে মূলত নারীদের পাচার করে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে মামলা।
সূত্রমতে, পাচারকারীদের মূল হোতারা থাকে দেশের বাইরে। দেশীয় দালাল ও সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমেই পাচার করা হয় নারীদের। আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারীদের সমন্বয়কদের একজন মানিকগঞ্জের হাজীনগরের কোহিনূর আলম। সৌদি আরব, দুবাই, জর্ডান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে কোহিনূর। দেশে রয়েছে তার শতাধিক দালাল। জর্ডানের আম্মানে আল রাইস রাবিয়া নামে একটি ট্রাস্ট রয়েছে। এর মাধ্যমে সিরিয়া ও লেবাননে পাঠানো হয় নারীদের। সিরিয়ার দামেস্কে আলমাহমুদ ও মজিদ, লেবাননের বৈরুতে ওমর ও আমিরসহ অনেক পাচারকারী রয়েছে। যারা নারীদের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে বন্দি করে রাখে। পরবর্তীতে মারধর করে, জোর করে যৌনকাজে বাধ্য করা হয়।
নারী পাচারে এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে চীনের নাম। ভিন্ন কৌশলে চীনে পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি নারী। এক্ষত্রে সাধারণত টার্গেট করা হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে। পাহাড়ি নারীদের সঙ্গে চীনের নারীদের বেশ মিল থাকার কারণেই তাদের টার্গেট করা হয়। এ নারীদের উন্নত জীবন-যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হয়। চীনে ধানাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় তাদের। কলগার্ল হিসেবে কাজ করানো হয়। নাইটক্লাব, হোটেল ও বাসা তাদের কর্মস্থল। কোনো কোনো নারীকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিচ্ছেন চীনারা। এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও চীন এবং কোরিয়ার কিছু দালালের মাধ্যমে চক্র গড়ে উঠেছে ঢাকায়। চক্রের হোতাদের অন্যতম জোয়ান নামক কোরিয়ান নাগরিক। মাসে একাধিকবার ব্যবসার নামে বাংলাদেশ, চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারতসত বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে জোয়ান। প্রায়ই অবস্থান করে ঢাকার উত্তরায়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিটি দেশেই রয়েছে এই চক্রের সদস্যরা। ঢাকায় রয়েছে অফিস ও ফ্ল্যাটবাসা। এখান থেকেই সারা দেশে কার্যক্রম চালানো হয়। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে রয়েছে কমিশনভিত্তিক এজেন্ট। এজেন্টদের বেশির ভাগই নারী। তাদের মধ্যে একজন লিপি বেগম। উত্তরার-১৪ নম্বর সেক্টরের বাসায় থাকতেন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এই নারী। কোরিয়ান নাগরিক জোয়ানের অন্যতম সহযোগী লিপিকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে লিপি জানিয়েছে, পাচার হওয়া নারীদের মধ্যে অন্তত সাত জন রয়েছে চীনের বেইজিংয়ে। তাদের বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিযে চীনে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় দালালরা। পরবর্তীতে জোয়ানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। জোয়ান তাদের বিভিন্ন এঙ্গেলের ছবি ও প্রোফাইল সংগ্রহ করে চীনে পাঠায়। প্রোফাইলে তাদের উচ্চতা, গায়ের রং থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্য উল্লেখ করা থাকে। সাধারণত সুন্দরী কম বয়সী নারীদের বাছাই করা হয়। বাছাইকৃত নারীকে ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় উত্তরার ওই বাসায়।
চীনে বৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় তাদের। বিয়েটা শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে জানিয়ে এতে রাজি করানো হয়। এই চক্রেরই সদস্য চীনা নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পাসপোর্ট, ভিসা প্রস্তুত করা হয়। এসব বিষয়ে ওই নারীর পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরিচয় হওয়া থেকে দূরে থাকেন হোতারা। এমনকি নিজের প্রকৃত নাম, পরিচয়ও গোপন রাখতেন স্থানীয় দালালদের কাছে। বাছাইকৃত নারীদের চীনে নিয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় অন্য জীবন। লিপির কথানাসুারে, চীনে নিয়ে কৌশলে তাদের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানো হয়। কেউ এতে রাজি না হলে খাবার বন্ধ রেখে শাস্তি দেয়া হয়। মারধর করা হয়। ধর্ষণ করা হয়। এভাবেই একসময় এ মেয়েরা যৌনকর্মে জড়িত হতে বাধ্য হয়।
লিপির দেয়া তথ্যানুসারে, ঢাকার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও বিউটি পার্লারে কর্মরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের টার্গেট করে এগুচ্ছিল তারা। চীনে ভালো চাকরির প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল বেশ কয়েক জনকে। এর মধ্যেই অভিযান চালায় ডিবি। প্রতিজন নারী সংগ্রহের জন্য কমিশন হিসেবে অর্ধলক্ষ টাকা দেয়া হতো দালালদের। উত্তরা থেকে এই চক্রের সদস্য জোয়ান, আসাফুন নাহার লিপি ও আব্দুর রশিদকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। উদ্ধার করা হয়েছে সুর্বণ চাকমা নামে এক নারীকে। এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী ও মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, পাচার হওয়া নারীদের ৮০ ভাগই নানা ঝুঁকিতে থাকে। তারা দরিদ্র, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, বাল্যবিবাহের শিকার। এসব দুর্বলতার সুযোগে আন্তর্জাতিক চক্রের নজর বাংলাদেশে। নানা ভুল তথ্য, প্রলোভন দেখিয়ে অসচেতনতার সুযোগে পাচার করা হচ্ছে নারী ও শিশুদের। স্থলপথে অন্তত ১৮টি রুটে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়। পাচারের পরিসংখ্যান জানা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তবে নারী ও শিশু উদ্ধারসহ নানা আলামত থেকে ধারণা করছি বছরে ২০-২৫ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বৈধপথে গিয়ে পাচারের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে নারী ও শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।
No comments