আদালতের নির্দেশ অমান্য করে মাছ লুটের মচ্ছব
সিলেটে
পাথরখেকোদের থাবা এবার জলমহালে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেটের
জৈন্তাপুরে পাথরের পর এবার জলমহালে চোখ পড়েছে ক্ষমতাসীন দলের
প্রভাবশালীদের। শাসক দলের ওই নেতাদের নেতৃত্বে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য
করে উতলা, লেপটেন, হ্রাসমনি ও বর্নি বিল হরিলুটের আয়োজন করা হয়েছে।
হাইকোর্ট লিজ বাতিল করে রায় দেয়ার পরপরই সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রহরায় শুরু
হয়েছে জলমহাল লুটপাটের আয়োজন। অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ করে লাখ লাখ টাকার মাছ
লুট করে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাডাররা। গত এক সপ্তাহে প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাছ
লুটপাট হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় হাইকোর্টের নির্দেশ
অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে প্রশাসনেরও তেমন কোনো গরজ
নেই। পুলিশ সব কিছু জানলেও অজ্ঞাতকারণে নিশ্চুপ। সরকারি জলমহাল থেকে মাছ
লুটপাট হওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থানীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজ করছে
চরম উত্তেজনা। মাছ লুটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের
অঘটনের আশঙ্কা রয়েছে। সরেজমিন গেলে দেখা যায়, বর্নি বিলের পাশে একটি নোহা
মাইক্রোবাস। এ গাড়ির অদূরে একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ওই স্থাপনায়
সশস্ত্র ক্যাডাররা অবস্থান করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালীনগর গ্রামের
স্থানীয় একজন জানান, জলদস্যুরা মাছ লুটে নিতে দুটি অস্ত্রাগার তৈরি করেছে
প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার জন্য। ক্যাডাররা দেশীয় অস্ত্রের মজুদ রেখেছে।
দিনরাত অর্ধশতাধিক ক্যাডার সেখানে থাকে। তিনি জানান, এ মাইক্রোবাস দিয়ে
সিলেট শহর থেকে অস্ত্র নেয়া হয়েছে গত বুধবার। দুর্বৃত্তরা শক্তি বৃদ্ধি
করার পর বিলে মাছ ধরা শুরু করেছে। পুরো বিলের মাছ ধরতে প্রায় দুই আড়াই মাস
সময় লেগে যেতে পারে। নলজুড়ি গ্রামের মোহব্বত আলী অভিযোগ করে বলেন, বিলের
মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে মারামারি হতে পারে- এ আতঙ্কে রয়েছেন এলাকাবাসী।
অপরিচিত লোকদের হাওরে আনাগোনা বেড়েছে। ফলে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ হাওরে
যাচ্ছেন না। শিশুদেরও হাওরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বর্নি বিলের বাসিন্দা
ইউনুস মিয়া বলেন, কয়েক প্রভাবশালী বিলের লাখ লাখ টাকার মাছ জোর করে ধরে
নিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
গত বুধবার থেকে বিলের পানি
ছেড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ক্যাডারদের প্রহরায় প্রায় শতাধিক জেলে হাওরে মাছ
আহরণ করছেন। প্রায় দুইশ’ আট একর জায়গাজুড়ে রয়েছে বর্নি বিল। এ বিলে রয়েছে
ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ। হাইকোর্টের রায় দেয়ার পর ওই মাছ লুটে নিতে
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ৯ দুর্বৃত্ত। এ বিল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সর্বোচ্চ
দরদাতাকে না দিয়ে প্রায় সোয়া লাখ টাকা কম দরদাতাকে ৫ বছরের জন্য লিজ দেয়া
হয়। এ বিল থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে। পাথর আর হাওর ও বিলে
পরিবেষ্টিত জৈন্তাপুর উপজেলা। এ উপজেলায় ছোট-বড় ৬৮টি জলমহাল রয়েছে। এ বিল
থেকে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ
করে বিভিন্ন স্থানে মাছ বিক্রি করা হয়। মৎস্য আহরণ করে স্থানীয় জেলে
সম্প্রদায় জীবিকা নির্বাহ করে। জানা যায়, ২০১৬ সালে এই বিল লিজের জন্য
আবেদন আহ্বান করা হয়। নিয়মনীতি মেনে ১২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দর দিয়ে আবেদন
করে একতা মৎস্যজীবী সমিতি এবং ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা দর দিয়ে আবেদন করে
শেওলারটুক মৎস্যজীবী সমিতি। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে সর্বোচ্চ দরদাতা একতা
মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে ইজারা না দিয়ে তার চেয়ে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা কমে
দ্বিতীয় দরদাতা শেওলারটুক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে বিল ইজারা দেয়
মন্ত্রণালয়। এ লিজের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে একতা মৎস্যজীবী
সমবায় সমিতি লিমিটেড। হাইকোর্ট শুনানি শেষে শেওলারটুক মৎস্যজীবী লিমিটেডের
ইজারা বাতিল করে একতা সমবায় সমিতি লিমিটেডকে ইজারা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের
নির্দেশ দেন। পরে সরকার পক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে।
সুপ্রিমকোর্ট কার্যতালিকায় মামলাটি শুনানির জন্য আগামী বছরের ৬ মে দিন
ধার্য করেন। এদিকে গত রোববার জেলা প্রশাসকের কাছে একতা মৎস্যজীবী সমবায়
সমিতির সভাপতি ময়না মিয়া অভিযোগ করেন। সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ
সম্পাদক লিয়াকত আলী, এখলাছুর রহমান, ফরিদ, শাহ আলম, আলাল, ফিরোজ, ফারুক
সোবহান ও ওমরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থায় মাছ লুটের অভিযোগ করা হয়েছে।
জৈন্তাপুর উপজেলার ইউএনও মৌরীন করিম যুগান্তরকে বলেন, কেউ মাছ না ধরতে
হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে। আদালতের নির্দেশমতে পুলিশ কাজ করছে। যারা আইন
আমান্য করে বিলে মাছ ধরতে যাবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। থানার
ওসি খান মোহাম্মদ মইনুল জাকির বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়ে দেয়া
হয়েছে। বেআইনিভাবে মাছ লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না-
জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ মাছ লুটপাট করেছে কিনা তার জানা নেই। একতা
মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ময়না মিয়া জানান, লিয়াকতের নেতৃত্বে পাথর
লুটের পর এবার জলমহালে হাত দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জেলা
প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, শেওলারটুক
সমবায় সমিতি লিয়াকত বাহিনীর কাছে প্রায় আড়াই কোটি টাকায় বিলটি বিক্রি করে
দিয়েছে। শেওলারটুক সমবায় সমিতির সভাপতি ফজর আহমদ মাছ লুটপাটের কথা স্বীকার
করে বলেন, হাইকোর্ট আমাদের বিপক্ষে গেলেও লিয়াকত সঙ্গে আছেন, তাই আমরা মাছ
ধরছি। কত টাকায় লিয়াকত আলীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে- জানতে চাইলে বলেন, এটা
আমি জানি না, এগুলো সমিতির সাধারণ সম্পাদক আকবর জানেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের
সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে এগুলোর
সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে বলেন, এগুলো প্রতিপক্ষের অপপ্রচার।
এ ব্যাপারে শেওলারটুক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন
বলেন, হাইকোর্ট তো আমাদের কিছু জানায়নি। নিয়মনীতি ভঙ্গ করে মাছ লুটপাটের
অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘কী করমু হাওর উন্নয়ন করতে হলে প্রতি বছরই
মাছ বিক্রি করতেই হবে।’
No comments