প্রার্থী নিয়ে স্বস্তিতে জাতীয় পার্টি আ’লীগ চায় ধরে রাখতে
কালীগঞ্জ
ও আদিতমারী উপজেলা নিয়ে গঠিত লালমনিরহাট-২ আসনটি জাতীয় পার্টির আসন
হিসেবেই পরিচিত ছিল এতদিন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে এ আসনে একাই রাজত্ব করেন
মজিবুর রহমান। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য থাকাকালে ২০১৬ সালে তিনি
মারা যান। তবে গত বছর এ আসনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা নুরুজ্জামান আহমেদ।
তিনি বর্তমান সরকারের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা
ভালো থাকলেও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে দলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে
পড়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে দলের তৃণমূলেও। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং বিএনপিকে
ভীষণভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। জামায়াতের অবস্থান সেভাবে না থাকলেও একটি দলকে
বিজয়ী করতে জামায়াতের ভোট এখনও ‘ফ্যাক্টর’। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
বিএনপি সে সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায়। নানা হিসাব-নিকাশের পর ক্ষমতাসীন দল
তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অপরদিকে জাতীয় পার্টির
প্রার্থী দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইমেজ কাজে লাগিয়ে দলকে
জয়ের শিবিরে নিয়ে যেতে চায়। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে বিএনপিও
চাইছে ভোটযুদ্ধে জয়ী হতে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকার পরও এরই
মধ্যে প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে সরব হয়ে উঠেছেন। এদিকে মনোনয়ন
প্রত্যাশীদের দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে জাতীয় পার্টি। আগামী
নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সমাজকল্যাণ সম্পাদক রোকন উদ্দিন
বাবুল দলের একক প্রার্থী। আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী আগামী নির্বাচনে
দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। প্রার্থীদের ভিড়ে বর্তমান এমপি ও সমাজকল্যাণ
প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের অবস্থান শক্ত। তিনি ছাড়াও আদিতমারী
উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সভাপতি
সিরাজুল হক মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে নুরুজ্জামান আহমেদ সবদিক থেকে এগিয়ে আছেন
বলে দাবি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। অপরদিকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাচ্ছেন
সাবেক এমপি সালেহ উদ্দিন আহমেদ হেলাল। তবে দলের একটি অংশ এ আসনে সাবেক
উপমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় নেতা ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ
আসাদুল হাবিব দুলুকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন।
দুই উপজেলার আটটি করে
১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত লালমনিরহাট-২ আসনের বর্তমান এমপি নুরুজ্জামান আহমেদ
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। কালীগঞ্জ
উপজেলার বাসিন্দা নুরুজ্জামানের বাবা প্রয়াত করিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৭০ ও ১৯৭৩
সালে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। বাবার হাত ধরেই তার রাজনীতিতে আসা।
একাধিকবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, দু’বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান
নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের টিকিটে ভোটে অংশ
নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী প্রয়াত মজিবুর রহমানের কাছে পরাজিত হন। ২০০১
সালেও আওয়ামী লীগের টিকিট পান নুরুজ্জামান আহমেদ। কিন্তু ঋণখেলাপির অভিযোগে
প্রথমে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। পরে দলীয় প্রতীক তুলে দেয়া হয় ওই
সময়ে জোটের গণফোরামের প্রার্থীর কাছে। পরে উচ্চ আদালত ভোট গ্রহণের কয়েকদিন
আগে নুরুজ্জামানকে বৈধ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী
হিসেবে ভোট যুদ্ধে নেমে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন প্রয়াত মজিবুর
রহমানের কাছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয়
পার্টির মজিবুর রহমান বিজয়ী হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর প্রথমে
তাকে খাদ্য প্রতিমন্ত্রী পরে তাকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া
হয়। গত প্রায় চার বছরে তিনি রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে নানা উন্নয়নমূলক কাজ
করেন। আগামী নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, নির্বাচন
সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। দলীয় মনোনয়ন নয়, জোটগত নির্বাচন হলেও আমি
মনোনয়ন পাব বলে বিশ্বাস করি। নিশ্চয়ই এলাকার মানুষ বর্তমান সরকারের উন্নয়ন
কর্মকাণ্ড দেখে আমাকে ভোট দেবেন। তাদের পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র
সহসভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সিরাজুল হকও মনোনয়ন প্রত্যাশী। এর আগে দুই
দফায় আদিতমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিরাজুল
হক। তবে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েও
বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। সিরাজুল হক বলেন, মনোনয়নের জন্য অবশ্যই
আবেদন করব। তবে এক্ষেত্রে দল যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তাই মেনে নেব। এর আগে
কালীগঞ্জের চাপারহাটের এক জনসভায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ
এরশাদ লালমনিরহাট-২ আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে রোকন উদ্দিন বাবুলকে পরিচয়
করিয়ে দেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে তখন থেকেই দল গোছানোর কাজে
নামেন বাবুল। নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন তিনি। কালীগঞ্জের
পাশাপশি আদিতমারীতেও সমান তালে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। ইতিমধ্যেই
দুই উপজেলার ওয়ার্ড-ইউনিয়ন কমিটিগুলো নতুন করে গঠিত হওয়ায় চাঙ্গা হয়ে উঠছে
এখানকার জাতীয় পার্টি। ফলে আগামী নির্বাচনে আসনটি পুনরুদ্ধারে জাতীয় পার্টি
শক্ত অবস্থানে আছে বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করেন। বর্তমানে
লালমনিরহাট-২ আসনে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে তিনি যেভাবে মাঠ চষে
বেড়াচ্ছেন, তাতে করে বাবুলকে দিয়েই হারানো আসন পুনরুদ্ধার ‘সম্ভব’ বলে মনে
করেন জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। জানতে চাইলে রোকন উদ্দিন বাবুল
বলেন, ‘আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় পার্টির ছিল। এখনও এখানকার মানুষজন জাতীয়
পার্টির সঙ্গে আছে। তাই আগামী নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যেই জাতীয় পার্টি কাজ
করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালেহ
উদ্দিন আহমেদ হেলাল দলীয় মনোনয়ন পেতে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৬ সালের ১৫
ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি ক্লিন ইমেজের অধিকারী। তাই আগামী নির্বাচনে তিনি
বিএনপির শক্ত প্রার্থী। তবে সম্প্রতি কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠন
নিয়ে দল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বিএনপির একটি অংশ সাবেক উপমন্ত্রী ও
লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুকে প্রার্থী
হিসেবে পেতে চাইছেন। দুলুরও এলাকায় জনপ্রিয়তা রয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি
কেন্দ্রীয় কমিটির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ
সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা সালেহ উদ্দিন আহমেদ হেলাল বলেন, আমি যুগ
যুগ ধরে এ আসনের মানুষের সঙ্গে আছি, তাদের জন্য কাজ করছি। আগামী নির্বাচনেও
আমি দলীয় মনোনয়ন পাব বলে বিশ্বাস করি। আর নির্বাচনী মাঠে নেতাকর্মীরা
ঐক্যবদ্ধভাবেই তার পক্ষে কাজ করবেন বলে মনে করি। তবে কালীগঞ্জ উপজেলা
বিএনপির সদস্য সচিব ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমও
বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর জেলা বিএনপির সভাপতি ও
সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সর্বশেষ উপজেলা
পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। বিএনপি নেতা
জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এখানকার
নেতাকর্মীরা লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল
হাবিব দুলু ভাইকে এ আসনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন। এরপরও যদি দুলু ভাই
অপারগতা প্রকাশ করেন, তাহলে সেক্ষেত্রে আমি মনোনয়ন চাইব।
No comments