রাজনীতিতে মুরব্বি-মক্কেলচক্র
এই
মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে মুরব্বি-মক্কেলচক্র। এই
রাজনীতির চাবিকাঠি হচ্ছে পৃষ্ঠপোষকদের আশীর্বাদ। মক্কেলরা হালুয়া-রুটির
রাজনীতি করে। যেখানে মুরব্বিরা পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারেন, সেখানেই মক্কেলদের
ভিড় জমে। তবে দেশে সম্পদ সীমিত। কাজেই আইনসম্মতভাবে পৃষ্ঠপোষকতার প্রসার
সম্ভব নয়। বেশিরভাগ পৃষ্ঠপোষকতাই এখানে বেআইনি। এই বেআইনি পৃষ্ঠপোষকতাকে
টিকিয়ে রেখেছে দুর্নীতির দুষ্টুচক্র। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে,
বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশগুলোর অন্যতম।
তবু এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন দেখা যায়
না। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলোই দুর্নীতির প্রধান সমর্থক বলে সন্দেহ করা
হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ে এসব কথা লিখেছেন।
‘বংশানুক্রমিক রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি’ শীর্ষক প্যারায় তিনি লিখেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলসমূহের প্রাণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা। এ ব্যবস্থায় তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সব রাজনৈতিক নেতা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন। দলের সাধারণ সদস্যরা চাইলে যেকোনো পর্যায়ে নেতা পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বংশভিত্তিক। দলের প্রতিষ্ঠাতার গোষ্ঠীর নেতাকেই দলের প্রধান নির্বাচন করতে হয়। দলের প্রধান দলের কোনো পদের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তা তিনিই নির্ধারণ করেন। এখানে দলের সাধারণ ভোটারদের কোনো দায়িত্ব নেই। দলের সংবিধানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিধান থাকলেও আসলে কোনো নির্বাচন হয় না।
পরিবর্তনহীন রাজনীতি: সাধারণত রাজনৈতিক দলে নতুন সদস্যরা যোগ দেন রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়ে। তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক হয় এবং গণসমর্থনের ভিত্তিতে নতুন কর্মসূচি গৃহীত হয় ও নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যেসব দেশে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব, সেসব দেশে নতুন দলের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে পুরনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব নয়।
সহযোগী সংগঠনের আধিক্যের ফলে সিভিল সমাজের বিভক্তি ও সংঘর্ষমূলক রাজনীতির উদ্ভব: সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সিভিল সমাজের সংগঠনসমূহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় থাকে। কিন্তু যেসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেসব দেশে সিভিল সমাজের রাজনৈতিকীকরণ হলে সংঘর্ষের দুষ্টুচক্র থেকে পরিত্রাণ অত্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বড় দলের সমর্থকেরা সহযোগী সংগঠন বা ফ্রন্ট সংগঠন করে সিভিল সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে। সংঘর্ষের রাজনীতি তাই সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে।
উপদলীয় কোন্দল: উপদলীয় কোন্দল সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমবেশি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল আদর্শভিত্তিক নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ এখানে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাই বাংলাদেশে উপদলীয় রাজনীতি অনেক বেশি সহিংস। এর ফলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনেক ক্ষেত্রে রুদ্ধ।
দলীয় ও সরকারি নেতৃত্ব অভিন্ন: গণতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুসারে দল ও সরকার ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তাদের নেতৃত্বও হবে ভিন্ন। সরকার পরিচালনা করবেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সরকার সঠিকভাবে কাজ করছে কি-না তার তদারক করবে দলীয় নেতৃত্ব। দলীয় ও সরকারি নেতৃত্ব অভিন্ন হলে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি: গঠনতন্ত্র অনুসারে নিয়মিতভাবে দলের নেতৃত্বের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হয় না।
তহবিল সংগ্রহে অনিয়ম এবং স্বচ্ছ হিসাবরক্ষণে ব্যর্থতা: পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই রাজনৈতিক দলসমূহের তহবিল সংগ্রহে অনিয়ম ঘটে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মানতে চায় না, তাই এক্ষেত্রে সুষ্ঠু আইন প্রণয়ন সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হিসাব রক্ষার নিয়মগুলোও সঠিকভাবে প্রতিপালন করে না।
ওপরের আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে তা অত্যন্ত ব্যপক ও জটিল। এগুলোর সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান নেতৃত্বের কোনো লাভ নেই। কাজেই তাদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। এখানে সংস্কারের কয়েকটি সম্ভাব্য পথ রয়েছে। প্রথমত, একটি পথ হতে পারে একবারে সব সংস্কার না করে আস্তে আস্তে সংস্কার করা। এ ধরনের সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হবে না। দ্বিতীয়ত, একবারে সব আইনকানুন ঠিক করা। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ে এসব কথা লিখেছেন।
‘বংশানুক্রমিক রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি’ শীর্ষক প্যারায় তিনি লিখেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলসমূহের প্রাণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা। এ ব্যবস্থায় তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সব রাজনৈতিক নেতা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন। দলের সাধারণ সদস্যরা চাইলে যেকোনো পর্যায়ে নেতা পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বংশভিত্তিক। দলের প্রতিষ্ঠাতার গোষ্ঠীর নেতাকেই দলের প্রধান নির্বাচন করতে হয়। দলের প্রধান দলের কোনো পদের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তা তিনিই নির্ধারণ করেন। এখানে দলের সাধারণ ভোটারদের কোনো দায়িত্ব নেই। দলের সংবিধানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিধান থাকলেও আসলে কোনো নির্বাচন হয় না।
পরিবর্তনহীন রাজনীতি: সাধারণত রাজনৈতিক দলে নতুন সদস্যরা যোগ দেন রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়ে। তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক হয় এবং গণসমর্থনের ভিত্তিতে নতুন কর্মসূচি গৃহীত হয় ও নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যেসব দেশে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব, সেসব দেশে নতুন দলের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে পুরনো রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব নয়।
সহযোগী সংগঠনের আধিক্যের ফলে সিভিল সমাজের বিভক্তি ও সংঘর্ষমূলক রাজনীতির উদ্ভব: সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সিভিল সমাজের সংগঠনসমূহের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় থাকে। কিন্তু যেসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেসব দেশে সিভিল সমাজের রাজনৈতিকীকরণ হলে সংঘর্ষের দুষ্টুচক্র থেকে পরিত্রাণ অত্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বড় দলের সমর্থকেরা সহযোগী সংগঠন বা ফ্রন্ট সংগঠন করে সিভিল সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে। সংঘর্ষের রাজনীতি তাই সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে।
উপদলীয় কোন্দল: উপদলীয় কোন্দল সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমবেশি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল আদর্শভিত্তিক নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ এখানে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাই বাংলাদেশে উপদলীয় রাজনীতি অনেক বেশি সহিংস। এর ফলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ অনেক ক্ষেত্রে রুদ্ধ।
দলীয় ও সরকারি নেতৃত্ব অভিন্ন: গণতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুসারে দল ও সরকার ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তাদের নেতৃত্বও হবে ভিন্ন। সরকার পরিচালনা করবেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সরকার সঠিকভাবে কাজ করছে কি-না তার তদারক করবে দলীয় নেতৃত্ব। দলীয় ও সরকারি নেতৃত্ব অভিন্ন হলে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি: গঠনতন্ত্র অনুসারে নিয়মিতভাবে দলের নেতৃত্বের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হয় না।
তহবিল সংগ্রহে অনিয়ম এবং স্বচ্ছ হিসাবরক্ষণে ব্যর্থতা: পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই রাজনৈতিক দলসমূহের তহবিল সংগ্রহে অনিয়ম ঘটে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মানতে চায় না, তাই এক্ষেত্রে সুষ্ঠু আইন প্রণয়ন সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হিসাব রক্ষার নিয়মগুলোও সঠিকভাবে প্রতিপালন করে না।
ওপরের আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে তা অত্যন্ত ব্যপক ও জটিল। এগুলোর সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান নেতৃত্বের কোনো লাভ নেই। কাজেই তাদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। এখানে সংস্কারের কয়েকটি সম্ভাব্য পথ রয়েছে। প্রথমত, একটি পথ হতে পারে একবারে সব সংস্কার না করে আস্তে আস্তে সংস্কার করা। এ ধরনের সংস্কারে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হবে না। দ্বিতীয়ত, একবারে সব আইনকানুন ঠিক করা। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
No comments