মজুদে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা
চাল মজুদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানা হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনামাফিক পর্যাপ্ত মজুদ গড়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে আপৎকালীন মজুদ থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে (১০ টাকা কেজি দরের চাল) সাড়ে ৭ লাখ টন চাল বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি বাজার দরের চেয়ে সরকারি মূল্য কম নির্ধারণ করায় কৃষক এবং মিলাররাও সরকারকে চাল দিতে অনীহা দেখায়। ফলে দিন দিন কমতে থাকে চালের মজুদ। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টনে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অতি দরিদ্রদের জন্য ভিজিএফসহ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কাবিখা, টিআর এবং জিআর কর্মসূচিতে চালের পরিবর্তে গম দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতি কেজি চালের মূল্য অনুযায়ী সমমূল্যের গম দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (১৫ শতাংশ) তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সম্পূরক শুল্কসহ ১৮ শতাংশ কমে চাল আমদানিতে শুল্ক দাঁড়াবে মোটে ১০ শতাংশ। এছাড়া সরকার টু সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ছয় লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই মাস আগেও সাড়ে তিন লাখ চালসহ সাত লাখ টন মজুদ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে মজুদ কমছে। সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে চার লাখ টন চাল সংগ্রহ হওয়ার কথা সেখানে হয়েছে মাত্র ৩৮ হাজার টন। সংগ্রহ না হওয়ার কারণে মজুদের এ অবস্থা।’ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এসব বাজে কথা ও অপপ্রচার। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চালু হয়েছে। আর এ চাল দেয়া হয়েছে কাবিখা কাবিটা হওয়ায় উদ্বৃত্ত চাল থেকে।’ এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি খাদ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই নির্দেশনার এক নম্বরেই ছিল- পরিকল্পনামাফিক পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ গড়ে তোলা। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সব মৌসুমে খাদ্য উৎপাদন ভালো নাও হতে পারে। এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনামাফিক পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ সাধারণ শুল্কের (সিডি) পাশাপাশি ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপ করা হয়। দুটি মিলে ২৫ শতাংশ হওয়ায় বিধি অনুযায়ী এর সঙ্গে যুক্ত হয় সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ৩ শতাংশ। ফলে ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হয়। কেজিতে তা পড়ে প্রায় ৯ টাকা। এতে দেড় বছর ধরে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ। এছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি কর্মসূচিতে সাড়ে সাত লাখ টন চাল সরবরাহ করার কারণেই মূলত মজুদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ওই কর্মসূচি নেয়ার আগে ছিল না তেমন কোনো প্রস্তুতি অথবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। পাশাপাশি বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ, সারা দেশে অতিবৃষ্টি, হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোরা এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামের পাহাড় ধস খাদ্য মজুদ কমে যাওয়ার কারণ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আমলে না নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে কোনো ধরনের দুর্যোগ না থাকা সত্ত্বেও ১০ টাকা কেজি দরে বিপুল পরিমাণ চাল বিতরণ করা হয়েছে। আপৎকালীন মজুদ বা দুর্যোগের বিষয়টি খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। সরকারের খাদ্য মজুদ সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। আপৎকালীন খাদ্য মজুদ ১০ লাখ টন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে সরকারের গুদামে চাল ও গম আছে মাত্র ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭ টন। এর মধ্যে চালের মজুদ মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার ৯১ টন। গত বছরের এই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৮০ হাজার টন। যার মধ্যে শুধু চালই ছিল ৬ লাখ ৪ হাজার টন। দুর্বল মজুদ পরিস্থিতি টের পেয়েই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ তারা জানেন দাম স্বাভাবিক রাখতে দেশব্যাপী ওএমএস কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয় সরকারের। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, মাঝারি ও মোটা চালের পাইকারি ও খুচরা উভয় মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। গুটি ও স্বর্ণার মতো মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা দরে। কিন্তু বাজারে ৫০ টাকা কেজির নিচে কোনো চাল পাওয়া যাচ্ছে না। গত ২ মে থেকে সারা দেশে বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৩২ হাজার ২৯৬ টন সিদ্ধ ও আতপ চাল। ইতিমধ্যে ৭ হাজার ২৬২টি মিল মালিকের সঙ্গে ২ লাখ ১০ হাজার টন বোরো চাল সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। সরকারের তালিকাভুক্ত মিল মালিকের সংখ্যা ২২ হাজার ৬৫৪টি। যেসব মিল মালিক সরকারের সঙ্গে এবার চুক্তি করেনি তাদের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী এ বিষয়ে বলেন, বর্তমান বাজারে মোটা চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা দরে। আর সরকার চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা। সরকারি দামে কোথাও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষক ওই দামে আমাদের চাল দিচ্ছে না। ফলে আমরাও সরকারকে ওই দামে চাল দিতে পারছি না। কারণ এক কেজি ধান কিনে তা মিলে ভাঙিয়ে চালে পরিণত করতে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা খরচ পড়ে। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার চাল সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে হাত বাড়ায়। ভিয়েতনাম থেকে জিটুজি পর্যায়ে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে আরও দেড় লাখ টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। শিগগিরই আরও ৫০ হাজার টন চালের জন্য টেন্ডার হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পরে আরও দেড় লাখ টনও আনা হবে।
No comments