হাওরবাসীর কন্ঠে কেবলই বাঁচার আকুতি
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ফসলহারা প্রত্যন্ত গ্রাম গুলোতে ঈদের আনন্দ নেই। পরপর কয়েক বছর শিলাবৃষ্টি, অতিবর্ষন আর গেল চৈত্র মাসের বন্যার কারনে বছরে একটি মাত্র বোরো ফসল ঘরে তুলতে না পারার ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের ঈদরে আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। পবিত্র রোজায় চরম কষ্টে দিনযাপন করে কোন রকম সংসার চালাতে তাদের কন্ঠে কেবলই শুধু বাঁচার আকুতি। সারা বছর পরিশ্রম করে গোলাঘরে ধান ভর্তি করে প্রতিবছর যারা ঈদের আনন্দে মেতে ওঠতেন, চলতি বছর ফসল ডুবির কারণে তাদের ঘরে অন্যান্য বছরের মতো এবার ঈদের আনন্দ নেই। অনেকেই ছেলে মেয়ে ও পরিবার পরিজনকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারছেন না। জামালগঞ্জের বৃহত্তর ফসলী এলাকা পাকনা হাওরের ফেনারবাঁক গ্রামের বাসিন্দা তিন সন্তানের জননী স্বাধীনা বেগম বলেন, বানে (বন্যায়) আমরার ঈদের খুশি নিছেগা, ধনীরাই কোন ধান পায়নাই আমরার গরীবেরতো কিচ্ছুই নাই। ঘরে কোন খাওন নাই, সরকারী কোন সাহায্যেও পাইনাই আমার ছোট-ছোট অবুঝ দুধের বাচ্চা কাচ্চা নিয়া ঊনা-উফাসে চলতাছি। ঈদ কি জিনিষ আমরার মনে নাই, জীবন বাঁনোই দায়। রোপাবালী গ্রামের স্মামী হারা ৫৫ উর্দ্ধ বয়সের রংমালা বেগম বড় আক্ষেপ করে বলেন, তার স্মামী মারা যাবার পর চরম দুর্দীনে কাটছে তার সংসার জীবন। আয় রোজগারের কোন মানুষ নেই, অন্যের ঘরে কাজ করে জীবন চলছে, সরকারী কোন সাহায্য কখনো তিনি পাননি। অভাবের কারণে তার দুই কন্যা সন্তান মেয়ের বাড়িতে রেখেছেন, ঈদের আনন্দ বলতে তাঁর কাছে কিছুই নাই বলেই চোখ মুচতে লাগলেন। উদয়পুর গ্রামের রেজুয়ান আহমদ বলেন, রোজাই রাখতাছি খুব কষ্টে আর এই বছর আমরার ঈদের খুশি নাই। আমরার ফসলতো গেছেই জৈষ্ঠ্য মাইয়া বানে গেরামের ৪৫ টা গরু মইরা আমরার এখন গোয়াল শূন্য হইছি। সরকারে যে সাহায্য দিছে আমরার গেরামে মাত্র কয়েকজনে পাইলেও বেশীর ভাগ মানুষ এখনো পায়নি। কত কষ্টে আমরা আছি ঈদ নামের একটা দিন আছে, হাসি খুশি করমু মুখে হাসিও আয় না। ঘরে গিয়রা ছোট ভাই বোনদের মুখের দিকে চাইলে ছোকে পানি আয়। কেউরে তো নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে পারছিনা। কেউর ঘরে ধান-চাল নাই আমরার গেরামে ঈদের আনন্দ নাই। রাজাপুর গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, আমরার এইবার ঈদ নাই গো, ফসল তলাইয়া যাওয়ায় কোন ধান পাইনাই। কোন রকম খাইয়া-না খাইয়া বাঁইচা আছি। বাচ্ছা-কাচ্ছারে নয়া কাপড় কিন্না দিতে পারিনাই, লেখাপড়া করাইতে সমস্যা দেখা দিছে। কিযে করি এই চিন্তায় বালা লাগেনা, আমরার কিয়ের ঈদ। অমরার খবর কে লয়। আমরা শুধু এহন বাঁচতে চাই। পাকনা হাওর ও হালির হাওরের বেশ ক’জন কৃষক ও জেলেরা এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা যদি এহন হাওররে মাছ ধরতে পারতাম তা হইলে কুনো মতে জীবন বাঁচত। বিলের (জলমহালের) ইজারাদাররার কারনে গরীবরা মাছও ধরতে পারিনা। কই যাই, কি করি, এই চিন্তায় ভালা লাগেনা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দিগন্ত বিস্তৃর্ণ যে জলা ভুমি রয়েছে, বছরের ছয় মাস সেখানে জলের রাজত্ব আর ছয় মাস ফসলের আনন্দ। এখানকার হিজল-করচ বাগে বসে অতিথি পাখির মেলা। পাহাড় ঘেড়া আর হাওর বেষ্টিত এই জনপদের নাম সুনামগঞ্জ। দেশের আট-দশটা জনপদের থেকে একে বারেই ভিন্ন। বাংলাদেশের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের অনেকাংশই আসে এই অবহেলিত সুনামগঞ্জের হাওর থেকে। প্রবাদে আছে, বালু-পাথর, মাছ-ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ। এখানকার হাওরের প্রাণী, উদ্ভিদের বন ও মৎস্য সম্পদ পরিবেশগত ভারস্যাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অবদান রাখছে। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রায় ২০ লাখ সুবিধা বঞ্চিত-নিপীড়িত জনগোষ্টির কান্না আজো কেউ শোনেনা। সীমাহীন বৈষম্য আর উন্নয়ন বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষগুলো ডুবে আছে অন্ধকারে। চরম অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার এ অঞ্চলের মানুষের প্রাকৃতিক দুর্যোগই হচ্ছে জীবন সঙ্গী। এর মধ্যে পাল্লা দিয়ে মোকাবেলা করতে হচ্ছে জোতদার ইজারাদারদের শাসন। রক্ত চক্ষু আর অন্যায় ভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে নিরিহ মানুষজন। এ ভাবেই সংকটের পর সংকটে চিরকাল দিনাতিপাত করছেন তারা। বছরের একটি সময় এ অঞ্চলের মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। তাদের হাতে কোন কাজ থাকে না, ফলে দেখা দেয় চরম খাদ্য সংকট। উন্নয়ন, শিক্ষা আর প্রযুক্তির আলো থেকে আজো তারা অনেক দূরে। বিশাল হাওরাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষেরা এ ভাবেই যুগের পর যুগ মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক আর অবহেলায়। ফসলহারা হাওরবাসীর কন্ঠে কেবলই শুধু বাঁচার আকুতি।
No comments