কত হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন?
উচ্চ
আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে নেয়া সংক্রান্ত
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে
রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানি গতকাল পঞ্চম দিনের মতো শেষ হয়েছে। শুনানিতে
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই।
আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট একজন
বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন। তবে, অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যে
বিস্ময় ও উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে
তিনি বলেন, এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও প্রেসিডেন্ট একজন বিচারপতিকে সরিয়ে
দেবেন? কত হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কি মনে করছেন?
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারকের বেঞ্চে গতকাল এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। মাঝখানে ৩০ মিনিট বিরতিতে যান আদালত। পরে সাড়ে ১১টায় আবারো শুনানি শুরু হয়ে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানি হয়। গতকাল রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও রিট আবেদনকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ উপস্থিত ছিলেন। আজ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
গতকালের শুনানিতে সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমেরিকার সংবিধান কতবার টাচ হয়েছে জানেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ তখনই অকার্যকর হয়ে পড়বে যখন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু দেশ এখনো সে পর্যায়ে নেই। তিনি বলেন, আমেরিকাতে মূল সংবিধান পরিবর্তন করা হয়নি। সংযুক্ত হয়েছে। আমাদেরও দোষ আছে। আমরা মূল সংবিধান সংশোধন করেছি। তা না করে সংযুক্ত করা যেতো। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ বলতে পারে না যে মূল সংবিধানের এই ব্যবস্থা ঠিক না। শুধুমাত্র সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারে। তিনি বলেন, এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ে কিছু কিছু মন্তব্য রুঢ় হয়ে গেছে। আশা করি এগুলো বাদ দেবেন। এ সময় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, আমরা সব সময় সংবিধান বাঁচিয়ে রেখেই রায় দেই। প্রত্যেকটি বাক্য, সেমিকলন আলোচনা করেই রায় দেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সংবিধান মাথায় রেখেই রায় দেবো। আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করে রায় দিতে হয়। মানবাধিকার, সংবিধান, আইনের শাসন এসব কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। আমরা বিচারকরা চিন্তাভাবনা করি, যাতে রাষ্ট্রের কাজের ব্যাঘাত না ঘটে। তিনি বলেন, আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে যা বলি তা বিচার বিভাগের জন্যই বলি। আইনমন্ত্রী বলে থাকেন যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচারকদের বেতন বেড়েছে। বেতন বাড়লেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যায়?
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তো মার্শাল ল’ (সামরিক আইন) জারির মাধ্যমে হয়েছে। তাই, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, ১৯৭২-এর মূল চেতনায় ফিরে যেতেই সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে। দেশের স্বার্থেই ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। ৭ অনুচ্ছেদের চেতনা পুনর্বহালের জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাছাড়া, বিষয়টি এমন না যে, সংসদ সদস্যরা হাত তুললেই বিচারপতি অপসারিত হয়ে যাবেন। এ বিষয়ে আইনে পুরো প্রক্রিয়া বলা আছে। সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আপনারা মার্শাল ল’ এর কথা বলছেন। মার্শাল ল’ এর ১৯৮২ সালের আইন, এখন ২০১৭-এখনো ওই আইনটা রয়ে গেছে। পরিবর্তন করেননি। প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের ল’ জুডিশিয়ারি কখনোই মার্শাল ল’ সমর্থন করেনি। সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে ফেলতে একমাত্র বিচার বিভাগ ভূমিকা রেখেছে। এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, অতীতে একজন প্রধান বিচারপতিও শপথ ভঙ্গ করে চিফ ল’ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন (প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক) হয়েছিলেন। সংবিধান স্থগিত করেছিলেন। ভবিষ্যতেও যে আরো একজন হবেন না এর নিশ্চয়তা নেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, ওই সময় তো অনেক কিছু হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এ আইন ক’দিন পরই তো সংশোধন হতে পারে। তাছাড়া এ মামলা (১৬তম সংশোধনী) বিচারাধীন থাকাবস্থায় আপনারা তাড়াহুড়ো করে আইনের খসড়া করেছেন। প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে আইন না করার জন্য বললেন। কিন্তু তা মানলেন না। এখানে তাড়াহুড়োর কি ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তো সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আর্থ সামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২-এর চিন্তা-চেতনা থেকে ২০১৭ সালের চিন্তা-চেতনার অনেক পার্থক্য থাকবে। পেছনে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানও পরিবর্তন হবে। এটা ব্যালান্স করতে হবে।
শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এর একটি ইতিহাস আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের (সংসদ সদস্য) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না- তার নিশ্চয়তা কোথায়? সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। আপনারা নিজ দলের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না কেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের রিট করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তাদের রিট করার এখতিয়ার নেই। ?এ সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, এ যুক্তি ঠিক নয়। যারা এসেছেন তারা এ বারেরই (আইনজীবী সমিতি) সদস্য। বিচার বিভাগে মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তারা এটা করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, তারা এই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তারা সচেতন নাগরিক। তাদের রিট করার এখতিয়ার আছে। এ সময় তিনি ভারতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সেখানকার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
শুনানির শেষ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি সংসদ সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকার কথা বলেছেন। এই বক্তব্য সত্য না হলে তাকে অপসারণের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো উচিত। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন না থাকলেও কি প্রেসিডেন্ট একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই। আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যে বিস্ময় ও উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কত হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কি মনে করছেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা আমার অভিমত। আপনারা বিষয়টি রায়ে বলে দিতে পারেন। এরপরই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্য বিচারকরা এজলাস ত্যাগ করেন।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। পরে ২২শে সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ই মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা ও মতামত দেয়ার জন্য গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন সিনিয়র আইনজীবীর (অ্যামিকাস কিউরি) নাম ঘোষণা করা হয়। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শুনানিতে যারা অংশ নেবেন তারা হলেন-টিএইচ খান, এম আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, এম আই ফারুকী, এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল ও শফিক আহমেদ। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে জমা দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারকের বেঞ্চে গতকাল এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। মাঝখানে ৩০ মিনিট বিরতিতে যান আদালত। পরে সাড়ে ১১টায় আবারো শুনানি শুরু হয়ে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত শুনানি হয়। গতকাল রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও রিট আবেদনকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ উপস্থিত ছিলেন। আজ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
গতকালের শুনানিতে সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমেরিকার সংবিধান কতবার টাচ হয়েছে জানেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ তখনই অকার্যকর হয়ে পড়বে যখন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু দেশ এখনো সে পর্যায়ে নেই। তিনি বলেন, আমেরিকাতে মূল সংবিধান পরিবর্তন করা হয়নি। সংযুক্ত হয়েছে। আমাদেরও দোষ আছে। আমরা মূল সংবিধান সংশোধন করেছি। তা না করে সংযুক্ত করা যেতো। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ বলতে পারে না যে মূল সংবিধানের এই ব্যবস্থা ঠিক না। শুধুমাত্র সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারে। তিনি বলেন, এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ে কিছু কিছু মন্তব্য রুঢ় হয়ে গেছে। আশা করি এগুলো বাদ দেবেন। এ সময় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, আমরা সব সময় সংবিধান বাঁচিয়ে রেখেই রায় দেই। প্রত্যেকটি বাক্য, সেমিকলন আলোচনা করেই রায় দেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সংবিধান মাথায় রেখেই রায় দেবো। আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করে রায় দিতে হয়। মানবাধিকার, সংবিধান, আইনের শাসন এসব কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। আমরা বিচারকরা চিন্তাভাবনা করি, যাতে রাষ্ট্রের কাজের ব্যাঘাত না ঘটে। তিনি বলেন, আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে যা বলি তা বিচার বিভাগের জন্যই বলি। আইনমন্ত্রী বলে থাকেন যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচারকদের বেতন বেড়েছে। বেতন বাড়লেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যায়?
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তো মার্শাল ল’ (সামরিক আইন) জারির মাধ্যমে হয়েছে। তাই, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, ১৯৭২-এর মূল চেতনায় ফিরে যেতেই সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে। দেশের স্বার্থেই ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। ৭ অনুচ্ছেদের চেতনা পুনর্বহালের জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাছাড়া, বিষয়টি এমন না যে, সংসদ সদস্যরা হাত তুললেই বিচারপতি অপসারিত হয়ে যাবেন। এ বিষয়ে আইনে পুরো প্রক্রিয়া বলা আছে। সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আপনারা মার্শাল ল’ এর কথা বলছেন। মার্শাল ল’ এর ১৯৮২ সালের আইন, এখন ২০১৭-এখনো ওই আইনটা রয়ে গেছে। পরিবর্তন করেননি। প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের ল’ জুডিশিয়ারি কখনোই মার্শাল ল’ সমর্থন করেনি। সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে ফেলতে একমাত্র বিচার বিভাগ ভূমিকা রেখেছে। এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, অতীতে একজন প্রধান বিচারপতিও শপথ ভঙ্গ করে চিফ ল’ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন (প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক) হয়েছিলেন। সংবিধান স্থগিত করেছিলেন। ভবিষ্যতেও যে আরো একজন হবেন না এর নিশ্চয়তা নেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, ওই সময় তো অনেক কিছু হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এ আইন ক’দিন পরই তো সংশোধন হতে পারে। তাছাড়া এ মামলা (১৬তম সংশোধনী) বিচারাধীন থাকাবস্থায় আপনারা তাড়াহুড়ো করে আইনের খসড়া করেছেন। প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে আইন না করার জন্য বললেন। কিন্তু তা মানলেন না। এখানে তাড়াহুড়োর কি ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তো সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আর্থ সামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২-এর চিন্তা-চেতনা থেকে ২০১৭ সালের চিন্তা-চেতনার অনেক পার্থক্য থাকবে। পেছনে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানও পরিবর্তন হবে। এটা ব্যালান্স করতে হবে।
শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এর একটি ইতিহাস আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের (সংসদ সদস্য) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না- তার নিশ্চয়তা কোথায়? সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। আপনারা নিজ দলের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না কেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের রিট করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তাদের রিট করার এখতিয়ার নেই। ?এ সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, এ যুক্তি ঠিক নয়। যারা এসেছেন তারা এ বারেরই (আইনজীবী সমিতি) সদস্য। বিচার বিভাগে মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তারা এটা করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, তারা এই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তারা সচেতন নাগরিক। তাদের রিট করার এখতিয়ার আছে। এ সময় তিনি ভারতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সেখানকার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
শুনানির শেষ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি সংসদ সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকার কথা বলেছেন। এই বক্তব্য সত্য না হলে তাকে অপসারণের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো উচিত। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন না থাকলেও কি প্রেসিডেন্ট একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই। আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যে বিস্ময় ও উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কত হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কি মনে করছেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা আমার অভিমত। আপনারা বিষয়টি রায়ে বলে দিতে পারেন। এরপরই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্য বিচারকরা এজলাস ত্যাগ করেন।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। পরে ২২শে সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ই মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা ও মতামত দেয়ার জন্য গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন সিনিয়র আইনজীবীর (অ্যামিকাস কিউরি) নাম ঘোষণা করা হয়। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শুনানিতে যারা অংশ নেবেন তারা হলেন-টিএইচ খান, এম আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, এম আই ফারুকী, এ জে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল ও শফিক আহমেদ। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া ও এম আই ফারুকী তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে জমা দিয়েছেন।
No comments