প্রবৃদ্ধি বিতর্ক ও বিনিয়োগ স্থবিরতা
মিথ্যা তিন ধরনের : সাধারণ মিথ্যা, নির্জলা মিথ্যা ও পরিসংখ্যান। তবে পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা না রেখে পথ চলা দায়। ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্নজাল বুনতে দরকার হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত। আমাদের পুথিশাস্ত্রেও উঠে এসেছে পরিসংখ্যান বিভ্রান্তির বিষয়। উল্লেখ আছে, লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, গুনিয়া দেখে মর্দ ৩২ হাজার। তবে এই জনপদে পরিসংখ্যান শাস্ত্র চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। ২ হাজার বছরেরও আগে, বিশেষ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে সরকারি কার্যক্রমে পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বলছে, বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দেও জৈব পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহ করা হতো। মোগল আমলেও বাংলায় পরিসংখ্যান কাজে লাগাত নীতিনির্ধারকরা। ব্রিটিশ শাসকরাও নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ চালাত। আর স্বাধীনতার পর সীমিত সম্পদ এবং সীমাহীন চাহিদার প্রেক্ষাপটে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতিষ্ঠা করে সরকার। সেই থেকে অদ্যাবধি আমাদের পরিসংখ্যানের একমাত্র ভরসাস্থল বিবিএস।
তবে সরকারি এ সংস্থার প্রতিবেদন নিয়ে নানা সময়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। দেশের গণ্ডিতে অর্থনীতিবিদ আর গবেষকরা প্রশ্ন তুললেও অনেক সময় উন্নয়ন সহযোগীরাও এতে যোগ দেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেখা দেয় সরকার এবং বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭.২৪ শতাংশ। এর পক্ষে বাখ্যাও তুলে ধরেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। কৃষি খাতে ৩ দশমিক ৪ ভাগ, শিল্প খাতে ১০ দশমিক ৫ ভাগ এবং সেবা খাতে ৬ দশমিক ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি হবে। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২৪৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৭ দশমিক ২৬ ভাগ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ ভাগে উন্নীত হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাবটা একটু অন্যরকম। সংস্থাটির লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বিনিয়োগ-ব্যয় হিসাব করে দেখিয়েছেন কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে সংশয় আছে। বিবিএসের সাময়িক হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, সরকারের বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। মূল বাজেটে মূলধন ব্যয় বরাদ্দ আছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার মতো। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঋণ বাদ দিলে এবং সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ব্যয় যোগ করলে সরকারের মূলধন ব্যয় দাঁড়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এখানে পার্থক্য ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক ৮ শতাংশের মতো। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মতে, সরকারের বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান এসেছে, তা শুধু চলতি অর্থবছরে এডিপির ব্যয় নয়।
এর সঙ্গে আগের অর্থবছরের বাস্তবায়ন না হওয়া অনুমোদনহীন প্রকল্পের ব্যয়ও রয়েছে। একটি দেশের জিডিপি বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের ভেতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য। একে উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে পণ্য ও সেবার ওপর সংযোজিত মূল্যের সমষ্টি হিসেবেও দেখা হয়। জিডিপি পরিমাপ ও বোঝার সবচেয়ে সাধারণ উপায় হচ্ছে ব্যয় পদ্ধতি : ভোগ, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয়, আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে রফতানি আয়ের যোগফল। জিডিপি হল এক বছরের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত দর্পণ। এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার নানা ধরনের চলক দ্বারা প্রভাবিত, যেমন- দেশীয় উৎপাদন, জলবায়ু, দেশের অস্থিতিশীলতা, দেশ-বিদেশের চাহিদা। আমাদের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি রফতানি খাতের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রফতানি বেড়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। অন্যদিকে রেমিটেন্স কমেছে ১৬ শতাংশ। আর বেসরকারি বিনিয়োগ খুব চাঙ্গা হয়েছে তা-ও বলা যাবে না। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। গত অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। মূলত সরকারি বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশি অবদান রেখেছে। পরিসংখ্যান বলছে, মূলত সরকারি বিনিয়োগের ওপরই ভরসা করে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশের সমান।
চলতি মূল্যে এর পরিমাণ ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। বিনিয়োগের হিসাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তার মতে, ক্রমবর্ধমান মূলধন-উৎপাদন অনুপাত বাংলাদেশে এখনও সাড়ে ৪ শতাংশের নিচে নয়। তাহলে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ হওয়া উচিত জিডিপির সাড়ে ৩২ শতাংশের বেশি। বাস্তবে তা হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগেও মন্দা অবস্থা চলছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজেদের আয়-উপার্জন। মানুষের প্রত্যাশা- বাজারের স্থিতিশীলতা, সহায়ক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর নিরূপদ্রব জীবনযাত্রার জন্য সুলভে সেবাপ্রাপ্তি। এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। অর্থনীতি যদি চাঙ্গা থাকে অর্থাৎ জাতীয় প্রবৃদ্ধি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে চাকরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজের সুযোগ বাড়বে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি আসে উৎসের ওপর ভর করে। বিনিয়োগ আর উৎপাদনশীলতা তার দুই চাকা। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে। তাই প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও হিসাব কাঠামো নিয়ে সাধারণের আগ্রহ নেই। প্রবৃদ্ধির ফলে দেশে দারিদ্র্য কমছে। ২০০০ সালের ৫০ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আবার সরকারি খানা আয় জরিপ থেকে দেখা যায়, এ সময়কালে আয়-বৈষম্য পরিস্থিতির তেমন অবনতি হয়নি। যদিও সাদাচোখেই অল্প মানুষের হাতে অনেক বেশি সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার হয়। সেজন্যই বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির ফল সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না। তবে আয়-বৈষম্যের চেয়েও এখন বড় হয়ে উঠছে অর্থনৈতিক সুযোগের বৈষম্য। চলতি অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৬০২ ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। জিডিপিতে ৭ শতাংশের প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। সরকারি বিনিয়োগের দক্ষতা,
শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ এবং উৎপাদনে সম্পদের ব্যবহার বাড়ানো গেলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে জিডিপিতে বাড়তি ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যুক্ত করা সম্ভব। এর মধ্যে শুধু উৎপাদনশীলতার দক্ষতা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১.৫ শতাংশ এবং শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়ে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক পরিবেশ জরুরি। বাংলাদেশের জায়ান্ট বাণিজ্যিক গ্রুপগুলো এখন বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ চাচ্ছে। অর্থাৎ তাদের কাছে লগ্নি করা অর্থের সংকট নেই। পণ্য বৈচিত্র্যকরণে তাদের বিনিয়োগ ধরে রাখতে এখনই উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আগের পূর্বাভাস থেকে সরে এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩.৪ শতাংশ। আর ২০১৭ সালে প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৩.৬ শতাংশ। এর আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে সংস্থাটি ২০১৬ সালে ৩.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে এখনও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com
No comments