এই সমঝোতা অভিনন্দনযোগ্য, কিন্তু একটি বিষয়ে সতর্ক থাকাও প্রয়োজন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তার বিশাল সফরসঙ্গীসহ দিল্লিতে পৌঁছেছেন এবং অভূতপূর্ব সংবর্ধনা লাভ করেছেন, এটা এখন পুরনো খবর। দিল্লি বিমানবন্দরে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসার কথা ছিল না। কিন্তু তিনিও একটি চমৎকার ফুল নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন। এটা ঢাকা এবং দিল্লি দুই রাজধানীতেই চমক সৃষ্টি করেছে। কেউ বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে এটা মোদির আন্তরিকতা ও আগ্রহের প্রমাণ। কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সব অমীমাংসিত বিবাদ মীমাংসার এটা একটা শুভ সূচনা। এই ঘটনায় হাসিনা সরকারের শুভাকাক্সক্ষীরা আনন্দে হিল্লোলিত। সমালোচকরা এখন অনেকটা নিশ্চুপ। তারা হয়তো আশা করেছিলেন, মমতা ব্যানার্জি দিল্লিতে যাবেন না। ঢাকার ওপর দিল্লি কোনো ধরনের সামরিক চুক্তি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। সমালোচক এবং নিন্দুকরা ভারতবিরোধী একটা ঝড়ো হাওয়া বহানোর সুযোগ পাবেন। এখন পর্যন্ত দিল্লিতে যা ঘটেছে, তাতে এই সমালোচকরা রসনা অসংযত করার সুযোগ পাননি। আদৌ পাবেন কিনা তা শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন এবং সম্পাদিত চুক্তিগুলোর বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পরই জানা যাবে।
তিস্তা চুক্তি এই বৈঠকে না হলেও সমালোচকরা হাসিনা সরকারকে এখনই দায়ী করতে পারবে না। কারণ, এই বৈঠকেই তিস্তা চুক্তি হবে এমন কোনো কথা বাংলাদেশ অথবা ভারত কোনো পক্ষ থেকেই বলা হয়নি। বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এই চুক্তি সম্পাদনের ব্যবস্থা করা হবে। মমতা ব্যানার্জির রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে দিল্লি গমনে সম্মতি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও তিস্তা চুক্তি সম্পাদন সম্পর্কে প্রকাশ্যে আশাবাদ প্রকাশ এই সম্ভাবনাই সূচিত করে যে, তিস্তার পানি নিয়ে এই দিল্লি বৈঠকেই ফাইনাল চুক্তি হবে না; তবে একটা সমঝোতা হয়তো হবে। তা-ও যদি হয়, তাহলে গঙ্গার পানি চুক্তির মতো আরেকটি সাফল্যজনক চুক্তির পথ সুগম করার একটা বড় কৃতিত্ব হাসিনা সরকার অর্জন করবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি শুধু তিস্তার পানি নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত অন্যান্য নদ-নদীর পানিবণ্টন সম্পর্কেও দুই দেশের সমঝোতা সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যদিও মমতা ব্যানার্জি পানি চুক্তি সম্পর্কে দিয়েছেন বিকল্প প্রস্তাব। তিস্তা সমস্যার পরই আসে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সামরিক চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি। প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ঢাকা-দিল্লি কোনো সামরিক চুক্তি হয়নি। তবে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে ভারত ৫০ কোটি ডলারের ঋণদান সাপেক্ষে সমরাস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ অস্ত্র কিনতে পারে প্রধানত ভারত, রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে। রাশিয়ার কাছ থেকে মিগজেট এবং চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে সে অন্য দেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনার অধিকার হারায়নি। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমঝোতায় সামরিক তথ্য বিনিময় এবং ভারতীয় অস্ত্র কেনার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু অন্য দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ অস্ত্র কিনতে পারবে না এরূপ কোনো শর্ত আছে বলে জানা যায়নি।
শর্ত থাকার কথাও নয়। দুই দেশের যুক্ত ইশতেহারটি পাঠ করলে বোঝা যায়, যেসব এজেন্ডা নিয়ে দিল্লি বৈঠক ডাকা হয়েছিল তা অনেকটাই সফল হয়েছে। সমালোচকরা বলতে পারেন, তিস্তা নদীর সমস্যাটি অমীমাংসিত রয়েছে। দিল্লিতে এসেও এ ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি নমনীয় হননি। বরং তার বিকল্প প্রস্তাবে অন্য কোনো নদ-নদী থেকে বাংলাদেশকে পানি দিয়ে ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ হবে না। এ প্রসঙ্গে আবারও একটি কথাই বলা যায়, তিস্তা সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জির এ কথাই শেষ কথা নয়। বর্তমান দিল্লি বৈঠকে এ সম্পর্কে চুক্তি হওয়ার কথাও বলা হয়নি। সুতরাং পরবর্তী ধাপে কোনো বৈঠকে সমস্যার একটা সুরাহা হবে এটা আশা করা যায়। তিস্তা সমস্যা সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও বলেছেন, ‘হাসিনা সরকার ও আমার সরকার মিলেই এ সমস্যার সমাধান করবে। আমরাই তা পারব।’ বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন সম্পর্কে অতীতেও ভারতের মনমোহন সরকার (কংগ্রেস) আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখিয়েছে। প্রতিবেশী কয়েকটি ভারতীয় রাজ্য সরকারও দেখিয়েছে। বর্তমানের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারও দেখাচ্ছে। হাসিনা সরকার অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে এই সমস্যাটি সমাধানের পথে এগোচ্ছে। গঙ্গার পানি চুক্তির মতো এই চুক্তিতেও তিনি সফল হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। যুদ্ধ করে পানি সমস্যার সমাধান করা যায় না। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত সমালোচকরা বলতে পারেন, তিস্তা চুক্তি ছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত আর সব চুক্তির কোনো মূল্য নেই। এটা ঠিক নয়। চুক্তি বড় কথা নয়, সম্পর্ক বড় কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন জার্মানির হিটলারের সঙ্গে মিউনিখ চুক্তি করেছিলেন ইউরোপে অন্তত ২০ বছরের জন্য যুদ্ধাশঙ্কা দূর করার জন্য, সেই চুক্তি দু’বছরও টেকেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। ব্রিটেন ও জার্মানির মধ্যে শুধু কাগুজে চুক্তি হয়েছিল। সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই চুক্তি টেকেনি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো চুক্তি কার্যকর হবে না,
যদি সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। দু’দেশের মধ্যে ছিটমহল চুক্তি তো হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তা বাস্তবায়িত হল দীর্ঘকাল পর বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে। কারণ, বর্তমানে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। বর্তমানের চুক্তিগুলোর মূল্য এখানেই যে, এই চুক্তি দু’দেশের সম্পর্ক ধাপে ধাপে উন্নত করছে। এই উন্নত সম্পর্কই অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তির পথ সুগম করবে। তাইওয়ান ও ফরমোজা সমস্যার সমাধান ছাড়াই কি এক সময় নয়াচীন আমেরিকার সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়নি এবং তার দ্বারা উপকৃত হয়নি? পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় মোদি সরকার তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে। কিন্তু তাতে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টি হবে এবং সমস্যাটিরও স্থায়ী সমাধান হবে না। গঙ্গার পানি চুক্তির সময়েও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের তখনকার রাজ্য সরকারের সম্মতি গ্রহণ করেছিল। বলতে গেলে তখন রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুই বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। হাসিনা-জ্যোতিবসু সম্পর্কটি ছিল এক্সেলেন্ট। এ সম্পর্কটি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কল্যাণে তা এখন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, তা অদূর ভবিষ্যতে সফল হবে। সমালোচকরা অবশ্যই আবদার জানাতে পারেন; কিন্তু সম্পর্কোন্নয়নের কোনো টাইম ফ্রেম আগাম নির্ধারণ করা যায় না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়ন সম্পর্কে ‘কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে’ আমি রাজি নই। এটা হাসিনা সরকারের সমালোচকরা করতে থাকুক। আমি আশা করব, দু’দেশের মধ্যে বহু বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে দু’পক্ষেরই দোষে ঝুলে থাকায় জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। রাতারাতি তার সমাধান সম্ভব নয়। দু’পক্ষের মধ্যে আন্তরিকতা থাকলে সমস্যার জটগুলো ধীরে ধীরে খুলবে। দিল্লি বৈঠকে সেই জট সম্পূর্ণ খোলেনি। কিন্তু তা খোলার পথ প্রশস্ত করেছে। এখানেই দিল্লি বৈঠকের সাফল্য। তবু এ সম্পর্কে আমার শেষ কথার এক কথা, সব সম্পর্ক ও সহযোগিতার মধ্যেই একটা সতর্কতা থাকা ভালো। ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমঝোতা এবং সহযোগিতা ভালো। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেন চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কোন্নয়নের পথে বাধা না হয়। চীনও আমাদের বড় প্রতিবেশী এবং বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাটভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে দেশটি। এই সহযোগিতার প্রসারিত হাতকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
এই প্রতিরক্ষা সমঝোতার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত দ্বিধার সঙ্গে উল্লেখ করছি। ইসরাইলের সঙ্গে এখন ভারতের মোদি সরকারের রমরমা সম্পর্ক। নেহেরু সরকার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি। কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাও করেনি। এটা বিজেপি সরকার করেছে। তাতে কারও আপত্তি করার সুযোগ নেই। এটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। আমার কথা, ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের যে নিবিড় সামরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার সূত্র ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমঝোতার সুযোগে সামরিক তথ্য বিনিময় ও অন্যান্য ব্যাপারে ইসরাইলের মোসাদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুণœ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারসাম্যের রাজনীতিতে অত্যন্ত দক্ষ। সে জন্য আমার আশা হয়, এই নাজুক সমস্যাটিও তিনি সাফল্যের সঙ্গে পার হতে পারবেন। এই সেদিন মাত্র তিনি ঢাকায় আগত প্যালেস্টাইনের প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাৎদান করেছেন এবং তাদের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নত হোক। কিন্তু সেই সুযোগে ইসরাইলের মোসাদ যাতে আমাদের রাজনীতিতে নাক গলানোর (সৌদি আরবে তারা তা করেছে) সুযোগ না পায় সেদিকে হাসিনা সরকার কঠোর দৃষ্টি রাখবে, এটা আমার একান্ত আশা।
লন্ডন ৯ এপ্রিল, রবিবার, ২০১৭
লন্ডন ৯ এপ্রিল, রবিবার, ২০১৭
No comments