মার্চেই ঘটে পাকিস্তানের পরাজয় by সৈয়দ আবুল মকসুদ
স্বাধীনতার
আকাঙ্ক্ষা সব জনগোষ্ঠীরই সহজাত। একটি স্বাধীন সার্বভৌম বহুজাতিক
রাষ্ট্রের সব প্রদেশ বা প্রতিটি অংশই স্বাধীন। তাহলে একটি স্বাধীন
রাষ্ট্রের ভেতরের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে নতুন করে স্বাধীন করার জন্য
সেখানকার জনগণ চঞ্চল হয়ে ওঠে কেন? একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যখন দেখে তাদের
ন্যায়সংগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি অধিকার রাষ্ট্র হরণ
করছে এবং তারা হচ্ছে নির্মম অবিচার ও নিপীড়নের শিকার, তখন তাদের স্বশাসিত
বা স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। উনিশ শ একাত্তর
খ্রিষ্টীয় অব্দের মার্চ মাসের প্রথম দিনই বাংলাদেশে তেমনটির প্রকাশ ঘটেছিল।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ছিল বহু কালের, তার বহিঃপ্রকাশ বা
বিস্ফোরণ ঘটে একাত্তরের মার্চে।
কোনো রাষ্ট্রের কোনো একটি অংশের মানুষ স্বাধীনতা চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেয়—এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। অন্যদিকে রাষ্ট্রের কোনো একটি অংশের মানুষ স্বাধীনতার দাবি তুললেই কেন্দ্রীয় সরকারের সশস্ত্র বাহিনী স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র একটি খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটি একাত্তরের বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক কালের পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র একেবারেই আলাদা।ষাটের দশকে আমরা দেখেছি পৃথিবীর বহু জাতি সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রাম করছে; তাদের কেউ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, অনেকেরই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। অগণিত প্রাণ গেছে, কিন্তু স্বাধীনতা আসেনি। কেন আসেনি, তার কারণগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ওই সব আন্দোলনে ত্রুটি ও দুর্বলতা ছিল। এবং সেগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলনের যৌক্তিকতার অভাব ছিল। আমাদের অনেক বিদ্বান ব্যক্তিরও বদ্ধমূল ধারণা যে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন খুব বেশি চালালেই এবং ব্যাপক রক্তপাত হলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি খুব সহজ হয়। এই ধারণা ভিত্তিহীন।
ষাটের দশকে নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তেলসমৃদ্ধ বায়াফ্রা প্রদেশ ‘বায়াফ্রা রিপাবলিক’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল। একাত্তরের বাংলাদেশের মতো সেখানে অবর্ণনীয় গণহত্যা হয়। দুর্ভিক্ষে মানুষ মরে। স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক কিছু সমর্থনও পায়। কিন্তু স্বাধীনতা আসে না। আজও বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার অংশ। মনে পড়ে একাত্তরে আমি রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ ভাষ্যে শুনেছি, পাকিস্তানি রাজাকার আলবদর বিশ্লেষকেরা বলছেন: পূর্ব পাকিস্তানের নিয়তি হবে বায়াফ্রার মতো। তাঁদের অনুমান ও প্রত্যাশা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
পর্তুগিজ তিমুরের জনগণ ইন্দোনেশিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উত্তাল আন্দোলন করে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অগণিত প্রাণ ঝরে পড়ে। স্বাধীনতা থাকে বহুদিনের জন্য সুদূরপরাহত। তুরস্ক, ইরান, ইরাক, গ্রিস প্রভৃতি দেশের কুর্দিরা কতকাল থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র চাইছে। তারা একটি প্রাচীন জাতি। আজও তাদের সংগ্রাম চলছে, তারা স্বাধীনতা পায়নি। বর্তমান জায়ার বা কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক থেকে কাতাঙ্গা বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। প্যাট্রিস লুমুম্বা কাতাঙ্গার বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ দিলেন। স্বাধীনতা এল না।
কানাডার ফরাসি ভাষাভাষী অঞ্চল কুইবেকের স্বাধীনতার দাবি উঠেছে। তবে সে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। কাতালান ও বাস্ক ভাষাভাষীরা স্পেনে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র চায়। ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হতে স্কটল্যান্ড গণভোট করছে। হয়তো শান্তিপূর্ণ উপায়েই একদিন স্বাধীনতা পাবে। এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বহু আছে।
কসোভো স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীনতা অত সোজা জিনিস নয়। ছেলের হাতের মোয়া তো একেবারেই নয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে, গণতান্ত্রিক উপায়ে, গায়ের জোরে নয়। বাংলাদেশও স্বাধীনতা অর্জন করে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী, তবে সীমাহীন রক্ত ও নির্যাতনের বিনিময়ে। যদি ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়ে থাকে পাকিস্তানের জন্য গণভোট, তাহলে ২৪ বছর পর আর একটি সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে; এই নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা বা স্বাধীনতার জন্য গণভোট।
১৯৭০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সামান্যতম আস্থা থাকলে ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই অধিবেশন বসিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করত। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে
আমি বহুবার ভেবে দেখেছি, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকট ১৯৭০ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই সমাধান হতে পারত কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তা ঝুলিয়ে রাখে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত।
সব সংগ্রাম ও যুদ্ধেরই দুটি দিক। একটি সামরিক ও আরেকটি নৈতিক। কোনো পক্ষ সামরিকভাবে বিজয়ী হলেও নৈতিকভাবে পরাজিত হয়। কেউ শক্তি পরীক্ষায় হেরে গেলেও নৈতিকভাবে জয়লাভ করে। পাকিস্তান একাত্তরে সামরিক ও নৈতিক দুভাবেই পরাজিত হয়। পাকিস্তান নৈতিকভাবে শেষ হয়ে যায়; তার নৈতিক পরাজয় ঘটে ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১ মিনিটে। তার সামরিক পরাজয় ঘটে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের চত্বরে। ওই পরাজয়ের গ্লানি থেকে সে বাঁচতে পারত যদি ২৫ মার্চের মধ্যে কোনো একদিন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে গিয়ে উড়োজাহাজে উঠে ইয়াহিয়া খান ইসলামাবাদ চলে যেতেন। সে পরামর্শই টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষের বুড়ো সারা মার্চ মাস ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন: মাউন্টব্যাটেন যেমন জিন্নাহ-নেহরুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, সেভাবে আপনিও মুজিবের হাতে ক্ষমতা দিয়ে হ্যান্ডশেক করে চলে যান। তা না করলে বাংলাদেশের মানুষ যা করার তা-ই করবে।
সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একজন অবিচল গণতান্ত্রিক নেতার মতো অতি সংযত আচরণ করেছেন। তাঁর ওই তিন মাসের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক। অন্যদিকে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার প্রতিটি কাজ ছিল অগণতান্ত্রিক ও ষড়যন্ত্রমূলক। একাত্তরে বাংলাদেশে মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটির মতো। তাদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ও ভোটার ছিলেন এবং যাঁদের সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদের দেড় কোটির মতো মানুষ এখনো বেঁচে আছেন। আমি তাঁদের একজন। কী রকম ছিল সেই একাত্তরের মার্চ, তা এখন যাদের বয়স ষাটের নিচে, তাদের বোঝাতে পারব না।
একাত্তরের পয়লা মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন হোটেল পূর্বাণীতে তাঁর দলের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করছিলেন, তখনই ইয়াহিয়া খান রেডিওতে পাকিস্তানের মৃত্যুপরোয়ানা পাঠ করেন। আমি কী এক কাজে বা বিনা প্রয়োজনেই সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল পত্রিকার অফিসে বসে ছিলাম। রাস্তায় শোরগোল শুনতে পেয়ে বেরিয়ে শিল্প ভবনের গোলচত্বরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তখন এত সংবাদপত্রও ছিল না, টিভি চ্যানেল শব্দটাই কেউ শোনেনি, এত সাংবাদিকও ছিলেন না। হাঁটতে হাঁটতে বিমান অফিসের সামনে যাই। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের অল্প কিছু বক্তব্য দিয়ে ‘অপেক্ষা’ করতে বলেন। পরে তাঁর হরতাল ও অসহযোগের ঘোষণা আসে।
ইয়াহিয়ার সংসদ অধিবেশন মুলতবির ঘোষণার পর মানুষ বুঝে যায় পঞ্চনদীর দেশ পাকিস্তান তাদের নয়, তাদের ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে ঢাকার চেহারা বদলে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বাস, মোটরগাড়ি, রিকশা রাস্তা থেকে সরে যায়। মানুষ নেমে পড়ে রাস্তায়। তখন অল্প কয়েকটি বাড়িতে গ্যাস–সংযোগ ছিল। রান্নাবান্না হতো কেরোসিন ও লাকড়িতে। বিভিন্ন জায়গায় লাকড়ির দোকান ছিল। মণ দরে বিক্রি হতো। অনেক মানুষ দোকান থেকে লাকড়ি হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পাকিস্তানবিরোধী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দেয়। ওই লাকড়ি বা লাঠি ছিল সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতীকী অস্ত্র—মেশিনগান, কামানের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার।
পাকিস্তানি জান্তা শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে কোটি খানেক মানুষকে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আধুনিক অস্ত্র ও রণকৌশল শত্রুকে পরাজিত করতে অবশ্যই ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনে সবচেয়ে কঠিন ভূমিকা রেখেছে সাধারণ মানুষের ত্যাগ ও মনোবল এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
কোনো রাষ্ট্রের কোনো একটি অংশের মানুষ স্বাধীনতা চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেয়—এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। অন্যদিকে রাষ্ট্রের কোনো একটি অংশের মানুষ স্বাধীনতার দাবি তুললেই কেন্দ্রীয় সরকারের সশস্ত্র বাহিনী স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র একটি খুঁজে পাওয়া যাবে। সেটি একাত্তরের বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক কালের পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র একেবারেই আলাদা।ষাটের দশকে আমরা দেখেছি পৃথিবীর বহু জাতি সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রাম করছে; তাদের কেউ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, অনেকেরই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। অগণিত প্রাণ গেছে, কিন্তু স্বাধীনতা আসেনি। কেন আসেনি, তার কারণগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ওই সব আন্দোলনে ত্রুটি ও দুর্বলতা ছিল। এবং সেগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলনের যৌক্তিকতার অভাব ছিল। আমাদের অনেক বিদ্বান ব্যক্তিরও বদ্ধমূল ধারণা যে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন খুব বেশি চালালেই এবং ব্যাপক রক্তপাত হলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি খুব সহজ হয়। এই ধারণা ভিত্তিহীন।
ষাটের দশকে নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তেলসমৃদ্ধ বায়াফ্রা প্রদেশ ‘বায়াফ্রা রিপাবলিক’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল। একাত্তরের বাংলাদেশের মতো সেখানে অবর্ণনীয় গণহত্যা হয়। দুর্ভিক্ষে মানুষ মরে। স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক কিছু সমর্থনও পায়। কিন্তু স্বাধীনতা আসে না। আজও বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার অংশ। মনে পড়ে একাত্তরে আমি রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ ভাষ্যে শুনেছি, পাকিস্তানি রাজাকার আলবদর বিশ্লেষকেরা বলছেন: পূর্ব পাকিস্তানের নিয়তি হবে বায়াফ্রার মতো। তাঁদের অনুমান ও প্রত্যাশা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
পর্তুগিজ তিমুরের জনগণ ইন্দোনেশিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উত্তাল আন্দোলন করে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অগণিত প্রাণ ঝরে পড়ে। স্বাধীনতা থাকে বহুদিনের জন্য সুদূরপরাহত। তুরস্ক, ইরান, ইরাক, গ্রিস প্রভৃতি দেশের কুর্দিরা কতকাল থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র চাইছে। তারা একটি প্রাচীন জাতি। আজও তাদের সংগ্রাম চলছে, তারা স্বাধীনতা পায়নি। বর্তমান জায়ার বা কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক থেকে কাতাঙ্গা বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। প্যাট্রিস লুমুম্বা কাতাঙ্গার বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ দিলেন। স্বাধীনতা এল না।
কানাডার ফরাসি ভাষাভাষী অঞ্চল কুইবেকের স্বাধীনতার দাবি উঠেছে। তবে সে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। কাতালান ও বাস্ক ভাষাভাষীরা স্পেনে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র চায়। ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হতে স্কটল্যান্ড গণভোট করছে। হয়তো শান্তিপূর্ণ উপায়েই একদিন স্বাধীনতা পাবে। এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বহু আছে।
কসোভো স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীনতা অত সোজা জিনিস নয়। ছেলের হাতের মোয়া তো একেবারেই নয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে, গণতান্ত্রিক উপায়ে, গায়ের জোরে নয়। বাংলাদেশও স্বাধীনতা অর্জন করে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী, তবে সীমাহীন রক্ত ও নির্যাতনের বিনিময়ে। যদি ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়ে থাকে পাকিস্তানের জন্য গণভোট, তাহলে ২৪ বছর পর আর একটি সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে; এই নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা বা স্বাধীনতার জন্য গণভোট।
১৯৭০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে সামান্যতম আস্থা থাকলে ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই অধিবেশন বসিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করত। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে
আমি বহুবার ভেবে দেখেছি, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকট ১৯৭০ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই সমাধান হতে পারত কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তা ঝুলিয়ে রাখে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত।
সব সংগ্রাম ও যুদ্ধেরই দুটি দিক। একটি সামরিক ও আরেকটি নৈতিক। কোনো পক্ষ সামরিকভাবে বিজয়ী হলেও নৈতিকভাবে পরাজিত হয়। কেউ শক্তি পরীক্ষায় হেরে গেলেও নৈতিকভাবে জয়লাভ করে। পাকিস্তান একাত্তরে সামরিক ও নৈতিক দুভাবেই পরাজিত হয়। পাকিস্তান নৈতিকভাবে শেষ হয়ে যায়; তার নৈতিক পরাজয় ঘটে ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১ মিনিটে। তার সামরিক পরাজয় ঘটে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের চত্বরে। ওই পরাজয়ের গ্লানি থেকে সে বাঁচতে পারত যদি ২৫ মার্চের মধ্যে কোনো একদিন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে গিয়ে উড়োজাহাজে উঠে ইয়াহিয়া খান ইসলামাবাদ চলে যেতেন। সে পরামর্শই টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষের বুড়ো সারা মার্চ মাস ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন: মাউন্টব্যাটেন যেমন জিন্নাহ-নেহরুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, সেভাবে আপনিও মুজিবের হাতে ক্ষমতা দিয়ে হ্যান্ডশেক করে চলে যান। তা না করলে বাংলাদেশের মানুষ যা করার তা-ই করবে।
সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একজন অবিচল গণতান্ত্রিক নেতার মতো অতি সংযত আচরণ করেছেন। তাঁর ওই তিন মাসের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক। অন্যদিকে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার প্রতিটি কাজ ছিল অগণতান্ত্রিক ও ষড়যন্ত্রমূলক। একাত্তরে বাংলাদেশে মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটির মতো। তাদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ও ভোটার ছিলেন এবং যাঁদের সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদের দেড় কোটির মতো মানুষ এখনো বেঁচে আছেন। আমি তাঁদের একজন। কী রকম ছিল সেই একাত্তরের মার্চ, তা এখন যাদের বয়স ষাটের নিচে, তাদের বোঝাতে পারব না।
একাত্তরের পয়লা মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন হোটেল পূর্বাণীতে তাঁর দলের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করছিলেন, তখনই ইয়াহিয়া খান রেডিওতে পাকিস্তানের মৃত্যুপরোয়ানা পাঠ করেন। আমি কী এক কাজে বা বিনা প্রয়োজনেই সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল পত্রিকার অফিসে বসে ছিলাম। রাস্তায় শোরগোল শুনতে পেয়ে বেরিয়ে শিল্প ভবনের গোলচত্বরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তখন এত সংবাদপত্রও ছিল না, টিভি চ্যানেল শব্দটাই কেউ শোনেনি, এত সাংবাদিকও ছিলেন না। হাঁটতে হাঁটতে বিমান অফিসের সামনে যাই। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের অল্প কিছু বক্তব্য দিয়ে ‘অপেক্ষা’ করতে বলেন। পরে তাঁর হরতাল ও অসহযোগের ঘোষণা আসে।
ইয়াহিয়ার সংসদ অধিবেশন মুলতবির ঘোষণার পর মানুষ বুঝে যায় পঞ্চনদীর দেশ পাকিস্তান তাদের নয়, তাদের ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে ঢাকার চেহারা বদলে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বাস, মোটরগাড়ি, রিকশা রাস্তা থেকে সরে যায়। মানুষ নেমে পড়ে রাস্তায়। তখন অল্প কয়েকটি বাড়িতে গ্যাস–সংযোগ ছিল। রান্নাবান্না হতো কেরোসিন ও লাকড়িতে। বিভিন্ন জায়গায় লাকড়ির দোকান ছিল। মণ দরে বিক্রি হতো। অনেক মানুষ দোকান থেকে লাকড়ি হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পাকিস্তানবিরোধী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দেয়। ওই লাকড়ি বা লাঠি ছিল সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতীকী অস্ত্র—মেশিনগান, কামানের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার।
পাকিস্তানি জান্তা শিশু, বৃদ্ধ, নারীসহ লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে কোটি খানেক মানুষকে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আধুনিক অস্ত্র ও রণকৌশল শত্রুকে পরাজিত করতে অবশ্যই ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনে সবচেয়ে কঠিন ভূমিকা রেখেছে সাধারণ মানুষের ত্যাগ ও মনোবল এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
No comments