সংশয়ে ইউরোপের জানালা- সংশয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন! by সরাফ আহমেদ
কথামতো শরণার্থীদের গ্রহণ না করেই অনেক দেশ তাদের সীমান্ত পথ বন্ধ করে দিচ্ছে |
নতুন
বছর ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয়ে
পড়েছে ইউরোপের মানুষ। ইউরোপের জাতিগোষ্ঠীগুলোকে এক করে পারস্পরিক সমন্বয় ও
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গত শতাব্দীতে যে উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, যা আপাতত
২৮টি আঞ্চলিক দেশের সমন্বয়ে উন্নয়ন ও সংহতির বৈশ্বিক মডেল, সেই ইউরোপীয়
ইউনিয়নে এখন নানা প্রশ্নে অনৈক্যের সুর।
গত বছরের শেষ দিক থেকে যুদ্ধ ও দাঙ্গাপীড়িত নানা দেশ থেকে লাখ লাখ শরণার্থীর ইউরোপে আগমনে ভীত হয়ে আন্তর্দেশীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইউরোপে অবস্থানরত শরণার্থীদের বণ্টনের প্রশ্ন নিয়ে বিরোধ এখনো মেটেনি। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য কর্তৃক তাদের দেশে প্রচুর পূর্ব ইউরোপের অভিবাসী চাকরির কারণে প্রবেশ করছে বিধায় এবং কিছু অর্থনৈতিক ছাড় না দেওয়ার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্জনের হুমকি এবং বেশির ভাগ দেশে মূলধারার রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রত্যাবর্তন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য ও সংহতির ভিতকে দুর্বল করছে।
পৃথিবীজুড়ে এই মুহূর্তে ৬ কোটি শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ১০, ২০ বা ৩০ লাখ শরণার্থীকে গ্রহণ করতে গিয়ে যে নাটক পৃথিবীর অন্যতম ধনী মহাদেশ ইউরোপ করছে, তা গণতন্ত্র ও মানবিকতার অবতারদের জন্য একটা লজ্জাজনক ঘটনা। গত শতাব্দীতে ইউরোপ দুটি মহাযুদ্ধ দেখেছে, দেখেছে পূর্ব-পশ্চিম সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ ধারার ঠান্ডা যুদ্ধ। তদুপরি সব সমস্যা ও ভিন্নমতকে সমন্বিত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন এবং ইউনিয়নের মূল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইউরোপীয় জাতিসত্তাগুলো নিঃসন্দেহে একটি বিশ্ব নজির স্থাপন করতে পেরেছে।
গত প্রায় ৭০ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দাঁড়িয়েছে ২৮-এ, সদস্যসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাদেশীয় ঐক্য উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, তাই আগের আর এখনকার ইউরোপের চেহারার আদল অনেকটাই ভিন্ন। তা শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভিবাসন, কর্মসংস্থান, শ্রমিক, পরিবহন, সামাজিক ভাতা, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও মানবাধিকার—সব বিষয়ে সদস্যদেশগুলোর নিয়মকানুন একই নিয়মে বাঁধার চেষ্টা করেছে। সদস্যদেশগুলো নিজেদের মধ্যে সীমান্তপ্রথা তুলে দেওয়া, বিশাল অভিন্ন বাজারব্যবস্থা, যেখানে পণ্য ও সেবা অবাধে চলাচল করতে পারছে। পাশাপাশি বৈদেশিক নীতি বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক নীতি—সব মিলিয়ে সব ক্ষেত্রেই সমন্বয় আর সহযোগিতার প্রয়াস। তবে সেই সমন্বয় ও সহযোগিতায় আপাতত ভাটা পড়েছে মূলত শরণার্থীদের গ্রহণ করার প্রশ্নে।
দীর্ঘদিন থেকেই ইউরোপীয় কমিশন প্রস্তাব রেখেছিল ইউরোপে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে কীভাবে যৌথভাবে কাজ করা যায়, ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও একই আলোচনা ও প্রস্তাবের কথা অনেক দিন থেকে আলোচিত হলেও সদস্যদেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় কাউন্সিলের কিছু সদস্যদেশের বাধার মুখে শরণার্থীদের নিয়ে কোনো যৌথ সমন্বিত আলোচনা বেশি দূর এগোতে পারেনি আর তা হয়নি বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের কারণে।
দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রপথে যখন হাজার হাজার শরণার্থী ইতালির ল্যাম্পাডুসা ও গ্রিসের লেসবসে জমায়েত হচ্ছিল, তখন তা নিয়ে ইউনিয়নভুক্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলো ততটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু এসব শরণার্থী যখন ইতালি ও গ্রিস ত্যাগ করে মধ্য ইউরোপের সচ্ছল দেশগুলোর দিকে পাড়ি জমাল, তখন থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে শরণার্থীবিষয়ক আলোচনা ও পুনর্বাসন-প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি মাত্রা পেল। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় কমিশন হলো ২৮টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সর্বোচ্চ ফোরাম আর ইউরোপীয় কাউন্সিল হলো সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের ফোরাম।
তবে ৫০ কোটি জনসংখ্যা-অধ্যুষিত ২৮ জাতিসত্তা আর ২৪ ভাষাভাষী জাতির নিজস্ব অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন আছে মাত্র ৫ লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যা-অধ্যুষিত ছোট দেশ লুক্সেমবার্গ, তেমনি আছে ১১ কোটি জনসংখ্যা-অধ্যুষিত বড় দেশ জার্মানি। সদস্যদেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা সমান নয়, তা ছাড়া ইউরোপের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের দেশগুলোতে রয়েছে ২০ শতাংশ বেকার, যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। দেশগুলোর ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্যটাও বেশ প্রকট, তাই দরিদ্র সদস্যদেশগুলোর বেকারেরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসী আইনের আওতায় চাকরির সন্ধানে ধনী দেশগুলোয় অভিবাসিত হতে চাইছে।
শুধু গত বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন লাখ ইউরোপীয় অভিবাসী দরিদ্র সদস্যদেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ অভিবাসী সেখানে চাকরিতে নিয়োজিত হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও অন্য ধনী দেশগুলোয় মূলত ১০টি সদস্যদেশ হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া থেকে চাকরির সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য থেকেও ১০ লাখের বেশি অভিবাসী চাকরির কারণে ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় পাড়ি জমিয়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে যারা চাকরি করছে, তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের সন্তানেরা সঙ্গে না থাকলেও অনাবাসী শিশু ভাতা গ্রহণ করা ছাড়াও চার বছর পর রাষ্ট্রীয় সব সামাজিক ভাতা যেমন আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও জীবন ধারণের জন্য কল্যাণ ভাতা পাচ্ছে।
একদিকে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলো গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল ও ইতালিতে অর্থনৈতিক সংকট বা কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় পুরোটাই ঋণনির্ভর হয়ে যাওয়ার কারণে জনগণের কাছ থেকে নানা খাতে অধিক রাজস্ব আদায় করছে। অন্যদিকে, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে সদস্য হওয়া উল্লিখিত দেশগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাজের সন্ধানে ধনী দেশগুলোয় অভিবাসী হওয়া এবং ইদানীং বিপুলসংখ্যক যুদ্ধপীড়িত শরণার্থীর ইউরোপে আগমন, যাদের অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলদের ক্ষমতা গ্রহণ, ফ্রান্সে কয়েক দফা সন্ত্রাসী হামলা, যুক্তরাজ্যের ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি—এসব টানাপোড়েনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রীতি ও সম্ভাব্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিভিন্ন দেশের অতি জাতীয়তাবাদী দলগুলো সেখানকার জনগণকে বোঝাতে সচেষ্ট হচ্ছে, এভাবে অন্য জাতিসত্তা ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা, তা ইউরোপীয় অভিবাসী বা শরণার্থীরাই হোক, তারা এখানে আবাস গাড়লে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি বা আত্মপরিচয়ের সংকট হুমকির মুখে পড়বে। এ ছাড়া ইসলাম ধর্মাবলম্বী শরণার্থী নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের আপত্তি আছে। যদিও তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য ও সনদের পরিপন্থী, তদুপরি হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল সরকার এ ধরনের প্রচার চালাচ্ছে, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও অতি জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রচারণার কারণে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মানবিক সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে টানাপোড়েনে ভুগছে।
যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাখার ব্যাপারে ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় নীতিমালার বেশ কিছু কাটছাঁট করে বেশ ছাড় দেওয়া হয়েছে, তদুপরি আগামী ২৩ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের থাকা না-থাকার ব্যাপারে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাজ্যের ইউনিয়নে না থাকার প্রশ্নে সেখানকার বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভোডাফোন, জাগুয়ার, কিংফিশার, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারসেল, ল্যান্ডরোভার সম্প্রতি এই বলে সতর্ক করেছে যে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে যুক্তরাজ্যে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়বে এবং যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০১৫ সালের শেষের দিক থেকে চলতি বছরের শেষ নাগাদ প্রায় ৩০ লাখ শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থী ইতিমধ্যে জার্মানিতে অবস্থান করছে। ইউরোপে শরণার্থীদের পুনর্বণ্টন ও পুনর্বাসনের জন্য গত ডিসেম্বরে ব্রাসেলসে শরণার্থীদের কোটাভিত্তিক বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করবে বলে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা এখন অনেক দেশই মানছে না। কথামতো শরণার্থীদের গ্রহণ না করেই অনেক দেশ তাদের সীমান্ত পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল গত বছরের শেষ দিকে যে বিপুল শরণার্থী নিজ দেশে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই মানবিক বিপর্যয়ের ভার অন্য দেশগুলোকে নিতে বলেছিলেন, প্রথম দিকে অনেক ইউরোপীয় দেশ সহযোগিতার হাত বাড়ালেও, এখন অনেক দেশই তাদের হাত গুটিয়ে ফেলছে। এসব ঘটনায় ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ জাঙ্কার, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন সুলজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
৭০ বছর আগে যে অতিজাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টরা ইউরোপকে যুদ্ধ ও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, ইউরোপের দেশে দেশে এখন ঠিক সেই ধরনের ফ্যাসিস্ট রাজনীতি না হলেও অতিজাতীয়তাবাদী দলগুলোই জনগণকে উসকে দিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের মূলধারার ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।
sharaf.ahmed@gmx.net
গত বছরের শেষ দিক থেকে যুদ্ধ ও দাঙ্গাপীড়িত নানা দেশ থেকে লাখ লাখ শরণার্থীর ইউরোপে আগমনে ভীত হয়ে আন্তর্দেশীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইউরোপে অবস্থানরত শরণার্থীদের বণ্টনের প্রশ্ন নিয়ে বিরোধ এখনো মেটেনি। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য কর্তৃক তাদের দেশে প্রচুর পূর্ব ইউরোপের অভিবাসী চাকরির কারণে প্রবেশ করছে বিধায় এবং কিছু অর্থনৈতিক ছাড় না দেওয়ার প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্জনের হুমকি এবং বেশির ভাগ দেশে মূলধারার রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রত্যাবর্তন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য ও সংহতির ভিতকে দুর্বল করছে।
পৃথিবীজুড়ে এই মুহূর্তে ৬ কোটি শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ১০, ২০ বা ৩০ লাখ শরণার্থীকে গ্রহণ করতে গিয়ে যে নাটক পৃথিবীর অন্যতম ধনী মহাদেশ ইউরোপ করছে, তা গণতন্ত্র ও মানবিকতার অবতারদের জন্য একটা লজ্জাজনক ঘটনা। গত শতাব্দীতে ইউরোপ দুটি মহাযুদ্ধ দেখেছে, দেখেছে পূর্ব-পশ্চিম সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ ধারার ঠান্ডা যুদ্ধ। তদুপরি সব সমস্যা ও ভিন্নমতকে সমন্বিত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন এবং ইউনিয়নের মূল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইউরোপীয় জাতিসত্তাগুলো নিঃসন্দেহে একটি বিশ্ব নজির স্থাপন করতে পেরেছে।
গত প্রায় ৭০ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দাঁড়িয়েছে ২৮-এ, সদস্যসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাদেশীয় ঐক্য উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, তাই আগের আর এখনকার ইউরোপের চেহারার আদল অনেকটাই ভিন্ন। তা শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভিবাসন, কর্মসংস্থান, শ্রমিক, পরিবহন, সামাজিক ভাতা, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও মানবাধিকার—সব বিষয়ে সদস্যদেশগুলোর নিয়মকানুন একই নিয়মে বাঁধার চেষ্টা করেছে। সদস্যদেশগুলো নিজেদের মধ্যে সীমান্তপ্রথা তুলে দেওয়া, বিশাল অভিন্ন বাজারব্যবস্থা, যেখানে পণ্য ও সেবা অবাধে চলাচল করতে পারছে। পাশাপাশি বৈদেশিক নীতি বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক নীতি—সব মিলিয়ে সব ক্ষেত্রেই সমন্বয় আর সহযোগিতার প্রয়াস। তবে সেই সমন্বয় ও সহযোগিতায় আপাতত ভাটা পড়েছে মূলত শরণার্থীদের গ্রহণ করার প্রশ্নে।
দীর্ঘদিন থেকেই ইউরোপীয় কমিশন প্রস্তাব রেখেছিল ইউরোপে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে কীভাবে যৌথভাবে কাজ করা যায়, ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও একই আলোচনা ও প্রস্তাবের কথা অনেক দিন থেকে আলোচিত হলেও সদস্যদেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় কাউন্সিলের কিছু সদস্যদেশের বাধার মুখে শরণার্থীদের নিয়ে কোনো যৌথ সমন্বিত আলোচনা বেশি দূর এগোতে পারেনি আর তা হয়নি বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের কারণে।
দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রপথে যখন হাজার হাজার শরণার্থী ইতালির ল্যাম্পাডুসা ও গ্রিসের লেসবসে জমায়েত হচ্ছিল, তখন তা নিয়ে ইউনিয়নভুক্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলো ততটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু এসব শরণার্থী যখন ইতালি ও গ্রিস ত্যাগ করে মধ্য ইউরোপের সচ্ছল দেশগুলোর দিকে পাড়ি জমাল, তখন থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে শরণার্থীবিষয়ক আলোচনা ও পুনর্বাসন-প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি মাত্রা পেল। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় কমিশন হলো ২৮টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সর্বোচ্চ ফোরাম আর ইউরোপীয় কাউন্সিল হলো সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের ফোরাম।
তবে ৫০ কোটি জনসংখ্যা-অধ্যুষিত ২৮ জাতিসত্তা আর ২৪ ভাষাভাষী জাতির নিজস্ব অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন আছে মাত্র ৫ লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যা-অধ্যুষিত ছোট দেশ লুক্সেমবার্গ, তেমনি আছে ১১ কোটি জনসংখ্যা-অধ্যুষিত বড় দেশ জার্মানি। সদস্যদেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা সমান নয়, তা ছাড়া ইউরোপের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের দেশগুলোতে রয়েছে ২০ শতাংশ বেকার, যাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। দেশগুলোর ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্যটাও বেশ প্রকট, তাই দরিদ্র সদস্যদেশগুলোর বেকারেরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসী আইনের আওতায় চাকরির সন্ধানে ধনী দেশগুলোয় অভিবাসিত হতে চাইছে।
শুধু গত বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন লাখ ইউরোপীয় অভিবাসী দরিদ্র সদস্যদেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ অভিবাসী সেখানে চাকরিতে নিয়োজিত হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও অন্য ধনী দেশগুলোয় মূলত ১০টি সদস্যদেশ হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া থেকে চাকরির সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য থেকেও ১০ লাখের বেশি অভিবাসী চাকরির কারণে ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় পাড়ি জমিয়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে যারা চাকরি করছে, তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের সন্তানেরা সঙ্গে না থাকলেও অনাবাসী শিশু ভাতা গ্রহণ করা ছাড়াও চার বছর পর রাষ্ট্রীয় সব সামাজিক ভাতা যেমন আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও জীবন ধারণের জন্য কল্যাণ ভাতা পাচ্ছে।
একদিকে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলো গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল ও ইতালিতে অর্থনৈতিক সংকট বা কিছু দেশের রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় পুরোটাই ঋণনির্ভর হয়ে যাওয়ার কারণে জনগণের কাছ থেকে নানা খাতে অধিক রাজস্ব আদায় করছে। অন্যদিকে, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে সদস্য হওয়া উল্লিখিত দেশগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাজের সন্ধানে ধনী দেশগুলোয় অভিবাসী হওয়া এবং ইদানীং বিপুলসংখ্যক যুদ্ধপীড়িত শরণার্থীর ইউরোপে আগমন, যাদের অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলদের ক্ষমতা গ্রহণ, ফ্রান্সে কয়েক দফা সন্ত্রাসী হামলা, যুক্তরাজ্যের ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি—এসব টানাপোড়েনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রীতি ও সম্ভাব্যতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিভিন্ন দেশের অতি জাতীয়তাবাদী দলগুলো সেখানকার জনগণকে বোঝাতে সচেষ্ট হচ্ছে, এভাবে অন্য জাতিসত্তা ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা, তা ইউরোপীয় অভিবাসী বা শরণার্থীরাই হোক, তারা এখানে আবাস গাড়লে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি বা আত্মপরিচয়ের সংকট হুমকির মুখে পড়বে। এ ছাড়া ইসলাম ধর্মাবলম্বী শরণার্থী নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের আপত্তি আছে। যদিও তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য ও সনদের পরিপন্থী, তদুপরি হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল সরকার এ ধরনের প্রচার চালাচ্ছে, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও অতি জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রচারণার কারণে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মানবিক সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে টানাপোড়েনে ভুগছে।
যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাখার ব্যাপারে ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় নীতিমালার বেশ কিছু কাটছাঁট করে বেশ ছাড় দেওয়া হয়েছে, তদুপরি আগামী ২৩ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের থাকা না-থাকার ব্যাপারে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাজ্যের ইউনিয়নে না থাকার প্রশ্নে সেখানকার বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভোডাফোন, জাগুয়ার, কিংফিশার, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারসেল, ল্যান্ডরোভার সম্প্রতি এই বলে সতর্ক করেছে যে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে যুক্তরাজ্যে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়বে এবং যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০১৫ সালের শেষের দিক থেকে চলতি বছরের শেষ নাগাদ প্রায় ৩০ লাখ শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থী ইতিমধ্যে জার্মানিতে অবস্থান করছে। ইউরোপে শরণার্থীদের পুনর্বণ্টন ও পুনর্বাসনের জন্য গত ডিসেম্বরে ব্রাসেলসে শরণার্থীদের কোটাভিত্তিক বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করবে বলে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা এখন অনেক দেশই মানছে না। কথামতো শরণার্থীদের গ্রহণ না করেই অনেক দেশ তাদের সীমান্ত পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল গত বছরের শেষ দিকে যে বিপুল শরণার্থী নিজ দেশে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই মানবিক বিপর্যয়ের ভার অন্য দেশগুলোকে নিতে বলেছিলেন, প্রথম দিকে অনেক ইউরোপীয় দেশ সহযোগিতার হাত বাড়ালেও, এখন অনেক দেশই তাদের হাত গুটিয়ে ফেলছে। এসব ঘটনায় ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ জাঙ্কার, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন সুলজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
৭০ বছর আগে যে অতিজাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টরা ইউরোপকে যুদ্ধ ও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, ইউরোপের দেশে দেশে এখন ঠিক সেই ধরনের ফ্যাসিস্ট রাজনীতি না হলেও অতিজাতীয়তাবাদী দলগুলোই জনগণকে উসকে দিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের মূলধারার ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।
sharaf.ahmed@gmx.net
No comments