কেমন হবে এবারের নির্বাচন by এম সাখাওয়াত হোসেন

২২ মার্চ ৪ হাজার ২৭৯টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ঘোষিত ৭৫২টির মধ্যে ৭২৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই মনোনয়ন বাছাই হয়ে প্রার্থীরা প্রচারণায় নেমেছেন। তবে নির্বাচনের প্রথম ধাপ প্রাক-নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়েই অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ উঠেছে যে প্রায় ১১৪টি জায়গায় বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় নানা পন্থায় বাধা দেওয়া হয়েছে, যার কারণে প্রার্থীরা মনোনয়ন দাখিল করতে পারেননি।
অপর দিকে বাংলাদেশ তথা পাকিস্তান সময় থেকে যেভাবে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হতো, তার আদল বদলেছে। হালের পৌরসভা নির্বাচনের মতোই ইউনিয়ন পরিষদের একমাত্র চেয়ারম্যান পদেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে দলীয়ও বলা যাবে না। কারণ, শুধু চেয়ারম্যান দলীয় হলেও পরিষদ আগের মতোই থাকছে। এ কারণেও তৃণমূল পর্যায়ের এই নির্বাচনও বেশ জটিল হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৫০টি চেয়ারম্যান পদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছে বা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯টিই বাগেরহাট জেলায়। এ কাণ্ডও ঐতিহাসিক। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যায়ের নির্বাচনে এতসংখ্যক চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি। অন্তত আমার জানামতে নয়।
অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যাপক নির্বাচনের ধারাবাহিকতা চলে আসছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে। নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যাঁরা প্রচুর গবেষণা করছেন, তাঁদের মতে, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় যদি একবার বিপর্যয় ঘটে, তবে ওই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সংস্থার ওপর জনগণ যেমন আস্থা হারায়, বেপরোয়া হয়ে ওঠে, মরিয়া প্রার্থীরা যেকোনো উপায়ে নির্বাচনকে নিজের অনুকূলে আনতে চান। এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায়ও ধস নামে। অবশ্য তাঁদের মতে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটে উঠতি গণতন্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে। অবশ্য এসব গবেষণার ক্ষেত্র আফ্রিকা এবং দু-একটি এশিয়ান রাষ্ট্র, যার মধ্যে ফিলিপাইন অন্তর্গত ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বিগত নির্বাচনগুলো বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত গবেষণার নতুন ক্ষেত্র হতে পারে। গবেষণার বিষয় হতে পারে কেন বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পরের নির্বাচন, বিশেষ করে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেল না।
যা-ই হোক, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা যে ভঙ্গুরের পথে, তা নিয়ে বড় গবেষণার প্রয়োজন নেই। দৃশ্যমান যে তেমনটি হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের সব স্তরের নির্বাচনগুলোর মধ্যে সর্বকালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সব সময়ই জটিল এবং সর্ববৃহৎ নির্বাচন
বলে বিবেচিত। শুধু প্রথম ধাপেই প্রায় ৩৯ হাজার ৪৩০ জন বিভিন্ন স্তরের প্রার্থীর সমাবেশ ঘটেছে। এই ধারায় ৪ হাজার ২৭৯ ইউনিয়নে সর্বমোট কত প্রার্থী হবেন, তা অনুমেয়। প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোটারের এই নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করার কথা রয়েছে।
শুধু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জই নয়, প্রথম ধাপে যেসব অঞ্চলে নির্বাচন হচ্ছে, সেসব অঞ্চল বাংলাদেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোর অন্যতম। এ অঞ্চলে রয়েছে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল। বঙ্গোপসাগরের মোহনার চরাঞ্চলগুলোর ইউনিয়ন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশের অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল চর কুকরি–মুকরি ইউনিয়ন, ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়নগুলো, যার মধ্যে মনপুরা উপজেলা অন্তর্গত। লক্ষ্মীপুর, ফেনী অঞ্চলের চরাঞ্চল, বাগেরহাটসহ সুন্দরবনের দুর্গম অঞ্চলের ইউনিয়নগুলো। এগুলো সাধারণ অবস্থায়ও আইনশৃঙ্খলার প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলের নিম্ন অঞ্চল ও চরগুলোতে সব সময় জলদস্যুদের আতঙ্কে থাকেন সাধারণ জনগণ। কাজেই এসব অঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর নির্বাচন এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। কাজেই বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং দৃশ্যমান অনিয়ম ও সংঘাত যোগ হলে এবারের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ তো হবেই, সংঘাতময়ও হয়ে উঠতে পারে। এ সংঘাত শুধু সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যেই নয়, সরকারি দল ও অন্যান্য দলের আন্তদলীয় কোন্দলে রূপ নিতে পারে।
যেমনটি আগেই বলেছি যে এবারই প্রথম দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে, যার পরিসর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নির্বাচন বলে আখ্যায়িত। ২০১১ সালের শেষ নির্দলীয় নির্বাচনেও কয়েক ধাপে নির্বাচন হয়েছিল। তখন এক ধাপের ফলাফল অন্য ধাপকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তবে এবার বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। এতগুলো নির্বাচন এক দিনে অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়, অবশ্যই ধাপে ধাপে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার চলমান পদ্ধতির অবশ্যই পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। পৃথিবীর প্রায় সব দলীয় পরিচয়ে ধাপে ধাপে নির্বাচনের ফলাফল একটি নির্ধারিত দিনে প্রকাশ করা হয়, যাতে আগাম প্রভাব না পড়ে। আগাম প্রভাব পড়লে সে নির্বাচনকে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য বলা যায় না। কারণ অতি সহজ। এক অঞ্চলের নির্বাচনের ফলাফল বাকি নির্বাচনকে ও নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করবেই। এ বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা বা চিন্তাভাবনা আদৌ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এই বিষয়টি অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
ইউপি নির্বাচন ২০১৬, কতখানি সুষ্ঠু হবে তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ ইতিমধ্যেই জন্মাতে শুরু করেছে, বিশেষ করে যে ধরনের পরিস্থিতির আলামত দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনকে অনুকূলে আনার নানা ধরনের কৌশল বিভিন্ন নির্বাচনে বিভিন্নভাবে গ্রহণ করে থাকে। প্রতি নির্বাচনে প্রতিবার একই ধরনের কৌশল গৃহীত হয় না। বুথ দখল সবচেয়ে সহজ পন্থা। তবে অনেক সময় বিভিন্ন পন্থার সঙ্গে বুথ দখল করা হয়। সম্পূর্ণ নির্বাচনে যেসব জায়গায় কোনো শক্তিশালী দলীয় প্রার্থীর হারার আশঙ্কা থাকে, সেসব জায়গায় বেআইনিভাবে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ হয় বেশি। আমাদের মতো দেশে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা সরকারি দলেরই বেশি। এই প্রভাবের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যখন দলীয় সরকার ধারাবাহিকভাবে একাধিক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকে এবং থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করতে থাকে। দলীয় সরকারের হাত ততই শক্ত হয়, যখন বিরোধী পক্ষ দুর্বল হতে থাকে।
এমন কথাই বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। নির্বাচন কেন বিতর্কিত বা পরাজিত হয়, তেমন একটি গ্রন্থে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ‘কমপেরেটিভ পলিটিকস’-এর প্রফেসর পিপ্পা নরিস তাঁর গবেষণাধর্মী পুস্তক হোয়াই ইলেকশন ফেইলস (Why Election Fails) প্রারম্ভে নির্বাচন বিতর্কিত, মানসম্পন্ন না হওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার যত সব কারণ উল্লেখ করেছেন, তাতে বলেছেন যে ক্ষমতাসীনেরা যখন প্রতিপক্ষের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জকে বিভিন্ন কৌশলে ভোঁতা করে এসব কৌশলেরও ফিরিস্তি দিয়েছেন, যা আমরা বিগত বেশ কিছু নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছি।
অনেক কৌশলের মধ্যে কিছু কিছু কৌশল প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন বাইরে নিজস্ব সমর্থকদের বিশাল লাইন এবং ওই লাইন ধীরগতিতে বুথে প্রবেশ করে এবং একই সময়ে বুথের ভেতরে বুথ দখল করে ব্যালট ছিনতাই করে বাক্স ভর্তি করা হয়। এ পদ্ধতিকে বুথ জ্যাম বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আড়াল করতে গণমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকদের বুথে প্রবেশাধিকার খর্ব করা হয়। অপর কৌশল যা কার্যকর বলে প্রতীয়মান, তা হচ্ছে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদানে বাধা ও ভয়ভীতির মাধ্যমে প্রত্যাহার অথবা কারিগরি ত্রুটি দেখিয়ে বাতিল করা। এসবই নির্বাচনকে অনুকূলে আনতে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যবহার করে থাকেন। গবেষকদের মতে, এ ধরনের অরাজকতা তখনই সম্ভব, যখন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা সংস্থা বা নির্বাচন কমিশন কার্যকারিতা হারায় বা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে নত হয়।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আসন্ন ইউপি নির্বাচনের যে হালচিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নির্বাচন কমিশন অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে।অন্যথায় যেসব অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারত বা পারে। অতীত পর্যালোচনা করলেই বর্তমান পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায়। বিশ্বব্যাপী বর্তমান ব্যবস্থাপনায় গণমাধ্যম নির্বাচন কমিশনের অন্যতম সহায়ক শক্তি। কাজেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত নির্বাচনী ব্যত্যয়গুলো নির্বাচন কমিশনকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা উচিত। মৌখিক অভিযোগও গুরুতর অভিযোগ। তা ছাড়া, নির্বাচনকে ন্যূনতম পক্ষে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে ‘রি-অ্যাক্টিভ’ নয় ‘প্রো-অ্যাক্টিভ’ হতে হবে। ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কমিশনের জন্য শক্ত চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তারা কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে এই কমিশন ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবে। এটাই হয়তো তাদের শেষ বড় ধরনের নির্বাচন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.