প্যারিস হামলা ও সিরিয়া সঙ্কট by মিরিয়াম ফ্রাঁসোয়া-কেরা
মিরিয়াম
ফ্রাঁসোয়া-কেরা ফরাসি-ব্রিটিশ সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার, লেখক ও নিউ
স্টেটসম্যান পত্রিকার কলামিস্ট। গার্ডিয়ান ও হাফিংটন পোস্টেও তিনি লেখেন।
ফ্রান্স ও মধ্যপ্রাচ্যের সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে লেখালেখি করেন। অক্সফোর্ট
ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ ডি করা মিরিয়াম ফ্রাঁসোয়া হার্ভার্ট
ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করেন।
স্র্রেব্রেনিকার গণহত্যার ব্যাপারে বিবিসির করা সিরিজ ডকুমেন্টারির
উপস্থাপিকা ছিলেন মিরিয়াম। এখন আল জাজিরার ‘হেড টু হেড’ অনুষ্ঠানের
ফ্রিল্যান্স উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করছেন। ১২ বছর বয়সে নায়িকা হিসেবে কাজ
শুরু করা মিরিয়াম ২০০৩ সালে ক্যামব্রিজ থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর ২১ বছর
বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। আগে তিনি রোমান ক্যাথলিক ছিলেন। তার লেখাটি অনুবাদ
করেছেন তানজিলা তাশিন
প্যারিস হামলার পর ইউরোপীয় নেতারা একটি কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন। আর তা হলো, সিরীয়দের সাথে তাদের ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দায়েশের (ইসলামিক স্টেট বা আইএসের স্থানীয় নাম) এই হামলাকে কি কলামিস্ট আইয়ান মার্টিনের ভাগ্য অনুযায়ী ‘পশ্চিমা সভ্যতার’ ওপর হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? বা রাফিয়া জাকারিয়ার মতো ‘মজার জন্য যুদ্ধ’ (ওয়ার অন ফান)? আইএসের সাম্প্রতিক হামলাকে কী বলা যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণায় বহু কালি খরচ হয়ে গেছে। ‘তারা আমাদের ঘৃণা করে কেন?’ এমন প্রশ্নের জবাব সুবিধাজনক দ্বিমুখী মতামতে পূর্ণ। যেখানে সহিংসতার উৎসমূলকে দেখান হয় অধরা হিসেবে। যেন বাস্তব পৃথিবীর সাথে এগুলোর কোনো যোগসূত্র নেই। বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো তৎপর থাকে। বাইরে দিয়ে তারা আদর্শের প্যাকেজ প্রদর্শন করলেও ভেতর ভেতর সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাত বা আদর্শগত আধিপত্যের কোনো বিষয় নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর দায়েশের হামলার জন্য ‘আমরা’ দায়ী কি না এ প্রশ্ন না তুলে জানতে চাওয়া উচিত এ ধরনের সহিংসতার মাধ্যমে দায়েশ কী অর্জন করতে চাইছে? শূন্যস্থানের মাঝের বিন্দুগুলো পূরণ করা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
মিসরের সিনাইয়ে বোমা বিস্ফোরণে রুশ বিমান বিধ্বস্ত করা, বৈরুতের উপকণ্ঠে হামলা, আঙ্কারার শান্তিমিছিলে হামলা, বাগদাদের শেষকৃত্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং গত শুক্রবার প্যারিসে সমন্বিত হামলা- এই সবক’টি হামলার মধ্যে মিল কোথায়?
এর জবাব একটাই, ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশ সামরিকভাবে যে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে তারই উত্তর এগুলো। ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জোটের ক্রমবর্ধমান বোমা হামলায় ভূমি হারাচ্ছে দায়েশ। হিজবুল্লাহ সিরিয়ায় যে লড়াই চালাচ্ছে, তারই প্রতিক্রিয়া হলো গত সপ্তাহে লেবাননে জোড়া বোমা হামলা। এই হামলায় ৪১ জন নিহত হয়। সিরিয়ায় এক কমান্ডারকে হারানোর পর গত কয়েক মাসে লড়াই আরো জোরদার করেছে হিজবুল্লাহ।
দায়েশবিরোধী লড়াইয়ে এক ইরাকি শিয়া যোদ্ধা নিহত হয়। বাগদাদে তারই জানাজায় হামলা চালায় জঙ্গি গ্রুপটি। নিহত হয় ২৬ জন। এ মাসে রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত করার ঘটনায় দায়েশ জড়িত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর আগে সিরিয়ায় লাগাতার বোমা ফেলে রাশিয়া (সিরিয়ারবিরোধী গোষ্ঠীর সাথে জোট বাহিনীর যোগাযোগ আছে এমন কথাও শোনা যায়)। এক অনলাইন ভিডিওতে দায়েশ সিরিয়ায় এর (রাশিয়ার) বিমান হামলার প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এতে বলা হয়, ক্রেমলিন সরকারকে টেনে নামানো হবে।
ফ্রান্স গত সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দেয়, সিরিয়ায় দায়েশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালাবে তারা। ফরাসি বিমান হামলায় সিরিয়ার রাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় ফোরাত নদী তীরের এই শহরটিকে দায়েশ এর খিলাফতের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে। ফরাসি বিমান দায়েশের তেলের কূপগুলোতেও হামলা চালায়। জঙ্গি সংগঠনটির অর্থের অন্যতম উৎস এই কূপগুলো। ইরাকের দায়েশ ঘাঁটিগুলোতেও হামলা চালানো হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পর্যন্ত এই গ্রুপটি সম্প্রতি যে হামলা চালাচ্ছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে দায়েশের স্বার্থে এসব হামলা চালানো হয়।
গ্রুপটির ওপর যারাই বিমান হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়ে ভিডিও অনলাইনে ছাড়ে দায়েশ। এটা থেকেই হামলার উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। প্যারিসভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ফাউন্ডেশন অব স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের পরিচালক ক্যামিলা গ্র্যান্ডের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ‘ইসলামিক স্টেট ক্রমেই রক্ষণাত্মক হয়ে উঠছে। এ কারণেই সন্ত্রাসী তৎপরতার দিকে এগোচ্ছে তারা।’
হামলার জন্য ক্যাফে, কনসার্ট হল, ফুটবল মাঠের মতো ‘দুর্বল লক্ষ্য’ বেছে নেয়া হচ্ছে। সমালোচনা করা হচ্ছে সংস্কৃতির কিন্তু ভয় দেখানোর জন্য তেমন কোনো লক্ষ্য বেছে নেয়া হচ্ছে না। আমাদের ‘নৈতিকতাবোধ’ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। আমাদের ‘জীবনযাপনের ধরন’ ধসিয়ে দেয়া হচ্ছে। দায়েশের বৈদেশিক প্রচারবিষয়ক শাখা আল-হায়াত মিডিয়া সেন্টারের এক ভিডিওতে বলা হয়, জোটবাহিনী তাদের ওপর যেভাবে হামলা চালাচ্ছে তাতে তারাও (পশ্চিমা দেশগুলো) ‘কখনো নিরাপদ’ থাকতে পারবে না। এই সন্ত্রাসীদের কৌশলই হয়ে দাঁড়ায়, জনবহুল এলাকাগুলো বেছে নেয়া। শিক্ষবিদ মার্ক জুয়েরগানসমেয়ার তার বই টেরর ইন দ্য মাইন্ড অব গড : দ্য গ্লোবাল রাইস অব রিলিজিয়াস ভায়োলেন্স-এ বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী তৎপরতা শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং তা আরো বড় ধরনের আধ্যাত্মিক সঙ্ঘাতও ডেকে আনছে।’
দায়েশ সিরিয়া ও ইরাকে একটি আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। শুরুতে পশ্চিমা লক্ষ্যের ওপর হামলার বিরোধী ছিল তারা। তাদের আদর্শগত সমকক্ষ আলকায়েদার মধ্যে অবশ্য এই নীতি শুরু থেকেই ছিল। তবে সাম্প্রতিক প্যারিসসহ অন্যান্য হামলা এবং বছরের গোড়ার দিকে ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী শার্লি এবদোকে আলকায়েদাকে সাথে নিয়ে হামলা চালানো থেকেই একটি বিষয় স্পষ্ট যে, দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে এই পার্থক্যটুকুও মিটে গেছে।
ফ্রান্সের মুক্ত, সাম্যবাদী মতামতের জন্য দেশটির ওপর হামলা চালানো হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। যদিও দায়েশ আদর্শগতভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। তাদের দৃষ্টিতে এটি ‘মানুষের তৈরি আইন’। ‘ঘৃণা ও বিকৃতির রাজধানী’ হিসেবে অভিহিত করলেও ফ্রান্সের বিষয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না তাদের। ফ্রান্স তাদের ওপর বিমান হামলা চালানোর পরই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তাদের ‘যুদ্ধ’ শুরুর এটাই কারণ। পরে এলিসি প্রাসাদ থেকেও একই শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
দায়েশ প্রচারণারও খুব সহজ লক্ষ্য ফ্রান্স। দেশটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। তাদের এক ভিডিওতে মুসলিম নারীদের নেকাব পরার ওপর দেশটি নিষেধাজ্ঞা জারির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, এমন দেশে মুসলমানেরা বসবাস করতে পারে না, যেখানে ধর্মচর্চার ওপর রাজনৈতিকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
ফ্রান্স এ বছর এর আগেও ছোট ছোট কয়েকটি হামলার মুখে পড়ে। গত জানুয়ারিতে এক মুদির দোকানে হামলা চালায় আমেদি কৌলিবালি নামে এক লোক। হামলার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তোমরা খিলাফতে হামলা চালিয়েছ অথবা তোমরা দায়েশের ওপর হামলা চালিয়েছ। আমরা তোমাদের ওপরও হামলা চালাব।’ আত্মঘাতী ওই হামলায় তার মৃত্যুর পর প্রচারিত এক ভিডিও থেকে পাওয়া যায় এ বক্তব্য। এর সাথে শার্লি এবদোর দফতরের হামলারও একটা যোগসূত্র রয়েছে। এই হামলায় কয়েকজন কার্টুনিস্টসহ ১৮ জন নিহত হয়। এর মধ্যে থালিস-এ যাত্রীভর্তি ট্রেন থেকে এক বন্দুকধারীকে আটক করা হয়। দক্ষিণ ফ্রান্সে শিরñেদের একটি ঘটনা ঘটে। মনে করা হয়, সিরিয়া যেতে অপারগ ফ্রান্সে বসবাসকারী দায়েশের সমর্থকেরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। দায়েশও তাদের প্রতি একই ধরনের আহ্বান জানায়। ২০১৪ সালে ছাড়া এক ভিডিওতে এককভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর আহ্বান জানানো হয়। তবে গত শুক্রবারের হামলার পর একটি বার্তা স্পষ্ট। দায়েশের সম্প্রসারণকে যারাই চ্যালেঞ্জ করবে তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
সম্মুখ লড়াইয়ে হয়তো এই গোষ্ঠীর মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপের মুসলমানদের মধ্যে খুব স্বল্পসংখ্যক হলেও কিছু লোক কী করে চরম কট্টরপন্থী হয়ে গেল তারও কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এগোনোর রাস্তা এটাই। বিশ্বের আন্তঃযোগাযোগের বিষয়টি কখনোই আজকের পর্যায়ে এতটা প্রবল ছিল না। শরণার্থী সঙ্কট এবং দায়েশের হুমকি- দুই-ই ইউরোপকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের তৈরি করা পরিস্থিতিরই প্রতিক্রিয়া এটি। এখন সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান খুঁজে বের করার মধ্যেই ইউরোপের নিরাপত্তা নিহিত- বিষয়টি বুঝতে পারছে তারা।
প্যারিস হামলার পর ইউরোপীয় নেতারা একটি কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন। আর তা হলো, সিরীয়দের সাথে তাদের ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দায়েশের (ইসলামিক স্টেট বা আইএসের স্থানীয় নাম) এই হামলাকে কি কলামিস্ট আইয়ান মার্টিনের ভাগ্য অনুযায়ী ‘পশ্চিমা সভ্যতার’ ওপর হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? বা রাফিয়া জাকারিয়ার মতো ‘মজার জন্য যুদ্ধ’ (ওয়ার অন ফান)? আইএসের সাম্প্রতিক হামলাকে কী বলা যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণায় বহু কালি খরচ হয়ে গেছে। ‘তারা আমাদের ঘৃণা করে কেন?’ এমন প্রশ্নের জবাব সুবিধাজনক দ্বিমুখী মতামতে পূর্ণ। যেখানে সহিংসতার উৎসমূলকে দেখান হয় অধরা হিসেবে। যেন বাস্তব পৃথিবীর সাথে এগুলোর কোনো যোগসূত্র নেই। বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো তৎপর থাকে। বাইরে দিয়ে তারা আদর্শের প্যাকেজ প্রদর্শন করলেও ভেতর ভেতর সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাত বা আদর্শগত আধিপত্যের কোনো বিষয় নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর দায়েশের হামলার জন্য ‘আমরা’ দায়ী কি না এ প্রশ্ন না তুলে জানতে চাওয়া উচিত এ ধরনের সহিংসতার মাধ্যমে দায়েশ কী অর্জন করতে চাইছে? শূন্যস্থানের মাঝের বিন্দুগুলো পূরণ করা এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
মিসরের সিনাইয়ে বোমা বিস্ফোরণে রুশ বিমান বিধ্বস্ত করা, বৈরুতের উপকণ্ঠে হামলা, আঙ্কারার শান্তিমিছিলে হামলা, বাগদাদের শেষকৃত্যে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং গত শুক্রবার প্যারিসে সমন্বিত হামলা- এই সবক’টি হামলার মধ্যে মিল কোথায়?
এর জবাব একটাই, ইরাক ও সিরিয়ায় দায়েশ সামরিকভাবে যে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে তারই উত্তর এগুলো। ফ্রান্স ও রাশিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জোটের ক্রমবর্ধমান বোমা হামলায় ভূমি হারাচ্ছে দায়েশ। হিজবুল্লাহ সিরিয়ায় যে লড়াই চালাচ্ছে, তারই প্রতিক্রিয়া হলো গত সপ্তাহে লেবাননে জোড়া বোমা হামলা। এই হামলায় ৪১ জন নিহত হয়। সিরিয়ায় এক কমান্ডারকে হারানোর পর গত কয়েক মাসে লড়াই আরো জোরদার করেছে হিজবুল্লাহ।
দায়েশবিরোধী লড়াইয়ে এক ইরাকি শিয়া যোদ্ধা নিহত হয়। বাগদাদে তারই জানাজায় হামলা চালায় জঙ্গি গ্রুপটি। নিহত হয় ২৬ জন। এ মাসে রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত করার ঘটনায় দায়েশ জড়িত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর আগে সিরিয়ায় লাগাতার বোমা ফেলে রাশিয়া (সিরিয়ারবিরোধী গোষ্ঠীর সাথে জোট বাহিনীর যোগাযোগ আছে এমন কথাও শোনা যায়)। এক অনলাইন ভিডিওতে দায়েশ সিরিয়ায় এর (রাশিয়ার) বিমান হামলার প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এতে বলা হয়, ক্রেমলিন সরকারকে টেনে নামানো হবে।
ফ্রান্স গত সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দেয়, সিরিয়ায় দায়েশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালাবে তারা। ফরাসি বিমান হামলায় সিরিয়ার রাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় ফোরাত নদী তীরের এই শহরটিকে দায়েশ এর খিলাফতের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে। ফরাসি বিমান দায়েশের তেলের কূপগুলোতেও হামলা চালায়। জঙ্গি সংগঠনটির অর্থের অন্যতম উৎস এই কূপগুলো। ইরাকের দায়েশ ঘাঁটিগুলোতেও হামলা চালানো হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পর্যন্ত এই গ্রুপটি সম্প্রতি যে হামলা চালাচ্ছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে দায়েশের স্বার্থে এসব হামলা চালানো হয়।
গ্রুপটির ওপর যারাই বিমান হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়ে ভিডিও অনলাইনে ছাড়ে দায়েশ। এটা থেকেই হামলার উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। প্যারিসভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ফাউন্ডেশন অব স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের পরিচালক ক্যামিলা গ্র্যান্ডের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ‘ইসলামিক স্টেট ক্রমেই রক্ষণাত্মক হয়ে উঠছে। এ কারণেই সন্ত্রাসী তৎপরতার দিকে এগোচ্ছে তারা।’
হামলার জন্য ক্যাফে, কনসার্ট হল, ফুটবল মাঠের মতো ‘দুর্বল লক্ষ্য’ বেছে নেয়া হচ্ছে। সমালোচনা করা হচ্ছে সংস্কৃতির কিন্তু ভয় দেখানোর জন্য তেমন কোনো লক্ষ্য বেছে নেয়া হচ্ছে না। আমাদের ‘নৈতিকতাবোধ’ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। আমাদের ‘জীবনযাপনের ধরন’ ধসিয়ে দেয়া হচ্ছে। দায়েশের বৈদেশিক প্রচারবিষয়ক শাখা আল-হায়াত মিডিয়া সেন্টারের এক ভিডিওতে বলা হয়, জোটবাহিনী তাদের ওপর যেভাবে হামলা চালাচ্ছে তাতে তারাও (পশ্চিমা দেশগুলো) ‘কখনো নিরাপদ’ থাকতে পারবে না। এই সন্ত্রাসীদের কৌশলই হয়ে দাঁড়ায়, জনবহুল এলাকাগুলো বেছে নেয়া। শিক্ষবিদ মার্ক জুয়েরগানসমেয়ার তার বই টেরর ইন দ্য মাইন্ড অব গড : দ্য গ্লোবাল রাইস অব রিলিজিয়াস ভায়োলেন্স-এ বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী তৎপরতা শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং তা আরো বড় ধরনের আধ্যাত্মিক সঙ্ঘাতও ডেকে আনছে।’
দায়েশ সিরিয়া ও ইরাকে একটি আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। শুরুতে পশ্চিমা লক্ষ্যের ওপর হামলার বিরোধী ছিল তারা। তাদের আদর্শগত সমকক্ষ আলকায়েদার মধ্যে অবশ্য এই নীতি শুরু থেকেই ছিল। তবে সাম্প্রতিক প্যারিসসহ অন্যান্য হামলা এবং বছরের গোড়ার দিকে ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী শার্লি এবদোকে আলকায়েদাকে সাথে নিয়ে হামলা চালানো থেকেই একটি বিষয় স্পষ্ট যে, দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে এই পার্থক্যটুকুও মিটে গেছে।
ফ্রান্সের মুক্ত, সাম্যবাদী মতামতের জন্য দেশটির ওপর হামলা চালানো হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। যদিও দায়েশ আদর্শগতভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। তাদের দৃষ্টিতে এটি ‘মানুষের তৈরি আইন’। ‘ঘৃণা ও বিকৃতির রাজধানী’ হিসেবে অভিহিত করলেও ফ্রান্সের বিষয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না তাদের। ফ্রান্স তাদের ওপর বিমান হামলা চালানোর পরই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তাদের ‘যুদ্ধ’ শুরুর এটাই কারণ। পরে এলিসি প্রাসাদ থেকেও একই শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
দায়েশ প্রচারণারও খুব সহজ লক্ষ্য ফ্রান্স। দেশটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। তাদের এক ভিডিওতে মুসলিম নারীদের নেকাব পরার ওপর দেশটি নিষেধাজ্ঞা জারির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, এমন দেশে মুসলমানেরা বসবাস করতে পারে না, যেখানে ধর্মচর্চার ওপর রাজনৈতিকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
ফ্রান্স এ বছর এর আগেও ছোট ছোট কয়েকটি হামলার মুখে পড়ে। গত জানুয়ারিতে এক মুদির দোকানে হামলা চালায় আমেদি কৌলিবালি নামে এক লোক। হামলার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তোমরা খিলাফতে হামলা চালিয়েছ অথবা তোমরা দায়েশের ওপর হামলা চালিয়েছ। আমরা তোমাদের ওপরও হামলা চালাব।’ আত্মঘাতী ওই হামলায় তার মৃত্যুর পর প্রচারিত এক ভিডিও থেকে পাওয়া যায় এ বক্তব্য। এর সাথে শার্লি এবদোর দফতরের হামলারও একটা যোগসূত্র রয়েছে। এই হামলায় কয়েকজন কার্টুনিস্টসহ ১৮ জন নিহত হয়। এর মধ্যে থালিস-এ যাত্রীভর্তি ট্রেন থেকে এক বন্দুকধারীকে আটক করা হয়। দক্ষিণ ফ্রান্সে শিরñেদের একটি ঘটনা ঘটে। মনে করা হয়, সিরিয়া যেতে অপারগ ফ্রান্সে বসবাসকারী দায়েশের সমর্থকেরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। দায়েশও তাদের প্রতি একই ধরনের আহ্বান জানায়। ২০১৪ সালে ছাড়া এক ভিডিওতে এককভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর আহ্বান জানানো হয়। তবে গত শুক্রবারের হামলার পর একটি বার্তা স্পষ্ট। দায়েশের সম্প্রসারণকে যারাই চ্যালেঞ্জ করবে তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
সম্মুখ লড়াইয়ে হয়তো এই গোষ্ঠীর মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপের মুসলমানদের মধ্যে খুব স্বল্পসংখ্যক হলেও কিছু লোক কী করে চরম কট্টরপন্থী হয়ে গেল তারও কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এগোনোর রাস্তা এটাই। বিশ্বের আন্তঃযোগাযোগের বিষয়টি কখনোই আজকের পর্যায়ে এতটা প্রবল ছিল না। শরণার্থী সঙ্কট এবং দায়েশের হুমকি- দুই-ই ইউরোপকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের তৈরি করা পরিস্থিতিরই প্রতিক্রিয়া এটি। এখন সিরিয়া সঙ্কটের সমাধান খুঁজে বের করার মধ্যেই ইউরোপের নিরাপত্তা নিহিত- বিষয়টি বুঝতে পারছে তারা।
No comments