সু চির অহিংস নীতি এবং বাংলাদেশ by - মিজানুর রহমান খান
অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়াকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যে সাফল্যের উদাহরণ অং সান সু চি সৃষ্টি
করেছেন, তা আমাদের একটা আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ এনে দিয়েছে। অং সান সু চি
অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো বর্মিদের জীবনে একটি সত্তরের নির্বাচন
নামিয়ে আনতে পেরেছেন। গান্ধী, ম্যান্ডেলা ও বঙ্গবন্ধুর সামনে নতুন রাষ্ট্র
গঠন ও সংবিধান তৈরির প্রশ্ন ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার গোটা ইতিহাসজুড়ে ভূমিধস
বিজয়ের মহিমা হচ্ছে সংবিধানের খোলনলচে পাল্টানো। উপমহাদেশীয়
জননেতা–নেত্রীরা ভোটের পরেই জোরেশোরে বলেন, অবাধ নির্বাচনে জনগণ যেহেতু
তাঁদের ম্যান্ডেট দিয়েছেন, তাই তাঁদের প্রত্যেকেরই সংবিধানকে ইচ্ছামতো
বদলানোর অধিকার জন্মেছে। আর প্রায়ই তাতে সংখ্যালঘু বা বিরোধী দলের মতামত
অনেকটাই উপেক্ষিত থাকে।
উল্লিখিত রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে সহজেই বলা যায়, অং সান সু চি আমাদের চোখের সামনে এমন একটি ইতিহাস গড়ছেন, যার কোনো তুলনা নেই। ইন্দিরা, বেনজির, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা—প্রত্যেকের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার আছে। সুচিরও আছে। সুচি মিয়ানমারের জাতির পিতা অং সানের কন্যা। এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সু চি বুঝি নীরবে একটি প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন এবং এবারের নির্বাচনে তারই সুফল পেয়েছেন। কিন্তু রেঙ্গুনে আট বছরের বেশি সময় ধরে থাকা একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে সেই ভুল ভাঙল। সু চি দল গড়তে পারেননি। অবশ্য তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের নেত্রীদের নামের জাদু আছে। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের বিজয়কে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে। সু চি প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ালে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হতেন। এবারের নির্বাচন সম্পর্কে তাই বলা চলে, এনএলডির প্রতীক নিয়ে কলাগাছও জয়ী হয়েছে। তাই মিয়ানমারে যে নির্বাচনটা হলো, সেটা আসলে বারাক ওবামার নির্বাচনে জেতার মতো একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কিন্তু তফাত হলো, সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না।
ইয়াহিয়া যেটা জানতেন না, সেটা বর্মি সামরিক জান্তার জানা ছিল। তাই তাঁরা সংবিধান এমনভাবে রচনা করেছেন যে নির্বাচনী ফলাফল যাতে তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারে। এনএলডির নির্বাচনী বিজয় জেনারেলদের অবাক করেছে বলে মনে হয় না। তাঁরা বহু বছর ধরে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই তবে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন দিয়েছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে কারণে ভোটদানসর্বস্ব গণতন্ত্রকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করি, মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও সেভাবেই দেখতে চাই। কারণ, মিয়ানমারের জনগণ যেভাবে ‘কলাগাছ’ মার্কায় ভোট দিয়ে গণতন্ত্র উৎসব করেছেন, তা একটি গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার বড় বেশি মৌলিক ঘাটতির মধ্যে একটি নির্বাচন হয়েছে।
নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে জেনারেলরা বিশ্ববাসীকে যা দেখিয়েছেন, তা তাঁদের আসল পরিচয় নয়; বরং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের সাফল্যের মুকুটে শুধু রঙিন পালক যুক্ত করেছেন। তবে তার অর্থ এই নয় যে অং সান সু চির সামনে রাজনৈতিক দলভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেননি। বিষয়টি এখন সু চির ওপর নির্ভর করছে, তিনি কীভাবে অর্জিত বিজয়কে ব্যবহার করবেন। তিনি যদি আজীবন ক্ষমতা কিংবা দলীয় ক্ষমতার পাদপ্রদীপে থাকতে চান, তাহলে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা আগের মতোই নাজুক থেকে যেতে পারে। সু চি কোন দিকে তাকাবেন? ম্যান্ডেলার দিকে, নাকি তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলো অভাগা দেশের দিকে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর জন্য ম্যান্ডেলা হওয়া কঠিন, কারণ ম্যান্ডেলা ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন, কিন্তু স্বেচ্ছায় হননি। সু চির সামনে সেই পথ আপাতত রুদ্ধ।
সামরিকায়নের বিরুদ্ধে লড়তে সু চির এখন উচিত হবে সর্বশক্তি দিয়ে রাজনৈতিক দলব্যবস্থা গড়ে তোলা। কারণ, দলব্যবস্থা গঠন করতে না পারলে ভোট কোনো কাজে দেবে না। ক্ষমতাপ্রেমী দেশপ্রেমিক হতে না চাইলে তিনি সেটা পারবেন, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নেই। পরিবারতন্ত্র থেকে তিনি বহু তফাতে আছেন। ছেলে, মেয়ে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, তাঁর আশপাশে কেউ নেই।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম ব্যবহার এবং বৃহত্তর জনস্বার্থ রক্ষা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারে—কথাটা ঠিক না–ও হতে পারে। এর চেয়ে একটি কর্তৃত্বপরায়ণ অথচ শৃঙ্খলাপূর্ণ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাও উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে আমরা শুনছি, উন্নয়ন ও জঙ্গি অবদমনের স্বার্থে কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যবস্থা মেনে নাও। কেউ বলবেন মেনে নেব, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাটা দিতে হবে। কোনো মতবাদের নামেই লুটপাট গ্রহণযোগ্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পরে একাধিকবার আমরা সামরিক হস্তক্ষেপ দেখেছি এবং বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলোকে আমরা তাকে স্বাগত জানাতেও দেখেছি।
ব্রিটিশ ও চীনা শাসনব্যবস্থার সংমিশ্রণে একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সংবিধানেই সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। ওই পর্যবেক্ষকের কাছে মিয়ানমারের ক্ষমতাকাঠামোর যে বিবরণ পেলাম, তাতে আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেছি। স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দেশে তিনটি আলাদা মন্ত্রণালয়। মিয়ানমারে এর সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উপরন্তু, সীমান্ত বিষয় দেখভালের জন্য আবার একটি পৃথক মন্ত্রণালয় আছে। এখন এই স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষেয়র সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়টির নিয়ন্ত্রণও সরাসরি সামরিক বাহিনীর কাছে থাকবে। সু চি যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছেন, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদে থাকবেন জেনারেলরা। এই অর্থে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একজন ক্ষমতাহীন জননেত্রীর ভূমিধস বিজয়কে মেনে নেওয়ার ভূমিকায় প্রাণবন্ত অভিনয় করতে পারছেন।
জেনারেলরাও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের কার্ড’ ব্যবহার করেছেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা জাতিগতভাবে বর্মি হিসেবে পরিচিত। বাঙালির মতো। কিন্তু সম্পদশালী রাজ্যগুলো জাতিগত সংখ্যালঘুদের দখলে। তাই জেনারেলরা বলেছেন, এটা বর্মিদের দেশ। তাই সম্পদের বণ্টন অঞ্চল বিবেচনায় হবে না। জাতিগত সংখ্যালঘুদের দুঃখটা একাত্তর–পূর্ব বাঙালির মতো। আমরা বলেছিলাম, জেনারেল-অধ্যুষিত পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী সব লুটে নিচ্ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে চাকরি চাই। বৈদেশিক সাহায্যে ভাগ চাই। খনিজ সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চাই। মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুরাও তা-ই বলছে। কিন্তু পাচ্ছে না। গণতন্ত্র না এলে তারা তা পাবে না।
মিয়ানমারের সমস্যা আমাদের চেয়ে কম কঠিন নয়। কারণ, সেখানে সাতটি প্রধান (মোট ১৩৫টি) জাতিগত সংখ্যালঘুতে দেশের জনসংখ্যা বিভক্ত। তারা হলো শান, কারেন, চিন, মন, রাখাইন, কাচিন ও তাইয়া। মিয়ানমারের শাসক জেনারেল, যাঁদের বেশির ভাগ বর্মি, তাঁরা এই জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির আওতায় পরিচালনা করছেন। একটি উদাহরণ দিই। কাচিন প্রদেশটি একদা স্বাধীন ছিল। গণভোট ছাড়াই তাদের মিয়ানমারের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। বহুকাল ধরে জাতিগত সংখ্যালঘু কাচিনদের জীবনে সত্তরের বাঙালির পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী হয়ে আছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি সম্প্রদায়ের জেনারেলরা। পাঞ্জাবিরা পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদকে ‘জাতীয় সম্পদ’ বিবেচনায় যথেচ্ছ ভোগ করত। পাঞ্জাবিরা একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঙালিদের কথা শুনতে চায়নি। একইভাবে অভিন্ন ধর্মের হয়েও বর্মি জেনারেলরা বলেন, জাতিগত সংখ্যালঘুর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না। গত বছর কাচিন প্রদেশের পান্না পাথর বিক্রি করে ৩১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন জেনারেলরা। এটা হলো সেই ভয়ংকর মিলবিজ, মানে মিলিটারি বিজনেস। দেশটির সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ প্রাকৃতিক সম্পদ সেনা মালিকানাধীন এমইএইচএলের (মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড) করতলগত। আঞ্চলিক সরকারগুলোর ক্ষমতা আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মতো। হাটবাজারের ওপর রাজস্ব আদায় করে চলে।
সু চি দুঃখজনকভাবে কেবল যে রোহিঙ্গা প্রশ্নে নীরব, তা কিন্তু নয়; শাসনগত বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রশ্নে তিনি এখনো তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেননি। তবে এটা দেখার বিষয় যে সু চি এতটা পথ কিন্তু অহিংস নীতি নিয়ে এসেছেন। তিনি নিজেই বলছেন যে সংবিধান সংশোধন তাঁর অগ্রাধিকার নয়। তাঁর অগ্রাধিকার সরকারব্যবস্থা শোধরানোর। আসলে তিনি চাইলেও অহিংস নীতি দিয়ে সংবিধানে হাত দিতে পারবেন না। আবার সেটা বাকি রাখলে সরকারব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনা যাবে না।
তবে আপাতত সু চির অহিংস নীতির সাফল্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চাই। যদিও তিনি বলেছেন, ‘অনেকের বিশ্বাস, আমি নৈতিক কারণে অহিংস নীতিতে চলছি। কিন্তু তা নয়, বাস্তব রাজনৈতিক কারণে অহিংস পথ বেছে নিয়েছি।’ আমাদের নেতারা এই পাঠ নিলে আমরা বেঁচে যাই। বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক হিংসাত্মক লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি, যাতে শতাধিক নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, সেটা কি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আকস্মিক কোনো ঘটনা? এরশাদবিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহালের আন্দোলনে কত লাশ পড়েছিল? সুচি যা পারছেন, তা আমরা পারছি না কেন? এর কারণ কতটা ক্ষমতা-ক্ষুধায়, কতটা রাজনীতিতে, কতটা সংস্কৃতিতে, কতটা ধর্মে, তা আমি জানি না। তবে আমরা এক অহিংস বাংলাদেশের স্বপ্নের জাল বুনব।
একটা হাঁসফাঁস করা অবস্থার মধ্যে আমরা ঘরের কাছে একটি নতুন আলোকবর্তিকা দেখলাম। মার্টিন লুথার কিং ও গান্ধীজির অনুসারী হয়ে ম্যান্ডেলা ইতিহাস গড়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ক্ষমতায় না থেকেও দেশপ্রেমিক এবং জাতীয় উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখা সম্ভব। তবে গান্ধী থেকে সু চির পরিস্থিতি ভিন্ন। সেটা অন্তত এই অর্থে যে গান্ধী পরাধীন ব্যবস্থায় থেকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন। কিন্তু সু চি গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন এবং লড়ছেন একটি স্বাধীন হওয়া সামরিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে। সু চি এতে কীভাবে সফল হবেন, কী করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সুবিধা না বিলিয়ে সততার সঙ্গে একটা অংশীদারত্ব গড়েন, সেটা দেখতেই অপেক্ষায় থাকব। রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির অন্যায্য নীতিকে দেশটির গণতন্ত্রায়ণের বাধা থেকে আলাদা করা যাবে না। প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো শর্ত আরোপ করা ঠিক হবে না। রোহিঙ্গা সমস্যাকে যতটা সম্ভব পৃথকভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উল্লিখিত রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে সহজেই বলা যায়, অং সান সু চি আমাদের চোখের সামনে এমন একটি ইতিহাস গড়ছেন, যার কোনো তুলনা নেই। ইন্দিরা, বেনজির, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা—প্রত্যেকের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার আছে। সুচিরও আছে। সুচি মিয়ানমারের জাতির পিতা অং সানের কন্যা। এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সু চি বুঝি নীরবে একটি প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন এবং এবারের নির্বাচনে তারই সুফল পেয়েছেন। কিন্তু রেঙ্গুনে আট বছরের বেশি সময় ধরে থাকা একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে সেই ভুল ভাঙল। সু চি দল গড়তে পারেননি। অবশ্য তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের নেত্রীদের নামের জাদু আছে। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের বিজয়কে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে। সু চি প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ালে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হতেন। এবারের নির্বাচন সম্পর্কে তাই বলা চলে, এনএলডির প্রতীক নিয়ে কলাগাছও জয়ী হয়েছে। তাই মিয়ানমারে যে নির্বাচনটা হলো, সেটা আসলে বারাক ওবামার নির্বাচনে জেতার মতো একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কিন্তু তফাত হলো, সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না।
ইয়াহিয়া যেটা জানতেন না, সেটা বর্মি সামরিক জান্তার জানা ছিল। তাই তাঁরা সংবিধান এমনভাবে রচনা করেছেন যে নির্বাচনী ফলাফল যাতে তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারে। এনএলডির নির্বাচনী বিজয় জেনারেলদের অবাক করেছে বলে মনে হয় না। তাঁরা বহু বছর ধরে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই তবে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন দিয়েছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে কারণে ভোটদানসর্বস্ব গণতন্ত্রকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করি, মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও সেভাবেই দেখতে চাই। কারণ, মিয়ানমারের জনগণ যেভাবে ‘কলাগাছ’ মার্কায় ভোট দিয়ে গণতন্ত্র উৎসব করেছেন, তা একটি গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে। গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার বড় বেশি মৌলিক ঘাটতির মধ্যে একটি নির্বাচন হয়েছে।
নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে জেনারেলরা বিশ্ববাসীকে যা দেখিয়েছেন, তা তাঁদের আসল পরিচয় নয়; বরং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের সাফল্যের মুকুটে শুধু রঙিন পালক যুক্ত করেছেন। তবে তার অর্থ এই নয় যে অং সান সু চির সামনে রাজনৈতিক দলভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেননি। বিষয়টি এখন সু চির ওপর নির্ভর করছে, তিনি কীভাবে অর্জিত বিজয়কে ব্যবহার করবেন। তিনি যদি আজীবন ক্ষমতা কিংবা দলীয় ক্ষমতার পাদপ্রদীপে থাকতে চান, তাহলে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা আগের মতোই নাজুক থেকে যেতে পারে। সু চি কোন দিকে তাকাবেন? ম্যান্ডেলার দিকে, নাকি তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলো অভাগা দেশের দিকে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাঁর জন্য ম্যান্ডেলা হওয়া কঠিন, কারণ ম্যান্ডেলা ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন, কিন্তু স্বেচ্ছায় হননি। সু চির সামনে সেই পথ আপাতত রুদ্ধ।
সামরিকায়নের বিরুদ্ধে লড়তে সু চির এখন উচিত হবে সর্বশক্তি দিয়ে রাজনৈতিক দলব্যবস্থা গড়ে তোলা। কারণ, দলব্যবস্থা গঠন করতে না পারলে ভোট কোনো কাজে দেবে না। ক্ষমতাপ্রেমী দেশপ্রেমিক হতে না চাইলে তিনি সেটা পারবেন, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নেই। পরিবারতন্ত্র থেকে তিনি বহু তফাতে আছেন। ছেলে, মেয়ে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, তাঁর আশপাশে কেউ নেই।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম ব্যবহার এবং বৃহত্তর জনস্বার্থ রক্ষা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারে—কথাটা ঠিক না–ও হতে পারে। এর চেয়ে একটি কর্তৃত্বপরায়ণ অথচ শৃঙ্খলাপূর্ণ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাও উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে আমরা শুনছি, উন্নয়ন ও জঙ্গি অবদমনের স্বার্থে কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যবস্থা মেনে নাও। কেউ বলবেন মেনে নেব, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাটা দিতে হবে। কোনো মতবাদের নামেই লুটপাট গ্রহণযোগ্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পরে একাধিকবার আমরা সামরিক হস্তক্ষেপ দেখেছি এবং বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলোকে আমরা তাকে স্বাগত জানাতেও দেখেছি।
ব্রিটিশ ও চীনা শাসনব্যবস্থার সংমিশ্রণে একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সংবিধানেই সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। ওই পর্যবেক্ষকের কাছে মিয়ানমারের ক্ষমতাকাঠামোর যে বিবরণ পেলাম, তাতে আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেছি। স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দেশে তিনটি আলাদা মন্ত্রণালয়। মিয়ানমারে এর সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উপরন্তু, সীমান্ত বিষয় দেখভালের জন্য আবার একটি পৃথক মন্ত্রণালয় আছে। এখন এই স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তবিষেয়র সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়টির নিয়ন্ত্রণও সরাসরি সামরিক বাহিনীর কাছে থাকবে। সু চি যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছেন, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদে থাকবেন জেনারেলরা। এই অর্থে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একজন ক্ষমতাহীন জননেত্রীর ভূমিধস বিজয়কে মেনে নেওয়ার ভূমিকায় প্রাণবন্ত অভিনয় করতে পারছেন।
জেনারেলরাও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের কার্ড’ ব্যবহার করেছেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা জাতিগতভাবে বর্মি হিসেবে পরিচিত। বাঙালির মতো। কিন্তু সম্পদশালী রাজ্যগুলো জাতিগত সংখ্যালঘুদের দখলে। তাই জেনারেলরা বলেছেন, এটা বর্মিদের দেশ। তাই সম্পদের বণ্টন অঞ্চল বিবেচনায় হবে না। জাতিগত সংখ্যালঘুদের দুঃখটা একাত্তর–পূর্ব বাঙালির মতো। আমরা বলেছিলাম, জেনারেল-অধ্যুষিত পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী সব লুটে নিচ্ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে চাকরি চাই। বৈদেশিক সাহায্যে ভাগ চাই। খনিজ সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চাই। মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুরাও তা-ই বলছে। কিন্তু পাচ্ছে না। গণতন্ত্র না এলে তারা তা পাবে না।
মিয়ানমারের সমস্যা আমাদের চেয়ে কম কঠিন নয়। কারণ, সেখানে সাতটি প্রধান (মোট ১৩৫টি) জাতিগত সংখ্যালঘুতে দেশের জনসংখ্যা বিভক্ত। তারা হলো শান, কারেন, চিন, মন, রাখাইন, কাচিন ও তাইয়া। মিয়ানমারের শাসক জেনারেল, যাঁদের বেশির ভাগ বর্মি, তাঁরা এই জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতির আওতায় পরিচালনা করছেন। একটি উদাহরণ দিই। কাচিন প্রদেশটি একদা স্বাধীন ছিল। গণভোট ছাড়াই তাদের মিয়ানমারের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। বহুকাল ধরে জাতিগত সংখ্যালঘু কাচিনদের জীবনে সত্তরের বাঙালির পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী হয়ে আছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি সম্প্রদায়ের জেনারেলরা। পাঞ্জাবিরা পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদকে ‘জাতীয় সম্পদ’ বিবেচনায় যথেচ্ছ ভোগ করত। পাঞ্জাবিরা একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঙালিদের কথা শুনতে চায়নি। একইভাবে অভিন্ন ধর্মের হয়েও বর্মি জেনারেলরা বলেন, জাতিগত সংখ্যালঘুর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না। গত বছর কাচিন প্রদেশের পান্না পাথর বিক্রি করে ৩১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন জেনারেলরা। এটা হলো সেই ভয়ংকর মিলবিজ, মানে মিলিটারি বিজনেস। দেশটির সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ প্রাকৃতিক সম্পদ সেনা মালিকানাধীন এমইএইচএলের (মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড) করতলগত। আঞ্চলিক সরকারগুলোর ক্ষমতা আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মতো। হাটবাজারের ওপর রাজস্ব আদায় করে চলে।
সু চি দুঃখজনকভাবে কেবল যে রোহিঙ্গা প্রশ্নে নীরব, তা কিন্তু নয়; শাসনগত বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রশ্নে তিনি এখনো তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেননি। তবে এটা দেখার বিষয় যে সু চি এতটা পথ কিন্তু অহিংস নীতি নিয়ে এসেছেন। তিনি নিজেই বলছেন যে সংবিধান সংশোধন তাঁর অগ্রাধিকার নয়। তাঁর অগ্রাধিকার সরকারব্যবস্থা শোধরানোর। আসলে তিনি চাইলেও অহিংস নীতি দিয়ে সংবিধানে হাত দিতে পারবেন না। আবার সেটা বাকি রাখলে সরকারব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনা যাবে না।
তবে আপাতত সু চির অহিংস নীতির সাফল্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চাই। যদিও তিনি বলেছেন, ‘অনেকের বিশ্বাস, আমি নৈতিক কারণে অহিংস নীতিতে চলছি। কিন্তু তা নয়, বাস্তব রাজনৈতিক কারণে অহিংস পথ বেছে নিয়েছি।’ আমাদের নেতারা এই পাঠ নিলে আমরা বেঁচে যাই। বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক হিংসাত্মক লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি, যাতে শতাধিক নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে, সেটা কি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আকস্মিক কোনো ঘটনা? এরশাদবিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহালের আন্দোলনে কত লাশ পড়েছিল? সুচি যা পারছেন, তা আমরা পারছি না কেন? এর কারণ কতটা ক্ষমতা-ক্ষুধায়, কতটা রাজনীতিতে, কতটা সংস্কৃতিতে, কতটা ধর্মে, তা আমি জানি না। তবে আমরা এক অহিংস বাংলাদেশের স্বপ্নের জাল বুনব।
একটা হাঁসফাঁস করা অবস্থার মধ্যে আমরা ঘরের কাছে একটি নতুন আলোকবর্তিকা দেখলাম। মার্টিন লুথার কিং ও গান্ধীজির অনুসারী হয়ে ম্যান্ডেলা ইতিহাস গড়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ক্ষমতায় না থেকেও দেশপ্রেমিক এবং জাতীয় উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখা সম্ভব। তবে গান্ধী থেকে সু চির পরিস্থিতি ভিন্ন। সেটা অন্তত এই অর্থে যে গান্ধী পরাধীন ব্যবস্থায় থেকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন। কিন্তু সু চি গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন এবং লড়ছেন একটি স্বাধীন হওয়া সামরিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে। সু চি এতে কীভাবে সফল হবেন, কী করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সুবিধা না বিলিয়ে সততার সঙ্গে একটা অংশীদারত্ব গড়েন, সেটা দেখতেই অপেক্ষায় থাকব। রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির অন্যায্য নীতিকে দেশটির গণতন্ত্রায়ণের বাধা থেকে আলাদা করা যাবে না। প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো শর্ত আরোপ করা ঠিক হবে না। রোহিঙ্গা সমস্যাকে যতটা সম্ভব পৃথকভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
No comments