জঙ্গি নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিপদ by- ড. বদিউল আলম মজুমদার,
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি হত্যাসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনা ঘটে গেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এসব ঘটনার দায় স্বীকার করলেও আমাদের সরকার তা অস্বীকার করছে। বরং সরকারি দলের নেতারা এসব ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছেন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও একই বক্তব্য দিচ্ছে।
শুধু তা-ই নয়, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপি নেতা ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক সাবেক কমিশনারের ভাইসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে যে শিগগিরই এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। দুর্ভাগ্যবশত হত্যার রহস্য এখনো উদ্ঘাটিত তো হয়নিই, বরং এসব ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের সময়কাল ও তাঁদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে সরকার গ্রেপ্তার করেছে।
এরই মধ্যে ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সে আইএসের সন্ত্রাসীদের হামলায় ১৩০ জন নিহত ও চার শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। প্রতিবেশী ভারতও সম্প্রতি আইএসের সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে সতর্কবাণী প্রকাশ করেছে। শোনা যায়, বাংলাদেশকেও নাকি আইএস টার্গেট করে ঘোষণা দিয়েছে। তবু আমাদের সরকার অনড়। বরং প্রধানমন্ত্রী আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে পশ্চিমারা অসৎ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকার করার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে।
তবে গত এক বছরে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, তারা আইএসের সমন্বয়ক বলে নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যেই অস্ত্রশস্ত্র ও জিহাদি বইসহ কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করছে। ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে এবং জঙ্গিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। পরে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও মৌখিকভাবে দেশে জঙ্গির অস্তিত্ব অস্বীকার করছে, তবে সরকারের কার্যক্রমে পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতারই ইঙ্গিত বহন করে।
আমাদের দেশে সত্যিকারার্থে জঙ্গি আছে কি না, তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। বস্তুত আমরা বিভ্রান্ত। সরকারের পক্ষ থেকে দেশে জঙ্গি নেই বলে দাবি করা হলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জঙ্গিরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে জড়াচ্ছে। প্রথম আলোর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন (৮ নভেম্বর ২০১৫) অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৪৯২ জন জঙ্গি—হিযবুত তাহ্রীরের ৪২১, জেএমবির ৪২, হুজির ১৫ ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের চারজন জামিনে বেরিয়ে এসে নানা অপরাধ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
আর যদি জঙ্গি থেকেই থাকে, থাকলে তারা কারা, কী তাদের পরিচয়, তারা কী চায়, কী তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, কী কারণে তারা এত নৃশংস—এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। কত তাদের সংখ্যা, কী তাদের শক্তির উৎস, সে সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। সাধারণত কোনো উৎসাহী অনুসন্ধানী সাংবাদিক বা গবেষক এ ধরনের বিদ্রোহী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তাদের সম্পর্কে বাইরের দুনিয়াকে অবগত করে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এ কাজটি কেউ করেননি।
এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিদের অস্তিত্ব ও তাদের শক্তি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। এমনকি আমরা নিশ্চিত নই আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও জঙ্গিদের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে তাদের পুরো কার্যক্রমই অনুমানভিত্তিক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমতাবস্থায় আমাদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে এ পর্যন্ত আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও ‘সাফল্য’ নিয়ে স্বস্তি বোধ করা দুরূহ।
বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় অনেকেই এখন মনে করেন যে আমাদের বর্তমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ও সহিংসতার পেছনে দুটি কারণ বিরাজমান। এর একটি হলো, একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা, আরেকটি হলো গুরুতর রাজনৈতিক বিরোধ ও জনগণের বঞ্চনা। তবে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, বঞ্চিত ও রাজনৈতিকভাবে চরম ক্ষুব্ধ এবং চরম উগ্রবাদী শক্তিসমূহ এখনো একাকার হয়ে যায়নি, তারা তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছে ও সহিংসতা চালাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের একীভূত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা অনেক দেশেই ঘটেছে।
এই প্রসঙ্গে আফগানিস্তানের উদাহরণ টানা যায়। মার্কিন গবেষক সারাহ চেইস তাঁর থিবস অব স্টেট্স গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে আফগানিস্তানের জনগণের ক্রমাগত ধর্মাশ্রয়ী হওয়ার এবং তালেবানের ব্যাপক উত্থানের পেছনে রয়েছে কারচুপির নির্বাচন ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, যা আফগানদের ক্রমাগতভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে অন্য অনেক দেশেও ধর্মীয় উগ্রবাদের ক্রমবিস্তারের পেছনে রয়েছে একই ধরনের কারণ এবং মানুষের ব্যাপক বঞ্চনা।
এ ছাড়া অনেক বিশ্লেষকের মতে, আমাদের দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপক বিভাজন বিরাজমান। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সম্পর্ক চরম শত্রুতামূলক। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সহনশীলতা ও সমঝোতার পরিস্থিতি না থাকলে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় দমন–নিপীড়ন চললে, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে পৃথিবীর সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে এবং লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেও ধর্মীয় উগ্রবাদ দমন করা সম্ভব হয়নি; বরং এর মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভয়াবহ বিস্তারই ঘটেছে। তাই শুধু অন্ধভাবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্মূলের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আমাদের সাবধান হতে হবে।
একইভাবে আমাদের সাবধান হতে হবে চলমান সহিংসতাকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে। যদি সহিংসতার দায় অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়, তাহলে চরম ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে একটি ভয়াবহ সংমিশ্রণ ঘটে যেতে পারে। বস্তুত, ফ্রান্সে দুর্ধর্ষ হামলা চালিয়ে আইএস যেমন চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব নাশকতার হোতাদের পরিবর্তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’-এর সূচনা করুক, তেমনিভাবে আমাদের সন্ত্রাসীরাও চাইছে সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নে লিপ্ত হোক। কারণ, সরকার যদি সত্যিকারের অপরাধীদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে অন্যায়ভাবে দমন-পীড়নে লিপ্ত হয়, তাহলে সন্ত্রাসীরাই শক্তিশালী হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, যদি সরকারের চাপের কারণে, বিএনপির মতো বড় দলের একটি বড় অংশ পুরোপুরি ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রসঙ্গত, আইএসের ভয়াবহ উত্থানের পেছনেও রয়েছে চরম নিগ্রহের শিকার কিছু ইরাকি সুন্নি বা বাথ পার্টির অনেক সদস্যের সেই অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলানো। অনেকেই মনে করেন, আইএসের ব্যাপক সফলতার পেছনে রয়েছে সাদ্দাম হোসেনের অনেক সাবেক উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা ও সেনা কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক সহযোগীর এতে যোগদান।
তাই অনেকেই আজ মনে করেন জঙ্গিবাদের বিপদ মোকাবিলায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য দরকার। সরকার প্রতিপক্ষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করার যে কৌশল নিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় নিয়োজিত এবং সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে, যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা উগ্রবাদকে প্রতিহত করতে পারি। কারণ, উগ্রবাদ শুধু ক্ষমতাসীন দলেরই সমস্যা নয়, এটি দলমত-নির্বিশেষে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যই হুমকিস্বরূপ। আর সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ালেই এ অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা সফল হতে পারব।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
শুধু তা-ই নয়, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপি নেতা ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক সাবেক কমিশনারের ভাইসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে যে শিগগিরই এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। দুর্ভাগ্যবশত হত্যার রহস্য এখনো উদ্ঘাটিত তো হয়নিই, বরং এসব ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের সময়কাল ও তাঁদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে সরকার গ্রেপ্তার করেছে।
এরই মধ্যে ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সে আইএসের সন্ত্রাসীদের হামলায় ১৩০ জন নিহত ও চার শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। প্রতিবেশী ভারতও সম্প্রতি আইএসের সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে সতর্কবাণী প্রকাশ করেছে। শোনা যায়, বাংলাদেশকেও নাকি আইএস টার্গেট করে ঘোষণা দিয়েছে। তবু আমাদের সরকার অনড়। বরং প্রধানমন্ত্রী আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে পশ্চিমারা অসৎ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকার করার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে।
তবে গত এক বছরে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, তারা আইএসের সমন্বয়ক বলে নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যেই অস্ত্রশস্ত্র ও জিহাদি বইসহ কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করছে। ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে এবং জঙ্গিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। পরে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও মৌখিকভাবে দেশে জঙ্গির অস্তিত্ব অস্বীকার করছে, তবে সরকারের কার্যক্রমে পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতারই ইঙ্গিত বহন করে।
আমাদের দেশে সত্যিকারার্থে জঙ্গি আছে কি না, তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। বস্তুত আমরা বিভ্রান্ত। সরকারের পক্ষ থেকে দেশে জঙ্গি নেই বলে দাবি করা হলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জঙ্গিরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে জড়াচ্ছে। প্রথম আলোর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন (৮ নভেম্বর ২০১৫) অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৪৯২ জন জঙ্গি—হিযবুত তাহ্রীরের ৪২১, জেএমবির ৪২, হুজির ১৫ ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের চারজন জামিনে বেরিয়ে এসে নানা অপরাধ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
আর যদি জঙ্গি থেকেই থাকে, থাকলে তারা কারা, কী তাদের পরিচয়, তারা কী চায়, কী তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, কী কারণে তারা এত নৃশংস—এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। কত তাদের সংখ্যা, কী তাদের শক্তির উৎস, সে সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা নেই। সাধারণত কোনো উৎসাহী অনুসন্ধানী সাংবাদিক বা গবেষক এ ধরনের বিদ্রোহী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তাদের সম্পর্কে বাইরের দুনিয়াকে অবগত করে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এ কাজটি কেউ করেননি।
এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিদের অস্তিত্ব ও তাদের শক্তি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। এমনকি আমরা নিশ্চিত নই আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও জঙ্গিদের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে তাদের পুরো কার্যক্রমই অনুমানভিত্তিক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এমতাবস্থায় আমাদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে এ পর্যন্ত আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও ‘সাফল্য’ নিয়ে স্বস্তি বোধ করা দুরূহ।
বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় অনেকেই এখন মনে করেন যে আমাদের বর্তমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ও সহিংসতার পেছনে দুটি কারণ বিরাজমান। এর একটি হলো, একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা, আরেকটি হলো গুরুতর রাজনৈতিক বিরোধ ও জনগণের বঞ্চনা। তবে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, বঞ্চিত ও রাজনৈতিকভাবে চরম ক্ষুব্ধ এবং চরম উগ্রবাদী শক্তিসমূহ এখনো একাকার হয়ে যায়নি, তারা তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছে ও সহিংসতা চালাচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের একীভূত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা অনেক দেশেই ঘটেছে।
এই প্রসঙ্গে আফগানিস্তানের উদাহরণ টানা যায়। মার্কিন গবেষক সারাহ চেইস তাঁর থিবস অব স্টেট্স গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে আফগানিস্তানের জনগণের ক্রমাগত ধর্মাশ্রয়ী হওয়ার এবং তালেবানের ব্যাপক উত্থানের পেছনে রয়েছে কারচুপির নির্বাচন ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, যা আফগানদের ক্রমাগতভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে অন্য অনেক দেশেও ধর্মীয় উগ্রবাদের ক্রমবিস্তারের পেছনে রয়েছে একই ধরনের কারণ এবং মানুষের ব্যাপক বঞ্চনা।
এ ছাড়া অনেক বিশ্লেষকের মতে, আমাদের দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপক বিভাজন বিরাজমান। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সম্পর্ক চরম শত্রুতামূলক। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সহনশীলতা ও সমঝোতার পরিস্থিতি না থাকলে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় দমন–নিপীড়ন চললে, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে পৃথিবীর সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে এবং লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেও ধর্মীয় উগ্রবাদ দমন করা সম্ভব হয়নি; বরং এর মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভয়াবহ বিস্তারই ঘটেছে। তাই শুধু অন্ধভাবে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্মূলের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আমাদের সাবধান হতে হবে।
একইভাবে আমাদের সাবধান হতে হবে চলমান সহিংসতাকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে। যদি সহিংসতার দায় অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়, তাহলে চরম ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে একটি ভয়াবহ সংমিশ্রণ ঘটে যেতে পারে। বস্তুত, ফ্রান্সে দুর্ধর্ষ হামলা চালিয়ে আইএস যেমন চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব নাশকতার হোতাদের পরিবর্তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’-এর সূচনা করুক, তেমনিভাবে আমাদের সন্ত্রাসীরাও চাইছে সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নে লিপ্ত হোক। কারণ, সরকার যদি সত্যিকারের অপরাধীদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে অন্যায়ভাবে দমন-পীড়নে লিপ্ত হয়, তাহলে সন্ত্রাসীরাই শক্তিশালী হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, যদি সরকারের চাপের কারণে, বিএনপির মতো বড় দলের একটি বড় অংশ পুরোপুরি ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রসঙ্গত, আইএসের ভয়াবহ উত্থানের পেছনেও রয়েছে চরম নিগ্রহের শিকার কিছু ইরাকি সুন্নি বা বাথ পার্টির অনেক সদস্যের সেই অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলানো। অনেকেই মনে করেন, আইএসের ব্যাপক সফলতার পেছনে রয়েছে সাদ্দাম হোসেনের অনেক সাবেক উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা ও সেনা কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক সহযোগীর এতে যোগদান।
তাই অনেকেই আজ মনে করেন জঙ্গিবাদের বিপদ মোকাবিলায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য দরকার। সরকার প্রতিপক্ষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করার যে কৌশল নিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় নিয়োজিত এবং সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে, যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা উগ্রবাদকে প্রতিহত করতে পারি। কারণ, উগ্রবাদ শুধু ক্ষমতাসীন দলেরই সমস্যা নয়, এটি দলমত-নির্বিশেষে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যই হুমকিস্বরূপ। আর সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ালেই এ অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা সফল হতে পারব।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments