ধর্ষিতার কান্না by মহিউদ্দিন অদুল
জীবনের
নাম যন্ত্রণা। ধর্ষিতার কান্নার যেন শেষ নেই। বিচার চাইতে এসেও পদে পদে
যন্ত্রণাময় ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। মামলা দায়ের, থানা পুলিশ, হাসপাতাল
আর আদালত কোথায়ও নিস্তার নেই ধর্ষিতা নারীর। বছরের পর বছর বিচার না পেয়ে
ডুকরে কাঁদছে হাজারও ধর্ষিতা। আদালতের বারান্দা হয়ে গেছে তাদের চেনা জায়গা।
মামলার মারপ্যাঁচ, আর প্রভাবশালীদের কৌশলের কাছে মার খাচ্ছে ধর্ষিতার
বিচার পাওয়ার বাসনা। এমনই একজন মিরপুরের এক ধর্ষিতা। যখন ধর্ষিত হয়েছিল তখন
সে ছিল শিশু। তার বয়স ছিল তিন বছর। এখন সে কৈশোরে পা দিয়েছে। সেই ১৯৯৯
সালের ৪ঠা মার্চের কথা। রাজধানীর মিরপুরে ৩ বছরের এই শিশু ধর্ষণের শিকার
হয়। এ নিয়ে পরদিন মিরপুর থানায় সারোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। একই
বছরের ২৩শে জুলাই তাকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেন তদন্ত কর্মকর্তা।
২০০১ সালের ২৪শে জুন তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন হয়। ২০০৩ সালে মামলাটি
ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ স্থানান্তর হয়। ১৯৯৯ সাল
থেকে ২০১৫। দীর্ঘ ১৬ বছরেও মামলাটির বিচারকাজ শেষ হয়নি। ঘটনার পর
গ্রেপ্তারও হয়েছিল সারোয়ার। জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে যায়। এখনও সে লাপাত্তা। এ
ঘটনার এক মাস আগে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ৫ বছরের আরও এক শিশুকে ধর্ষণ করেছিল এই
সারোয়ার। এ ঘটনায় ওই দিনই মিরপুর থানায় মামলা হয়। একই বছরের ৩১শে মার্চ তার
বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। অভিযোগ গঠন হয় পরের বছর ১১ই মার্চ। এ
মামলাটিও ওই ট্রাইব্যুনালে যায়। দুটি ধর্ষণ ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল।
কিন্তু বছরের পর বছর গেলেও বিচার পায়নি ধর্ষিতারা। বরং নানা ভোগান্তি
পোহাচ্ছে ধর্ষিতা ও তাদের পরিবার। শুধু ধর্ষক সারোয়ারের মামলা নয়, ২০০০
সালের ৮ই এপ্রিল মিরপুরেই কাজে যাওয়ার সময় ১৭ বছরের এক গার্মেন্ট শ্রমিককে
অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। এ ব্যাপারে ধর্ষিতার পিতা বাদী হয়ে
মামলা করেন। মামলায় জয়নাল আকবর ও কামাল হোসেনকে আসামি করা হয়। একই বছরের
২৪শে অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। দীর্ঘ ১৫
বছরেও ধর্ষিতার পরিবার বিচার পাননি। কবে পাবেন তাও জানেন না তারা। আরেক
ঘটনা, ২০১১ সালের ১৪ই এপ্রিল সাভারের আশুলিয়া সিকদার মেডিক্যাল সেন্টারে
প্রকাশ্য দিবালোকে ১৭ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। নানা নাটকীয়তার পর
২৬শে এপ্রিল আশুলিয়া থানায় মামলা হয়। একই বছরের ৩রা নভেম্বর আদালতে
আসাদুজ্জামান রনির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এর ১১ দিন পরই মামলাটি
ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এ গেছে। ওই আদালতে মামলাটির
বিচারকাজ শুরু হলেও এ পর্যন্ত ৭ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১ জনের
সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। বাকি সাক্ষীদের এখনও উপস্থিত করতে পারেনি। দুর্ভোগ
লাঘবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৮০ কার্যদিবসে
এসব মামলার নিষ্পত্তির বিধানও করা হয়। তারপরও থমকে আছে সবকিছু।
এ কারণেই মামলার পাহাড় জমছে ট্রাইব্যুনালে। সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকার ৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১২ হাজার ৭৮৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে মতিঝিল, পল্টন, কাফরুল, কদমতলী, শ্যামপুর, সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও শাহজাহানপুর থানার ২ হাজার ৭৪৫টি মামলার বিচারকাজ চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ। ট্রাইব্যুনাল-২-এ গুলশান, ধানমন্ডি, কলাবাগান, উত্তরা, তুরাগ, নিউমার্কেট, লালবাগ, চকবাজার, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, দক্ষিণখান ও ভাটারা থানার ২ হাজার ৪৯২টি মামলা থাকলেও আদালতটি কয়েক মাস ধরে বিচারকশূন্য। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ রমনা, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, শাহবাগ, পল্লবী, বংশাল, গেণ্ডারিয়া, ধামরাই, রূপনগর ও ওয়ারী থানায় ২ হাজার ৩০০টি মামলা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-৪-এ পরিচালিত হয় মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ক্যান্টনমেন্ট, বাড্ডা, খিলগাঁও, খিলক্ষেত, নবাবগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর ও রামপুর থানার মামলা। এ আদালতে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৩০৮টি মামলা আছে। ট্রাইব্যুনাল-৫ এ মিরপুর, শাহআলী, দারুসসালাম, হাজারীবাগ, বিমানবন্দর, সবুজবাগ, মুগদা, দোহার ও ঢাকা রেলওয়ে থানার মামলার বিচারকাজ চলছে। ওই ট্রাইব্যুনালে ১ হাজার ৯৩৮টি মামলার বিচারকাজ চলছে। ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিশেষ পিপি মাহমুদা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষিতার ভোগান্তির কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই। ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে আইনে যাবজ্জীবনের মতো কঠিন শাস্তির বিধান থাকলেও, সেই বিচার পেতে ধর্ষিতাকে যেন আরও বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। হাসপাতাল ও থানা-পুলিশের ঝামেলার পর বিচারপ্রার্থীকে পড়তে হয় আদালতের দীর্ঘসূত্রতায়। সরকারি দায়িত্ব পালনকারী আইনজীবীকেও তাদের টাকা দিতে হয়। আমার কাছে ১৯৯৮ সালের ধর্ষণ মামলাও রয়েছে। ভিকটিম ও তাদের স্বজনরা যথাসময়ে সাক্ষ্য প্রদান করলেও মামলার অপর সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসকের সাক্ষ্যের অভাবে যুগ যুগ ধরে ঝুলে যাচ্ছে মামলার বিচার। অথচ যথাযথ তদারকি থাকলে ট্রাইব্যুনালের পক্ষে নির্ধারিত ১৮০ কার্যবিদসে রায় দেয়া সম্ভব। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর স্পেশাল পিপি আলী আসগর স্বপন বলেন, ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতা হ্রাসে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থা বা নারী সংগঠনগুলো বলছে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, কোন নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে তাকে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। হাসপাতাল, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), থানা পুলিশ, আদালতসহ সব জায়গাতেই তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ধর্ষণের পর পর ধর্ষিতার চিকিৎসা ও মামলার কার্যক্রম একই সঙ্গে চালাতে হয়। কিন্তু চিকিৎসক ও পুলিশের সমান্তরাল এবং যথাযথ ভূমিকার অভাবে তা হচ্ছে না। ফলে ধর্ষণের আলামত সংরক্ষণ, মামলা দায়ের ও প্রমাণের প্রায় সব স্তরে অবহেলা, অদক্ষতা, দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তি লেগেই রয়েছে। এতে বিচার বঞ্চিত হচ্ছে নারী ও শিশু। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। সমাজে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
ভুক্তভোগী, হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র জানায়, পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে যখন তখন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ যৌন অত্যাচারে তারা আহত হচ্ছেন। পালাক্রমের ধর্ষণের ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলছেন কেউ কেউ। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর প্রথমে চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও অনেক নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা জানাজানি ও লোকলজ্জার ভয়ে হাসপাতালেই নিতে চান না। এছাড়া প্রভাবশালী ধর্ষক ও তাদের স্বজনদের চাপে ঘটনা চাপা দিতে গিয়ে চিকিৎসা না দিয়ে দুর্বিষহ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বহু ধর্ষিতার জীবন।
একাধিক চিকিৎসক বলেন, ধর্ষিতাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ভোগান্তির শুরু সেখান থেকেই। অনেক চিকিৎসক পুলিশি মামলার অজুহাতে থানা পুলিশকে আগে জানানোর পরামর্শ দিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেন না। সংগ্রহ করেন না ধর্ষণের আলামতও। জরুরি বিভাগ থেকে তৎক্ষণাত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা হচ্ছে না। দায়িত্ব থাকলেও ওসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ উদ্যোগে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ধর্ষিতাদের খুঁজে বের করে ওসিসিতে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নেয় না। আবার জরুরি বিভাগও বিলম্বে ওসিসিতে পাঠায়। এতে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ওসিসিতে কর্মরতদের অদক্ষতা ও যথাযথ গুরুত্বের অভাবে চিকিৎসা ও থানায় মামলা দায়েরে বিলম্ব হচ্ছে। মামলায় অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ধারাও সংযোজন করা হয় না।
অনেক আইনজীবী বলেন, ধর্ষিতা আগে থানায় গেলে ঘটনাস্থলে তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের নামে দেরি করা হচ্ছে। এতে মামলার আলামত নষ্ট হয়। দেরি করলে বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে আলামত দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে কুমারি মেয়েরা আলামত রক্ষা করতে না জানায় তাদের ধর্ষণের আলামতও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ধর্ষণের শিকার হয়েও অনেক ঘটনা প্রমাণ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। ঘটনা সত্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মেডিক্যাল সনদ সংগ্রহে ঘুষও দিতে হচ্ছে। এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী ধর্ষিতার জবানবন্দিও যথাসময়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। এক্ষেত্রে অজ্ঞতাও কাজ করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে ধর্ষণে মৃত্যুর ঘটনায়ও রেহাই পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
আইনজীবীরা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকরা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অপেক্ষাকৃত গরিব ও অবহেলিত শ্রেণীর নারী-শিশুরা। তারা তদন্ত প্রভাবিত করছে। অভিযোগপত্রের পরিবর্তে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদায় করে নিচ্ছে। আর বাধ্য হয়ে অভিযোগপত্র দিলেও তাতে দীর্ঘ কালক্ষেপণ করে ধর্ষিতার পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে। নিম্ন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হলেও প্রায় প্রতি মাসে ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে দৌড়াতে হয় আদালতে। আইনজীবীদের ফি দিতে দিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। এ পর্বে চলে ধর্ষক পক্ষের মামলা তুলে নেয়ার হুমকি। অভিযোগ গঠনে চলে যায় আরও কয়েক মাস বা বছর। এরপর মামলা সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গেলেও দীর্ঘসূত্রতা থেকে রেহাই মেলে না। পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষের যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না করা, তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য প্রদানে বিলম্ব, আসামি গ্রেপ্তার করতে না পারা ইত্যাদি নানা কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেও মামলা নিষ্পত্তিতে অতিরিক্ত কালক্ষেপণ হচ্ছে। এ বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নির্ধারিত ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাতে শেষ না হলে আরও ৩০ কার্যদিবস সময় বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু ওই সময় পার হলে করণীয় কী আইনে তা উল্লেখ নেই। এই সুযোগেই বছর পেরিয়ে যুগ পার করছে একের পর এক মামলা। দিনে দিনে জমছে মামলার পাহাড়।
এ কারণেই মামলার পাহাড় জমছে ট্রাইব্যুনালে। সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকার ৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১২ হাজার ৭৮৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে মতিঝিল, পল্টন, কাফরুল, কদমতলী, শ্যামপুর, সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও শাহজাহানপুর থানার ২ হাজার ৭৪৫টি মামলার বিচারকাজ চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ। ট্রাইব্যুনাল-২-এ গুলশান, ধানমন্ডি, কলাবাগান, উত্তরা, তুরাগ, নিউমার্কেট, লালবাগ, চকবাজার, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, দক্ষিণখান ও ভাটারা থানার ২ হাজার ৪৯২টি মামলা থাকলেও আদালতটি কয়েক মাস ধরে বিচারকশূন্য। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ রমনা, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, শাহবাগ, পল্লবী, বংশাল, গেণ্ডারিয়া, ধামরাই, রূপনগর ও ওয়ারী থানায় ২ হাজার ৩০০টি মামলা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-৪-এ পরিচালিত হয় মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ক্যান্টনমেন্ট, বাড্ডা, খিলগাঁও, খিলক্ষেত, নবাবগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর ও রামপুর থানার মামলা। এ আদালতে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৩০৮টি মামলা আছে। ট্রাইব্যুনাল-৫ এ মিরপুর, শাহআলী, দারুসসালাম, হাজারীবাগ, বিমানবন্দর, সবুজবাগ, মুগদা, দোহার ও ঢাকা রেলওয়ে থানার মামলার বিচারকাজ চলছে। ওই ট্রাইব্যুনালে ১ হাজার ৯৩৮টি মামলার বিচারকাজ চলছে। ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিশেষ পিপি মাহমুদা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষিতার ভোগান্তির কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই। ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে আইনে যাবজ্জীবনের মতো কঠিন শাস্তির বিধান থাকলেও, সেই বিচার পেতে ধর্ষিতাকে যেন আরও বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। হাসপাতাল ও থানা-পুলিশের ঝামেলার পর বিচারপ্রার্থীকে পড়তে হয় আদালতের দীর্ঘসূত্রতায়। সরকারি দায়িত্ব পালনকারী আইনজীবীকেও তাদের টাকা দিতে হয়। আমার কাছে ১৯৯৮ সালের ধর্ষণ মামলাও রয়েছে। ভিকটিম ও তাদের স্বজনরা যথাসময়ে সাক্ষ্য প্রদান করলেও মামলার অপর সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসকের সাক্ষ্যের অভাবে যুগ যুগ ধরে ঝুলে যাচ্ছে মামলার বিচার। অথচ যথাযথ তদারকি থাকলে ট্রাইব্যুনালের পক্ষে নির্ধারিত ১৮০ কার্যবিদসে রায় দেয়া সম্ভব। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর স্পেশাল পিপি আলী আসগর স্বপন বলেন, ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতা হ্রাসে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থা বা নারী সংগঠনগুলো বলছে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, কোন নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে তাকে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। হাসপাতাল, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), থানা পুলিশ, আদালতসহ সব জায়গাতেই তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ধর্ষণের পর পর ধর্ষিতার চিকিৎসা ও মামলার কার্যক্রম একই সঙ্গে চালাতে হয়। কিন্তু চিকিৎসক ও পুলিশের সমান্তরাল এবং যথাযথ ভূমিকার অভাবে তা হচ্ছে না। ফলে ধর্ষণের আলামত সংরক্ষণ, মামলা দায়ের ও প্রমাণের প্রায় সব স্তরে অবহেলা, অদক্ষতা, দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তি লেগেই রয়েছে। এতে বিচার বঞ্চিত হচ্ছে নারী ও শিশু। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। সমাজে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
ভুক্তভোগী, হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র জানায়, পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে যখন তখন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা। নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ যৌন অত্যাচারে তারা আহত হচ্ছেন। পালাক্রমের ধর্ষণের ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলছেন কেউ কেউ। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর প্রথমে চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও অনেক নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা জানাজানি ও লোকলজ্জার ভয়ে হাসপাতালেই নিতে চান না। এছাড়া প্রভাবশালী ধর্ষক ও তাদের স্বজনদের চাপে ঘটনা চাপা দিতে গিয়ে চিকিৎসা না দিয়ে দুর্বিষহ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বহু ধর্ষিতার জীবন।
একাধিক চিকিৎসক বলেন, ধর্ষিতাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ভোগান্তির শুরু সেখান থেকেই। অনেক চিকিৎসক পুলিশি মামলার অজুহাতে থানা পুলিশকে আগে জানানোর পরামর্শ দিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেন না। সংগ্রহ করেন না ধর্ষণের আলামতও। জরুরি বিভাগ থেকে তৎক্ষণাত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা হচ্ছে না। দায়িত্ব থাকলেও ওসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ উদ্যোগে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ধর্ষিতাদের খুঁজে বের করে ওসিসিতে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নেয় না। আবার জরুরি বিভাগও বিলম্বে ওসিসিতে পাঠায়। এতে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ওসিসিতে কর্মরতদের অদক্ষতা ও যথাযথ গুরুত্বের অভাবে চিকিৎসা ও থানায় মামলা দায়েরে বিলম্ব হচ্ছে। মামলায় অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ধারাও সংযোজন করা হয় না।
অনেক আইনজীবী বলেন, ধর্ষিতা আগে থানায় গেলে ঘটনাস্থলে তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের নামে দেরি করা হচ্ছে। এতে মামলার আলামত নষ্ট হয়। দেরি করলে বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে আলামত দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে কুমারি মেয়েরা আলামত রক্ষা করতে না জানায় তাদের ধর্ষণের আলামতও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ধর্ষণের শিকার হয়েও অনেক ঘটনা প্রমাণ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। ঘটনা সত্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মেডিক্যাল সনদ সংগ্রহে ঘুষও দিতে হচ্ছে। এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী ধর্ষিতার জবানবন্দিও যথাসময়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। এক্ষেত্রে অজ্ঞতাও কাজ করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে ধর্ষণে মৃত্যুর ঘটনায়ও রেহাই পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
আইনজীবীরা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকরা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অপেক্ষাকৃত গরিব ও অবহেলিত শ্রেণীর নারী-শিশুরা। তারা তদন্ত প্রভাবিত করছে। অভিযোগপত্রের পরিবর্তে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদায় করে নিচ্ছে। আর বাধ্য হয়ে অভিযোগপত্র দিলেও তাতে দীর্ঘ কালক্ষেপণ করে ধর্ষিতার পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে। নিম্ন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হলেও প্রায় প্রতি মাসে ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে দৌড়াতে হয় আদালতে। আইনজীবীদের ফি দিতে দিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। এ পর্বে চলে ধর্ষক পক্ষের মামলা তুলে নেয়ার হুমকি। অভিযোগ গঠনে চলে যায় আরও কয়েক মাস বা বছর। এরপর মামলা সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গেলেও দীর্ঘসূত্রতা থেকে রেহাই মেলে না। পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষের যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না করা, তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য প্রদানে বিলম্ব, আসামি গ্রেপ্তার করতে না পারা ইত্যাদি নানা কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেও মামলা নিষ্পত্তিতে অতিরিক্ত কালক্ষেপণ হচ্ছে। এ বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নির্ধারিত ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাতে শেষ না হলে আরও ৩০ কার্যদিবস সময় বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু ওই সময় পার হলে করণীয় কী আইনে তা উল্লেখ নেই। এই সুযোগেই বছর পেরিয়ে যুগ পার করছে একের পর এক মামলা। দিনে দিনে জমছে মামলার পাহাড়।
No comments