বগুড়ার শিয়া মসজিদে হামলা by- আলী রীয়াজ
বগুড়ার শিবগঞ্জে মসজিদের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনাকে আমরা ‘আরও একটি হামলার ঘটনা, কিংবা ‘আরও একটি হত্যাকাণ্ড’ বলে বিবেচনা করতে পারি। সরকারি ভাষ্যের মতো করে—যা শুধু বর্তমান সরকারই নয়, অতীতের আরও অনেক সরকার এমনকি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সরকারের ক্ষেত্রেও সমপরিমাণে সত্য, একে আমরা আরেকটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে বিবেচনা করতে পারি। এটি যে একটি মর্মান্তিক ঘটনা, এই বিষয়ে কোনো রকম ভিন্নমতের অবকাশ নেই। নিহত মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবার-পরিজনের প্রতি আমাদের গভীর সহানুভূতি থাকবে। কিন্তু এই হামলার ঘটনার পরিসর আপাতদৃষ্টে সীমিত হলেও এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এই কারণে যে এই হামলা পরিকল্পিত, এই হামলা ঘটেছে মসজিদের অভ্যন্তরে এবং নামাজ পড়া অবস্থায় মুসল্লিরা আক্রান্ত হয়েছেন। এই মসজিদটি শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীদের। ঢাকায় গত ২৩ অক্টোবর তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময়ে হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলার আগে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে পরিকল্পিত হামলার ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। এই দুই ঘটনা প্রমাণ করে যে এই হামলা ও হত্যার ঘটনাগুলো সেক্যুলার লেখক ও প্রকাশক হত্যা ও হত্যার হুমকি প্রদান, ইসলামি চিন্তাবিদদের হত্যা, খ্রিষ্টান পাদরির ওপরে হামলা ও হুমকি এবং বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার ধারা বা ধরনের মধ্যে পড়ে। একটি ধরন বা প্যাটার্নের উপস্থিতি মানেই হলো যে এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা, তাদের সম্পত্তি দখল, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা এখন অহরহই ঘটে। দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী এই অবস্থার মধ্যে কয়েক দশক ধরেই জীবন যাপন করছে। কয়েক দশক আগে অবস্থা ছিল এই যে বড় বড় জাতীয় ঘটনার আড়ালে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য, শক্তি প্রদর্শনের জন্য, ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের আনুকূল্যে এসব ঘটনা ঘটত; এই নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হতো। আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে সংঘটিত অত্যাচারের ঘটনাবলি বিস্মৃত হইনি; বিএনপি-জামায়াতের জোটকর্মীরা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে এই ধরনের ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘বিক্ষিপ্ত’ ঘটনা নিয়মিত ঘটেই চলেছে, এই নিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণতর হয়েছে, গণমাধ্যমে তার খবর যা আসে তা সীমিত মাত্র। ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য ছাড়া এই ধরনের ঘটনা ঘটছে এমন মনে করার কারণ নেই; ফলে তারাই ওইসব ঘটনার সুবিধাভোগী। একইভাবে দেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী—যাদের এক বড় অংশ থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়, বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়, বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা ঘটে এবং তা নিয়ে আলোচনা হয়; কিন্তু এর বেশি কিছু নয়, যতক্ষণ না আমরা আরেক ঘটনার মধ্য দিয়ে এই বৃত্তচক্রে শামিল হই।
শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে হামলার ঘটনাগুলোকে আমরা দেশে ‘সংখ্যালঘু’ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপরে হামলার অংশ বলে বিবেচনা করতে পারি। কেননা, শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্য হলেও ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিবেচনায় তারা সংখ্যালঘু। সুন্নি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ শিয়াদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচরণ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাদের ইসলাম থেকে বাতিল করে দেওয়ার মত সমর্থন করেন। একই বিবেচনায় দেশের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরাও সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সূচনা হয় ১৯১২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহমদিয়া মুসলিম জামাত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই থেকেই আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালু রয়েছে। ১৯১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেওবন্দ ধারা অনুসারীরা জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, এই মাদ্রাসার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মতের প্রসার বন্ধ করা। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি যাঁরা পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন যে এতে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করা হয়েছিল। হেফাজতের বিরুদ্ধে যে সংগঠন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, সেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে যে দাবিদাওয়া তোলা হয়েছিল, তাতেও এই দাবি ছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০৩ সালে এই বিষয়ে একটি পুস্তিকা লিখে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী বা সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগের দুই অংশই আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে আসছে।
মুয়াজ্জিন নিহত ইমামসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ
আহমদিয়ারা ১৯৯০-এর দশক থেকেই বিভিন্ন রকম হামলা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনায় জুমার নামাজের সময় এক বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় তাদের সাতজন। পাকিস্তানভিত্তিক খতমে নবুয়ত আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করার পর থেকে আহমদিয়ারা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছে। ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন ইমাম মোহাম্মদ শাহ আলমকে হত্যা করা হয় (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন আমার গ্রন্থ ইসলামিক মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ: আ কমপ্লেক্স ওয়েব, লন্ডনের রাউটলেজ, ২০০৮, পৃ ৩৫-৩৬)। লক্ষণীয়, আহমদিয়াদের ওপরে এই ধরনের হামলা সত্ত্বেও শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হামলার ঘটনা ঘটেনি।
শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হামলার যেসব ঘটনা, সেগুলোকে একাদিক্রমে সাধারণভাবে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার ও সংখ্যাগুরু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার সম্প্রদায়গত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার একটি ধারা যে একেবারেই ছিল না তা নয়, আহমদিয়াদের ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা ও প্রচার তার প্রমাণ। কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে উপর্যুপরি হামলা প্রমাণ করেছে যে এখন এই বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এই হামলাগুলোকে কেবল এভাবে বিবেচনা করলে তার সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে এই হামলা ও হত্যাকাণ্ডগুলোর অধিকতর উদ্বেগের দিকটি আমাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাবে।
সেই বৃহত্তর প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর শক্তি সঞ্চয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের উপস্থিতির দাবি এবং দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কয়েক দশক ধরেই উপস্থিত, তাদের আঞ্চলিক যোগাযোগও অতীতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দেশে আইএসের উপস্থিতির বিষয় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্য বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলি এই বিষয়ে অবস্থার একধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কয়েক মাস আগেও সাংগঠনিকভাবে আইএসের উপস্থিতি যতটা নিশ্চিতভাবে নাকচ করে দেওয়া সম্ভব হতো, এখন তা সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে। আইএস তার কৌশল পরিবর্তন করেছে, যা সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাগুলোতে স্পষ্ট। আইএসের সাম্প্রতিক প্রকাশনা দাবিক-এ বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকাশিত নিবন্ধে এটা দাবি করা হয়েছে যে বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য আপাতত হলেও মেটাতে পেরেছে, শুধু তা-ই নয়, তারা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচন করতেও সক্ষম হয়েছে। সর্বোপরি এই রচনায় বলা হচ্ছে বাংলাদেশের জঙ্গিরাই যে আইএসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে এবং ‘দ্রুততার সঙ্গে’ আইএসের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘সামরিক অভিযানগুলো’ চালাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমরা এগুলোর আত্মপ্রচার বা প্রোপাগান্ডার দিক বিবেচনায় রাখব। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, যখন আমরা এই ধরনের হামলা দেখতে পাই, যা বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর অতীত আক্রমণের ধারা থেকে আলাদা। শুধু তা-ই নয়, খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদেরও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতির বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে এ বছরের মে মাস থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল যে আইএসের প্রতিনিধি চট্টগ্রামে জেএমবির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্তু দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার পর ভারতীয় গণমাধ্যমে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে উদ্ধৃত করে এর জন্য আইএস নয়, জামায়াতে ইসলামী দায়ী বলে বলা হয়। ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য হিন্দুতে ২৫ নভেম্বর প্রকাশিত এক খবরে বলা হচ্ছে যে জাপানি নাগরিকের হত্যাকারী আইএসের সঙ্গে যুক্ত দুজন ভারতে পালিয়ে গেছে এবং তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতকে তথ্য দিয়েছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অনুসরণ করছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য দ্য হিন্দুকে এ ধরেনর কোেনা তথ্য দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। সম্প্রতি নদীয়া ও মুর্শিদাবাদে আইএসের পোস্টার পাওয়া বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্যে আস্থা রাখলে এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অস্বীকারের প্রবণতাকে সন্দেহের চোখেই দেখতে হবে। একই সঙ্গে এটাও বিস্ময়ের উদ্রেক করে যে এই সপ্তাহে ঢাকার এক আদালতে এক মামলা শুরু হয়েছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইএসের সদস্য বলে বলা হচ্ছে এবং তাদের একজনকে ‘আইএসের সমন্বয়কারী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতির আরেকটি প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। অনেকেই বলবেন যে দেশে যেখানে কার্যত কোনো বিরোধী দল উপস্থিত নেই এবং সর্বত্রই ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রশ্ন উঠছে কেন। উঠছে কেননা, এখন দেশে কার্যত রাজনীতিই অনুপস্থিত হয়ে গেছে। রাজনীতির অনুপস্থিতি, মৌলিক অধিকারগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হওয়া, মত প্রকাশের ক্ষেত্রগুলো সীমিত হওয়া, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উপস্থিতি—এসবই এ ধরনের জঙ্গিবাদ বিকাশের পথে অবদান রাখছে। মনে রাখতে হবে যে এই ঘটনাবলি ঘটছে এমন সময়ে, যখন বৈশ্বিকভাবে উত্তেজনা তুঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের প্রভাবের পরিধি বাড়াতে চাইছে। দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির সুযোগে উগ্র সহিংস চরমপন্থার বিস্তার একবার শুরু হলে তার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয় না। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় জাতীয় নিরাপত্তা, সহিংস চরমপন্থা মোকাবিলা ও তার অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসানের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। তার জন্য উদ্যোগ আসতে হবে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকেই, কিন্তু তারা এই বিষয়ে কতটা আগ্রহী, সেটাই প্রশ্ন।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা, তাদের সম্পত্তি দখল, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা এখন অহরহই ঘটে। দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী এই অবস্থার মধ্যে কয়েক দশক ধরেই জীবন যাপন করছে। কয়েক দশক আগে অবস্থা ছিল এই যে বড় বড় জাতীয় ঘটনার আড়ালে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য, শক্তি প্রদর্শনের জন্য, ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের আনুকূল্যে এসব ঘটনা ঘটত; এই নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হতো। আমরা ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে সংঘটিত অত্যাচারের ঘটনাবলি বিস্মৃত হইনি; বিএনপি-জামায়াতের জোটকর্মীরা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে এই ধরনের ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘বিক্ষিপ্ত’ ঘটনা নিয়মিত ঘটেই চলেছে, এই নিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণতর হয়েছে, গণমাধ্যমে তার খবর যা আসে তা সীমিত মাত্র। ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য ছাড়া এই ধরনের ঘটনা ঘটছে এমন মনে করার কারণ নেই; ফলে তারাই ওইসব ঘটনার সুবিধাভোগী। একইভাবে দেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী—যাদের এক বড় অংশ থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়, বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়, বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা ঘটে এবং তা নিয়ে আলোচনা হয়; কিন্তু এর বেশি কিছু নয়, যতক্ষণ না আমরা আরেক ঘটনার মধ্য দিয়ে এই বৃত্তচক্রে শামিল হই।
শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে হামলার ঘটনাগুলোকে আমরা দেশে ‘সংখ্যালঘু’ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপরে হামলার অংশ বলে বিবেচনা করতে পারি। কেননা, শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্য হলেও ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিবেচনায় তারা সংখ্যালঘু। সুন্নি সম্প্রদায়ের কেউ কেউ শিয়াদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচরণ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাদের ইসলাম থেকে বাতিল করে দেওয়ার মত সমর্থন করেন। একই বিবেচনায় দেশের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরাও সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সূচনা হয় ১৯১২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহমদিয়া মুসলিম জামাত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই থেকেই আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালু রয়েছে। ১৯১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেওবন্দ ধারা অনুসারীরা জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, এই মাদ্রাসার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মতের প্রসার বন্ধ করা। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি যাঁরা পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন যে এতে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করা হয়েছিল। হেফাজতের বিরুদ্ধে যে সংগঠন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, সেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে যে দাবিদাওয়া তোলা হয়েছিল, তাতেও এই দাবি ছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০৩ সালে এই বিষয়ে একটি পুস্তিকা লিখে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী বা সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগের দুই অংশই আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে আসছে।
মুয়াজ্জিন নিহত ইমামসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ
আহমদিয়ারা ১৯৯০-এর দশক থেকেই বিভিন্ন রকম হামলা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনায় জুমার নামাজের সময় এক বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় তাদের সাতজন। পাকিস্তানভিত্তিক খতমে নবুয়ত আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করার পর থেকে আহমদিয়ারা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছে। ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন ইমাম মোহাম্মদ শাহ আলমকে হত্যা করা হয় (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন আমার গ্রন্থ ইসলামিক মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ: আ কমপ্লেক্স ওয়েব, লন্ডনের রাউটলেজ, ২০০৮, পৃ ৩৫-৩৬)। লক্ষণীয়, আহমদিয়াদের ওপরে এই ধরনের হামলা সত্ত্বেও শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হামলার ঘটনা ঘটেনি।
শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপরে হামলার যেসব ঘটনা, সেগুলোকে একাদিক্রমে সাধারণভাবে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার ও সংখ্যাগুরু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার সম্প্রদায়গত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার একটি ধারা যে একেবারেই ছিল না তা নয়, আহমদিয়াদের ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা ও প্রচার তার প্রমাণ। কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরে উপর্যুপরি হামলা প্রমাণ করেছে যে এখন এই বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এই হামলাগুলোকে কেবল এভাবে বিবেচনা করলে তার সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে এই হামলা ও হত্যাকাণ্ডগুলোর অধিকতর উদ্বেগের দিকটি আমাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাবে।
সেই বৃহত্তর প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর শক্তি সঞ্চয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের উপস্থিতির দাবি এবং দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কয়েক দশক ধরেই উপস্থিত, তাদের আঞ্চলিক যোগাযোগও অতীতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দেশে আইএসের উপস্থিতির বিষয় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্য বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলি এই বিষয়ে অবস্থার একধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কয়েক মাস আগেও সাংগঠনিকভাবে আইএসের উপস্থিতি যতটা নিশ্চিতভাবে নাকচ করে দেওয়া সম্ভব হতো, এখন তা সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে। আইএস তার কৌশল পরিবর্তন করেছে, যা সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাগুলোতে স্পষ্ট। আইএসের সাম্প্রতিক প্রকাশনা দাবিক-এ বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকাশিত নিবন্ধে এটা দাবি করা হয়েছে যে বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য আপাতত হলেও মেটাতে পেরেছে, শুধু তা-ই নয়, তারা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচন করতেও সক্ষম হয়েছে। সর্বোপরি এই রচনায় বলা হচ্ছে বাংলাদেশের জঙ্গিরাই যে আইএসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছে এবং ‘দ্রুততার সঙ্গে’ আইএসের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘সামরিক অভিযানগুলো’ চালাচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমরা এগুলোর আত্মপ্রচার বা প্রোপাগান্ডার দিক বিবেচনায় রাখব। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনের উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, যখন আমরা এই ধরনের হামলা দেখতে পাই, যা বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর অতীত আক্রমণের ধারা থেকে আলাদা। শুধু তা-ই নয়, খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদেরও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতির বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে এ বছরের মে মাস থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল যে আইএসের প্রতিনিধি চট্টগ্রামে জেএমবির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কিন্তু দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার পর ভারতীয় গণমাধ্যমে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে উদ্ধৃত করে এর জন্য আইএস নয়, জামায়াতে ইসলামী দায়ী বলে বলা হয়। ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য হিন্দুতে ২৫ নভেম্বর প্রকাশিত এক খবরে বলা হচ্ছে যে জাপানি নাগরিকের হত্যাকারী আইএসের সঙ্গে যুক্ত দুজন ভারতে পালিয়ে গেছে এবং তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতকে তথ্য দিয়েছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অনুসরণ করছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য দ্য হিন্দুকে এ ধরেনর কোেনা তথ্য দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। সম্প্রতি নদীয়া ও মুর্শিদাবাদে আইএসের পোস্টার পাওয়া বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তথ্যে আস্থা রাখলে এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অস্বীকারের প্রবণতাকে সন্দেহের চোখেই দেখতে হবে। একই সঙ্গে এটাও বিস্ময়ের উদ্রেক করে যে এই সপ্তাহে ঢাকার এক আদালতে এক মামলা শুরু হয়েছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইএসের সদস্য বলে বলা হচ্ছে এবং তাদের একজনকে ‘আইএসের সমন্বয়কারী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতির আরেকটি প্রেক্ষাপট হচ্ছে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। অনেকেই বলবেন যে দেশে যেখানে কার্যত কোনো বিরোধী দল উপস্থিত নেই এবং সর্বত্রই ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রশ্ন উঠছে কেন। উঠছে কেননা, এখন দেশে কার্যত রাজনীতিই অনুপস্থিত হয়ে গেছে। রাজনীতির অনুপস্থিতি, মৌলিক অধিকারগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হওয়া, মত প্রকাশের ক্ষেত্রগুলো সীমিত হওয়া, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উপস্থিতি—এসবই এ ধরনের জঙ্গিবাদ বিকাশের পথে অবদান রাখছে। মনে রাখতে হবে যে এই ঘটনাবলি ঘটছে এমন সময়ে, যখন বৈশ্বিকভাবে উত্তেজনা তুঙ্গে এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের প্রভাবের পরিধি বাড়াতে চাইছে। দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির সুযোগে উগ্র সহিংস চরমপন্থার বিস্তার একবার শুরু হলে তার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয় না। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় জাতীয় নিরাপত্তা, সহিংস চরমপন্থা মোকাবিলা ও তার অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসানের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। তার জন্য উদ্যোগ আসতে হবে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকেই, কিন্তু তারা এই বিষয়ে কতটা আগ্রহী, সেটাই প্রশ্ন।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক
No comments