অযোগ্যতাই সংলাপে বসার যোগ্যতা! by- মিজানুর রহমান খান
সংলাপে বসতে বিরোধী দলের প্রস্তাব এবং সরকারি তরফে নাকচ হওয়ায় তেমন বিস্ময়
নেই। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতির সঙ্গে এটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কিন্তু সারা দেশে নাশকতাপূর্ণ জঙ্গিবাদী তৎপরতার প্রেক্ষাপটে বিএনপি
চেয়ারপারসনের সর্বশেষ সংলাপের প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল
কাদেরের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির
সংলাপে বসার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিএনপি পরিষ্কার করতে পারে যে
তারা আগাম নির্বাচন নয়, জঙ্গিবাদ নিয়ে সংলাপ ও জাতীয় ঐক্য চাইছে। সরকারেরও
উচিত বিএনপির প্রস্তাবকে ‘টোটাল রাবিশ’ না বলে কেবল জঙ্গিবাদ মোকাবিলার
জায়গায় এনে একটা আলাপ-আলোচনার দরজা খোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করা। আত্মঘাতী
বোমা হামলার উপদ্রব আবার ফিরে এসেছে। লেবাননে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৩
ব্যক্তি নিহত হওয়ার পরপরই প্যারিসে সন্ত্রাসী ও আত্মঘাতী বোমা হামলায়
প্রাণ হারায় ১৩২ জন। বাংলাদেশে কথিত আইএসের অস্তিত্বের বিষয়টিকে যঁারা
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে এর কার্যক্রম নেই বলে অবিশ্বাস করেছিলেন, প্যারিসের
ঘটনা নিশ্চয়ই তঁাদের ভুল ভেঙে দিয়েছে। লেবাননে দুই ও প্যারিসে আটজন
আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নিহত হয়েছে। বাংলাদেশ এর আগে আত্মঘাতী বোমা
হামলা প্রত্যক্ষ করেছে। জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের এক ডজনের বেশি সদস্য
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে। আদালত চত্বরে দুই বিচারক নিহত হয়েছিলেন আত্মঘাতী
বোমা হামলাকারীর হামলায়।
এ প্রসঙ্গে গত বছরের বসন্তে পরিচালিত ওয়াশিংটনভিত্তিক পিউ ফাউন্ডেশনের জরিপ স্মরণে আনতে চাই। তারা বলেছে, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি (৬৯ ভাগ) ‘ইসলামি জঙ্গিবাদের’ উত্থানে শঙ্কিত। আবার ওই তিন দেশের তুলনায় আল-কায়েদা ও হিজবুল্লাহ বা হামাসের প্রতি সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি (যথাক্রমে ২৩ ও ২৮/২৯ ভাগ) সহানুভূতিশীল। এমনকি আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রতি ওই তিনটি দেশসহ মিসর ও লেবাননের মানুষের চেয়েও সর্বাধিক বাংলাদেশি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ১৪ ভাগ বাংলাদেশি উত্তরদাতা মনে করেন, আত্মঘাতী হামলার বিষয়টি নিয়মিতই গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে ৩৩ ভাগ মনে করেন, এই পথ মাঝেমধ্যে গ্রহণযোগ্য। এই পরিসংখ্যান অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। যাঁরা এটা নাকচ করবেন, তাঁদের যুক্তি নাকচ না করেও বলব, আমাদের সতর্ক হলে ক্ষতি কী। যখনই এ ধরনের ঘটনা দৃশ্যপটে আসে, তখন আমাদের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একদল স্মরণ করেন যে এসব নাশকতা আসলে পাশ্চাত্যের সৃষ্টি, তারাই দায়ী। তাদের যুক্তির জোর অনেকে হয়তো উড়িয়ে দেবেন না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে যা বলব তা হলো, আমাদের যা করণীয় তা আমরা করছি কি না। কারণ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমরা সব সময় নস্যাৎ কিংবা প্রতিহত করতে পারি না। যেটা পারি এবং অবশ্যই করা উচিত, সেটা হলো নিজেদের সাবধান রাখা।
জঙ্গিবাদ কখনো এ মাটিতে শিকড় গাড়তে পারবে না, ঘন ঘন এই অপরীক্ষিত আপ্তবাক্য উচ্চারণ করলেই জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা মজবুত হওয়ার কথা নয়। যাঁরা বলেন, একমাত্র নতুন সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার মধ্যেই এর প্রতিকার, তাঁরা সঠিক নন। যাঁরা বলেন, কেবল অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা বা প্রলম্বিত করার কৌশল গ্রহণটাই সঠিক, তঁারাও সঠিক নন। গণতন্ত্র, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাজনৈতিক সমঝোতা যে সংবিধানের মতো লিখিত দলিলের চেয়ে কত বড় ও কার্যকর, বিশ্বের বুকে তার আরেকটি অবিস্মরণীয় নজির স্থাপন করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী মিয়ানমার। দেশটির সামরিক নেতারা ও অং সান সু চির মধ্যে বোঝাপড়াটাই সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিক। জেনারেল ইয়াহিয়ার এলএফওর চেয়ে অনেক খারাপ এলএফওর অধীনে সু চি নির্বাচনে গেছেন। এর কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যালটের জোরের ওপর সু চি বেশি নির্ভর করেছিলেন।
সু চি কত বেশি ভোট পেয়ে তাঁর সামরিক প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে পারছেন, সেটা গণতন্ত্রের খোলস, আত্মা নয়। যদিও আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী আমরা কিন্তু গণতন্ত্র কন্যার ভূমিধস বিজয়টাকে বড় করে দেখতে এবং দেখানোর কসরত করছি। আমাদের সঠিক পথ হলো জঙ্গিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার মুহূর্তে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করা। অহিংস পন্থায় ধীরেসুস্থে অগ্রসর হওয়া। প্রতিপক্ষের হিংসাশ্রয়ী কর্মসূচির উত্তর হিংসা দিয়েই দেওয়ার যে মহড়া বাংলাদেশে চলছে, তা নিরীহ ও সচেতন মানুষের রক্তক্ষরণকে তীব্র করছে। রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো লক্ষণ বাংলাদেশে নেই। এ থেকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নকে আলাদা করা যাবে না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা পথে প্রতিপক্ষকে দমন কিংবা আপস কিংবা হালুয়া–রুটি বিতরণ করে মুখ বন্ধ রাখার কিছু লক্ষণ অন্তত আমরা দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে অনুধাবন বা অনুমান করতে পারি।
কার্যকর সংলাপ টেবিলে বসে হতেই পারে না, যদি আগেভাগে এর প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের অভ্যন্তরে স্বীকার করা না হয়। অন্যথায় গতানুগতিকভাবে বিএনপি মনে করতে পারে আওয়ামী লীগ এমনই দল, যার সঙ্গে সংলাপ চলে না। আর আওয়ামী লীগও মনে করতে পারে, বিএনপির সঙ্গে বসা যায় না। এমনকি দুই দলের সমর্থক নাগরিক সমাজও বসতে পারে না। আমাদের মনে হয়, এটা ভাবার সময় এসেছে যে এভাবে হঠাৎ করে কোনো সংলাপ হয় না। আশা করাও হয়তো অসমীচীন। সমাজে এর একটা পরিবেশ থাকতে হয়। উভয় পক্ষ একটি সত্যি উচ্চারণ করেছে, সেটা হলো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশ গঠন ছাড়াই আমরা কী করে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে পারি এবং অদূর ভবিষ্যতে এর ফলাফল কী হতে পারে? অনেক বিদগ্ধ জনের মতো সংলাপ ও সমঝোতা বলতে আমি নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলকে বুঝতে চাই না।
আইএসের নামে প্যারিসে যে নিন্দনীয় ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে গেল, সে বিষয়ে সামনের দিনগুলোতে আমাদের মসজিদ ও মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম-ওলামাদের সবাই কি গঠনমূলক ধর্মীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করবেন? আমরা কি মাদ্রাসাশিক্ষা যুগোপযোগী করতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছি? জিডিপির তুলনায় অন্যান্য সব মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন খরচ যে অনুপাতে বাড়ে, সে তুলনায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাড়ে না। বরং সবচেয়ে কম বাড়ে। আন্তধর্ম সংলাপ বিষয়ে একটি নতুন প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, কিন্তু তা এক বছর পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন এটা বোঝার সময় এসেছে যে রাষ্ট্রের এই অপারগতা ও পলায়নপরতা রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ঘাটতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ ঝুঁকি নিতে নারাজ। ‘ইসলামি শক্তি’কে যে যার মতো করে ব্যবহার করতে কারও কোনো অনীহা নেই। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া মাদ্রাসাশিক্ষার সংস্কার–বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ইসলামের শান্তির বাণী যথাযথভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার পথে যত বাধা, তা অপসারণে একটা বৃহত্তর বোঝাপড়া লাগবে। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে জরুরি। সরকার এবং বিএনপি-জামায়াত এ বিষয়ে লিখিত খসড়া রূপরেখা দিতে পারে।
লন্ডনে অবস্থানরত খালেদা জিয়া বাংলাদেশে ‘ক্রান্তিকাল’ চলছে দাবি করে ‘দেশ ও জাতির স্বার্থে’ সংকট উত্তরণে সরকার ‘কর্তৃত্ববাদী মনোভাব’ থেকে সরে এসে ‘জাতীয় সংলাপ’ সূচনার পরিবেশ তৈরি করবে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ তিনি কেবলই নির্বাচন চান? সেতুমন্ত্রী সংলাপ-সেতুর নীতিগত ভিত পরোক্ষভাবে হলেও স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ‘জাতীয় সংলাপ করতে হলে পরিবেশ দরকার। সেই পরিবেশ কারা নষ্ট করছে?’ এ পর্যন্ত যুক্তিসংগত। কিন্তু এরপরের অংশ গোলমেলে, মেঠো রাজনীতির ভাষা। সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘তারা লেখক, প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও পুলিশের ওপর হামলা করছে। তারা রাজনীতিকদের, লেখকদের টার্গেট করেছে। এই পরিবেশ কি সংলাপের পরিবেশ?’ প্রধানমন্ত্রী কিন্তু যোগ্যতার যে শর্ত দিয়েছেন তা সেতুমন্ত্রীর চেয়ে ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শর্ত সাপেক্ষে প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো খুনির সঙ্গে সংলাপে বসার ইচ্ছা নেই। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সমর্থন দিলে সংলাপের বিষয়টি তিনি ভেবে দেখবেন।’
তাহলে প্রশ্ন উঠবে, একদিন যখন এই বিচারপর্ব শেষ হবে, এর প্রতি সমর্থন দেওয়া না দেওয়া প্রসঙ্গ হারাবে, সেদিন
কি সংলাপ হবে? এর উত্তর হ্যাঁ ধরে নিতে পারলে আশ্বস্ত হতাম। সংলাপ মানে নতুন নির্বাচন, আর নির্বাচন মানেই বিরোধী দলের সম্পূর্ণ জয়, এই অনুমানও সংলাপ হওয়ার পথে অন্তরায়। সংলাপ না করেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করা গেছে। এ রকম আরও একটি নির্বাচন করার চেষ্টা হলে তা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকে আরও শিথিল করে দিতে পারে। আর তখন তা আরও বেশি অবনতিশীলভাবে জঙ্গিবাদকে উসকে দিতে পারে। এখন জঙ্গিবাদকেই মনে হচ্ছে সাংবিধানিক শাসনের পথে বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
উদীচী, রমনা বটমূল, ২১ আগস্ট ও ৬৪ জেলায় যখন বোমা ফাটানোর ঘটনা ঘটে, তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি ছিল না। হোসেনি দালানে হামলার ঘটনা গোষ্ঠীগত সহিংসতা (সেক্টেরিয়ান ভায়োলেন্স) সৃষ্টিরই ইঙ্গিতবহ। শ্রেণি হিসেবে এর আগে বিচারক হত্যার পর এবার পুলিশ হত্যা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা দেখছি। এখন সরকার যদি সত্যি সন্দেহ করে যে এসবই বিএনপির কাজ, কৌশলগত, তাহলে কিন্তু বিএনপির সঙ্গে এই ইস্যুতে সংলাপে বসার আহ্বান নাকচ করার যুক্তি থাকে না। বরং উল্টোটা হওয়ার কথা, সরকার সংলাপে বসতে চাইছে, ‘জঙ্গি’ বিএনপি নাকচ করছে। উভয়ে উভয়ের প্রতি উচ্চারিত সংজ্ঞায় যোগ্যতা-অযোগ্যতা আমরা খণ্ডন করতে যাব না। কিন্তু এমন একটি প্রশ্ন তো তোলাই যেতে পারে; সরকার যে কারণে বিএনপিকে সংলাপে বসার জন্য ‘অযোগ্য’ বলে মনে করছে, সেই অযোগ্যতাই আসলে তাদের সঙ্গে সংলাপে বসার যোগ্যতা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
এ প্রসঙ্গে গত বছরের বসন্তে পরিচালিত ওয়াশিংটনভিত্তিক পিউ ফাউন্ডেশনের জরিপ স্মরণে আনতে চাই। তারা বলেছে, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি (৬৯ ভাগ) ‘ইসলামি জঙ্গিবাদের’ উত্থানে শঙ্কিত। আবার ওই তিন দেশের তুলনায় আল-কায়েদা ও হিজবুল্লাহ বা হামাসের প্রতি সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি (যথাক্রমে ২৩ ও ২৮/২৯ ভাগ) সহানুভূতিশীল। এমনকি আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রতি ওই তিনটি দেশসহ মিসর ও লেবাননের মানুষের চেয়েও সর্বাধিক বাংলাদেশি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ১৪ ভাগ বাংলাদেশি উত্তরদাতা মনে করেন, আত্মঘাতী হামলার বিষয়টি নিয়মিতই গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে ৩৩ ভাগ মনে করেন, এই পথ মাঝেমধ্যে গ্রহণযোগ্য। এই পরিসংখ্যান অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। যাঁরা এটা নাকচ করবেন, তাঁদের যুক্তি নাকচ না করেও বলব, আমাদের সতর্ক হলে ক্ষতি কী। যখনই এ ধরনের ঘটনা দৃশ্যপটে আসে, তখন আমাদের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একদল স্মরণ করেন যে এসব নাশকতা আসলে পাশ্চাত্যের সৃষ্টি, তারাই দায়ী। তাদের যুক্তির জোর অনেকে হয়তো উড়িয়ে দেবেন না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে যা বলব তা হলো, আমাদের যা করণীয় তা আমরা করছি কি না। কারণ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আমরা সব সময় নস্যাৎ কিংবা প্রতিহত করতে পারি না। যেটা পারি এবং অবশ্যই করা উচিত, সেটা হলো নিজেদের সাবধান রাখা।
জঙ্গিবাদ কখনো এ মাটিতে শিকড় গাড়তে পারবে না, ঘন ঘন এই অপরীক্ষিত আপ্তবাক্য উচ্চারণ করলেই জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা মজবুত হওয়ার কথা নয়। যাঁরা বলেন, একমাত্র নতুন সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার মধ্যেই এর প্রতিকার, তাঁরা সঠিক নন। যাঁরা বলেন, কেবল অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা বা প্রলম্বিত করার কৌশল গ্রহণটাই সঠিক, তঁারাও সঠিক নন। গণতন্ত্র, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাজনৈতিক সমঝোতা যে সংবিধানের মতো লিখিত দলিলের চেয়ে কত বড় ও কার্যকর, বিশ্বের বুকে তার আরেকটি অবিস্মরণীয় নজির স্থাপন করতে যাচ্ছে প্রতিবেশী মিয়ানমার। দেশটির সামরিক নেতারা ও অং সান সু চির মধ্যে বোঝাপড়াটাই সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিক। জেনারেল ইয়াহিয়ার এলএফওর চেয়ে অনেক খারাপ এলএফওর অধীনে সু চি নির্বাচনে গেছেন। এর কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যালটের জোরের ওপর সু চি বেশি নির্ভর করেছিলেন।
সু চি কত বেশি ভোট পেয়ে তাঁর সামরিক প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে পারছেন, সেটা গণতন্ত্রের খোলস, আত্মা নয়। যদিও আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী আমরা কিন্তু গণতন্ত্র কন্যার ভূমিধস বিজয়টাকে বড় করে দেখতে এবং দেখানোর কসরত করছি। আমাদের সঠিক পথ হলো জঙ্গিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার মুহূর্তে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করা। অহিংস পন্থায় ধীরেসুস্থে অগ্রসর হওয়া। প্রতিপক্ষের হিংসাশ্রয়ী কর্মসূচির উত্তর হিংসা দিয়েই দেওয়ার যে মহড়া বাংলাদেশে চলছে, তা নিরীহ ও সচেতন মানুষের রক্তক্ষরণকে তীব্র করছে। রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো লক্ষণ বাংলাদেশে নেই। এ থেকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নকে আলাদা করা যাবে না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা পথে প্রতিপক্ষকে দমন কিংবা আপস কিংবা হালুয়া–রুটি বিতরণ করে মুখ বন্ধ রাখার কিছু লক্ষণ অন্তত আমরা দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে অনুধাবন বা অনুমান করতে পারি।
কার্যকর সংলাপ টেবিলে বসে হতেই পারে না, যদি আগেভাগে এর প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের অভ্যন্তরে স্বীকার করা না হয়। অন্যথায় গতানুগতিকভাবে বিএনপি মনে করতে পারে আওয়ামী লীগ এমনই দল, যার সঙ্গে সংলাপ চলে না। আর আওয়ামী লীগও মনে করতে পারে, বিএনপির সঙ্গে বসা যায় না। এমনকি দুই দলের সমর্থক নাগরিক সমাজও বসতে পারে না। আমাদের মনে হয়, এটা ভাবার সময় এসেছে যে এভাবে হঠাৎ করে কোনো সংলাপ হয় না। আশা করাও হয়তো অসমীচীন। সমাজে এর একটা পরিবেশ থাকতে হয়। উভয় পক্ষ একটি সত্যি উচ্চারণ করেছে, সেটা হলো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশ গঠন ছাড়াই আমরা কী করে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সামনে এগিয়ে নিতে পারি এবং অদূর ভবিষ্যতে এর ফলাফল কী হতে পারে? অনেক বিদগ্ধ জনের মতো সংলাপ ও সমঝোতা বলতে আমি নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলকে বুঝতে চাই না।
আইএসের নামে প্যারিসে যে নিন্দনীয় ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে গেল, সে বিষয়ে সামনের দিনগুলোতে আমাদের মসজিদ ও মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম-ওলামাদের সবাই কি গঠনমূলক ধর্মীয় ব্যাখ্যা উপস্থাপন করবেন? আমরা কি মাদ্রাসাশিক্ষা যুগোপযোগী করতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছি? জিডিপির তুলনায় অন্যান্য সব মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন খরচ যে অনুপাতে বাড়ে, সে তুলনায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বাড়ে না। বরং সবচেয়ে কম বাড়ে। আন্তধর্ম সংলাপ বিষয়ে একটি নতুন প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, কিন্তু তা এক বছর পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন এটা বোঝার সময় এসেছে যে রাষ্ট্রের এই অপারগতা ও পলায়নপরতা রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ঘাটতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ ঝুঁকি নিতে নারাজ। ‘ইসলামি শক্তি’কে যে যার মতো করে ব্যবহার করতে কারও কোনো অনীহা নেই। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া মাদ্রাসাশিক্ষার সংস্কার–বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ইসলামের শান্তির বাণী যথাযথভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার পথে যত বাধা, তা অপসারণে একটা বৃহত্তর বোঝাপড়া লাগবে। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে জরুরি। সরকার এবং বিএনপি-জামায়াত এ বিষয়ে লিখিত খসড়া রূপরেখা দিতে পারে।
লন্ডনে অবস্থানরত খালেদা জিয়া বাংলাদেশে ‘ক্রান্তিকাল’ চলছে দাবি করে ‘দেশ ও জাতির স্বার্থে’ সংকট উত্তরণে সরকার ‘কর্তৃত্ববাদী মনোভাব’ থেকে সরে এসে ‘জাতীয় সংলাপ’ সূচনার পরিবেশ তৈরি করবে বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ তিনি কেবলই নির্বাচন চান? সেতুমন্ত্রী সংলাপ-সেতুর নীতিগত ভিত পরোক্ষভাবে হলেও স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ‘জাতীয় সংলাপ করতে হলে পরিবেশ দরকার। সেই পরিবেশ কারা নষ্ট করছে?’ এ পর্যন্ত যুক্তিসংগত। কিন্তু এরপরের অংশ গোলমেলে, মেঠো রাজনীতির ভাষা। সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘তারা লেখক, প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও পুলিশের ওপর হামলা করছে। তারা রাজনীতিকদের, লেখকদের টার্গেট করেছে। এই পরিবেশ কি সংলাপের পরিবেশ?’ প্রধানমন্ত্রী কিন্তু যোগ্যতার যে শর্ত দিয়েছেন তা সেতুমন্ত্রীর চেয়ে ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শর্ত সাপেক্ষে প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো খুনির সঙ্গে সংলাপে বসার ইচ্ছা নেই। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সমর্থন দিলে সংলাপের বিষয়টি তিনি ভেবে দেখবেন।’
তাহলে প্রশ্ন উঠবে, একদিন যখন এই বিচারপর্ব শেষ হবে, এর প্রতি সমর্থন দেওয়া না দেওয়া প্রসঙ্গ হারাবে, সেদিন
কি সংলাপ হবে? এর উত্তর হ্যাঁ ধরে নিতে পারলে আশ্বস্ত হতাম। সংলাপ মানে নতুন নির্বাচন, আর নির্বাচন মানেই বিরোধী দলের সম্পূর্ণ জয়, এই অনুমানও সংলাপ হওয়ার পথে অন্তরায়। সংলাপ না করেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করা গেছে। এ রকম আরও একটি নির্বাচন করার চেষ্টা হলে তা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকে আরও শিথিল করে দিতে পারে। আর তখন তা আরও বেশি অবনতিশীলভাবে জঙ্গিবাদকে উসকে দিতে পারে। এখন জঙ্গিবাদকেই মনে হচ্ছে সাংবিধানিক শাসনের পথে বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
উদীচী, রমনা বটমূল, ২১ আগস্ট ও ৬৪ জেলায় যখন বোমা ফাটানোর ঘটনা ঘটে, তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি ছিল না। হোসেনি দালানে হামলার ঘটনা গোষ্ঠীগত সহিংসতা (সেক্টেরিয়ান ভায়োলেন্স) সৃষ্টিরই ইঙ্গিতবহ। শ্রেণি হিসেবে এর আগে বিচারক হত্যার পর এবার পুলিশ হত্যা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা দেখছি। এখন সরকার যদি সত্যি সন্দেহ করে যে এসবই বিএনপির কাজ, কৌশলগত, তাহলে কিন্তু বিএনপির সঙ্গে এই ইস্যুতে সংলাপে বসার আহ্বান নাকচ করার যুক্তি থাকে না। বরং উল্টোটা হওয়ার কথা, সরকার সংলাপে বসতে চাইছে, ‘জঙ্গি’ বিএনপি নাকচ করছে। উভয়ে উভয়ের প্রতি উচ্চারিত সংজ্ঞায় যোগ্যতা-অযোগ্যতা আমরা খণ্ডন করতে যাব না। কিন্তু এমন একটি প্রশ্ন তো তোলাই যেতে পারে; সরকার যে কারণে বিএনপিকে সংলাপে বসার জন্য ‘অযোগ্য’ বলে মনে করছে, সেই অযোগ্যতাই আসলে তাদের সঙ্গে সংলাপে বসার যোগ্যতা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
No comments