চাই সর্বজনের ঐক্য by- সারওয়ার আলী
আমি কারও মৃত্যু কামনা করি না। কিন্তু ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা ও পবিত্র ধর্মের নামে নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সংশ্লিষ্ট আইনে চরম দণ্ডটি তাদের প্রাপ্য ছিল। স্বাধীনতার আদিপর্বে এ ধরনের নির্মম অপকর্মের অংশী ও পরিকল্পনাকারীদের থেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রচলিত আদালত সাধারণ খুনিদের দণ্ড প্রদানের নৈতিক অধিকার হারান। সে জন্য চার দশক পরে হলেও আইনের সব ধাপ পেরিয়ে দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর থেকে নানা নাটকীয়তার পর রায় কার্যকর হওয়ায় স্বস্তিবোধ করছি।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায় নানা কারণে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরামর্শদাতা, পরিকল্পনাকারী ও উৎসাহদাতা হিসেবে আইনের ভাষায় সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি থাকার কারণে দুই দফা দেশের সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। এ-সংক্রান্ত সর্বশেষ আন্তর্জাতিক আইনেও এ ধরনের দায়িত্ব পালন গর্হিত অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য হয় না, কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা ও প্রসিকিউশন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে মুজাহিদ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ও নাখালপাড়ায় তদানীন্তন এমপি হোস্টেলে নির্যাতন ও হত্যা করতে প্ররোচিত করেন। অথচ বিচারের প্রাক্কালে মুজাহিদ এই বলে আস্ফালন করেছিলেন যে, দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, কোনো যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি।
এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ১৯৭০ সালে আলী আহসান মুজাহিদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র, তখন তিনি ঢাকা জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি সংগঠনটির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ভয়ংকর আলবদর বাহিনী, যারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস (১৯৭৩)-এর অধীনে ব্যক্তি হিসেবে অভিযুক্ত হন, কোনো সহযোগী সংস্থার সদস্য হয়ে নয়। তিনিই প্রথম যুদ্ধাপরাধী, যিনি সর্বমোট চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডাদেশ পান। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ একই দিনে তিনি চট্টগ্রামের মধ্য গহিরা, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় ও ঊনসত্তরপাড়া সুলতানপুরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করেন এবং ১৭ এপ্রিল শেখ মোজাফফর ও তাঁর সন্তানকে খুন করেন। উভয় ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের রায়ের ভাষায় ‘এটি ছিল ঠান্ডা মাথায় বর্বরতা, যা কেবল হিটলারের গ্যাস চেম্বারের অপকর্মের সঙ্গে তুলনীয়।’ এ ধূর্ত রাজনীতিবিদের দম্ভোক্তি সম্পর্কে সবাই অবহিত রয়েছে। তিনি প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে উপহাস করেছেন। এমনকি বিচারালয়েও বিচারক ও প্রসিকিউশনের উদ্দেশে মুদ্রণের অযোগ্য বাক্যবাণ উচ্চারণ করেছেন। বিচারকালে তিনি অ্যালিবাইয়ের আশ্রয় নিয়েছিলেন যে, তিনি ১৯৭১ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এ বিষয়ে সনদের ক্ষেত্রেও যে সর্বোচ্চ আদালতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি মাননীয় প্রধান বিচারপতি আদালতে শুনানিকালেই জানিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিচারিক আদালতে মামলা চলাকালে কেন এই সনদ পেশ করেননি। প্রধান বিচারপতি এও বলেছেন যে, একটি মিথ্যাকে ঢাকতে শত মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী শেষ মুহূর্তে যাঁদের সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, বিচারিক আদালতে তাঁদের কারও নাম দেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বদা নিজেকে সব আইনের ঊর্ধ্বে গণ্য করেছেন, কিন্তু শেষ বিচারে সর্বোচ্চ দণ্ড তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিষয়টি কেবল আইনের বিষয় নয়, এর সঙ্গে নৈতিকতা ও ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত
এ বিচারের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তা কেবল অযৌক্তিক নয়, উদ্দেশ্যমূলকও। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয়ে নানা অপচেষ্টা আমরা লক্ষ করেছি। ১৯৪৫ সালে আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল (যা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নামে সমধিক পরিচিত) ও টোকিও ট্রায়াল থেকে শুরু করে কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, পূর্ব তিমুর, পূর্বতন যুগোস্লাভিয়াসহ বেশ কয়েকটি মানবতাবিরোধী বিচারকাজ প্রত্যক্ষ করা যায়; সর্বশেষে ১৯৯৮ সালে গৃহীত ও ২০০২ সাল থেকে প্রচলিত আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট (রোম স্টাটিউট) গঠিত হয়েছে। পূর্ববর্তী আদালতসমূহে জাতিসংঘের যোগ রয়েছে, বাংলাদেশে বিচারকাজ চলেছে বাংলাদেশের আইনে, বাংলাদেশের বিচারপতিদের দ্বারা। মৌলিক বিষয় হচ্ছে, এই আইন ও আইনের প্রয়োগ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কি না।
উল্লেখ্য, এ আইনটি কার্যকর করার পর আইন কমিশনের পক্ষ থেকে দেশে ও বিদেশে সবার কাছ থেকে কোনো সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা জানতে একাধিকবার আহ্বান জানানো হয়; যাঁরা কয়েক বছর ধরে বিচারের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা কেউ কোনো সংশোধনী আনেননি। একমাত্র সংশোধনী পেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার বিশেষ দূত স্টিফেন র্যা প। তিনি পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেছেন, বিচারে বিধি ও প্রায়োগিক দিক নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। সরকার তার প্রায়োগিক সুপারিশগুলো গ্রহণ করলেও বিধি–সংক্রান্ত সুপারিশগুলো গ্রহণ করেনি। সর্বশেষ সফরে এসে র্যা প ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার পর তথ্যমাধ্যমের কাছে ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও দৃঢ়চিত্ত অবস্থানের প্রশংসা করেছেন।
বরং এ দুর্ভাগা দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না; সেটি আমাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটি মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অন্তত দেশের অভ্যন্তরে একাত্তরে জীবিত সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং দলমত-নির্বিশেষে সব মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সংগঠন ও ব্যক্তিদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। একাত্তরে একাধিক বিদেশি সাংবাদিকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নির্বিচারে সর্বত্র গণহত্যা চালিয়েছে; কিন্তু চিহ্নিত করে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস হামলার জন্য দায়ী তাদের সহযোগী দেশীয় অনুচরেরা। এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত থেকেও যখন বিএনপির মুখপাত্র সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাফাই গায় ও বিচারককে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন হতবাক হই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার কৌশলের কাছে নীতি পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার যে অপরিহার্যতা, সেটিও পরিত্যক্ত হলো।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আলবদর বইয়ে উল্লেখ আছে যে আলবদরদের নাজেম (মুজাহিদ) তাঁর ‘আখেরি খিতাবে’ (শেষ বক্তব্য) বলেন যে, ‘হতাশ হবেন না, সফরে বেরিয়ে যান; এখানে আমরা আবার মিলিত হতে পারি।’ চার দশক ধরে এককভাবে এবং যে বৃহৎ দলের ছত্রচ্ছায়ায় আজ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তারা আইনানুগ এবং সন্ত্রাসী উভয় পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনাশে লিপ্ত রয়েছে, সম্প্রতি নিরীহ বিদেশি ও ধর্মযাজক হত্যা ও হত্যার চেষ্টা, মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যা এবং সর্বশেষ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের হত্যার হুমকিতে উপলব্ধি করা যায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার–প্রক্রিয়া বানচাল এবং বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান একই সূত্রে গ্রথিত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি কেবল আইনের বিষয় নয়, এর সঙ্গে নৈতিকতা ও ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। ইতিহাসের দায়মুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দলমত-নির্বিশেষে সর্বজনের ঐক্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায় নানা কারণে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরামর্শদাতা, পরিকল্পনাকারী ও উৎসাহদাতা হিসেবে আইনের ভাষায় সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি থাকার কারণে দুই দফা দেশের সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। এ-সংক্রান্ত সর্বশেষ আন্তর্জাতিক আইনেও এ ধরনের দায়িত্ব পালন গর্হিত অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য হয় না, কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা ও প্রসিকিউশন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে মুজাহিদ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ও নাখালপাড়ায় তদানীন্তন এমপি হোস্টেলে নির্যাতন ও হত্যা করতে প্ররোচিত করেন। অথচ বিচারের প্রাক্কালে মুজাহিদ এই বলে আস্ফালন করেছিলেন যে, দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, কোনো যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি।
এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ১৯৭০ সালে আলী আহসান মুজাহিদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র, তখন তিনি ঢাকা জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি সংগঠনটির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ভয়ংকর আলবদর বাহিনী, যারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস (১৯৭৩)-এর অধীনে ব্যক্তি হিসেবে অভিযুক্ত হন, কোনো সহযোগী সংস্থার সদস্য হয়ে নয়। তিনিই প্রথম যুদ্ধাপরাধী, যিনি সর্বমোট চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডাদেশ পান। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ একই দিনে তিনি চট্টগ্রামের মধ্য গহিরা, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় ও ঊনসত্তরপাড়া সুলতানপুরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করেন এবং ১৭ এপ্রিল শেখ মোজাফফর ও তাঁর সন্তানকে খুন করেন। উভয় ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের রায়ের ভাষায় ‘এটি ছিল ঠান্ডা মাথায় বর্বরতা, যা কেবল হিটলারের গ্যাস চেম্বারের অপকর্মের সঙ্গে তুলনীয়।’ এ ধূর্ত রাজনীতিবিদের দম্ভোক্তি সম্পর্কে সবাই অবহিত রয়েছে। তিনি প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে উপহাস করেছেন। এমনকি বিচারালয়েও বিচারক ও প্রসিকিউশনের উদ্দেশে মুদ্রণের অযোগ্য বাক্যবাণ উচ্চারণ করেছেন। বিচারকালে তিনি অ্যালিবাইয়ের আশ্রয় নিয়েছিলেন যে, তিনি ১৯৭১ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এ বিষয়ে সনদের ক্ষেত্রেও যে সর্বোচ্চ আদালতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি মাননীয় প্রধান বিচারপতি আদালতে শুনানিকালেই জানিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিচারিক আদালতে মামলা চলাকালে কেন এই সনদ পেশ করেননি। প্রধান বিচারপতি এও বলেছেন যে, একটি মিথ্যাকে ঢাকতে শত মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী শেষ মুহূর্তে যাঁদের সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, বিচারিক আদালতে তাঁদের কারও নাম দেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বদা নিজেকে সব আইনের ঊর্ধ্বে গণ্য করেছেন, কিন্তু শেষ বিচারে সর্বোচ্চ দণ্ড তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিষয়টি কেবল আইনের বিষয় নয়, এর সঙ্গে নৈতিকতা ও ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত
এ বিচারের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তা কেবল অযৌক্তিক নয়, উদ্দেশ্যমূলকও। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয়ে নানা অপচেষ্টা আমরা লক্ষ করেছি। ১৯৪৫ সালে আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল (যা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নামে সমধিক পরিচিত) ও টোকিও ট্রায়াল থেকে শুরু করে কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, পূর্ব তিমুর, পূর্বতন যুগোস্লাভিয়াসহ বেশ কয়েকটি মানবতাবিরোধী বিচারকাজ প্রত্যক্ষ করা যায়; সর্বশেষে ১৯৯৮ সালে গৃহীত ও ২০০২ সাল থেকে প্রচলিত আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট (রোম স্টাটিউট) গঠিত হয়েছে। পূর্ববর্তী আদালতসমূহে জাতিসংঘের যোগ রয়েছে, বাংলাদেশে বিচারকাজ চলেছে বাংলাদেশের আইনে, বাংলাদেশের বিচারপতিদের দ্বারা। মৌলিক বিষয় হচ্ছে, এই আইন ও আইনের প্রয়োগ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কি না।
উল্লেখ্য, এ আইনটি কার্যকর করার পর আইন কমিশনের পক্ষ থেকে দেশে ও বিদেশে সবার কাছ থেকে কোনো সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা জানতে একাধিকবার আহ্বান জানানো হয়; যাঁরা কয়েক বছর ধরে বিচারের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা কেউ কোনো সংশোধনী আনেননি। একমাত্র সংশোধনী পেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার বিশেষ দূত স্টিফেন র্যা প। তিনি পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেছেন, বিচারে বিধি ও প্রায়োগিক দিক নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। সরকার তার প্রায়োগিক সুপারিশগুলো গ্রহণ করলেও বিধি–সংক্রান্ত সুপারিশগুলো গ্রহণ করেনি। সর্বশেষ সফরে এসে র্যা প ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার পর তথ্যমাধ্যমের কাছে ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও দৃঢ়চিত্ত অবস্থানের প্রশংসা করেছেন।
বরং এ দুর্ভাগা দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না; সেটি আমাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটি মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অন্তত দেশের অভ্যন্তরে একাত্তরে জীবিত সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং দলমত-নির্বিশেষে সব মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সংগঠন ও ব্যক্তিদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। একাত্তরে একাধিক বিদেশি সাংবাদিকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নির্বিচারে সর্বত্র গণহত্যা চালিয়েছে; কিন্তু চিহ্নিত করে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস হামলার জন্য দায়ী তাদের সহযোগী দেশীয় অনুচরেরা। এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত থেকেও যখন বিএনপির মুখপাত্র সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাফাই গায় ও বিচারককে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন হতবাক হই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার কৌশলের কাছে নীতি পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার যে অপরিহার্যতা, সেটিও পরিত্যক্ত হলো।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আলবদর বইয়ে উল্লেখ আছে যে আলবদরদের নাজেম (মুজাহিদ) তাঁর ‘আখেরি খিতাবে’ (শেষ বক্তব্য) বলেন যে, ‘হতাশ হবেন না, সফরে বেরিয়ে যান; এখানে আমরা আবার মিলিত হতে পারি।’ চার দশক ধরে এককভাবে এবং যে বৃহৎ দলের ছত্রচ্ছায়ায় আজ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তারা আইনানুগ এবং সন্ত্রাসী উভয় পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনাশে লিপ্ত রয়েছে, সম্প্রতি নিরীহ বিদেশি ও ধর্মযাজক হত্যা ও হত্যার চেষ্টা, মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যা এবং সর্বশেষ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের হত্যার হুমকিতে উপলব্ধি করা যায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার–প্রক্রিয়া বানচাল এবং বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান একই সূত্রে গ্রথিত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি কেবল আইনের বিষয় নয়, এর সঙ্গে নৈতিকতা ও ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। ইতিহাসের দায়মুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দলমত-নির্বিশেষে সর্বজনের ঐক্য একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সারওয়ার আলী: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
No comments