সংসদে বিতর্কে ধর্মনিরপেক্ষতা by- সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দিন দিন বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার যে প্রশ্নে ভারত ক্রমশ
দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে, ভারতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শুরুতে আজ
বৃহস্পতিবার সেটাই বড় হয়ে দেখা দিল। সেই সঙ্গে আলোচনায় উঠে এল ভারতের
ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রও। দুই বিষয়েই সরকারকে কোণঠাসা করলেন কংগ্রেস সভানেত্রী
সোনিয়া গান্ধী।
ভারতীয় সংবিধান নিবেদনের ৬৫তম এবং সংবিধানের অন্যতম রূপকার বাবাসাহেব
ভীমরাও আম্বেদকরের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে অধিবেশনের প্রথম
দুদিন বিশেষ এক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এই বিশেষ আলোচনাপর্বেই বড় হয়ে উঠে
আসে অসহিষ্ণুতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন। আর সেখানেই শাসক বিজেপিকে সরাসরি
কটাক্ষ করে সোনিয়া বলেন, ‘সংবিধান রচনায় যাঁদের পূর্বসূরিদের কোনো ভূমিকাই
ছিল না, সংবিধানের ওপর যাঁদের আস্থাই নেই, তাঁরাই আজ সংবিধান রক্ষকের দাবি
জানাচ্ছেন!’ আক্রমণাত্মক সোনিয়া বলেন, ‘কংগ্রেসই সংবিধানের জন্য লড়াই
করেছে। অথচ আজ আমরা দেখছি, সংবিধানের মূল আদর্শগুলো ধ্বংস হওয়ার মুখে এসে
দাঁড়িয়েছে। কয়েক মাস ধরে দেশে যা চলছে, তা সংবিধানের মূল ধ্যানধারণা ও
আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।’
সংবিধান রচনা, তাতে আম্বেদকরের ভূমিকা এবং সংবিধানের বেঁধে দেওয়া মূল
সুর অনুযায়ী ভারতের এগিয়ে চলা নিয়ে আলোচনা শুরু করে বিরোধী আক্রমণের মুখে
পড়েন লোকসভার উপনেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। বলিউড সুপারস্টার আমির
খানের নাম না করে প্রথমে তিনি কটাক্ষ করেন এই বলে যে, ‘জীবনকালে আম্বেদকরকে
প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে, পদে পদে বাধা পেতে হয়েছে,
কিন্তু তিনি কোনো দিন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবেননি।’ এর পরেই তিনি
বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ দুটি সংবিধানের প্রস্তাবনায়
প্রথমে ছিল না। কারণ, আম্বেদকর মনে করেছিলেন, দুই বিষয়ই ভারতের মূল
প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত। রাজনাথ বলেন, এ দেশে যে শব্দটির অপব্যবহার সবচেয়ে
বেশি, তা হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। এই শব্দটির বদলে ‘পন্থ (পথ) নিরপেক্ষ’
ব্যবহার হওয়া উচিত।
ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা নিয়েই অসহিষ্ণুতার মাথাচাড়া দেওয়া। কাজেই
কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে শুরু হয় প্রবল প্রতিরোধ। দলনেতা মল্লিকার্জুন খারগে
বলেন, আম্বেদকর অবশ্যই প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি রাখতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু প্রতিরোধের দরুন পারেননি। তাই পরে জুড়তে হয়।
রাজনাথের পরেই বলতে ওঠেন সোনিয়া। সংবিধান রচনায় কংগ্রেসের ভূমিকার
উল্লেখ করে তিনি সরাসরি চলে যান সরকার বিরোধিতায় এবং তাতেও তাঁর হাতিয়ার হন
আম্বেদকর। সোনিয়া বলেন, ‘আম্বেদকর বলেছিলেন, সংবিধান যতই ভালো হোক, যাঁরা
তা রূপায়ণ করবেন তাঁরা ভালো মানুষ না হলে সংবিধানও বাজে হয়ে যায়। আবার
রূপায়ণকারীরা ভালো মানুষ হলে খারাপ সংবিধানও ভালো হয়ে যায়।’ এই টিপ্পনী
কেটেই সোনিয়া বিরোধীদের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলেন, ‘এটা আপনারা ও
আমাদের উদ্দেশে।’
সংবিধান-সভায় (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) আম্বেদকরের নির্বাচন নিয়েও
বিতর্ক দেখা দেয় তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আম্বেদকর সংবিধান সভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন
বাংলা থেকে। বিজেপির সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি
নির্বাচিত হয়েছিলেন বোম্বে থেকে। এই বিতর্কের অবসান ঘটান তৃণমূল কংগ্রেসের
ইতিহাসবিদ সাংসদ সুগত বসু। তিনি বলেন, ১৯৪৬ সালে সংবিধান সভায় আম্বেদকর
নির্বাচিত হন যশোর-খুলনা কেন্দ্র থেকে। কিন্তু ৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁর
নির্বাচনী কেন্দ্র পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় আম্বেদকরকে বোম্বে থেকে
নির্বাচিত করা হয়।
আম্বেদকর ও সংবিধান প্রথম দুদিনের বিশেষ অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় হলেও
ঘুরেফিরে লোকসভায় প্রাধান্য পায় অসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংরক্ষণ।
স্বাধীনতার ৬৭ বছর পর এখন সংরক্ষণ ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন,
মন্তব্য করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত বিতর্কের শীর্ষে
উঠেছিলেন। ওই মন্তব্য বিহারে বিজেপির বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ বলেও
মনে করা হচ্ছে। রাজনাথসহ অন্য সদস্যরা তাই এই অবকাশে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
এবং সেই ক্ষেত্রে আম্বেদকরের অভিমতকেও তুলে ধরেন। তবে সব ছাপিয়ে বড় হয়ে
থাকে অসহিষ্ণুতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন।
কাল শুক্রবার এই বিতর্কে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
অসহিষ্ণুতা নিয়ে এ যাবৎ মৌন প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম প্রকাশ্যে এবং সংসদে
তাঁর ও সরকারের মনোভাব জানাবেন। তা যাতে নির্বিঘ্নে হয় এবং সংসদ যাতে
সুষ্ঠুভাবে চলে সে জন্য আবেদন জানিয়েছেন সংসদীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু।
তিনি বলেছেন, সরকারের লুকানোর কিছুই নেই। সরকার সবকিছু নিয়ে আলোচনায় রাজি।
প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন এই কথা। মোদি বৃহস্পতিবার সংসদ শুরুর আগে বলেন,
‘বিতর্ক ও আলোচনাই সংসদের প্রাণ। আশা করি, বিরোধীরা সংসদীয় অধিবেশন
সুষ্ঠুভাবে চলতে সাহায্য করবেন।’
No comments