এখন দল বদলের দিন by আব্দুল কাইয়ুম
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও নাশকতার আসামিকে ফুল দিয়ে দলে বরণ করছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী |
দিন
বদলের সওগাত নিয়ে ছয়-সাত বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। বদল এর
মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু হয়েছে। বিশেষ করে বলতে হয় ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা।
সরকারি অফিসের বেশ কিছু সেবা এখন ঘরে বসেই অনলাইনে পাওয়া যায়। ব্যাংক
লেনদেন, কেনাকাটা, ঈদের এই ব্যস্ত সময়ে অনলাইনে টিকিট কিনতে পারার চেয়ে
আনন্দের আর কী থাকতে পারে? পরীক্ষার্থীদের ফল জানতেও এখন আর স্কুল-কলেজের
নোটিশ বোর্ড দেখার জন্য হয়রান হতে হয় না। স্মার্টফোনে এখন ফেসবুক থেকে
স্কাইপ—সবই চলে।
তবে এখন দিন বদলে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে—দল বদল। ‘দিন বদল’-এর প্রথম শব্দটা বদলে গেছে। দিন-এর হ্রস্ব ই-কার বাদ পড়ে গেছে, আর শেষ অক্ষর, ন-এর পরিবর্তে ‘ল’ হয়ে গেছে। ফলে দিন বদলের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে দল বদল!
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতাকে গত রোববার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি রাউজানের একজন যুবলীগের কর্মী হত্যার আসামি। পুলিশ জানায়, তাঁর বিরুদ্ধে নাকি আরও অনেক মামলা রয়েছে। কিন্তু পরদিন সকালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বিকেলে তাঁকে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফুলের তোড়ায় তিনি দল বদল করেন। বলা হয়, তিনি স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন!
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর চারঘাটে ভোটকেন্দ্র পোড়ানো মামলার আসামি ও কৃষক দলের এক নেতা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শুধু বিএনপির নয়, জামায়াতের একজন সমর্থক-কর্মীও একই সময়ে তাঁদের দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।
যেখানে সরকার পেট্রলবোমা-ককটেল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে এত সোচ্চার, সেখানে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী কীভাবে বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনের যোগদান অনুমোদন করলেন?
অবশ্য দল থেকে বলা হচ্ছে, মামলা থাকলে তা নিজস্ব গতিতে চলবে। তাহলে কিসের আশায় ওরা বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাচ্ছে? আইন তো নিজস্ব গতিতে চলবেই। কিন্তু সরকারপক্ষ যদি উৎসাহী না হয়, তাহলে সেই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি কারও সন্দেহ থাকতে পারে? শেষ পর্যন্ত মামলাগুলো ফাইল-চাপা পড়ে যায়।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় এ রকম দল বদলের আরও খবর পাওয়া গেছে। মামলা, গ্রেপ্তারের হুমকি-ধমকি, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের চাপ এবং এ রকম আরও অনেক সমস্যার মুখে বিএনপি ও জামায়াত থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগে যাচ্ছেন। এভাবে তাঁরা আপাতত গা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে এসব বিষয়ে সাবধান থাকার কথা বলেছিলেন। ওই পর্যন্তই। এটা যে খারাপ, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী একটি দল যে এ রকম সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, এ বিষয়ে তো দলের সব পর্যায়ের নেতৃত্বের সচেতন থাকার কথা। কিন্তু না, সে রকম কিছু গভীর চিন্তাভাবনা চোখে পড়ল না।
প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধির কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলাম, এসব দল বদলের প্রতিক্রিয়া কী? তিনি জানালেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দারুণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন, যেখানে বিএনপি-জামায়াত এত সন্ত্রাস করল, বোমা মেরে আওয়ামী লীগের লোকজনকে মারাত্মকভাবে আহত করল, সেখানে আজ আবার তাঁদেরই কেন দলে টেনে নেওয়া হচ্ছে? সে সময় একজন ভ্যানচালকের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁর হাত ও ঘাড়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। প্রতিমন্ত্রী অবশ্য চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন তো তিনি ভালোভাবে ভ্যান চালিয়ে উপার্জন করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি দেখছেন, তাঁর জীবনটা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা সরকারি দলের আনুকূল্য পাচ্ছেন। সেই ভ্যানচালকের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখুন! সহিংসতার শিকার এই ভ্যানচালককে কী সান্ত্বনা দেবে আওয়ামী লীগ?
দল বদল নতুন কিছু নয়। প্রচলিত রাজনীতিতে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দলের কিছু নেতা-কর্মী দল বদলান। নিশ্চয়ই কিছু সুবিধা পান। না হলে কেন যাবেন এক দল ছেড়ে অন্য দলে। কিন্তু দল বদলেরও কিছু নিয়ম আছে। অন্য দল ছেড়ে আসা একজন কর্মীকে চট করে দলে নেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগেরই গঠনতন্ত্রে বলা আছে, শুধু ফুলের তোড়া দিয়েই কাজ হাসিল হবে না, তাঁকে প্রাথমিক সদস্যপদ নিতে হবে। ভিন্ন দল থেকে এসে কমিটিতে যেতে হলে তাঁকে অন্তত দুই বছর দলের কর্মী হিসেবে কাজ করতে হবে। ওপরের কমিটির অনুমোদন লাগবে ইত্যাদি। কিন্তু নিচের দিকে কে মানেন এসব নীতিমালা? বরং দলের মধ্যে নাম কেনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী অন্য দলের নেতাদের টানেন। দল ভারী করার কথা বলেন। আবার বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এখন বিপদে আছেন বলে সুযোগ নেন। কদিনের জন্য দল বদল করেন। অবস্থা ঘুরে গেলে হয়তো তাঁরাও আবার ঘুরে যাবেন।
ষাটের দশকে দেখেছি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আইয়ুব-মোনায়েমের শাসনে অনেক নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করে রাজনীতি করে গেছেন। দলের ও দেশের জন্য তাঁদের অবদান ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের বেশির ভাগ সময়ই জেল-জুলুম সহ্য করে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। তাঁর হাতে গড়া দলের আদর্শ ও ত্যাগের কথাগুলো এখন দলের অনেক নেতা-কর্মী হারিয়ে ফেলছেন। যখন জামায়াতের লোকজনকে দলে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসা হয়, তখন আদর্শ কোথায় থাকে?
আদর্শের সংকট দেখা দিলে আদর্শবাদী নেতা-কর্মীরা পেছনের সারিতে পড়ে যান। এটা দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। দলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সুযোগ–সন্ধানীরা তখন দলের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। আজ যে বুয়েট ক্যানটিনে ছাত্রলীগের নেতারা চাঁদাবাজি করতে যান, তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীরা ফাউ খাওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মারামারি বাধান। গাড়ি ভাঙচুর করে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করেন। এগুলো সেই ধরনের বিপর্যয়ের লক্ষণ। তাই দলকে এসব ব্যাপারে খুব দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
আজ দেশে কার্যকর বিরোধী দলকে বলতে গেলে অস্তিত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। বিএনপির মূল নেতাদের কেউই আজ সক্রিয় রাজনীতি করতে পারছেন না। বেশির ভাগ নেতাকেই বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য যে কজন বাইরে আছেন, তাঁদের ওপরও রয়েছে নানা চাপ। ভয়ভীতি। তাঁদের কেউই প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নিতে পারছেন না। আর সংসদের কথা না বলাই ভালো। সেখানে যে বিরোধী দল আছে, তা তো সরকারেরই আশীর্বাদপুষ্ট, সরকারেরই বর্ধিতাংশ মাত্র।
ফলে বিএনপির মধ্যে নেমেছে হতাশা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ রকম হতাশা বেশি। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো আপাতত আওয়ামী লীগে যোগদান করাকেই শ্রেয় মনে করছেন।
দমন-পীড়ন করে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা বাংলাদেশে কখনো টেকেনি। বিএনপিও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে? আওয়ামী লীগের মতো এ রকম একটা দল, তৃণমূল পর্যায়ে যাদের রয়েছে দৃঢ় ভিত্তি, তাদের শুধু জেল-জুলুম-হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা যায় না।
আজ আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। তারা যদি বিএনপির মতো একই কায়দা অনুসরণ করে, তা যে বুমেরাং হবে না, তা কে বলতে পারে? বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীকে দলে ভিড়িয়ে আওয়ামী লীগ দল ভারী করতে পারবে না। বরং এরা একদিন দলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
দল বদল যে দিন বদলের পথে বাধা, আওয়ামী লীগ সেটা যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
তবে এখন দিন বদলে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে—দল বদল। ‘দিন বদল’-এর প্রথম শব্দটা বদলে গেছে। দিন-এর হ্রস্ব ই-কার বাদ পড়ে গেছে, আর শেষ অক্ষর, ন-এর পরিবর্তে ‘ল’ হয়ে গেছে। ফলে দিন বদলের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে দল বদল!
চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতাকে গত রোববার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি রাউজানের একজন যুবলীগের কর্মী হত্যার আসামি। পুলিশ জানায়, তাঁর বিরুদ্ধে নাকি আরও অনেক মামলা রয়েছে। কিন্তু পরদিন সকালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বিকেলে তাঁকে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফুলের তোড়ায় তিনি দল বদল করেন। বলা হয়, তিনি স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন!
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর চারঘাটে ভোটকেন্দ্র পোড়ানো মামলার আসামি ও কৃষক দলের এক নেতা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শুধু বিএনপির নয়, জামায়াতের একজন সমর্থক-কর্মীও একই সময়ে তাঁদের দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।
যেখানে সরকার পেট্রলবোমা-ককটেল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে এত সোচ্চার, সেখানে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী কীভাবে বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনের যোগদান অনুমোদন করলেন?
অবশ্য দল থেকে বলা হচ্ছে, মামলা থাকলে তা নিজস্ব গতিতে চলবে। তাহলে কিসের আশায় ওরা বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাচ্ছে? আইন তো নিজস্ব গতিতে চলবেই। কিন্তু সরকারপক্ষ যদি উৎসাহী না হয়, তাহলে সেই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি কারও সন্দেহ থাকতে পারে? শেষ পর্যন্ত মামলাগুলো ফাইল-চাপা পড়ে যায়।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় এ রকম দল বদলের আরও খবর পাওয়া গেছে। মামলা, গ্রেপ্তারের হুমকি-ধমকি, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের চাপ এবং এ রকম আরও অনেক সমস্যার মুখে বিএনপি ও জামায়াত থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগে যাচ্ছেন। এভাবে তাঁরা আপাতত গা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে এসব বিষয়ে সাবধান থাকার কথা বলেছিলেন। ওই পর্যন্তই। এটা যে খারাপ, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী একটি দল যে এ রকম সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, এ বিষয়ে তো দলের সব পর্যায়ের নেতৃত্বের সচেতন থাকার কথা। কিন্তু না, সে রকম কিছু গভীর চিন্তাভাবনা চোখে পড়ল না।
প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধির কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলাম, এসব দল বদলের প্রতিক্রিয়া কী? তিনি জানালেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দারুণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন, যেখানে বিএনপি-জামায়াত এত সন্ত্রাস করল, বোমা মেরে আওয়ামী লীগের লোকজনকে মারাত্মকভাবে আহত করল, সেখানে আজ আবার তাঁদেরই কেন দলে টেনে নেওয়া হচ্ছে? সে সময় একজন ভ্যানচালকের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁর হাত ও ঘাড়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। প্রতিমন্ত্রী অবশ্য চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন তো তিনি ভালোভাবে ভ্যান চালিয়ে উপার্জন করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি দেখছেন, তাঁর জীবনটা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা সরকারি দলের আনুকূল্য পাচ্ছেন। সেই ভ্যানচালকের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখুন! সহিংসতার শিকার এই ভ্যানচালককে কী সান্ত্বনা দেবে আওয়ামী লীগ?
দল বদল নতুন কিছু নয়। প্রচলিত রাজনীতিতে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দলের কিছু নেতা-কর্মী দল বদলান। নিশ্চয়ই কিছু সুবিধা পান। না হলে কেন যাবেন এক দল ছেড়ে অন্য দলে। কিন্তু দল বদলেরও কিছু নিয়ম আছে। অন্য দল ছেড়ে আসা একজন কর্মীকে চট করে দলে নেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগেরই গঠনতন্ত্রে বলা আছে, শুধু ফুলের তোড়া দিয়েই কাজ হাসিল হবে না, তাঁকে প্রাথমিক সদস্যপদ নিতে হবে। ভিন্ন দল থেকে এসে কমিটিতে যেতে হলে তাঁকে অন্তত দুই বছর দলের কর্মী হিসেবে কাজ করতে হবে। ওপরের কমিটির অনুমোদন লাগবে ইত্যাদি। কিন্তু নিচের দিকে কে মানেন এসব নীতিমালা? বরং দলের মধ্যে নাম কেনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী অন্য দলের নেতাদের টানেন। দল ভারী করার কথা বলেন। আবার বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এখন বিপদে আছেন বলে সুযোগ নেন। কদিনের জন্য দল বদল করেন। অবস্থা ঘুরে গেলে হয়তো তাঁরাও আবার ঘুরে যাবেন।
ষাটের দশকে দেখেছি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আইয়ুব-মোনায়েমের শাসনে অনেক নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করে রাজনীতি করে গেছেন। দলের ও দেশের জন্য তাঁদের অবদান ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের বেশির ভাগ সময়ই জেল-জুলুম সহ্য করে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। তাঁর হাতে গড়া দলের আদর্শ ও ত্যাগের কথাগুলো এখন দলের অনেক নেতা-কর্মী হারিয়ে ফেলছেন। যখন জামায়াতের লোকজনকে দলে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসা হয়, তখন আদর্শ কোথায় থাকে?
আদর্শের সংকট দেখা দিলে আদর্শবাদী নেতা-কর্মীরা পেছনের সারিতে পড়ে যান। এটা দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। দলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সুযোগ–সন্ধানীরা তখন দলের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। আজ যে বুয়েট ক্যানটিনে ছাত্রলীগের নেতারা চাঁদাবাজি করতে যান, তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীরা ফাউ খাওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মারামারি বাধান। গাড়ি ভাঙচুর করে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করেন। এগুলো সেই ধরনের বিপর্যয়ের লক্ষণ। তাই দলকে এসব ব্যাপারে খুব দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
আজ দেশে কার্যকর বিরোধী দলকে বলতে গেলে অস্তিত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। বিএনপির মূল নেতাদের কেউই আজ সক্রিয় রাজনীতি করতে পারছেন না। বেশির ভাগ নেতাকেই বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। অন্য যে কজন বাইরে আছেন, তাঁদের ওপরও রয়েছে নানা চাপ। ভয়ভীতি। তাঁদের কেউই প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নিতে পারছেন না। আর সংসদের কথা না বলাই ভালো। সেখানে যে বিরোধী দল আছে, তা তো সরকারেরই আশীর্বাদপুষ্ট, সরকারেরই বর্ধিতাংশ মাত্র।
ফলে বিএনপির মধ্যে নেমেছে হতাশা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ রকম হতাশা বেশি। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো আপাতত আওয়ামী লীগে যোগদান করাকেই শ্রেয় মনে করছেন।
দমন-পীড়ন করে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা বাংলাদেশে কখনো টেকেনি। বিএনপিও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে? আওয়ামী লীগের মতো এ রকম একটা দল, তৃণমূল পর্যায়ে যাদের রয়েছে দৃঢ় ভিত্তি, তাদের শুধু জেল-জুলুম-হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা যায় না।
আজ আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। তারা যদি বিএনপির মতো একই কায়দা অনুসরণ করে, তা যে বুমেরাং হবে না, তা কে বলতে পারে? বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীকে দলে ভিড়িয়ে আওয়ামী লীগ দল ভারী করতে পারবে না। বরং এরা একদিন দলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
দল বদল যে দিন বদলের পথে বাধা, আওয়ামী লীগ সেটা যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments