সংযোগে লাভ বেশি না ক্ষতি? by আনু মুহাম্মদ
১৫
জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে যান
চলাচলে রূপরেখা চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দেশগুলোর মধ্যে
যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারবে। এতে বাংলাদেশ কী আর্থিক সুবিধা
পেতে পারে এবং কী ধরনের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে বলেছেন
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ
ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যে করিডরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাকে কানেকটিভিটি বা সংযুক্ততা নামক শব্দ দিয়ে আসলে অস্পষ্টই করা হয়। এক দশক ধরে এফক্যাব, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে একে বলা হচ্ছিল ট্রানজিট। এখন সেটা নতুন নামে এসেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ কতগুলো চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এ সম্পর্কে বাংলাদেশের নাগরিকেরা বিশদভাবে অবগত নন। আমরা জানি না, সরকারের কাছে কী কী সমীক্ষা আছে এবং এসব চুক্তির ধারা-উপধারায় বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায় কতটা রক্ষা পাবে বা পাবে না, তা-ও জনগণ জানতে পারেনি।
বাংলাদেশের সঙ্গে কলকাতা, আসাম, শিলিগুড়ি বা মিয়ানমারের যোগাযোগ তো ইতিমধ্যেই আছে। যেটা নেই, সেটা হলো ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের সরাসরি সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী যোগাযোগের ব্যবস্থা। এটা পেয়ে গেলে ভারতের ওই সব অঞ্চলের জনবিন্যাস, স্থানিক বিন্যাস, অর্থনৈতিক বিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তাদের যোগাযোগ খরচ ও সময় আগের তুলনায় শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগে নেমে আসবে। সুতরাং এটা ভারতের জন্য বিরাট সুফলদায়ক পরিবর্তন। কিন্তু আমাদের ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি, না লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি, তা সরকার দেশবাসীকে জানাচ্ছে না। এই রহস্যের কারণ কী?
আমাদের সড়কপথ ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত যানের ভারে ধুঁকছে। ভারতীয় যান চলাচল শুরু হলে এর ওপর চাপ বেড়ে যাবে অনেক। নতুন যোগাযোগ তৈরি করতে কতটা কৃষিজমি, জলাশয়, অরণ্য যাবে, সেটার হিসাব আমাদের কাছে আছে কি? এই প্রতিটির জন্য বাংলাদেশের জনগণকে বিভিন্নভাবে ভুগতে হবে। এর জন্য কী পরিমাণ শুল্ক পাওয়া যাবে, তা-ও নিশ্চিত নয়। এর আগে মানবিক কারণের কথা বলে ভারতীয় পণ্য চলাচল হয়েছে বিনা শুল্কে, ভবিষ্যতেও কি সে রকমই হবে?
অনেকে এ ধরনের যোগাযোগকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তুলনা করেন। প্রথমত, এই যোগাযোগ ভারত থেকে ভারতে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের প্রতিটি দেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশের স্বার্থ স্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত। বাংলাদেশের তুলনায় ভারত যে ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করে, সে রকম অবস্থা সেখানে নেই। আসলে এর সঙ্গে তুলনীয় দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে চার দিকে ঘেরাও থাকা দেশ লেসেথোর সঙ্গে। ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আশঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
আমরা ভুলতে পারি না, পানি মানবিকতার বা দয়াদাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক আইনস্বীকৃত অধিকার। আমরা ভুলতে পারি না, ভারত তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে তিন দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, সীমান্ত চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় কাঁটাতারের বেড়া সম্পূর্ণ করা নিশ্চিত হলো। আমরা যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা, তখন ভারতীয় পরিবহন বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে অবাধে চলাচল করবে!
কাঁটাতারের পেছনে বড় যুক্তি, বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি হুমকি ঠেকানো। আমাদের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীদের কারও কারও মুখেও এ কথা উচ্চারিত হয়। প্রথমত, কাঁটাতার রেখে কীভাবে কানেকটিভিটি সম্ভব? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের থেকে ভারতকে নিরাপদ করাই যদি কাঁটাতারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেই সন্ত্রাসের উৎস দেশের মধ্যে দিয়ে ভারতের পণ্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচল কীভাবে নিরাপদ হবে? কে নিশ্চয়তা দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। বাংলাদেশের অনেক পুরোনো ইচ্ছা, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। কয়েক বছর আগে ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে সমঝোতা হলেও কার্যত নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড পেরোনোর বন্দোবস্ত হয়নি।
বলা হচ্ছে, কানেকটিভিটির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। এ ধরনের দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকতেই পারে। সমস্যাটা হচ্ছে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশ যেসব পণ্য নিয়ে যেতে সক্ষম, সেগুলোও আটকে থাকছে। নানা রকম প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ বাধা তৈরি করে রাখা হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা না থাকলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বর্তমানের দ্বিগুণ হতে পারত। এ ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষণ কোনো চুক্তিতেই নেই। সে ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে বাংলাদেশের শিল্প বিনিয়োগকারীদের ভারতের বাজারে সুযোগ দিতে হবে। আমাদের পুঁজিপতিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা স্বাধীন দেশের শিল্পপতি হিসেবে লেনদেন করবেন, নাকি ভারতীয় পুঁজির কনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকবেন? ভারতীয় বিনিয়োগের ধরনও হলো, ভারতের পণ্যই ভারতে রপ্তানির ব্যবস্থা করা। এতে করে ভারতে বাংলাদেশের বর্তমান বাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশের টেকসই শিল্পভিত্তি তৈরি হওয়াও বিঘ্নিত হবে। এহেন বিনিয়োগে আমাদের শিল্পপতিদের স্বার্থের ক্ষতি হওয়ার কথা।
অভিন্ন নদী, বিশাল পানিসম্পদ, খনিজ সম্পদ ও মানবসম্পদ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সহযোগিতার পরিকল্পনা গ্রহণের বিরাট সুযোগ আছে। কিন্তু করপোরেট স্বার্থ, আঞ্চলিক আধিপত্য ও বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি এসব অভিন্ন স্বার্থকে খর্ব করছে। উন্নয়ন যদি এ অঞ্চলের স্বার্থেই হয়, তাহলে সবকিছু অন্ধকারে রাখার দরকার কী?
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যে করিডরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাকে কানেকটিভিটি বা সংযুক্ততা নামক শব্দ দিয়ে আসলে অস্পষ্টই করা হয়। এক দশক ধরে এফক্যাব, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে একে বলা হচ্ছিল ট্রানজিট। এখন সেটা নতুন নামে এসেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ কতগুলো চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এ সম্পর্কে বাংলাদেশের নাগরিকেরা বিশদভাবে অবগত নন। আমরা জানি না, সরকারের কাছে কী কী সমীক্ষা আছে এবং এসব চুক্তির ধারা-উপধারায় বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায় কতটা রক্ষা পাবে বা পাবে না, তা-ও জনগণ জানতে পারেনি।
বাংলাদেশের সঙ্গে কলকাতা, আসাম, শিলিগুড়ি বা মিয়ানমারের যোগাযোগ তো ইতিমধ্যেই আছে। যেটা নেই, সেটা হলো ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের সরাসরি সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী যোগাযোগের ব্যবস্থা। এটা পেয়ে গেলে ভারতের ওই সব অঞ্চলের জনবিন্যাস, স্থানিক বিন্যাস, অর্থনৈতিক বিন্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তাদের যোগাযোগ খরচ ও সময় আগের তুলনায় শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগে নেমে আসবে। সুতরাং এটা ভারতের জন্য বিরাট সুফলদায়ক পরিবর্তন। কিন্তু আমাদের ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি, না লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি, তা সরকার দেশবাসীকে জানাচ্ছে না। এই রহস্যের কারণ কী?
আমাদের সড়কপথ ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত যানের ভারে ধুঁকছে। ভারতীয় যান চলাচল শুরু হলে এর ওপর চাপ বেড়ে যাবে অনেক। নতুন যোগাযোগ তৈরি করতে কতটা কৃষিজমি, জলাশয়, অরণ্য যাবে, সেটার হিসাব আমাদের কাছে আছে কি? এই প্রতিটির জন্য বাংলাদেশের জনগণকে বিভিন্নভাবে ভুগতে হবে। এর জন্য কী পরিমাণ শুল্ক পাওয়া যাবে, তা-ও নিশ্চিত নয়। এর আগে মানবিক কারণের কথা বলে ভারতীয় পণ্য চলাচল হয়েছে বিনা শুল্কে, ভবিষ্যতেও কি সে রকমই হবে?
অনেকে এ ধরনের যোগাযোগকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তুলনা করেন। প্রথমত, এই যোগাযোগ ভারত থেকে ভারতে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের প্রতিটি দেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশের স্বার্থ স্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত। বাংলাদেশের তুলনায় ভারত যে ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করে, সে রকম অবস্থা সেখানে নেই। আসলে এর সঙ্গে তুলনীয় দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে চার দিকে ঘেরাও থাকা দেশ লেসেথোর সঙ্গে। ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আশঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।
আমরা ভুলতে পারি না, পানি মানবিকতার বা দয়াদাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক আইনস্বীকৃত অধিকার। আমরা ভুলতে পারি না, ভারত তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে তিন দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, সীমান্ত চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় কাঁটাতারের বেড়া সম্পূর্ণ করা নিশ্চিত হলো। আমরা যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা, তখন ভারতীয় পরিবহন বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে অবাধে চলাচল করবে!
কাঁটাতারের পেছনে বড় যুক্তি, বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি হুমকি ঠেকানো। আমাদের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীদের কারও কারও মুখেও এ কথা উচ্চারিত হয়। প্রথমত, কাঁটাতার রেখে কীভাবে কানেকটিভিটি সম্ভব? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের থেকে ভারতকে নিরাপদ করাই যদি কাঁটাতারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেই সন্ত্রাসের উৎস দেশের মধ্যে দিয়ে ভারতের পণ্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচল কীভাবে নিরাপদ হবে? কে নিশ্চয়তা দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। বাংলাদেশের অনেক পুরোনো ইচ্ছা, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। কয়েক বছর আগে ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে সমঝোতা হলেও কার্যত নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড পেরোনোর বন্দোবস্ত হয়নি।
বলা হচ্ছে, কানেকটিভিটির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। এ ধরনের দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকতেই পারে। সমস্যাটা হচ্ছে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশ যেসব পণ্য নিয়ে যেতে সক্ষম, সেগুলোও আটকে থাকছে। নানা রকম প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ বাধা তৈরি করে রাখা হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা না থাকলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বর্তমানের দ্বিগুণ হতে পারত। এ ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষণ কোনো চুক্তিতেই নেই। সে ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে বাংলাদেশের শিল্প বিনিয়োগকারীদের ভারতের বাজারে সুযোগ দিতে হবে। আমাদের পুঁজিপতিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা স্বাধীন দেশের শিল্পপতি হিসেবে লেনদেন করবেন, নাকি ভারতীয় পুঁজির কনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকবেন? ভারতীয় বিনিয়োগের ধরনও হলো, ভারতের পণ্যই ভারতে রপ্তানির ব্যবস্থা করা। এতে করে ভারতে বাংলাদেশের বর্তমান বাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশের টেকসই শিল্পভিত্তি তৈরি হওয়াও বিঘ্নিত হবে। এহেন বিনিয়োগে আমাদের শিল্পপতিদের স্বার্থের ক্ষতি হওয়ার কথা।
অভিন্ন নদী, বিশাল পানিসম্পদ, খনিজ সম্পদ ও মানবসম্পদ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সহযোগিতার পরিকল্পনা গ্রহণের বিরাট সুযোগ আছে। কিন্তু করপোরেট স্বার্থ, আঞ্চলিক আধিপত্য ও বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি এসব অভিন্ন স্বার্থকে খর্ব করছে। উন্নয়ন যদি এ অঞ্চলের স্বার্থেই হয়, তাহলে সবকিছু অন্ধকারে রাখার দরকার কী?
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments