রাজ্জাকের অপহরণের পেছনে রোহিঙ্গা রাজনীতি! by এম সাখাওয়াত হোসেন
এটাই
প্রথম নয়। প্রায় এক বছরের মাথায় একই সীমান্তে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রায়
একই ধরনের ঘটনায় এবার বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) নায়েক রাজ্জাককে
বাংলাদেশ সীমানা, মধ্য নাফ নদী থেকে অপহরণ করা হলো। অবশ্য এ সময় উভয়
পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয় বলে তথ্য প্রকাশ। ওই গোলাগুলিতে বিজিবি সদস্য
বিপ্লব কুমার গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছেন। এ গোলাগুলি ও অপহরণের
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সরকারের তরফ থেকে তেমনভাবে খোলাসা না করলেও
পত্রপত্রিকান্তরে, বিজিবি এবং অন্যান্য তথ্য থেকে যা পাওয়া যায়, তাতে মনে
হয়, বিজিপির এ অভিযান ছিল সুপরিকল্পিত এবং তেমন প্রস্তুতি নিয়েই বাংলাদেশের
জলসীমায় প্রবেশ করেছিল।
ওই অপহরণ ও গোলাগুলির পরপরই আমাদের সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উক্তি ছিল সত্যিই অবাক করার মতো। তিনি অবলীলাক্রমে বক্তব্য দিলেন, ‘এটা একটা ভুল-বোঝাবুঝি ছিল।’ মন্ত্রী মহোদয় সম্ভবত বিষয়টিকে জনসমক্ষে হালকা করতে চেয়েছিলেন, তবে বিষয়টি যে মোটেও হালকা ছিল না, তা বুঝতে বিজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যৎসামান্য সামরিক জ্ঞান নিয়ে ঘটনার শুরু থেকে উপলব্ধি করেছি যে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমার ক্রমেই বাংলাদেশের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। গত বছরের মে মাসে বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে কোনো উসকানি ছাড়া বিজিবির একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়, পরে তাঁকে হত্যা করা হয় এবং বহু দেনদরবারের পর তাঁর লাশ ফেরত দেয় বিজিপি কর্তৃপক্ষ। ওই সময়েও আমাদের সরকারকে তেমন সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এক বছরের মাথায় ফের অপহরণের ঘটনা ঘটার পরপরই যা করার ছিল, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করতে দেখা যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, সমগ্র পরিস্থিতি বিজিবির হাতে ছেড়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত ছিল যে স্বল্প সময়েই কথিত ‘ভুল-বোঝাবুঝির’ অবসান হবে।
কতখানি ভুল-বোঝাবুঝি ছিল, তা এত দিনে মিয়ানমার সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশে জবাবদিহি অনুপস্থিত, তাই অতিসংবেদনশীল বিষয়েও চিন্তাভাবনা বা পরামর্শ না করে তাৎক্ষণিক বক্তব্য দেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। সব বিষয়ে সবার ততটা জানার বিষয় না হলেও সলা–পরামর্শ করতে কখনো দেখা যায়নি।
পত্রপত্রিকা মারফত যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে মনে করা যায় যে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখন এই তৎপরতা কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মিয়ানমারের সঙ্গে ইদানীং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, যদিও বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তেমনও নয়। তথাপি সীমান্তে মিয়ানমার একধরনের উদ্ধত আচরণ করে চলেছে।
মিয়ানমার বাংলাদেশের কথিত কূটনৈতিক আবেদনে সাড়া তো দেয়ইনি, বরং ক্ষতস্থানে নুন ছিটানোর মতো নায়েক রাজ্জাকের যে ধরনের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেছে, তা অনেকটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মতো। এ ধরনের ছবি যেসব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ওই দেশের সেনাসমর্থিত বলে প্রকাশ।
নায়েক রাজ্জাকের যে ধরনের চিত্র প্রকাশিত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়েছে, তাতে দেশপ্রেমী যেকোনো ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হবেন। ইতিমধ্যেই স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। বিজিবিসহ যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমতার প্রতীক। বিজিবি তো অবশ্যই বাংলাদেশের সার্বভৌমতার গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক, যে কারণে বিজিবির প্রতিটি বর্ডার পোস্ট বা বিওপিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়, যা অন্য কোনো বাহিনীর ওই স্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধি নেই। কাজেই কোনো বিওপির সদস্য ওই প্রতীকের অংশীদার। নায়েক রাজ্জাকের এ ধরনের ছবি প্রকাশ করে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের আত্মগরিমায় আঘাত করেছে। তিনি ব্যক্তিমাত্র নন, একটি নিয়মিত বািহনীর সদস্য। আমরা জানি না যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে কী মতামত পোষণ করা হয়।
মিয়ানমার যা করেছে, তা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা শুধু মানবিক দিক থেকেই নয়, জাতিসংঘের নীতির লঙ্ঘন করেছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন যে তাহলে মিয়ানমার কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে উপর্যুপরি এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে? অনেকেই মনে করেন, করার সংগত কারণও রয়েছে, যে মিয়ানমার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ভারতের সেনাবাহিনীর অপারেশনের পর যে ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে, সেখান থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে এবং খবরের কাগজ ও ফেসবুকে এ ধরনের ছবি দিয়ে অন্য খাতে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। এ তথ্য কতখানি যৌক্তিক, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে আগে যেমন বলেছি, এ ঘটনায় মিয়ানমার সরকারের যে প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
যাহোক নায়েক রাজ্জাকের অপহরণ আর চিত্র প্রকাশ করা এবং আমাদের সরকারের অসহায়ত্ব যে জাতিকে হতাশ করেছে, তা মাত্র কয়েক দিন আগে সংসদে দাঁড়িয়ে হাজি সেলিম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে নায়েক রাজ্জাকের হাতে হাতকড়া পরানো মানে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের হাতে হাতকড়া পরানো। তিনি বিজিবির কার্যক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন (প্রথম আলো ২২ জুন, অনলাইন সংস্করণ)। হাজি সেলিম যথার্থই বলেছেন। বিজিবির কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু যে প্রশ্ন তিনি তোলেননি তা হলো দেশের অন্যতম প্যারামিলিটারি ফোর্স যার প্রধান দায়িত্ব শান্তিকালীন সীমান্তের পাহারা দেওয়া এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে সীমান্তে মোতায়েন থাকা, তাদের সে কাজ থেকে অতি ঘন ঘন রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনে নিয়োজিত করার বিষয়ে।
বিজিবি নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ ও পুনর্বিন্যাসের পর এখনো আগের প্রশিক্ষণের পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে ফিরে যেতে পারেনি। প্রায় এক-চতুর্থাংশের বেশি অত্যন্ত নবীন সৈনিক। একটি বাহিনী যেকোনো সমস্যার পর পুনর্গঠিত হয়ে পরিপক্ব হতে সময় লাগে। সে সময় অন্য কাজে নিয়োজিত করলে প্রশিক্ষণ ব্যাহত হবেই।
যাহোক, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা কীভাবে একজন বিজিবি সৈনিককে টহলের সময় ধরে নিয়ে যেতে পারল, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টরা জবাব দেবেন। তবে মিয়ানমার যে এ ধরনের কাজ করতে পারে, তার প্রমাণ আগেও দিয়েছে। সে কারণেই আমাদের সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল বেশি, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মানব পাচার এবং পরবর্তী সময়ে তাদের নিয়ে পূর্ব এশিয়ায় যে সংকট, সেটা এ ঘটনার পেছনের বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। নৌকার উদ্বাস্তু এবং আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ নিয়ে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। মিয়ানমার এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে চাপানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে নায়েক রাজ্জাক অপহৃত হয়েছেন। ২২ জুন বার্মা টাইমস-এ একটি খবর বের হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে অভ্যন্তরীণ সংকটে থাকা মিয়ানমার সরকার নায়েক রাজ্জাকের মুক্তির সঙ্গে সব উদ্ধারকৃত বাদবাকি ৫৫৫ জনকে বাংলাদেশি হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি জুড়ে দিয়েছে। ওই পত্রিকার ভাষ্যমতে, পর্দার পেছনে এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে দর-কষাকষি চলছে।
খবরটির সত্যতা কয়েক দিন আগেই নিশ্চিত করেছে বিজিবি। বিজিবি এ প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে বলেছে যে দুটি দুই বিষয়। অবশ্য এ ধরনের অবমাননাকর প্রস্তাবের ওপর সরকারের মন্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি (জুন ২২, ২০১৫-এ লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত)। এ ধরনের প্রস্তাব হতবাক করেছে দেশবাসীকে।
বার্মা টাইমস-এর খবর যা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করা হয়েছে তাতে প্রতীয়মান যে মিয়ানমারের এ ধরনের আচরণ অমানবিক ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি সার্বভৌম দেশ অপর সার্বভৌম দেশকে এভাবে ব্ল্যাকমেল করতে পারে না। এ ধরনের অভিপ্রায় সম্পূর্ণভাবে জাতিসংঘের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তির লঙ্ঘন। এ ধরেনর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এর পাশাপাশি নায়েক রাজ্জাককে উদ্ধার করে আনা সরকারের একান্ত কর্তব্য। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা পতাকা বৈঠকে রাজি হয়েছেন এবং আজ বৃহস্পতিবার দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বৈঠকটি হওয়ার কথা।
নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ এবং পরবর্তী সময়ে যে ধরনের আচরণ মিয়ানমার সরকার করছে, তা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অকল্পনীয়। চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের এহেন আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তাদের অমানবিক আচরণ ও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সোচ্চার হওয়া উচিত।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওই সীমান্তে মানব পাচার ও মাদকের চোরাচালানির সঙ্গে সীমান্তপারের বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ মিয়ানমার) যেমন যুক্ত, তেমনি বাংলাদেশের ওই অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও যুক্ত। যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ সদস্য। পত্রিকায় প্রকাশ, একজন সাংসদও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত এঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অতএব, আমাদের দায়িত্বও ভুলে গেলে চলবে না। নিজের ঘর সামলাতে না পারলে আমাদের মতো দুর্বল দেশকে সবাই পেয়ে বসবে। মিয়ানমারের এ ঘটনাই তার উদাহরণ।
আমরা দেশের ১৬ কোটি নাগরিক নায়েক রাজ্জাক ও তাঁর পরিবারের পাশে রয়েছি। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাব, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনে মিয়ানমারের এ ধরনের অমানবিক আচরণের বিষয় তুলে ধরতে। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া যে নায়েক রাজ্জাককে অক্ষত অবস্থায় সত্তর ফিরিয়ে দেওয়া ওই দেশের দায়িত্ব। একই সঙ্গে আমাদের সীমান্তে যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে, সরকারকে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
ওই অপহরণ ও গোলাগুলির পরপরই আমাদের সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উক্তি ছিল সত্যিই অবাক করার মতো। তিনি অবলীলাক্রমে বক্তব্য দিলেন, ‘এটা একটা ভুল-বোঝাবুঝি ছিল।’ মন্ত্রী মহোদয় সম্ভবত বিষয়টিকে জনসমক্ষে হালকা করতে চেয়েছিলেন, তবে বিষয়টি যে মোটেও হালকা ছিল না, তা বুঝতে বিজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যৎসামান্য সামরিক জ্ঞান নিয়ে ঘটনার শুরু থেকে উপলব্ধি করেছি যে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমার ক্রমেই বাংলাদেশের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। গত বছরের মে মাসে বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে কোনো উসকানি ছাড়া বিজিবির একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়, পরে তাঁকে হত্যা করা হয় এবং বহু দেনদরবারের পর তাঁর লাশ ফেরত দেয় বিজিপি কর্তৃপক্ষ। ওই সময়েও আমাদের সরকারকে তেমন সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এক বছরের মাথায় ফের অপহরণের ঘটনা ঘটার পরপরই যা করার ছিল, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করতে দেখা যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, সমগ্র পরিস্থিতি বিজিবির হাতে ছেড়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত ছিল যে স্বল্প সময়েই কথিত ‘ভুল-বোঝাবুঝির’ অবসান হবে।
কতখানি ভুল-বোঝাবুঝি ছিল, তা এত দিনে মিয়ানমার সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশে জবাবদিহি অনুপস্থিত, তাই অতিসংবেদনশীল বিষয়েও চিন্তাভাবনা বা পরামর্শ না করে তাৎক্ষণিক বক্তব্য দেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। সব বিষয়ে সবার ততটা জানার বিষয় না হলেও সলা–পরামর্শ করতে কখনো দেখা যায়নি।
পত্রপত্রিকা মারফত যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে মনে করা যায় যে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় বেশ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখন এই তৎপরতা কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মিয়ানমারের সঙ্গে ইদানীং রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, যদিও বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তেমনও নয়। তথাপি সীমান্তে মিয়ানমার একধরনের উদ্ধত আচরণ করে চলেছে।
মিয়ানমার বাংলাদেশের কথিত কূটনৈতিক আবেদনে সাড়া তো দেয়ইনি, বরং ক্ষতস্থানে নুন ছিটানোর মতো নায়েক রাজ্জাকের যে ধরনের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেছে, তা অনেকটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মতো। এ ধরনের ছবি যেসব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ওই দেশের সেনাসমর্থিত বলে প্রকাশ।
নায়েক রাজ্জাকের যে ধরনের চিত্র প্রকাশিত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়েছে, তাতে দেশপ্রেমী যেকোনো ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হবেন। ইতিমধ্যেই স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। বিজিবিসহ যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমতার প্রতীক। বিজিবি তো অবশ্যই বাংলাদেশের সার্বভৌমতার গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক, যে কারণে বিজিবির প্রতিটি বর্ডার পোস্ট বা বিওপিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়, যা অন্য কোনো বাহিনীর ওই স্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধি নেই। কাজেই কোনো বিওপির সদস্য ওই প্রতীকের অংশীদার। নায়েক রাজ্জাকের এ ধরনের ছবি প্রকাশ করে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের আত্মগরিমায় আঘাত করেছে। তিনি ব্যক্তিমাত্র নন, একটি নিয়মিত বািহনীর সদস্য। আমরা জানি না যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে কী মতামত পোষণ করা হয়।
মিয়ানমার যা করেছে, তা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা শুধু মানবিক দিক থেকেই নয়, জাতিসংঘের নীতির লঙ্ঘন করেছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন যে তাহলে মিয়ানমার কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে উপর্যুপরি এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে? অনেকেই মনে করেন, করার সংগত কারণও রয়েছে, যে মিয়ানমার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ভারতের সেনাবাহিনীর অপারেশনের পর যে ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে, সেখান থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে এবং খবরের কাগজ ও ফেসবুকে এ ধরনের ছবি দিয়ে অন্য খাতে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। এ তথ্য কতখানি যৌক্তিক, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে আগে যেমন বলেছি, এ ঘটনায় মিয়ানমার সরকারের যে প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
যাহোক নায়েক রাজ্জাকের অপহরণ আর চিত্র প্রকাশ করা এবং আমাদের সরকারের অসহায়ত্ব যে জাতিকে হতাশ করেছে, তা মাত্র কয়েক দিন আগে সংসদে দাঁড়িয়ে হাজি সেলিম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে নায়েক রাজ্জাকের হাতে হাতকড়া পরানো মানে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের হাতে হাতকড়া পরানো। তিনি বিজিবির কার্যক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন (প্রথম আলো ২২ জুন, অনলাইন সংস্করণ)। হাজি সেলিম যথার্থই বলেছেন। বিজিবির কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু যে প্রশ্ন তিনি তোলেননি তা হলো দেশের অন্যতম প্যারামিলিটারি ফোর্স যার প্রধান দায়িত্ব শান্তিকালীন সীমান্তের পাহারা দেওয়া এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে সীমান্তে মোতায়েন থাকা, তাদের সে কাজ থেকে অতি ঘন ঘন রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমনে নিয়োজিত করার বিষয়ে।
বিজিবি নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ ও পুনর্বিন্যাসের পর এখনো আগের প্রশিক্ষণের পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে ফিরে যেতে পারেনি। প্রায় এক-চতুর্থাংশের বেশি অত্যন্ত নবীন সৈনিক। একটি বাহিনী যেকোনো সমস্যার পর পুনর্গঠিত হয়ে পরিপক্ব হতে সময় লাগে। সে সময় অন্য কাজে নিয়োজিত করলে প্রশিক্ষণ ব্যাহত হবেই।
যাহোক, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা কীভাবে একজন বিজিবি সৈনিককে টহলের সময় ধরে নিয়ে যেতে পারল, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টরা জবাব দেবেন। তবে মিয়ানমার যে এ ধরনের কাজ করতে পারে, তার প্রমাণ আগেও দিয়েছে। সে কারণেই আমাদের সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল বেশি, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মানব পাচার এবং পরবর্তী সময়ে তাদের নিয়ে পূর্ব এশিয়ায় যে সংকট, সেটা এ ঘটনার পেছনের বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। নৌকার উদ্বাস্তু এবং আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ নিয়ে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। মিয়ানমার এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে চাপানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে নায়েক রাজ্জাক অপহৃত হয়েছেন। ২২ জুন বার্মা টাইমস-এ একটি খবর বের হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে অভ্যন্তরীণ সংকটে থাকা মিয়ানমার সরকার নায়েক রাজ্জাকের মুক্তির সঙ্গে সব উদ্ধারকৃত বাদবাকি ৫৫৫ জনকে বাংলাদেশি হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি জুড়ে দিয়েছে। ওই পত্রিকার ভাষ্যমতে, পর্দার পেছনে এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে দর-কষাকষি চলছে।
খবরটির সত্যতা কয়েক দিন আগেই নিশ্চিত করেছে বিজিবি। বিজিবি এ প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে বলেছে যে দুটি দুই বিষয়। অবশ্য এ ধরনের অবমাননাকর প্রস্তাবের ওপর সরকারের মন্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি (জুন ২২, ২০১৫-এ লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত)। এ ধরনের প্রস্তাব হতবাক করেছে দেশবাসীকে।
বার্মা টাইমস-এর খবর যা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করা হয়েছে তাতে প্রতীয়মান যে মিয়ানমারের এ ধরনের আচরণ অমানবিক ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি সার্বভৌম দেশ অপর সার্বভৌম দেশকে এভাবে ব্ল্যাকমেল করতে পারে না। এ ধরনের অভিপ্রায় সম্পূর্ণভাবে জাতিসংঘের এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তির লঙ্ঘন। এ ধরেনর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এর পাশাপাশি নায়েক রাজ্জাককে উদ্ধার করে আনা সরকারের একান্ত কর্তব্য। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা পতাকা বৈঠকে রাজি হয়েছেন এবং আজ বৃহস্পতিবার দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বৈঠকটি হওয়ার কথা।
নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ এবং পরবর্তী সময়ে যে ধরনের আচরণ মিয়ানমার সরকার করছে, তা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অকল্পনীয়। চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের এহেন আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তাদের অমানবিক আচরণ ও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সোচ্চার হওয়া উচিত।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওই সীমান্তে মানব পাচার ও মাদকের চোরাচালানির সঙ্গে সীমান্তপারের বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ মিয়ানমার) যেমন যুক্ত, তেমনি বাংলাদেশের ওই অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও যুক্ত। যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ সদস্য। পত্রিকায় প্রকাশ, একজন সাংসদও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত এঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অতএব, আমাদের দায়িত্বও ভুলে গেলে চলবে না। নিজের ঘর সামলাতে না পারলে আমাদের মতো দুর্বল দেশকে সবাই পেয়ে বসবে। মিয়ানমারের এ ঘটনাই তার উদাহরণ।
আমরা দেশের ১৬ কোটি নাগরিক নায়েক রাজ্জাক ও তাঁর পরিবারের পাশে রয়েছি। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাব, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইনে মিয়ানমারের এ ধরনের অমানবিক আচরণের বিষয় তুলে ধরতে। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া যে নায়েক রাজ্জাককে অক্ষত অবস্থায় সত্তর ফিরিয়ে দেওয়া ওই দেশের দায়িত্ব। একই সঙ্গে আমাদের সীমান্তে যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে, সরকারকে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments