ময়মুনার দ্বিতীয় বিয়ে by মাহবুব মোর্শেদ
হিট অ্যান্ড হট। এই ছিল ক্যাম্পাসের ময়মুনা। আলাদা লাইফস্টাইল, আলাদা আউটলুক। মাঝে মাঝে ইন্সপায়ারিংও মনে হতো। মিতুর রোলমডেল। বন্ধুত্ব অত গাঢ় না হলেও ময়মুনা আমারও ফেবারিট ছিল। ভালো সঙ্গী ছিলাম। অথচ ক্যাম্পাস ফুরাতে না-ফুরাতে ময়মুনা কীভাবে যেন আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকল। হয়তো চোখের আড়ালে থেকে প্রভাব সঞ্চারের মতো ব্যক্তিত্ব ময়মুনা নয়। হয়তো আমিই হারিয়ে ফেলেছি। আমারই সমস্যা। তবু মাঝে মাঝে ময়মুনার কথা মনে হয়। ওর নামটা ময়মুনা না হয়ে সিলভি বা সিনথিয়াও তো হতে পারত। হলে ভালোই মানাত। আমরা ময়মুনাকে মুনা বলে ডাকতাম। ময়মুনা বলত, খল মি ময়মুনা। আয় লাভ মাই নেইম। আইম প্রাউড অব ইট। জিহ্বা জড়িয়ে ইংলিশ অ্যাকসেন্টে কথা বলত। বাংলাও তেমনই। এ লেভেল, ও লেভেল করা মেয়ে। জিনসের ওপর রেড, ব্লু অথবা ম্যাজেন্টা পরত বেশির ভাগ সময়। আমরা যখন সেমিজ ছাড়তে পারিনি, তখন ময়মুনা ওড়না ছাড়াই ঘুরে বেড়ায়। হলের মেয়েরা বলত, ওর অনেক ড্রেস কিন্তু ওড়না নেই একটাও। স্কিনি জিনস ছিল ওর প্রিয়। এখন ও রকম জিনসকে লেগিংসের অনুকরণে বলে জেনিংস। উইকএন্ডটা ঢাকার বাসায় কাটিয়ে মুনা যখন ক্যাম্পাসে ফিরত, তখন একটা চকলেট কালারের টয়োটা করোলা ওকে নামিয়ে দিত। এমন একটা মেয়ের নাম কী বুঝে যে ওর বাবা ময়মুনা রেখেছিল!
ক্যাম্পাস ছাড়ার পরপর ময়মুনা অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। এডিলেডে এমএস করবে বলে। মনে হয় শেষ করেনি। মুনা ছিল অ্যাভারেজ ছাত্রী, স্টুডিয়াস হওয়ার কোনো লক্ষণ ওর মধ্যে কখনোই ছিল না। এরপর বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল। ক্যাম্পাসের পর ময়মুনার অতটুকু খবরই এসেছিল কানে। বিয়ে-থা নিয়ে কোনো কথা আমার কান পর্যন্ত আসেনি। এখন জানি, ময়মুনা ম্যানহাটনে থাকে। ইউএসএইডে কাজ করে। মাঝেমধ্যে ময়মুনার আপডেট টাইমলাইনে ভেসে আসে। আপডেট মানে ছবি। আইওএস ডিভাইস থেকে পোস্ট করা পিকস। নানা দেশের এয়ারপোর্টের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে সেলফি তোলে আর আপলোড করে। ছবিগুলো কমন, ওয়েস্টার্ন স্টাইল রপ্ত করা একটা এশিয়ান মেয়ে বড় বড় বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে সেলফি তোলে। দেখে মনে হয়, এটা ওর অবসেশন হয়ে গেছে।
যোগাযোগ বলতে ফেসবুকটুকই। আগে মনে হতো ক্যাম্পাসের বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। ময়মুনা, সোমা, মিতু কারও সঙ্গে আর দেখা হবে না। বছর পাঁচেক আগে এক বিকেলে সোমার ছবিটা খুব মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই মনে পড়ল না। এত কাছের বন্ধু ছিল সোমা। অ্যালবামেও ওর কোনো ছবি খুঁজে পেলাম না। আগ বাড়িয়ে ভাবতে গিয়ে মনে মনে হাসছিলাম। আমরা তো দেখতে মহিলা হয়ে গেছি। রাস্তায় দেখা হলেও হয়তো সোমাকে চিনতে পারব না।
ময়মুনার ছবিটাও স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। ফেসবুকে হঠাৎ কমন ফ্রেন্ডদের মধ্যে ওকে পেলাম। রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর ময়মুনার সে কী উচ্ছ্বাস। বলে, দোস্ত, মোটা হয়ে যাচ্ছিস কেন? ওওর্ক আউট রেগুলার। ওয়াক, ওয়াক, ওয়াক। হুমম, পর্যন্ত বলে আমি থমকে থাকি। ময়মুনা যে কীভাবে এত স্লিম থাকল। সেই একই ফিগার। ফর্টি ক্রস করেছে কেউ ভাবতেই পারবে না। ময়মুনার স্লিম থাকা নিয়ে আমার মধ্যে খুব যে বিস্ময় কাজ করে তা নয়। বরং একটা দূরত্বই ফিল করি। ক্যাম্পাসে আমরা ছিলাম গ্রাম থেকে আসা মেয়ে। গায়ে ধুলার গন্ধ। পায়ে কাদা লেগে থাকা। সার্কেলে ময়মুনাই ছিল ব্যতিক্রম। কমপ্লিট আরবান।
ময়মুনা বুঝত, আমাদের মধ্যে সে-ই একমাত্র আরবান। আমরাও তো আরবানই হতে চাইতাম মনে মনে। গোপনে হোক বা প্রকাশ্যে ময়মুনার হাবভাব খেয়াল করতাম। ও বুঝেও না বোঝার ভান করত। এটাই ওর ভালো। এর বাইরে ময়মুনার এমন কিছু ছিল না যা আমার মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারত। এখন বরং ময়মুনার কথা মনে হলে হাসি পায়। আমি ওর নাম নিয়ে ভাবি। ওর নাম সিলভি বা সিনথিয়া হলেই বেশি মানাত। এই দুইটা নাম কোথা থেকে আমার মাথায় ঢুকেছে জানি না। পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো স্মার্ট মেয়ের নাম কি সিলভি বা সিনথিয়া ছিল? মনে পড়ে না। ময়মুনার কথা মনে হলে তবু ওই দুইটা নাম মনে আসে। কোনো কো-ইনসিডেন্স আছে কি না জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করাও তো যায় না। ক্লাসমেটদের প্রতি সহজাত জেলাসি সবারই থাকে। সেখান থেকে কি আসে ব্যাপারটা? মিতু শুনলে বলবে, তোমার জেলাসি এখনো যায়নি। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, ময়মুনাকে অত অ্যাট্রাকটিভ লাগে না আমার কখনোই।
ফেসবুকে ময়মুনা অনেক অ্যাকটিভ। সরকারি চাকরি করি বলে আমাদের প্রায় সবকিছুতেই মানা। স্ট্যাটাস দিতে পারি না। ছবি শেয়ারেও সাবধানী হতে হয়। শুধু লাইক দিই। শেয়ারও করি না তেমন। ময়মুনা হিথরো এয়ারপোর্টে সেলফি তুলেছে, চোখে পড়ল তো লাইক দিলাম। হয়তো ওয়াটার টাউন এয়ারপোর্টের সেলফি চোখেই পড়ল না। ওর টাইমলাইনে গিয়ে স্ট্যাটাস ঘাঁটাঘাঁটি করছি, চেক আউট-চেক ইন খেয়াল করছি এমন এখনো ঘটেনি। আর ঘাঁটলেও ময়মুনার পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু ফেসবুক থেকে জানা সম্ভব কি না জানি না। ইনবক্সে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু করা হয়নি কখনো।
অথচ ময়মুনার পার্সোনাল কিছু ব্যাপার এখন আমাকে তাড়া করে ফিরছে। গত মাসের ২৬ তারিখ সকালের ঘটনা। তারিখটা মনে আছে। এমনকি বারটাও। মনে থাকার কারণ ময়মুনা না। ওই দিন একটা জরুরি মিটিং ছিল প্ল্যানিং কমিশনে। অফিসে ফাইল গোছাচ্ছি। আগারগাঁও যেতে হবে। হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা ফোন এল।
স্মৃতি, ইটস মাইমুনা।
আমি একটু উচ্ছ্বাস দেখিয়ে গলা চড়াতে যাব, অমনি ময়মুনা গম্ভীরভাবে বলল, ফ্রেন্ড! অল ইউ ডিড টু মি ইজ রং। ইউ গট ইট রং। শোনো, আমি সেকেন্ড ম্যারেজ করিনি। ইন ফ্যাক্ট আমি এর প্রয়োজনও এই মুহূর্তে অনুভব করছি না। এখন একটা টার্কিশ ছেলের সঙ্গে লিভ ইন করছি। না, কোনো পাকিস্তানিকে বিয়ে করিনি। অ্যানি প্রবলেম?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিছু বলতেও পারছিলাম না। ময়মুনা আমাকে ভুলে ফোন দেয়নি, সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কথাগুলো আমাকেই কেন বলছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমি শুধু একটাই প্রশ্ন করলাম, তোমার বিয়েটা কি ভেঙে গেছে?
ইউ নো নাথিং, না? সবাইকে তো ঠিকই বলে বেড়াচ্ছ।
সেক্রেটারিয়েটের গেটে মাইক্রো অপেক্ষা করছে। বললাম, মুনা আমি একটু ব্যস্ত। তোমাকে পরে কলব্যাক করছি। এটাই তো তোমার নম্বর? একটু ফ্রি হয়েই...।
ময়মুনাকে বললাম বিজি। কিন্তু যে কাজে বিজি থাকার কথা সে কাজে আর মন বসছিল না। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবছিলাম, ময়মুনার কী হয়েছে? স্বাভাবিকভাবে ওর একটা সংসার থাকার কথা। হয়তো ছিলও। একটা মেয়ে ছিল। নাকি ছেলে? সংসারটা ভেঙে গিয়েছে? কেন ভেঙে গেল? ডিভোর্স নাকি সেপারেশন? তারপর ময়মুনা কী করল? আর বিয়ে করেনি কেন? লিভ ইন করছে? এখন তো এ দেশেও করে লোকে। ময়মুনাও করতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে আমি কীভাবে এলাম?
ময়মুনার সংসার নিয়ে কমন ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কোনো কথা হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। হলে মাথায় থাকত। তবে এটা ঠিক, ফেসবুকের নিউজফিডে ময়মুনার যত ছবি পাই, সবই ওর একার। ব্যাপারটা আগেই মাথায় খেলতে পারত। কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারতাম। করিনি।
ময়মুনার নম্বরটা ঢাকার। হয়তো কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা তখনই উঠেছে। ময়মুনা কি তাহলে পাকিস্তানি একজনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে? নাকি ও যা বলল সেটাই সত্যি, টার্কিশ একটা ছেলের সঙ্গে লিভ টুগেদার?
ময়মুনাদের ধানমন্ডির বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম আমরা। আমি, সোমা, মিতু, সাদেক আর আসিফ। ওর বড় ভাইয়ের মেয়ের বার্থডে ছিল। অতটুকুই পারিবারিক হতে পেরেছিলাম। ময়মুনা শেষ পর্যন্ত কাকে বিয়ে করেছিল জানি না। ক্যাম্পাসের ছেলেদের ও পছন্দ করত না। কারও সঙ্গে প্রেম হয়নি নিশ্চিত। তবে মাঝে মাঝে দু-একজন ঢাকা থেকে আসত। হলের জানালা থেকে আমরা দেখতাম, মুনা কোনো দিন স্পোর্টস কার, কোনো দিন হোন্ডার পেছনে উঠে চলে যাচ্ছে। হলের গেট বন্ধ হওয়ার আগে তারা নামিয়েও দিয়ে যেত। তাদের কাউকে কি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছিল? সত্যিই জানি না।
ফ্রি হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। অফিস আওয়ার শেষ। রিকশায় শেখেরটেক ফিরতে ফিরতে মুনার নম্বরে কল করলাম।
ময়মুনা ধরেই বলল, প্লিজ স্মৃতি, প্লিজ। ডোন্ট পুট ইওর নোজ ইন মাই পার্সোনাল বিজনেস।
তুমি কি আমার কয়েকটা কথা শুনবে?
কী বলবা তুমি? বলো। শুনি।
শোনো, আমি আসলে জানিও না তোমার আগের বিয়েটা ভেঙে গেছে কি না।
আগের বিয়ে মানে কী? আমি প্রতিদিন একটা করে বিয়ে করে বেড়াচ্ছি নাকি। হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আগের বিয়ে? তোমরা গ্রামের মেয়েরা বুঝলা চিন্তাভাবনায় সেই রকমই থেকে গেলা। শোনো, তোমাকে একটা কথাই জানানোর ছিল আমার। তুমি আমার পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে কোনো কমেন্ট করবা না।
ফোন কেটে দিল ময়মুনা।
অদ্ভুত একটা সমস্যা। আমি জানি না, এমন একটা বিষয় নিয়ে প্রায় সারা দিন ভাবছি। ময়মুনার অভিযোগটা গায়ে এসে লাগছে। পুরোটা সে বলছে না, আমার কথাও শুনছে না। ক্লাসমেট হিসেবে একটা অধিকারবোধ হয়তো তার আছে। কিন্তু এত দিন পর কথা হচ্ছে। মানুষ তো সাধারণ হাই-হ্যালো করার পর ঝগড়া শুরু করে। একটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ সে নিতে বা দিতে পারত।
বাসায় ফিরে মেয়েকে নাশতা দিয়ে, চা চাপিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। অনেক নোটিফিকেশন, মেসেজ। ফেসবুকে ময়মুনা ঢাকা এয়ারপোর্টে তোলা সেলফি দিয়েছে তিন দিন আগে। এরপর আর কিছু নেই। প্রথমবারের মতো ময়মুনার অ্যালবামগুলো দেখলাম মন দিয়ে। ওর পার্সোনাল লাইফের কোনো হিন্ট সেখানে নেই। আগে চাইলেও ফেসবুক থেকে কিছু জানতে পারতাম না।
ক্যাম্পাসে মিতু ছিল ময়মুনার সবচেয়ে কাছের। মিতু-ময়মুনা জুটি হয়ে গিয়েছিল। ওর দেখাদেখি মিতুও ক্যাম্পাসে কামিজের সঙ্গে জিনস পরা ধরেছিল। ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে চৌরঙ্গী থেকে ট্রান্সপোর্টের দিকে যাচ্ছে—এ রকম একটা দৃশ্য মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে। দুজন দুজনের হাত হাতের ভেতর নিয়েছে। কেন এই দৃশ্যটা মনে পড়ে জানি না। ওরা দুজন বরাবরই কনট্রাস্ট। মিতু এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ময়মুনাকে আগের মতোই ফলো করে। ঢাকা এয়ারপোর্টের ছবিতেও দেখলাম লাইক দিয়েছে। কমেন্ট একটাই, ওরই—সি ইউ সুন।
মিতুর টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম, এরই মধ্যে ওদের দেখা হয়েছে। বেলিসিমোতে আইসক্রিম খেতে খেতে তোলা আড্ডার সেলফিও পোস্ট করেছে। মিতুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, মাস দু-এক আগে। ওর ছোট ভাইকে সার্টিফিকেট সত্যায়িত করতে পাঠিয়েছিল। নম্বরটা আছে। ক্লাসমেট মিতু। হয়তো মিতু জানবে, কেন ময়মুনা আমার ওপর খেপেছে। হয়তো কেন, মিতু নিশ্চিতভাবেই জানবে। ময়মুনার সব আপডেট খেয়াল করে মিতু। ময়মুনার সংসার কবে ভাঙল। সেপারেশন না ডিভোর্স। ছেলেটা বা মেয়েটা এক্স হাজব্যান্ডের সঙ্গে থাকে নাকি ময়মুনার মায়ের কাছে। ময়মুনা কার সঙ্গে নাইট আউট করছে। টার্কিশ না পাকিস্তানি কার সঙ্গে বিয়ে বসছে। কার সঙ্গে লিভ ইন করছে।
হয়তো মিতুই আলাপে আলাপে ঝামেলাটা পাকিয়েছে। ময়মুনার পেট থেকে কথা বের করার জন্য বিয়ের খবরটা বলে টোপ ফেলেছে। পার্সোনাল ব্যাপারে ময়মুনা বেশ অ্যালার্ট। জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কীভাবে জানলা। আমার নাম বলে দিয়েছে। অনেক ভেবেও মিতুকে ফোন দেব কি দেব না সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। রাতের রান্না বাকি। সাদেক ফিরেই মন দিল টিভির টকশোতে। মেয়ের ফার্স্ট সেমিস্টার কাল থেকে শুরু। রাতের রান্না শুধু না, সকালের জন্যও কিছু করে রাখতে হবে।
অফিস-বাসা করতে করতে ময়মুনার ব্যাপারটা প্রায় ফিকে হয়ে আসছিল। হঠাৎ পয়লা রমজানের আগের সন্ধ্যায় মিতুর ফোন। ফোনে ক্লাসমেট মিতু নামটা দেখার পর মনে হলো কী ব্যস্ত জীবন। প্রায় মাস গড়াতে চলল। ময়মুনা এত বাজে আচরণ করার পরও মিতা-ময়মুনা কাউকেই আর ফোন দেওয়া হয়নি। ফোনটা একটু গম্ভীর গলাতেই ধরলাম।
বন্ধু, তুমি তো ডিএস হয়েই গেলা। কিন্তু কাকে নিয়ে কী বলে বেড়াও কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। আর বললেও ঠিক খবরটা নিয়ে বলবা না? সরকার তোমাদের এত বড় বড় দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে কি এমনি এমনি। এইটুকু রেসপনসিবিলিটি দিয়ে তোমরা দেশ চালাবা?
মিতু ফোন দিলে একাই বলে। আমি শুনছি কি না এটা ওর কাছে ম্যাটার করে না।
আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারলাম, কোন ব্যাপারটা বলো তো?
আরে আমাদের ময়মুনা। শোনো ময়মুনা পাকিস্তানি ছেলেকে বিয়ে করেছে—এটা সত্য নয়। ওর প্রেমিকটা আসলে টার্কিশই। কিন্তু লিভ ইনটা আসলে হেডলাইন না, দোস্ত। আসল খবর হলো, ময়মুনা কনসিভ করেছে। পেটে টার্কিশ বাচ্চা। ভাবতে পারো, আমাদের ক্লাসমেট লিভ ইন করে কনসিভ করে ফেলেছে। তার পেটে টার্কিশ বাচ্চা। সত্যি ময়মুনা আনপ্যারালাল। আমরা তো সেই তুলনায় কিছুই করতে পারলাম না দোস্ত। তবে এটা ঠিক, পার্সোনাল লাইফ নিয়ে বরাবরই খুব রিজার্ভ মেয়েটা। নিজে থেকে বলে না যে কেন, বললেই তো সবাই মিলে সেলিব্রেট করা যায়। টার্কিশ ছেলেদের দেখারই তো ভাগ্য হলো না আমাদের। আর দেখো ময়মুনা, পেটে টার্কিশ বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এয়ারপোর্টে ওর সেলফি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই তড়িঘড়ি দেখা করলাম। যা ভেবেছিলাম সত্যি। দেখেই বুঝেছি, চার মাস চলছে। সরাসরি তো জিজ্ঞেস করা যায় না। তাই তোমার রেফারেন্স দিলাম। খুব দুঃখ পেল। জানো, ময়মুনা হু হু করে কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে সবই বলে দিল। খুব ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। লিভ টুগেদারের বাচ্চা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওর ফ্যামিলি। অ্যান্টিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলো, সেভেনটি আপ মা কোনো দিন মেয়ের এই অবস্থা মেনে নেবে? দেশটা তো এখনো ফ্রান্স বা ইতালি হয়ে যায়নি। অ্যান্টির সঙ্গে দেখা করেই চলে গেছে ময়মুনা। মা-মেয়ের তর্কে কোনো সমাধান হয়নি।
এক ফাঁকে মিতুকে জিজ্ঞেস করলাম, ময়মুনা জিজ্ঞেস করল না একবারও, ওর পার্সোনাল খবর আমি কীভাবে পেলাম?
করেছিল। আমি বলেছি ফেসবুকের যুগে কি কিছু আর গোপন থাকে। কানেকটিভিটির যুগ, ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন তো সবাই কানেকটিভিটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি এসেও তো সেই কথাই বললেন। আর সিলভি, সিনথিয়া বদমাশ দুইটা তো তোমার পেছনে লেগেই আছে। এই দুই বোনকে চেনো তো? ময়মুনার এক্স হাজব্যান্ড মামুনকে বিয়ে করেছে সিলভি। সিলভির ছোট বোন সিনথিয়া। বিশ্বসুন্দরী। তোমাদের ওদিকেই তো থাকে। সিলভির জীবনের মোেটা কি জানো? ময়মুনার লাইফটা হেল করে দেওয়া। ময়মুনার স্বামী আর মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাতেও শেষ হয়নি। এখনো ওর পেছনে লেগে আছে। ম্যানহাটন পর্যন্ত গোয়েন্দা লাগানো ওর। সিলভিই ময়মুনার মাকে লিভ টুগেদারের বাচ্চার খবর দিয়েছে। খবর ছড়াতে আমাকেও ফোন দেয় রেগুলার। বাচ্চার কথা অবশ্য আমাকে সরাসরি বলেনি। আচ্ছা তুমি সিলভিকে চিনছ তো? ওই যে আমরা একবার ওদের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম না? ময়মুনার বড় ভাইয়ের মেয়ের জন্মদিনে। সেখানে ময়মুনার ভাবির দুই বোন ছিল। মনে আছে?
নাহ্। মনে পড়ে না তো।
দেখেছ তুমি। মনে থাকার কথা।
নাহ্। মনে পড়ে না।
আচ্ছা। একটা কথা তো মনে থাকার কথা। ময়মুনার ভাবির নাম। এটা নিয়ে সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। মনে আছে?
এবার মনে পড়ল আমার। ময়মুনার ভাবির নাম স্মৃতি। তিন বোন। স্মৃতি, সিলভি, সিনথিয়া। সবার বড় বোনের নাম স্মৃতি। উনিই ময়মুনার ভাবি, বড় ভাইয়ের বউ। কিন্তু আহামরি সুন্দরী কি ছিল সিনথিয়া? সাদেকের সঙ্গে ওই সময়টা খুব সমস্যা যাচ্ছিল আমার। হয়তো সে কারণে ভালো করে কিছু মনে নেই। অন্যমনস্ক ছিলাম। তবে এইটুকু মনে আছে, ময়মুনার বড় ভাবি আর আমার নাম মিলে যাওয়ায় সবাই একটু দুষ্টুমি করছিল।
ঝাপসা হয়ে গেছে।
মিতু বলে চলে, বুঝলা স্মৃতি, ময়মুনার কিছু খবর আমি স্মৃতির কাছেও পাই। তুমি স্মৃতি না। ময়মুনার বড় ভাবি স্মৃতি। খুব দুষ্ট প্রকৃতির মহিলা। তোমার নামেই নাম। তুমি কিছু মনে কোরো না, দোস্ত। একবার হয়েছে কি...।
ক্যাম্পাস ছাড়ার পরপর ময়মুনা অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। এডিলেডে এমএস করবে বলে। মনে হয় শেষ করেনি। মুনা ছিল অ্যাভারেজ ছাত্রী, স্টুডিয়াস হওয়ার কোনো লক্ষণ ওর মধ্যে কখনোই ছিল না। এরপর বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল। ক্যাম্পাসের পর ময়মুনার অতটুকু খবরই এসেছিল কানে। বিয়ে-থা নিয়ে কোনো কথা আমার কান পর্যন্ত আসেনি। এখন জানি, ময়মুনা ম্যানহাটনে থাকে। ইউএসএইডে কাজ করে। মাঝেমধ্যে ময়মুনার আপডেট টাইমলাইনে ভেসে আসে। আপডেট মানে ছবি। আইওএস ডিভাইস থেকে পোস্ট করা পিকস। নানা দেশের এয়ারপোর্টের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে সেলফি তোলে আর আপলোড করে। ছবিগুলো কমন, ওয়েস্টার্ন স্টাইল রপ্ত করা একটা এশিয়ান মেয়ে বড় বড় বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে সেলফি তোলে। দেখে মনে হয়, এটা ওর অবসেশন হয়ে গেছে।
যোগাযোগ বলতে ফেসবুকটুকই। আগে মনে হতো ক্যাম্পাসের বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। ময়মুনা, সোমা, মিতু কারও সঙ্গে আর দেখা হবে না। বছর পাঁচেক আগে এক বিকেলে সোমার ছবিটা খুব মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই মনে পড়ল না। এত কাছের বন্ধু ছিল সোমা। অ্যালবামেও ওর কোনো ছবি খুঁজে পেলাম না। আগ বাড়িয়ে ভাবতে গিয়ে মনে মনে হাসছিলাম। আমরা তো দেখতে মহিলা হয়ে গেছি। রাস্তায় দেখা হলেও হয়তো সোমাকে চিনতে পারব না।
ময়মুনার ছবিটাও স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। ফেসবুকে হঠাৎ কমন ফ্রেন্ডদের মধ্যে ওকে পেলাম। রিকোয়েস্ট পাঠানোর পর ময়মুনার সে কী উচ্ছ্বাস। বলে, দোস্ত, মোটা হয়ে যাচ্ছিস কেন? ওওর্ক আউট রেগুলার। ওয়াক, ওয়াক, ওয়াক। হুমম, পর্যন্ত বলে আমি থমকে থাকি। ময়মুনা যে কীভাবে এত স্লিম থাকল। সেই একই ফিগার। ফর্টি ক্রস করেছে কেউ ভাবতেই পারবে না। ময়মুনার স্লিম থাকা নিয়ে আমার মধ্যে খুব যে বিস্ময় কাজ করে তা নয়। বরং একটা দূরত্বই ফিল করি। ক্যাম্পাসে আমরা ছিলাম গ্রাম থেকে আসা মেয়ে। গায়ে ধুলার গন্ধ। পায়ে কাদা লেগে থাকা। সার্কেলে ময়মুনাই ছিল ব্যতিক্রম। কমপ্লিট আরবান।
ময়মুনা বুঝত, আমাদের মধ্যে সে-ই একমাত্র আরবান। আমরাও তো আরবানই হতে চাইতাম মনে মনে। গোপনে হোক বা প্রকাশ্যে ময়মুনার হাবভাব খেয়াল করতাম। ও বুঝেও না বোঝার ভান করত। এটাই ওর ভালো। এর বাইরে ময়মুনার এমন কিছু ছিল না যা আমার মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলতে পারত। এখন বরং ময়মুনার কথা মনে হলে হাসি পায়। আমি ওর নাম নিয়ে ভাবি। ওর নাম সিলভি বা সিনথিয়া হলেই বেশি মানাত। এই দুইটা নাম কোথা থেকে আমার মাথায় ঢুকেছে জানি না। পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো স্মার্ট মেয়ের নাম কি সিলভি বা সিনথিয়া ছিল? মনে পড়ে না। ময়মুনার কথা মনে হলে তবু ওই দুইটা নাম মনে আসে। কোনো কো-ইনসিডেন্স আছে কি না জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করাও তো যায় না। ক্লাসমেটদের প্রতি সহজাত জেলাসি সবারই থাকে। সেখান থেকে কি আসে ব্যাপারটা? মিতু শুনলে বলবে, তোমার জেলাসি এখনো যায়নি। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, ময়মুনাকে অত অ্যাট্রাকটিভ লাগে না আমার কখনোই।
ফেসবুকে ময়মুনা অনেক অ্যাকটিভ। সরকারি চাকরি করি বলে আমাদের প্রায় সবকিছুতেই মানা। স্ট্যাটাস দিতে পারি না। ছবি শেয়ারেও সাবধানী হতে হয়। শুধু লাইক দিই। শেয়ারও করি না তেমন। ময়মুনা হিথরো এয়ারপোর্টে সেলফি তুলেছে, চোখে পড়ল তো লাইক দিলাম। হয়তো ওয়াটার টাউন এয়ারপোর্টের সেলফি চোখেই পড়ল না। ওর টাইমলাইনে গিয়ে স্ট্যাটাস ঘাঁটাঘাঁটি করছি, চেক আউট-চেক ইন খেয়াল করছি এমন এখনো ঘটেনি। আর ঘাঁটলেও ময়মুনার পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু ফেসবুক থেকে জানা সম্ভব কি না জানি না। ইনবক্সে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু করা হয়নি কখনো।
অথচ ময়মুনার পার্সোনাল কিছু ব্যাপার এখন আমাকে তাড়া করে ফিরছে। গত মাসের ২৬ তারিখ সকালের ঘটনা। তারিখটা মনে আছে। এমনকি বারটাও। মনে থাকার কারণ ময়মুনা না। ওই দিন একটা জরুরি মিটিং ছিল প্ল্যানিং কমিশনে। অফিসে ফাইল গোছাচ্ছি। আগারগাঁও যেতে হবে। হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা ফোন এল।
স্মৃতি, ইটস মাইমুনা।
আমি একটু উচ্ছ্বাস দেখিয়ে গলা চড়াতে যাব, অমনি ময়মুনা গম্ভীরভাবে বলল, ফ্রেন্ড! অল ইউ ডিড টু মি ইজ রং। ইউ গট ইট রং। শোনো, আমি সেকেন্ড ম্যারেজ করিনি। ইন ফ্যাক্ট আমি এর প্রয়োজনও এই মুহূর্তে অনুভব করছি না। এখন একটা টার্কিশ ছেলের সঙ্গে লিভ ইন করছি। না, কোনো পাকিস্তানিকে বিয়ে করিনি। অ্যানি প্রবলেম?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিছু বলতেও পারছিলাম না। ময়মুনা আমাকে ভুলে ফোন দেয়নি, সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কথাগুলো আমাকেই কেন বলছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমি শুধু একটাই প্রশ্ন করলাম, তোমার বিয়েটা কি ভেঙে গেছে?
ইউ নো নাথিং, না? সবাইকে তো ঠিকই বলে বেড়াচ্ছ।
সেক্রেটারিয়েটের গেটে মাইক্রো অপেক্ষা করছে। বললাম, মুনা আমি একটু ব্যস্ত। তোমাকে পরে কলব্যাক করছি। এটাই তো তোমার নম্বর? একটু ফ্রি হয়েই...।
ময়মুনাকে বললাম বিজি। কিন্তু যে কাজে বিজি থাকার কথা সে কাজে আর মন বসছিল না। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবছিলাম, ময়মুনার কী হয়েছে? স্বাভাবিকভাবে ওর একটা সংসার থাকার কথা। হয়তো ছিলও। একটা মেয়ে ছিল। নাকি ছেলে? সংসারটা ভেঙে গিয়েছে? কেন ভেঙে গেল? ডিভোর্স নাকি সেপারেশন? তারপর ময়মুনা কী করল? আর বিয়ে করেনি কেন? লিভ ইন করছে? এখন তো এ দেশেও করে লোকে। ময়মুনাও করতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে আমি কীভাবে এলাম?
ময়মুনার সংসার নিয়ে কমন ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কোনো কথা হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। হলে মাথায় থাকত। তবে এটা ঠিক, ফেসবুকের নিউজফিডে ময়মুনার যত ছবি পাই, সবই ওর একার। ব্যাপারটা আগেই মাথায় খেলতে পারত। কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারতাম। করিনি।
ময়মুনার নম্বরটা ঢাকার। হয়তো কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা তখনই উঠেছে। ময়মুনা কি তাহলে পাকিস্তানি একজনকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে? নাকি ও যা বলল সেটাই সত্যি, টার্কিশ একটা ছেলের সঙ্গে লিভ টুগেদার?
ময়মুনাদের ধানমন্ডির বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম আমরা। আমি, সোমা, মিতু, সাদেক আর আসিফ। ওর বড় ভাইয়ের মেয়ের বার্থডে ছিল। অতটুকুই পারিবারিক হতে পেরেছিলাম। ময়মুনা শেষ পর্যন্ত কাকে বিয়ে করেছিল জানি না। ক্যাম্পাসের ছেলেদের ও পছন্দ করত না। কারও সঙ্গে প্রেম হয়নি নিশ্চিত। তবে মাঝে মাঝে দু-একজন ঢাকা থেকে আসত। হলের জানালা থেকে আমরা দেখতাম, মুনা কোনো দিন স্পোর্টস কার, কোনো দিন হোন্ডার পেছনে উঠে চলে যাচ্ছে। হলের গেট বন্ধ হওয়ার আগে তারা নামিয়েও দিয়ে যেত। তাদের কাউকে কি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছিল? সত্যিই জানি না।
ফ্রি হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। অফিস আওয়ার শেষ। রিকশায় শেখেরটেক ফিরতে ফিরতে মুনার নম্বরে কল করলাম।
ময়মুনা ধরেই বলল, প্লিজ স্মৃতি, প্লিজ। ডোন্ট পুট ইওর নোজ ইন মাই পার্সোনাল বিজনেস।
তুমি কি আমার কয়েকটা কথা শুনবে?
কী বলবা তুমি? বলো। শুনি।
শোনো, আমি আসলে জানিও না তোমার আগের বিয়েটা ভেঙে গেছে কি না।
আগের বিয়ে মানে কী? আমি প্রতিদিন একটা করে বিয়ে করে বেড়াচ্ছি নাকি। হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আগের বিয়ে? তোমরা গ্রামের মেয়েরা বুঝলা চিন্তাভাবনায় সেই রকমই থেকে গেলা। শোনো, তোমাকে একটা কথাই জানানোর ছিল আমার। তুমি আমার পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে কোনো কমেন্ট করবা না।
ফোন কেটে দিল ময়মুনা।
অদ্ভুত একটা সমস্যা। আমি জানি না, এমন একটা বিষয় নিয়ে প্রায় সারা দিন ভাবছি। ময়মুনার অভিযোগটা গায়ে এসে লাগছে। পুরোটা সে বলছে না, আমার কথাও শুনছে না। ক্লাসমেট হিসেবে একটা অধিকারবোধ হয়তো তার আছে। কিন্তু এত দিন পর কথা হচ্ছে। মানুষ তো সাধারণ হাই-হ্যালো করার পর ঝগড়া শুরু করে। একটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ সে নিতে বা দিতে পারত।
বাসায় ফিরে মেয়েকে নাশতা দিয়ে, চা চাপিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। অনেক নোটিফিকেশন, মেসেজ। ফেসবুকে ময়মুনা ঢাকা এয়ারপোর্টে তোলা সেলফি দিয়েছে তিন দিন আগে। এরপর আর কিছু নেই। প্রথমবারের মতো ময়মুনার অ্যালবামগুলো দেখলাম মন দিয়ে। ওর পার্সোনাল লাইফের কোনো হিন্ট সেখানে নেই। আগে চাইলেও ফেসবুক থেকে কিছু জানতে পারতাম না।
ক্যাম্পাসে মিতু ছিল ময়মুনার সবচেয়ে কাছের। মিতু-ময়মুনা জুটি হয়ে গিয়েছিল। ওর দেখাদেখি মিতুও ক্যাম্পাসে কামিজের সঙ্গে জিনস পরা ধরেছিল। ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে চৌরঙ্গী থেকে ট্রান্সপোর্টের দিকে যাচ্ছে—এ রকম একটা দৃশ্য মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে। দুজন দুজনের হাত হাতের ভেতর নিয়েছে। কেন এই দৃশ্যটা মনে পড়ে জানি না। ওরা দুজন বরাবরই কনট্রাস্ট। মিতু এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ময়মুনাকে আগের মতোই ফলো করে। ঢাকা এয়ারপোর্টের ছবিতেও দেখলাম লাইক দিয়েছে। কমেন্ট একটাই, ওরই—সি ইউ সুন।
মিতুর টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম, এরই মধ্যে ওদের দেখা হয়েছে। বেলিসিমোতে আইসক্রিম খেতে খেতে তোলা আড্ডার সেলফিও পোস্ট করেছে। মিতুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, মাস দু-এক আগে। ওর ছোট ভাইকে সার্টিফিকেট সত্যায়িত করতে পাঠিয়েছিল। নম্বরটা আছে। ক্লাসমেট মিতু। হয়তো মিতু জানবে, কেন ময়মুনা আমার ওপর খেপেছে। হয়তো কেন, মিতু নিশ্চিতভাবেই জানবে। ময়মুনার সব আপডেট খেয়াল করে মিতু। ময়মুনার সংসার কবে ভাঙল। সেপারেশন না ডিভোর্স। ছেলেটা বা মেয়েটা এক্স হাজব্যান্ডের সঙ্গে থাকে নাকি ময়মুনার মায়ের কাছে। ময়মুনা কার সঙ্গে নাইট আউট করছে। টার্কিশ না পাকিস্তানি কার সঙ্গে বিয়ে বসছে। কার সঙ্গে লিভ ইন করছে।
হয়তো মিতুই আলাপে আলাপে ঝামেলাটা পাকিয়েছে। ময়মুনার পেট থেকে কথা বের করার জন্য বিয়ের খবরটা বলে টোপ ফেলেছে। পার্সোনাল ব্যাপারে ময়মুনা বেশ অ্যালার্ট। জিজ্ঞেস করেছে, তুমি কীভাবে জানলা। আমার নাম বলে দিয়েছে। অনেক ভেবেও মিতুকে ফোন দেব কি দেব না সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। রাতের রান্না বাকি। সাদেক ফিরেই মন দিল টিভির টকশোতে। মেয়ের ফার্স্ট সেমিস্টার কাল থেকে শুরু। রাতের রান্না শুধু না, সকালের জন্যও কিছু করে রাখতে হবে।
অফিস-বাসা করতে করতে ময়মুনার ব্যাপারটা প্রায় ফিকে হয়ে আসছিল। হঠাৎ পয়লা রমজানের আগের সন্ধ্যায় মিতুর ফোন। ফোনে ক্লাসমেট মিতু নামটা দেখার পর মনে হলো কী ব্যস্ত জীবন। প্রায় মাস গড়াতে চলল। ময়মুনা এত বাজে আচরণ করার পরও মিতা-ময়মুনা কাউকেই আর ফোন দেওয়া হয়নি। ফোনটা একটু গম্ভীর গলাতেই ধরলাম।
বন্ধু, তুমি তো ডিএস হয়েই গেলা। কিন্তু কাকে নিয়ে কী বলে বেড়াও কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। আর বললেও ঠিক খবরটা নিয়ে বলবা না? সরকার তোমাদের এত বড় বড় দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে কি এমনি এমনি। এইটুকু রেসপনসিবিলিটি দিয়ে তোমরা দেশ চালাবা?
মিতু ফোন দিলে একাই বলে। আমি শুনছি কি না এটা ওর কাছে ম্যাটার করে না।
আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারলাম, কোন ব্যাপারটা বলো তো?
আরে আমাদের ময়মুনা। শোনো ময়মুনা পাকিস্তানি ছেলেকে বিয়ে করেছে—এটা সত্য নয়। ওর প্রেমিকটা আসলে টার্কিশই। কিন্তু লিভ ইনটা আসলে হেডলাইন না, দোস্ত। আসল খবর হলো, ময়মুনা কনসিভ করেছে। পেটে টার্কিশ বাচ্চা। ভাবতে পারো, আমাদের ক্লাসমেট লিভ ইন করে কনসিভ করে ফেলেছে। তার পেটে টার্কিশ বাচ্চা। সত্যি ময়মুনা আনপ্যারালাল। আমরা তো সেই তুলনায় কিছুই করতে পারলাম না দোস্ত। তবে এটা ঠিক, পার্সোনাল লাইফ নিয়ে বরাবরই খুব রিজার্ভ মেয়েটা। নিজে থেকে বলে না যে কেন, বললেই তো সবাই মিলে সেলিব্রেট করা যায়। টার্কিশ ছেলেদের দেখারই তো ভাগ্য হলো না আমাদের। আর দেখো ময়মুনা, পেটে টার্কিশ বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এয়ারপোর্টে ওর সেলফি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই তড়িঘড়ি দেখা করলাম। যা ভেবেছিলাম সত্যি। দেখেই বুঝেছি, চার মাস চলছে। সরাসরি তো জিজ্ঞেস করা যায় না। তাই তোমার রেফারেন্স দিলাম। খুব দুঃখ পেল। জানো, ময়মুনা হু হু করে কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে সবই বলে দিল। খুব ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। লিভ টুগেদারের বাচ্চা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওর ফ্যামিলি। অ্যান্টিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলো, সেভেনটি আপ মা কোনো দিন মেয়ের এই অবস্থা মেনে নেবে? দেশটা তো এখনো ফ্রান্স বা ইতালি হয়ে যায়নি। অ্যান্টির সঙ্গে দেখা করেই চলে গেছে ময়মুনা। মা-মেয়ের তর্কে কোনো সমাধান হয়নি।
এক ফাঁকে মিতুকে জিজ্ঞেস করলাম, ময়মুনা জিজ্ঞেস করল না একবারও, ওর পার্সোনাল খবর আমি কীভাবে পেলাম?
করেছিল। আমি বলেছি ফেসবুকের যুগে কি কিছু আর গোপন থাকে। কানেকটিভিটির যুগ, ডিজিটাল বাংলাদেশ। এখন তো সবাই কানেকটিভিটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি এসেও তো সেই কথাই বললেন। আর সিলভি, সিনথিয়া বদমাশ দুইটা তো তোমার পেছনে লেগেই আছে। এই দুই বোনকে চেনো তো? ময়মুনার এক্স হাজব্যান্ড মামুনকে বিয়ে করেছে সিলভি। সিলভির ছোট বোন সিনথিয়া। বিশ্বসুন্দরী। তোমাদের ওদিকেই তো থাকে। সিলভির জীবনের মোেটা কি জানো? ময়মুনার লাইফটা হেল করে দেওয়া। ময়মুনার স্বামী আর মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাতেও শেষ হয়নি। এখনো ওর পেছনে লেগে আছে। ম্যানহাটন পর্যন্ত গোয়েন্দা লাগানো ওর। সিলভিই ময়মুনার মাকে লিভ টুগেদারের বাচ্চার খবর দিয়েছে। খবর ছড়াতে আমাকেও ফোন দেয় রেগুলার। বাচ্চার কথা অবশ্য আমাকে সরাসরি বলেনি। আচ্ছা তুমি সিলভিকে চিনছ তো? ওই যে আমরা একবার ওদের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম না? ময়মুনার বড় ভাইয়ের মেয়ের জন্মদিনে। সেখানে ময়মুনার ভাবির দুই বোন ছিল। মনে আছে?
নাহ্। মনে পড়ে না তো।
দেখেছ তুমি। মনে থাকার কথা।
নাহ্। মনে পড়ে না।
আচ্ছা। একটা কথা তো মনে থাকার কথা। ময়মুনার ভাবির নাম। এটা নিয়ে সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। মনে আছে?
এবার মনে পড়ল আমার। ময়মুনার ভাবির নাম স্মৃতি। তিন বোন। স্মৃতি, সিলভি, সিনথিয়া। সবার বড় বোনের নাম স্মৃতি। উনিই ময়মুনার ভাবি, বড় ভাইয়ের বউ। কিন্তু আহামরি সুন্দরী কি ছিল সিনথিয়া? সাদেকের সঙ্গে ওই সময়টা খুব সমস্যা যাচ্ছিল আমার। হয়তো সে কারণে ভালো করে কিছু মনে নেই। অন্যমনস্ক ছিলাম। তবে এইটুকু মনে আছে, ময়মুনার বড় ভাবি আর আমার নাম মিলে যাওয়ায় সবাই একটু দুষ্টুমি করছিল।
ঝাপসা হয়ে গেছে।
মিতু বলে চলে, বুঝলা স্মৃতি, ময়মুনার কিছু খবর আমি স্মৃতির কাছেও পাই। তুমি স্মৃতি না। ময়মুনার বড় ভাবি স্মৃতি। খুব দুষ্ট প্রকৃতির মহিলা। তোমার নামেই নাম। তুমি কিছু মনে কোরো না, দোস্ত। একবার হয়েছে কি...।
No comments