ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আ.লীগ সরব, বিএনপি নীরব
ঢাকার
দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র ও
কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা গতকাল রোববার সরবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
অন্যদিকে বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোটের সমর্থক হিসেবে পরিচিত মেয়র ও কাউন্সিলর
পদপ্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন একেবারেই নীরবে।
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পাঁচ মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে একজন ছাড়া কেউই নিজে উপস্থিত থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেননি। স্ত্রী, সন্তান, আইনজীবী বা শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁদের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে দেখা গেছে, সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে যতটা উদ্দীপনা ছিল, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঠিক তার উল্টো জড়তা ও ভীতি কাজ করেছে। অবশ্য মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে কোথাও কোনো বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী রফিক-উল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা হয়তো গ্রেপ্তার এড়াতে এটি একটি কৌশল হিসেবে নিয়েছেন। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে নিশ্চয়ই তাঁরা প্রকাশ্যে আসতে পারবেন।
গুলিস্তানে অবস্থিত ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে স্থাপিত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা নেওয়া হয় ঢাকা দক্ষিণের মনোনয়নপত্র। আর উত্তরের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয় আগারগাঁওয়ে জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট (এনআইএলজি) ভবনে। দক্ষিণে মেয়র পদে ২৬ ও উত্তরে ২১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হিসেবে দক্ষিণে ৭০৫ ও উত্তরে ৬২৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন।
দক্ষিণের চিত্র: আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী সাঈদ খোকন মনোনয়নপত্র জমা দিতে এলে হঠাৎ বদলে যায় নাট্যমঞ্চের ভেতর ও বাইরের এলাকা।
আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও পুরান ঢাকার দিক থেকে কয়েক হাজার মানুষ নাট্যমঞ্চের আশপাশে জড়ো হন। শতাধিক মোটরসাইকেলে চড়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সাঈদ খোকন যখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছিলেন, তখন ওই কক্ষেই অন্তত আওয়ামী লীগের ৫০ জন নেতা-কর্মী ছিলেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ হিমশিম খায়। মহানগর নাট্যমঞ্চের মূল ফটকে পুলিশের সঙ্গে সরকারদলীয় কর্মীদের কয়েক দফা বচসা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। সাঈদ খোকনের পক্ষে মাঝেমধ্যে কর্মীরা স্লোগান শুরু করলেও নেতারা আচরণবিধির কথা বলে থামিয়ে দেন। নাট্যমঞ্চে সাঈদ খোকন পৌঁছার আগেই সাংসদ আবদুর রাজ্জাক ও ফজলে নূর তাপস এবং সাবেক সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। সাঈদ খোকন সেখানে উপস্থিত হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজকে সঙ্গে নিয়ে।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বলেছে পাঁচজনকে নিয়ে এসে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। আমি পাঁচজনকেই নিয়ে এসেছি। বাকিরা অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে এসেছেন। আমি আচরণবিধি লঙ্ঘন করিনি।’
দক্ষিণে আওয়ামী লীগের আর কোনো প্রার্থী মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেননি। মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. সেলিম মনোনয়নপত্র কিনলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেননি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
বিএনপির পাঁচ প্রার্থী: দক্ষিণে মেয়র পদে বিএনপির চার নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর আইনজীবী যুবদলের নেতা আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালামের পক্ষে স্ত্রী ফাতেমা সালাম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দীন আহমেদ পিন্টুর পক্ষে স্ত্রী নাসরিন আক্তার কল্পনা এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন নিজেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল বাশারও মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। শিক্ষক নেতা সেলিম ভূঁইয়া মনোনয়নপত্র নিলেও জমা দেননি।
আসাদুজ্জামান রিপন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ধরপাকড় করছে। প্রার্থীরা গ্রেপ্তার এড়াতে আসেননি। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সমান সুযোগ) সৃষ্টি হলে প্রার্থীরা মাঠে নামবেন। তা ছাড়া এখন তো প্রচার-প্রচারণা নিষিদ্ধ।
দক্ষিণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় নেতাদের বাইরে মেয়র পদে আরও যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি, জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, সিপিবি-বাসদ সমর্থিত বজলুল রশীদ ফিরোজ প্রমুখ।
উত্তরের চিত্র: ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে ৩০ জন মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন, বেলা একটা পর্যন্ত জমা দেন মাত্র তিনজন। কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন ৮২৩ জন। বেলা একটা পর্যন্ত জমা দেন ১৪০ জন। এঁদের প্রায় সবাই সরকারি দলের সমর্থক।
বেলা দুইটার পর প্রার্থী ও তাঁদের সঙ্গীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বেলা তিনটার দিকে এনআইএলজি ভবন ও আশপাশে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকের ঢল নামে। এ সময় মনোনয়নপত্র জমা দিতে ভবনের ভেতরে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে কড়াকড়ি আরোপ করতে হয়। একজন প্রার্থীর সঙ্গে দুজনের বেশি ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক মনোনয়নপত্র জমা দেন বেলা তিনটার দিকে। এ সময় তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান, ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ ও বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি একটি বড় দলের সমর্থন পেয়েছি, প্রধানমন্ত্রী আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। এটা একটা বড় শক্তি।’
বিএনপি-সমর্থক প্রার্থী আবদুল আউয়াল মিন্টুর পক্ষে তাঁর দুই ছেলে তাফসির আউয়াল ও তাজওয়ার আউয়াল মনোনয়নপত্র জমা দেন।
তাফসির আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি। এটা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। প্রার্থীদের কেউ মাঠে সক্রিয় আছেন, কেউ বা আদালতে ছুটছেন। নির্বাচন কমিশনকে পরিবেশ ঠিক করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
উত্তরে মিন্টুর পাশাপাশি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়ালও। জানতে চাইলে তাবিথ প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে প্রার্থী হওয়ার কারণ কিছুটা কৌশলগত। কারণ, আগে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে অনেক বাধা সৃষ্টি হয়। আর বাবার প্রার্থী হওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রার্থিতার সরাসরি কোনো যোগ নেই। বাবার মতো তিনি রাজনৈতিক দল-সমর্থিত প্রার্থী হবেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো কারণে তাঁর বাবা শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে না পারলে এর একটা সুবিধা তো তিনি পাবেন।
উত্তরে আরও যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী, বিকল্পধারার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল, জাতীয় পার্টি-সমর্থিত বাহাউদ্দিন আহমেদ, সিপিবি-বাসদ-সমর্থিত আবদুল্লাহ আল ক্বাফী, গণসংহতি আন্দোলন-সমর্থিত জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকি, অভিনেতা নাদের চৌধুরী, এইচ এম এরশাদের সাবেক উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ, সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের (বিএনএ) শেখ শহিদুজ্জামান প্রমুখ।
ঢাকা উত্তরে কাউন্সিলর পদে মোট ৬২৯ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সংরক্ষিত আসনে ১৩৫ ও সাধারণ আসনে ৪৯৪ জন। বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে ৪৮৯ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে সব প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ওই ব্যতিক্রমী ব্যক্তি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসেছিলেন। এ ছাড়া কেউ মিছিল, শোভাযাত্রা কিংবা ব্যানার-ফেস্টুন বহন করেননি।
তবে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের অনেককেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সমস্যায় পড়তে দেখা গেছে। বিশেষ করে আয়কর রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার প্রত্যয়নপত্র অনেকেরই ঠিকঠাক ছিল না।
বিকেল পাঁচটার কিছুক্ষণ পর রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম সাংবাদিকদের বলেন, সুষ্ঠুভাবে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
প্রতি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী: দক্ষিণে প্রতিটি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য আলতাফ হোসেন মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছিলেন। তিনি জানালেন, ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ অন্তত সাতজন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একক প্রার্থী থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দল থেকে সাংসদদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বেলাল হোসেন নামে ওই ওয়ার্ডের এক আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, তিনি নিজে দুই প্রার্থীর সঙ্গে এখানে এসেছেন।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন এলাকায় ভোট গ্রহণ করা হবে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ১ ও ২ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ এপ্রিল। ১০ এপ্রিল প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে।
বিক্ষোভ: নির্ধারিত সময় পাঁচটার মধ্যে উপস্থিত না হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ৩০-৪০ জনের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা। এঁদের বেশির ভাগ যুব মহিলা লীগের নেতা-কর্মী। তাঁরা নারী কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত মহানগর নাট্যমঞ্চে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে অবস্থান করেন এবং কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার মোর্শেদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু মিহির সারোয়ার তাঁদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি। তিনি কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে তা লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানানোর অনুরোধ জানান। পরে নারী নেত্রীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
অভিযোগ উঠেছে, দক্ষিণে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পরে গিয়েও কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ পান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল ইসলাম। তিনি শতাধিক কর্মী নিয়ে মিছিল করে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে যান। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশও তাঁদের বাধা দেয়নি। এ বিষয়ে জানতে মিহির সারোয়ারকে ফোন করে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সংরক্ষিত আসনের কিছু নারী প্রার্থী নির্ধারিত সময়ের পরে এসে মনোনয়নপত্র গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তবে আইন-কানুন বুঝিয়ে দেওয়ার পর তাঁরা চলে যান।
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পাঁচ মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে একজন ছাড়া কেউই নিজে উপস্থিত থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেননি। স্ত্রী, সন্তান, আইনজীবী বা শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁদের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে দেখা গেছে, সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে যতটা উদ্দীপনা ছিল, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঠিক তার উল্টো জড়তা ও ভীতি কাজ করেছে। অবশ্য মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে কোথাও কোনো বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী রফিক-উল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা হয়তো গ্রেপ্তার এড়াতে এটি একটি কৌশল হিসেবে নিয়েছেন। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে নিশ্চয়ই তাঁরা প্রকাশ্যে আসতে পারবেন।
গুলিস্তানে অবস্থিত ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে স্থাপিত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা নেওয়া হয় ঢাকা দক্ষিণের মনোনয়নপত্র। আর উত্তরের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয় আগারগাঁওয়ে জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট (এনআইএলজি) ভবনে। দক্ষিণে মেয়র পদে ২৬ ও উত্তরে ২১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হিসেবে দক্ষিণে ৭০৫ ও উত্তরে ৬২৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন।
দক্ষিণের চিত্র: আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী সাঈদ খোকন মনোনয়নপত্র জমা দিতে এলে হঠাৎ বদলে যায় নাট্যমঞ্চের ভেতর ও বাইরের এলাকা।
আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও পুরান ঢাকার দিক থেকে কয়েক হাজার মানুষ নাট্যমঞ্চের আশপাশে জড়ো হন। শতাধিক মোটরসাইকেলে চড়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সাঈদ খোকন যখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছিলেন, তখন ওই কক্ষেই অন্তত আওয়ামী লীগের ৫০ জন নেতা-কর্মী ছিলেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ হিমশিম খায়। মহানগর নাট্যমঞ্চের মূল ফটকে পুলিশের সঙ্গে সরকারদলীয় কর্মীদের কয়েক দফা বচসা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। সাঈদ খোকনের পক্ষে মাঝেমধ্যে কর্মীরা স্লোগান শুরু করলেও নেতারা আচরণবিধির কথা বলে থামিয়ে দেন। নাট্যমঞ্চে সাঈদ খোকন পৌঁছার আগেই সাংসদ আবদুর রাজ্জাক ও ফজলে নূর তাপস এবং সাবেক সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। সাঈদ খোকন সেখানে উপস্থিত হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজকে সঙ্গে নিয়ে।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বলেছে পাঁচজনকে নিয়ে এসে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। আমি পাঁচজনকেই নিয়ে এসেছি। বাকিরা অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে এসেছেন। আমি আচরণবিধি লঙ্ঘন করিনি।’
দক্ষিণে আওয়ামী লীগের আর কোনো প্রার্থী মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেননি। মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. সেলিম মনোনয়নপত্র কিনলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেননি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
বিএনপির পাঁচ প্রার্থী: দক্ষিণে মেয়র পদে বিএনপির চার নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর আইনজীবী যুবদলের নেতা আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালামের পক্ষে স্ত্রী ফাতেমা সালাম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দীন আহমেদ পিন্টুর পক্ষে স্ত্রী নাসরিন আক্তার কল্পনা এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন নিজেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল বাশারও মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। শিক্ষক নেতা সেলিম ভূঁইয়া মনোনয়নপত্র নিলেও জমা দেননি।
আসাদুজ্জামান রিপন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ধরপাকড় করছে। প্রার্থীরা গ্রেপ্তার এড়াতে আসেননি। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সমান সুযোগ) সৃষ্টি হলে প্রার্থীরা মাঠে নামবেন। তা ছাড়া এখন তো প্রচার-প্রচারণা নিষিদ্ধ।
দক্ষিণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় নেতাদের বাইরে মেয়র পদে আরও যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি, জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, সিপিবি-বাসদ সমর্থিত বজলুল রশীদ ফিরোজ প্রমুখ।
উত্তরের চিত্র: ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে ৩০ জন মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন, বেলা একটা পর্যন্ত জমা দেন মাত্র তিনজন। কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন ৮২৩ জন। বেলা একটা পর্যন্ত জমা দেন ১৪০ জন। এঁদের প্রায় সবাই সরকারি দলের সমর্থক।
বেলা দুইটার পর প্রার্থী ও তাঁদের সঙ্গীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বেলা তিনটার দিকে এনআইএলজি ভবন ও আশপাশে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকের ঢল নামে। এ সময় মনোনয়নপত্র জমা দিতে ভবনের ভেতরে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে কড়াকড়ি আরোপ করতে হয়। একজন প্রার্থীর সঙ্গে দুজনের বেশি ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক মনোনয়নপত্র জমা দেন বেলা তিনটার দিকে। এ সময় তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান, ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ ও বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি একটি বড় দলের সমর্থন পেয়েছি, প্রধানমন্ত্রী আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। এটা একটা বড় শক্তি।’
বিএনপি-সমর্থক প্রার্থী আবদুল আউয়াল মিন্টুর পক্ষে তাঁর দুই ছেলে তাফসির আউয়াল ও তাজওয়ার আউয়াল মনোনয়নপত্র জমা দেন।
তাফসির আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি। এটা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। প্রার্থীদের কেউ মাঠে সক্রিয় আছেন, কেউ বা আদালতে ছুটছেন। নির্বাচন কমিশনকে পরিবেশ ঠিক করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
উত্তরে মিন্টুর পাশাপাশি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তাঁর ছেলে তাবিথ আউয়ালও। জানতে চাইলে তাবিথ প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে প্রার্থী হওয়ার কারণ কিছুটা কৌশলগত। কারণ, আগে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে অনেক বাধা সৃষ্টি হয়। আর বাবার প্রার্থী হওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রার্থিতার সরাসরি কোনো যোগ নেই। বাবার মতো তিনি রাজনৈতিক দল-সমর্থিত প্রার্থী হবেন না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো কারণে তাঁর বাবা শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে না পারলে এর একটা সুবিধা তো তিনি পাবেন।
উত্তরে আরও যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী, বিকল্পধারার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল, জাতীয় পার্টি-সমর্থিত বাহাউদ্দিন আহমেদ, সিপিবি-বাসদ-সমর্থিত আবদুল্লাহ আল ক্বাফী, গণসংহতি আন্দোলন-সমর্থিত জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকি, অভিনেতা নাদের চৌধুরী, এইচ এম এরশাদের সাবেক উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ, সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের (বিএনএ) শেখ শহিদুজ্জামান প্রমুখ।
ঢাকা উত্তরে কাউন্সিলর পদে মোট ৬২৯ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সংরক্ষিত আসনে ১৩৫ ও সাধারণ আসনে ৪৯৪ জন। বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে ৪৮৯ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে সব প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। ওই ব্যতিক্রমী ব্যক্তি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসেছিলেন। এ ছাড়া কেউ মিছিল, শোভাযাত্রা কিংবা ব্যানার-ফেস্টুন বহন করেননি।
তবে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের অনেককেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সমস্যায় পড়তে দেখা গেছে। বিশেষ করে আয়কর রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার প্রত্যয়নপত্র অনেকেরই ঠিকঠাক ছিল না।
বিকেল পাঁচটার কিছুক্ষণ পর রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম সাংবাদিকদের বলেন, সুষ্ঠুভাবে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
প্রতি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী: দক্ষিণে প্রতিটি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য আলতাফ হোসেন মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছিলেন। তিনি জানালেন, ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ অন্তত সাতজন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একক প্রার্থী থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দল থেকে সাংসদদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ১৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বেলাল হোসেন নামে ওই ওয়ার্ডের এক আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, তিনি নিজে দুই প্রার্থীর সঙ্গে এখানে এসেছেন।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন এলাকায় ভোট গ্রহণ করা হবে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ১ ও ২ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ এপ্রিল। ১০ এপ্রিল প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে।
বিক্ষোভ: নির্ধারিত সময় পাঁচটার মধ্যে উপস্থিত না হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ৩০-৪০ জনের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা। এঁদের বেশির ভাগ যুব মহিলা লীগের নেতা-কর্মী। তাঁরা নারী কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন জমা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত মহানগর নাট্যমঞ্চে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে অবস্থান করেন এবং কর্মকর্তা মিহির সারোয়ার মোর্শেদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু মিহির সারোয়ার তাঁদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি। তিনি কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে তা লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানানোর অনুরোধ জানান। পরে নারী নেত্রীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
অভিযোগ উঠেছে, দক্ষিণে নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পরে গিয়েও কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ পান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল ইসলাম। তিনি শতাধিক কর্মী নিয়ে মিছিল করে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে যান। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশও তাঁদের বাধা দেয়নি। এ বিষয়ে জানতে মিহির সারোয়ারকে ফোন করে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সংরক্ষিত আসনের কিছু নারী প্রার্থী নির্ধারিত সময়ের পরে এসে মনোনয়নপত্র গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তবে আইন-কানুন বুঝিয়ে দেওয়ার পর তাঁরা চলে যান।
No comments