‘তাহলে আমি কে?’ by মানসুরা হোসাইন
ইভান আহমেদ কথা (বামে) ও অনন্যা বণিক। ছবি: জাহিদুল করিম |
‘আমি দেখতে ভাইয়ের মতো না, আবার বোনের মতোও না। তাহলে আমি কে? ’
যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই এই প্রশ্নটাই বারবার মনে এসেছে অনন্যা বণিকের। একা লেগেছে নিজেকে। মন চেয়েছে বউ সাজতে। অথচ শার্ট-প্যান্ট পরতে বলেছে সবাই।
বাড়ি থেকে অনন্যার নাম দেওয়া হয়েছিল গৌতম বণিক। কিন্তু অনন্যার মন চাইত মেয়েদের মতো সাজতে। বাড়ির লোকেরা চোখ রাঙিয়ে বলতেন, বোনের ফ্রক পড়া চলবে না, মেয়েদের মতো সাজগোজ করা যাবে না। সবাই বলেছিলেন, গৌতম হয়েই থাকতে হবে। বড়দা, সেজদারা ধরে মারতেন। সাইকেলের চেইন দিয়ে পায়ের জন্য বেড়ি বানানো হয়েছিল। শুধু শৌচাগার পর্যন্ত যেতে পারতেন। অনন্যা যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেন, তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। সেখানে চিকিৎসকও দেখানো হয়। এরই মধ্যে অনন্যার বাবা মারা যান। পারিবারিক নির্যাতন আর সহ্য হচ্ছিল না। মায়ের সহায়তায় পায়ের বেড়ি খুলে বাড়ি ছাড়েন অনন্যা। ভাইয়েরা বলে দিয়েছিলেন, এই যাওয়াই শেষ যাওয়া। তবে অনন্যা মনে করেন তিনি পরিবারকে মুক্তি দিয়ে এসেছেন।
গৌতম বণিক এখন হয়েছেন অনন্যা বণিক। অনন্যা বলেন, ‘আমি গৌতমকে কবর দিয়েছি। আমি গৌতম হতেও চাই না।’ অনন্যা বণিক একজন হিজড়া। অনেক সামাজিক প্রতিকূলতা পার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্যা। জীবনের প্রতি পদে লড়াই করে যেতে হয়েছে তাঁকে। অনন্যা এখন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার নামে একটি সংগঠনে লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া তাঁর সাদাকালো নামে নিজস্ব একটি সংগঠন আছে। এই সংগঠন হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি চালায়। বন্ধু সংগঠনের কর্মকর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) কাজ করেছেন অনন্যা। ২০১০ সালে হিজড়াদের পরিসংখ্যান বের করার জন্য আইসিডিডিআরবির চালানো জরিপে (সার্ভে) তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ তো গেল পেশাগত জীবনের কথা। অনন্যার ভালোবাসার জায়গা হলো নাচ। নিজেকে তিনি একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি ভালোবাসেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে নাচের ওপর ডিপ্লোমা করেছেন। পেয়েছেন নানান স্বীকৃতি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নৃত্যশিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করেছেন। ২০১০ সালে জার্মান কালচারাল সেন্টার এবং বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি হিজড়া সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেখানে অনন্যা দ্বিতীয় হন।
তবে হিজড়া সমাজে অনন্যাদের মতো সবাই জয়ী নয়। সবাই প্রতিকূলতা জয় করে ওপরে উঠে আসতে পারেননি। বেশির ভাগেরই জীবন মানবেতর। অনন্যা বলেন, ‘শুধু একজন অনন্যাকে দেখে পুরো হিজড়া সমাজকে চিন্তা করলে হবে না। বেশির ভাগ হিজড়া মানবেতর জীবনযাপন করছে।’
অনন্যার মা-বাবা কেউ এখন নেই। দুজনই মারা গেছেন। যে ভাইয়েরা একসময় অনন্যাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন, তাঁরা এখন নিজেরাই যোগাযোগ শুরু করেছেন। ভাইবোনদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। তাঁরা কেউ দেশে। কেউ বিদেশে। সবাই কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। এক ভাগনি খুব পছন্দ করেন অনন্যাকে। তবে ভাগনির বিয়েতে অনন্যা থাকতে পারবেন না। তাহলে ভাগনির বিয়ে ভেঙে যাবে। আরেক ভাগনির বিয়েতেও গিয়েছিলেন অনন্যা। ভাগনিকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। বর আসতেই পালিয়ে এসেছেন।
অনন্যা উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পর্যন্ত পড়েছেন। পাসের সনদে আছে গৌতমের নাম। ফলে সেগুলো এখন আর অনন্যা নিজের বলে দাবি করতে পারেন না। এ নিয়ে অনন্যার আফসোসও নেই। তাঁর কথা, ‘বাসা নাই, বাসে সিট নাই তো সনদ দিয়ে কী হবে? ’
এই সনদ নিজের বলে দাবি করতে হলে ফরেনসিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন জটিলতা পার হতে হবে। তা হবে আরও যন্ত্রণার। গৌতমের নামে সনদ থাকায় অনন্যা পারিবারিক সম্পত্তির ভাগও হয়তো পাবেন না। তবে অনন্যা বলেন, ‘যেখানে পরিবারের সদস্যরাই আমাকে মেনে নিতে পারেননি, সেখানে সম্পত্তি দিয়ে আর কী হবে? সম্পত্তি কে খাবে?’
যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই এই প্রশ্নটাই বারবার মনে এসেছে অনন্যা বণিকের। একা লেগেছে নিজেকে। মন চেয়েছে বউ সাজতে। অথচ শার্ট-প্যান্ট পরতে বলেছে সবাই।
বাড়ি থেকে অনন্যার নাম দেওয়া হয়েছিল গৌতম বণিক। কিন্তু অনন্যার মন চাইত মেয়েদের মতো সাজতে। বাড়ির লোকেরা চোখ রাঙিয়ে বলতেন, বোনের ফ্রক পড়া চলবে না, মেয়েদের মতো সাজগোজ করা যাবে না। সবাই বলেছিলেন, গৌতম হয়েই থাকতে হবে। বড়দা, সেজদারা ধরে মারতেন। সাইকেলের চেইন দিয়ে পায়ের জন্য বেড়ি বানানো হয়েছিল। শুধু শৌচাগার পর্যন্ত যেতে পারতেন। অনন্যা যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেন, তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। সেখানে চিকিৎসকও দেখানো হয়। এরই মধ্যে অনন্যার বাবা মারা যান। পারিবারিক নির্যাতন আর সহ্য হচ্ছিল না। মায়ের সহায়তায় পায়ের বেড়ি খুলে বাড়ি ছাড়েন অনন্যা। ভাইয়েরা বলে দিয়েছিলেন, এই যাওয়াই শেষ যাওয়া। তবে অনন্যা মনে করেন তিনি পরিবারকে মুক্তি দিয়ে এসেছেন।
গৌতম বণিক এখন হয়েছেন অনন্যা বণিক। অনন্যা বলেন, ‘আমি গৌতমকে কবর দিয়েছি। আমি গৌতম হতেও চাই না।’ অনন্যা বণিক একজন হিজড়া। অনেক সামাজিক প্রতিকূলতা পার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্যা। জীবনের প্রতি পদে লড়াই করে যেতে হয়েছে তাঁকে। অনন্যা এখন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার নামে একটি সংগঠনে লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া তাঁর সাদাকালো নামে নিজস্ব একটি সংগঠন আছে। এই সংগঠন হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি চালায়। বন্ধু সংগঠনের কর্মকর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) কাজ করেছেন অনন্যা। ২০১০ সালে হিজড়াদের পরিসংখ্যান বের করার জন্য আইসিডিডিআরবির চালানো জরিপে (সার্ভে) তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ তো গেল পেশাগত জীবনের কথা। অনন্যার ভালোবাসার জায়গা হলো নাচ। নিজেকে তিনি একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি ভালোবাসেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে নাচের ওপর ডিপ্লোমা করেছেন। পেয়েছেন নানান স্বীকৃতি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নৃত্যশিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করেছেন। ২০১০ সালে জার্মান কালচারাল সেন্টার এবং বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি হিজড়া সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেখানে অনন্যা দ্বিতীয় হন।
তবে হিজড়া সমাজে অনন্যাদের মতো সবাই জয়ী নয়। সবাই প্রতিকূলতা জয় করে ওপরে উঠে আসতে পারেননি। বেশির ভাগেরই জীবন মানবেতর। অনন্যা বলেন, ‘শুধু একজন অনন্যাকে দেখে পুরো হিজড়া সমাজকে চিন্তা করলে হবে না। বেশির ভাগ হিজড়া মানবেতর জীবনযাপন করছে।’
অনন্যার মা-বাবা কেউ এখন নেই। দুজনই মারা গেছেন। যে ভাইয়েরা একসময় অনন্যাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন, তাঁরা এখন নিজেরাই যোগাযোগ শুরু করেছেন। ভাইবোনদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। তাঁরা কেউ দেশে। কেউ বিদেশে। সবাই কমবেশি প্রতিষ্ঠিত। এক ভাগনি খুব পছন্দ করেন অনন্যাকে। তবে ভাগনির বিয়েতে অনন্যা থাকতে পারবেন না। তাহলে ভাগনির বিয়ে ভেঙে যাবে। আরেক ভাগনির বিয়েতেও গিয়েছিলেন অনন্যা। ভাগনিকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। বর আসতেই পালিয়ে এসেছেন।
অনন্যা উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পর্যন্ত পড়েছেন। পাসের সনদে আছে গৌতমের নাম। ফলে সেগুলো এখন আর অনন্যা নিজের বলে দাবি করতে পারেন না। এ নিয়ে অনন্যার আফসোসও নেই। তাঁর কথা, ‘বাসা নাই, বাসে সিট নাই তো সনদ দিয়ে কী হবে? ’
এই সনদ নিজের বলে দাবি করতে হলে ফরেনসিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন জটিলতা পার হতে হবে। তা হবে আরও যন্ত্রণার। গৌতমের নামে সনদ থাকায় অনন্যা পারিবারিক সম্পত্তির ভাগও হয়তো পাবেন না। তবে অনন্যা বলেন, ‘যেখানে পরিবারের সদস্যরাই আমাকে মেনে নিতে পারেননি, সেখানে সম্পত্তি দিয়ে আর কী হবে? সম্পত্তি কে খাবে?’
ইভান আহমেদ কথা (বামে) ও অনন্যা বণিক। ছবি: জাহিদুল করিম |
দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এক ভদ্রলোক অনন্যাকে ভালোবাসেন।
তিনি অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করেননি। কিন্তু ভালোবাসার বাইরে আর কিছু
চিন্তা করার সুযোগ নেই।
হিজড়া সমাজের আরেক সফল নাম ‘কথা’। পারিবারিক নাম ইভান আহমেদ। তাঁর গল্পও অনন্যার মতো। কথার বাবা নেই। মা আছেন। ভাইবোনেরা থেকেও না থাকার মতো। কথাকে মেনে নেননি কেউ। পারিবারিক, সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছেন কথা। যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে।
কথা এখন সচেতন শিল্পী সংঘের প্রেসিডেন্ট। এই সংগঠন হিজড়াদের মানবাধিকার, এইচআইভি এইডস নিয়ে কাজ করে। সংগঠনের সদস্য ৪৫০ জন। শিল্পী আছেন ৪০ জন। এই সংগঠন ছাড়াও কথা সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে হিজড়া নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। শিশু একাডেমিতে চার বছরের শিশুদের নাচ শিখিয়েছেন। কিন্তু শিশুদের অভিভাবকেরা সহজভাবে কথাকে নিতে পারেননি। তাই নাচ শেখানো বাদ দিয়েছেন। তবে দমে যাননি। সব ধরনের শিশুদের নাচ এবং অভিনয় শেখানোর জন্য কথাকলি শিশু কিশোর নামে একটি সংগঠন খুলেছেন। বিবিসি ওয়ার্ল্ডে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে জমা দিয়েছিলেন। ছয় মাসের জন্য একটি কাজের সুযোগও পান। ব্যক্তিগত ঝামেলার জন্য কাজটি করতে পারেননি।
কথাও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। শিক্ষা সনদ ইভান আহমেদ নামে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্যও অনন্যার মতোই। সনদ দিয়ে কী হবে? এফিডেভিটের যন্ত্রণা পোহাতে রাজি নন তিনিও।
কাগুজে স্বীকৃতি দিয়ে লাভ নেই
২০১৩ সালে নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের আলাদা লিঙ্গ বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অনন্যা এবং কথা বলেন, ‘কাগুজে স্বীকৃতি দিয়ে লাভ নাই। পাসপোর্ট করতে গেলে বলে হিজড়া টিজড়া বুঝি না। ও শাড়ি পরেছেন, তাহলে নারী হিসেবেই পাসপোর্ট করেন। ভোটার তালিকা করার সময়ও একই অবস্থা। আমরা নির্বাচন করতে পারি না। স্কুলে ভর্তি বা চাকরির সময়ও আমাদের কথা উল্লেখ থাকে না। ইতিহাসে, পাঠ্যপুস্তকে কোথাও হিজড়াদের ইতিবাচক ইতিহাস লেখা হয়নি। সরকার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট ঘোষণা করেছে, আমরা নাচানাচি করে আনন্দ করেছি। সরকারের কিছু ভোট বেড়েছে। এইটুকুই। নারী-পুরুষের বাইরে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হিসেবে আমাদের উল্লেখ করতে চায় সরকার। কিন্তু আমরা প্রতিবন্ধী নই।’
অনন্যা ও কথা নিজেদের নারী ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁরা জানেন কোনো দিন সংসার করতে পারবেন না। তাঁরা রাতে ঘুমাতে যান একলা। শরীর খারাপ লাগলে পরিবারের কাউকে জানাতে পারেন না। ঘরে মারা গেলে দরজা কেটে বের করতে হয়। তার পরও আছে বঞ্চনা। মৃতদেহটির শেষকৃত্য কেউ করতে চান না। খবর পেয়ে হয়তো পরিবারের লোকজন আসেন। আগেই খোঁজ নেন হিজড়া কী কী সম্পত্তি রেখে গেছে।
বেশির ভাগ হিজড়া বাচ্চা নাচানোর নাম করে বা রাস্তায় যাত্রীদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি করছে। এ ব্যাপারে অনন্যা এবং কথা বলেন, তাঁরা বাধ্য হয়েই এ ধরনের কাজ করছে। প্রতিটি হিজড়া পরিবার থেকে নির্যাতিত হয়ে পথে নামেন কিশোর বয়সে। তাঁদের শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দুমুঠো ভাত জোগাড়ের সংগ্রামে নামেন।
হিজড়াদের তাঁদের মতো করে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে এবং শিক্ষিত করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান অনন্যা ও কথারা।
অনন্যা এবং কথা বর্তমানে পরিচিত মুখ। তার পরও তাঁদের যৌন হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। শুনতে হয় নানান কটু কথা। তাঁরা বলেন, ‘প্রকৃতির কোন খেয়ালে আমাদের জন্ম, তা জানি না। এ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আক্ষেপেরও অন্ত থাকে না। কিন্তু মানুষ হিসেবে অধিকার থেকে আমরা কেন বঞ্চিত হব? ’
হিজড়া সমাজের আরেক সফল নাম ‘কথা’। পারিবারিক নাম ইভান আহমেদ। তাঁর গল্পও অনন্যার মতো। কথার বাবা নেই। মা আছেন। ভাইবোনেরা থেকেও না থাকার মতো। কথাকে মেনে নেননি কেউ। পারিবারিক, সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছেন কথা। যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে।
কথা এখন সচেতন শিল্পী সংঘের প্রেসিডেন্ট। এই সংগঠন হিজড়াদের মানবাধিকার, এইচআইভি এইডস নিয়ে কাজ করে। সংগঠনের সদস্য ৪৫০ জন। শিল্পী আছেন ৪০ জন। এই সংগঠন ছাড়াও কথা সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে হিজড়া নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। শিশু একাডেমিতে চার বছরের শিশুদের নাচ শিখিয়েছেন। কিন্তু শিশুদের অভিভাবকেরা সহজভাবে কথাকে নিতে পারেননি। তাই নাচ শেখানো বাদ দিয়েছেন। তবে দমে যাননি। সব ধরনের শিশুদের নাচ এবং অভিনয় শেখানোর জন্য কথাকলি শিশু কিশোর নামে একটি সংগঠন খুলেছেন। বিবিসি ওয়ার্ল্ডে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে জমা দিয়েছিলেন। ছয় মাসের জন্য একটি কাজের সুযোগও পান। ব্যক্তিগত ঝামেলার জন্য কাজটি করতে পারেননি।
কথাও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছেন। শিক্ষা সনদ ইভান আহমেদ নামে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্যও অনন্যার মতোই। সনদ দিয়ে কী হবে? এফিডেভিটের যন্ত্রণা পোহাতে রাজি নন তিনিও।
কাগুজে স্বীকৃতি দিয়ে লাভ নেই
২০১৩ সালে নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের আলাদা লিঙ্গ বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অনন্যা এবং কথা বলেন, ‘কাগুজে স্বীকৃতি দিয়ে লাভ নাই। পাসপোর্ট করতে গেলে বলে হিজড়া টিজড়া বুঝি না। ও শাড়ি পরেছেন, তাহলে নারী হিসেবেই পাসপোর্ট করেন। ভোটার তালিকা করার সময়ও একই অবস্থা। আমরা নির্বাচন করতে পারি না। স্কুলে ভর্তি বা চাকরির সময়ও আমাদের কথা উল্লেখ থাকে না। ইতিহাসে, পাঠ্যপুস্তকে কোথাও হিজড়াদের ইতিবাচক ইতিহাস লেখা হয়নি। সরকার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট ঘোষণা করেছে, আমরা নাচানাচি করে আনন্দ করেছি। সরকারের কিছু ভোট বেড়েছে। এইটুকুই। নারী-পুরুষের বাইরে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হিসেবে আমাদের উল্লেখ করতে চায় সরকার। কিন্তু আমরা প্রতিবন্ধী নই।’
অনন্যা ও কথা নিজেদের নারী ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁরা জানেন কোনো দিন সংসার করতে পারবেন না। তাঁরা রাতে ঘুমাতে যান একলা। শরীর খারাপ লাগলে পরিবারের কাউকে জানাতে পারেন না। ঘরে মারা গেলে দরজা কেটে বের করতে হয়। তার পরও আছে বঞ্চনা। মৃতদেহটির শেষকৃত্য কেউ করতে চান না। খবর পেয়ে হয়তো পরিবারের লোকজন আসেন। আগেই খোঁজ নেন হিজড়া কী কী সম্পত্তি রেখে গেছে।
বেশির ভাগ হিজড়া বাচ্চা নাচানোর নাম করে বা রাস্তায় যাত্রীদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি করছে। এ ব্যাপারে অনন্যা এবং কথা বলেন, তাঁরা বাধ্য হয়েই এ ধরনের কাজ করছে। প্রতিটি হিজড়া পরিবার থেকে নির্যাতিত হয়ে পথে নামেন কিশোর বয়সে। তাঁদের শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দুমুঠো ভাত জোগাড়ের সংগ্রামে নামেন।
হিজড়াদের তাঁদের মতো করে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে এবং শিক্ষিত করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান অনন্যা ও কথারা।
অনন্যা এবং কথা বর্তমানে পরিচিত মুখ। তার পরও তাঁদের যৌন হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। শুনতে হয় নানান কটু কথা। তাঁরা বলেন, ‘প্রকৃতির কোন খেয়ালে আমাদের জন্ম, তা জানি না। এ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আক্ষেপেরও অন্ত থাকে না। কিন্তু মানুষ হিসেবে অধিকার থেকে আমরা কেন বঞ্চিত হব? ’
No comments