দুটি শহরে তিনটি নির্বাচন, চ্যালেঞ্জ সবার জন্য by এম সাখাওয়াত হোসেন
বহু
জল্পনা-কল্পনা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে সরকার বিভক্ত ঢাকার সিটি
করপোরেশন নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশের কয়েক দিনের মধ্যেই সীমানা নির্ধারণের
জটিলতা কেটে গেল, সূচিত হলো নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। সরকারের পদক্ষেপের
পরপরই নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় দফা দুই
করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার। প্রথমে জুনের মাঝামাঝি নির্বাচন
অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার কথা বলা হলেও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তার অনুরোধে
নির্বাচন কমিশন ওই সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য দ্বিতীয়বারের
মতো তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সম্ভাব্য সময় সম্বন্ধে
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর এই মত পরিবর্তন নিয়ে অনেকেই মনে করেন,
২০-দলীয় জোটের চলমান আন্দোলনকে ভোঁতা করার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে
এই নির্বাচন একটি রাজনৈতিক চাল। সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো কৌশল
গ্রহণ করেছে। যা-ই হোক, যেভাবেই হোক, অবশেষে বিভাজিত ঢাকার দুই সিটি
করপোরেশনে আগামী ২৮ এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। শুধু ওই দুটি
সিটি করপোরেশনেই নয়, একই দিনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের—মেয়াদের
মধ্যেই—নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এককথায় একই দিনে দেশের দুটি বড় শহরের তিনটি
করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে দেশের প্রায় ৭০ লাখ
ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। উল্লেখ্য, ঢাকা সিটি করপোরেশনের
নির্বাচন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় আট বছর আগে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি বা করা যায়নি। এরই মধ্যে ২০১২ সালে সিটি
করপোরেশনকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়। অতীতে বিবিধ কারণে—যার মধ্যে রাজনৈতিক
কারণই প্রধান—ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সময়মতো হয়নি। বিভাজিত হওয়ার
পরও আরেকবার তফসিল দিলেও সেটাও অত্যন্ত দুর্বল কারণে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।
এসব কারণেই স্বভাবতই অনেকের মতে, সরকারি দলের সুবিধা হবে না—এমন আশঙ্কার
কারণেই এত দিন এই নির্বাচন ঝুলে ছিল।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দেশের রাজনীতির, বিশেষ করে সরকারি দলের রাজনীতির একটা যোগসূত্র অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমন রয়েছে। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনের পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিদেশে এই সরকারের অসুবিধাজনক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অবশ্য চট্টগ্রামও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সন্দেহ নেই। তবে রাজধানী শহর হওয়ায় ঢাকা দেশের রাজনীতিতে অধিক গুরুত্ব বহন করে।
বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলমান, তার আঙ্গিকে বিবেচনা করলে এই নির্বাচন সরকার ও আন্দোলনরত বিরোধী জোট—উভয়ের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সরকারি দল বিরোধী দলকে যেভাবে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বশূন্য করেছে, তাতে হয়তো, তাদের বিবেচনায়, বিরোধী ২০-দলীয় জোট এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে অথবা অংশ নিলেও সরকারি দলের কূটকৌশলে পরাজিত হতে পারে। অপর দিকে ২০-দলীয় জোট যে ধরনের আন্দোলনে রয়েছে, তাদের মতে, তাতে সরকার অনেকটা বেকায়দায় রয়েছে, অন্তত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সরকারের জন্য আরও বিব্রতকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের রহস্যজনক অন্তর্ধান। সালাহ উদ্দিন আহমদের অন্তর্ধানের পেছনে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা যদি না থাকে, যেমনটা তাদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তা আরও বড় আতঙ্কের কারণ। এর মানে যে দেশে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী শক্তি বিদ্যমান, যা রাষ্ট্র ও সমাজ কোনোটার জন্যই সুখকর নয়। এ ধরনের পরিস্থিতি একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে।
এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি কৌশলে বেশ কিছুদিনের জন্য হলেও দেশের দুই বৃহত্তম শহরে, যেখানে প্রায় দুই কোটি লোকের বাস, চলমান আন্দোলন ও সরকারের বিব্রতকর অবস্থা থেকে মনোযোগ সরাতে সক্ষম হবে বা হচ্ছে। অপর দিকে ২০-দলীয় জোটের আন্দোলনকে সরকার গণবিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে পেট্রলবোমায় হতাহত মানুষের বিভীষিকাময় চিত্র আন্দোলনকারীদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হরতাল আর অবরোধ রয়েছে নামে মাত্র। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে উভয়সংকটে রয়েছে ২০-দলীয় জোট, বিশেষ করে বিএনপি। অবস্থাটা প্রায় ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, সরকার এই চালে এগিয়ে রয়েছে। তবে ২০-দলীয় জোট যে ধরনের আন্দোলনের চোরাবালিতে আটকে আছে, সেখান থেকে বের হয়ে নতুন আঙ্গিকে আরও জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের পথ ধরতে পারছে না। এই দুই শহরের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০-দলীয় জোটের সামনে চোরাবালি থেকে বের হওয়ার পথের সন্ধান দিতে পারে।
বিএনপি জোট এই তিনটি নির্বাচনে সমর্থিত প্রার্থী দেবে বা দিচ্ছে এমনটাই সংকেত পাওয়া গেছে। এমন সিদ্ধান্ত হলে হয়তো তাদেরও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হবে। আন্দোলনকে আরও জনসম্পৃক্ত করার কৌশল হতে পারে। বিএনপি ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের পরেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কাজেই এ তিনটি নির্বাচন অন্য কোনো অজুহাতে বর্জন করার যৌক্তিকতা নেই। অংশগ্রহণে ২০ দল-সমর্থিত প্রার্থী জিতলেও ২০-দলীয় জোট জিতবে বা হারলেও জিতবে; যদি সে হার আইনবহির্ভূত বলে প্রমাণিত হয়। অপর দিকে সরকারি দল যদি অন্য কোনো কৌশল অবলম্বনে জয়ী হয়, তবে সেটা হবে বড় ধরনের হার আর পরাজিত হলে তা হবে সরকারের একধরনের বিজয়। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, যে পরিস্থিতিতে এই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সে সময়টি অতীব কঠিন। অতীতে কোনো নির্বাচনই এত কঠিন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। অতীতে এই দুই শহরের নির্বাচনও এতটা জটিল আর কঠিন মনে হয়নি।
ওপরের আলোচনার আঙ্গিকে সহজ ভাষায় বলা যায় যে এই তিনটি নির্বাচন যে পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে, তা স্বাভাবিক অবস্থায় অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক সংকটের ‘যৌক্তিক সমাধান’-এর বাইরে অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। বিশেষ করে ঢাকা নগরের নির্বাচন সব সময়ই বেশ জটিল। এখানে দুটি নির্বাচন নয়, নির্বাচন হবে মোট ৯৩টি ওয়ার্ডে, যার প্রতিটি ভোটার ও লোকসংখ্যা দেশের সিংহভাগ পৌরসভা থেকেও অনেক অধিক। তার ওপর রয়েছে একাধিক প্রার্থী, যাঁদের প্রত্যেকেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। নির্বাচিত হবেন ৩১ জন মহিলা সদস্য। কাজেই একজন ভোটারকে তিনটি করে ব্যালট পেপার সামলাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা যেমন জটিল, তেমনি পরিচালনাও বেশ কষ্টকর।
আগেই বলেছি, বিবিধ কারণে এই তিনটি নির্বাচনই হবে বেশ জটিল। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। বিগত উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। জাতীয় সংসদের কথা বাদ দিলেও অন্যান্য নির্বাচনেও কমিশনের ভূমিকা বিতর্কের মুখে পড়ে। এ বিতর্ক আরও উসকে দেয় নির্বাচন নিয়ে একজন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের বক্তব্য। কাজেই সংগত কারণেই নির্বাচন কমিশনকে প্রথম থেকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। যেহেতু রিটার্নিং কর্মকর্তারা কমিশনের কর্মকর্তা, সে ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু সুবিধা থাকলেও সার্বক্ষণিকভাবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সব সময় নির্বাচন কমিশন থেকে দিকনির্দেশনার প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে কমিশনকেই সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।
নির্বাচনই গণতন্ত্রের প্রথম সোপান, যার মাধ্যমে ভোটাররা তাঁদের মতো করে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। সে নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সর্বত সহযোগিতা করা। তবে যেখানে সরকার বা সরকারি দল নির্বাচনে পক্ষ হয়, সেখানে, বিশেষ করে আমাদের দেশে সরকার থেকে সহযোগিতা আদায় করে নিতে হয়। তার এ কাজটি মাঝেমধ্যে দুরূহ বিষয় বলে প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশের বাস্তবিক চিত্র হলো, এখানে নির্বাচন কমিশনের সহায়ক শক্তি বলে কথিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। অপর দিকে বহুবিধ কারণে সময়ে সময়ে নির্বাচন কমিশনও তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে যত্নবান হয় না।
যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব অনেক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হলেও এর শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। কাজেই কমিশনে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পরিচালনা, দিকনির্দেশনা ও মনোবল জোগানোর দায়িত্ব একমাত্র কমিশনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। সোজা কথায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের। সফলতা ভাগাভাগি করা যায়, তবে ব্যর্থতার দায়ভার কমিশনের ওপরই বর্তাবে। এ কথা পরীক্ষিত সত্য।
দুটি শহরের আসন্ন তিনটি নির্বাচন শুধু সরকার, সরকারি দল, বিরোধী ২০-দলীয় জোটের জন্যই চ্যালেঞ্জ নয়, বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের জন্যও। হাল অতীতের—বিশেষ করে জানুয়ারি ৫, ২০১৪ এবং পরে উপজেলা নির্বাচন—অভিজ্ঞতা কমিশনের জন্য সুখকর হয়নি। সেখান থেকে বের হওয়ার কিছুটা সুযোগ এই তিনটি নির্বাচন করে দিতে পারে। কাজেই সিটি করপোরেশনের এই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশে আগামী রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক নির্দেশ যেমন করবে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ স্পষ্ট করতে পারে। বস্তুত, এই আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন সব পক্ষের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দেশের রাজনীতির, বিশেষ করে সরকারি দলের রাজনীতির একটা যোগসূত্র অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমন রয়েছে। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনের পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিদেশে এই সরকারের অসুবিধাজনক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অবশ্য চট্টগ্রামও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সন্দেহ নেই। তবে রাজধানী শহর হওয়ায় ঢাকা দেশের রাজনীতিতে অধিক গুরুত্ব বহন করে।
বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলমান, তার আঙ্গিকে বিবেচনা করলে এই নির্বাচন সরকার ও আন্দোলনরত বিরোধী জোট—উভয়ের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সরকারি দল বিরোধী দলকে যেভাবে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বশূন্য করেছে, তাতে হয়তো, তাদের বিবেচনায়, বিরোধী ২০-দলীয় জোট এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারে অথবা অংশ নিলেও সরকারি দলের কূটকৌশলে পরাজিত হতে পারে। অপর দিকে ২০-দলীয় জোট যে ধরনের আন্দোলনে রয়েছে, তাদের মতে, তাতে সরকার অনেকটা বেকায়দায় রয়েছে, অন্তত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সরকারের জন্য আরও বিব্রতকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের রহস্যজনক অন্তর্ধান। সালাহ উদ্দিন আহমদের অন্তর্ধানের পেছনে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা যদি না থাকে, যেমনটা তাদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তা আরও বড় আতঙ্কের কারণ। এর মানে যে দেশে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী শক্তি বিদ্যমান, যা রাষ্ট্র ও সমাজ কোনোটার জন্যই সুখকর নয়। এ ধরনের পরিস্থিতি একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে।
এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি কৌশলে বেশ কিছুদিনের জন্য হলেও দেশের দুই বৃহত্তম শহরে, যেখানে প্রায় দুই কোটি লোকের বাস, চলমান আন্দোলন ও সরকারের বিব্রতকর অবস্থা থেকে মনোযোগ সরাতে সক্ষম হবে বা হচ্ছে। অপর দিকে ২০-দলীয় জোটের আন্দোলনকে সরকার গণবিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে পেট্রলবোমায় হতাহত মানুষের বিভীষিকাময় চিত্র আন্দোলনকারীদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হরতাল আর অবরোধ রয়েছে নামে মাত্র। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে উভয়সংকটে রয়েছে ২০-দলীয় জোট, বিশেষ করে বিএনপি। অবস্থাটা প্রায় ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, সরকার এই চালে এগিয়ে রয়েছে। তবে ২০-দলীয় জোট যে ধরনের আন্দোলনের চোরাবালিতে আটকে আছে, সেখান থেকে বের হয়ে নতুন আঙ্গিকে আরও জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের পথ ধরতে পারছে না। এই দুই শহরের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০-দলীয় জোটের সামনে চোরাবালি থেকে বের হওয়ার পথের সন্ধান দিতে পারে।
বিএনপি জোট এই তিনটি নির্বাচনে সমর্থিত প্রার্থী দেবে বা দিচ্ছে এমনটাই সংকেত পাওয়া গেছে। এমন সিদ্ধান্ত হলে হয়তো তাদেরও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হবে। আন্দোলনকে আরও জনসম্পৃক্ত করার কৌশল হতে পারে। বিএনপি ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের পরেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কাজেই এ তিনটি নির্বাচন অন্য কোনো অজুহাতে বর্জন করার যৌক্তিকতা নেই। অংশগ্রহণে ২০ দল-সমর্থিত প্রার্থী জিতলেও ২০-দলীয় জোট জিতবে বা হারলেও জিতবে; যদি সে হার আইনবহির্ভূত বলে প্রমাণিত হয়। অপর দিকে সরকারি দল যদি অন্য কোনো কৌশল অবলম্বনে জয়ী হয়, তবে সেটা হবে বড় ধরনের হার আর পরাজিত হলে তা হবে সরকারের একধরনের বিজয়। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, যে পরিস্থিতিতে এই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সে সময়টি অতীব কঠিন। অতীতে কোনো নির্বাচনই এত কঠিন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। অতীতে এই দুই শহরের নির্বাচনও এতটা জটিল আর কঠিন মনে হয়নি।
ওপরের আলোচনার আঙ্গিকে সহজ ভাষায় বলা যায় যে এই তিনটি নির্বাচন যে পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে, তা স্বাভাবিক অবস্থায় অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক সংকটের ‘যৌক্তিক সমাধান’-এর বাইরে অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। বিশেষ করে ঢাকা নগরের নির্বাচন সব সময়ই বেশ জটিল। এখানে দুটি নির্বাচন নয়, নির্বাচন হবে মোট ৯৩টি ওয়ার্ডে, যার প্রতিটি ভোটার ও লোকসংখ্যা দেশের সিংহভাগ পৌরসভা থেকেও অনেক অধিক। তার ওপর রয়েছে একাধিক প্রার্থী, যাঁদের প্রত্যেকেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। নির্বাচিত হবেন ৩১ জন মহিলা সদস্য। কাজেই একজন ভোটারকে তিনটি করে ব্যালট পেপার সামলাতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা যেমন জটিল, তেমনি পরিচালনাও বেশ কষ্টকর।
আগেই বলেছি, বিবিধ কারণে এই তিনটি নির্বাচনই হবে বেশ জটিল। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। বিগত উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। জাতীয় সংসদের কথা বাদ দিলেও অন্যান্য নির্বাচনেও কমিশনের ভূমিকা বিতর্কের মুখে পড়ে। এ বিতর্ক আরও উসকে দেয় নির্বাচন নিয়ে একজন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের বক্তব্য। কাজেই সংগত কারণেই নির্বাচন কমিশনকে প্রথম থেকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। যেহেতু রিটার্নিং কর্মকর্তারা কমিশনের কর্মকর্তা, সে ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু সুবিধা থাকলেও সার্বক্ষণিকভাবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সব সময় নির্বাচন কমিশন থেকে দিকনির্দেশনার প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে কমিশনকেই সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।
নির্বাচনই গণতন্ত্রের প্রথম সোপান, যার মাধ্যমে ভোটাররা তাঁদের মতো করে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। সে নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সর্বত সহযোগিতা করা। তবে যেখানে সরকার বা সরকারি দল নির্বাচনে পক্ষ হয়, সেখানে, বিশেষ করে আমাদের দেশে সরকার থেকে সহযোগিতা আদায় করে নিতে হয়। তার এ কাজটি মাঝেমধ্যে দুরূহ বিষয় বলে প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশের বাস্তবিক চিত্র হলো, এখানে নির্বাচন কমিশনের সহায়ক শক্তি বলে কথিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। অপর দিকে বহুবিধ কারণে সময়ে সময়ে নির্বাচন কমিশনও তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে যত্নবান হয় না।
যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব অনেক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হলেও এর শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। কাজেই কমিশনে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পরিচালনা, দিকনির্দেশনা ও মনোবল জোগানোর দায়িত্ব একমাত্র কমিশনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। সোজা কথায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের। সফলতা ভাগাভাগি করা যায়, তবে ব্যর্থতার দায়ভার কমিশনের ওপরই বর্তাবে। এ কথা পরীক্ষিত সত্য।
দুটি শহরের আসন্ন তিনটি নির্বাচন শুধু সরকার, সরকারি দল, বিরোধী ২০-দলীয় জোটের জন্যই চ্যালেঞ্জ নয়, বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের জন্যও। হাল অতীতের—বিশেষ করে জানুয়ারি ৫, ২০১৪ এবং পরে উপজেলা নির্বাচন—অভিজ্ঞতা কমিশনের জন্য সুখকর হয়নি। সেখান থেকে বের হওয়ার কিছুটা সুযোগ এই তিনটি নির্বাচন করে দিতে পারে। কাজেই সিটি করপোরেশনের এই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি নির্বাচন বাংলাদেশে আগামী রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক নির্দেশ যেমন করবে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ স্পষ্ট করতে পারে। বস্তুত, এই আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন সব পক্ষের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments