সঙ্কট নিরসনে সংলাপ খুবই জরুরি by এম রহমান
দেশ
আজ এক গভীর সঙ্কটে নিপতিত। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে
সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট প্রায় এক মাস ধরে
আন্দোলন করে যাচ্ছে। এবারের ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটকে ‘গণতন্ত্র হত্যা
দিবস’ পালনের লক্ষ্যে সভা করতে না দেয়া এবং বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে
রাখা ও বিএনপি কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রাখায় চলমান আন্দোলনের সূত্রপাত।
কোনো আইনিপ্রক্রিয়া ছাড়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে কিভাবে তার
কার্যালয়ে অবরুদ্ধ এবং প্রধান বিরোধী দলের কার্যালয়ে তালা দিয়ে রাখে, তা
বোধগম্য নয়। কোনো অজুহাতেই একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় তালা দিয়ে রাখা যায়
না। ভিন্ন মতের কারণে, সরকার আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে বহু দিন ধরে
এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। একই কারণে, দিগন্ত
টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়েছে। এগুলো গণতন্ত্র চর্চার জন্য
সহায়ক নয়, বরং অন্তরায়। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন ও
বাকশাল গঠন করে তৎকালীন সরকার চারটি পত্রিকা বাদে অন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে
দিয়েছিল।
আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ হলো, এবার সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে বাধ্য করা। কেননা গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচন যেখানে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে অধিকাংশ নির্বাচনী এলাকায় ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর ১৪৭টি আসনের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পরও ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। এটাকে সরকারের মুখ রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন ৪০ শতাংশ বানিয়েছে বলে বিরোধী জোটের দাবি। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এ যাবৎ দু’টি নির্বাচন হয়েছেÑ একটি ১৯৭৩ সালে, আরেকটি ২০১৪ সালে। এ দুটো নির্বাচনের প্রথমটিতে অনেককে নমিনেশন পেপার দাখিল করতে দেয়া হয়নি, অন্যটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের অভিধা পেয়েছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলেছিলেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, নির্বাচনের পর একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে আলাপ হতে পারে, তখন অনেকেই তার কথায় আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েই তিনি বললেন যে, ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। এটা ওয়াদাভঙ্গের শামিল বলে অনেকের অভিমত। তিনি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে ‘সীমিত গণতন্ত্রের’ তত্ত্ব দিচ্ছেন। সামরিক শাসকেরাও কিন্তু স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তাদের অবৈধ শাসন বৈধ করার প্রয়াস পেতেন। প্রকৃতপক্ষে একটি সরকারের ক্ষমতার ভিত হলো জনসমর্থন যা অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচনের মানদণ্ডে নির্ণীত হতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন উল্লিখিত কোনো মানদণ্ডে টেকে না। দেশ-বিদেশেও এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পুনর্নির্বাচনের জন্য এক বছর অপেক্ষার পালা শেষ করে ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসংবলিত সাত দফা দাবি পেশ করেন। সরকার এ ব্যাপারে কোনো আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে। জন এফ কেনেডির একটি বিখ্যাত উক্তি হলো : Do not negotiate out of fear but do not fear to negotiate. সাত দফা নিয়ে আলোচনা করলে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান বেরিয়ে না এলেও বিরোধী দলীয় জোট বিশেষ করে বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান কিছুটা হলেও ঘুচত। পরবর্তী সময়ে হয়তো সমাধান বের হয়ে আসত। আলোচনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেলে আন্দোলন ছাড়া বিরোধী দলীয় জোটের জন্য কী বিকল্প থাকে? আর ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটকে কর্মসূচি পালন করতে না দিয়ে এবং বেগম খালেদা জিয়াকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে রেখে সরকার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। বিরোধী জোট অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করলে সরকার এ জোটের বড় অংশীদার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেফতার করা শুরু করে দিয়েছে। আর বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশী-বিদেশী সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবুও তা অব্যাহত রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িতে দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যাকে অনেকেই বলছেন ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’। দমন পীড়নের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য নাশকতা চালানো হচ্ছে বলে ২০ দলীয় জোটের অভিযোগ। একটি বিড়ালকে পর্যন্ত ঘরের মধ্যে আটকে ফেলে পেটাতে গেলে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। অনুরূপভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করতে না পেরে জোর-জুলুম, দমন-পীড়ন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হলে বিরোধী কর্মী-সমর্থকদের সহিংস হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। অতীতেও এমন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে On Civil Disobedience রচনায় হেনরি থোরের একটি উক্তি স্মর্তব্য : To be right is more honourable than to be law-abiding. আর বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভলতেয়ারের মত হলো- It is dangerous to be right when the government is wrong. আন্দোলনরত বিরোধী নেতাকর্মীদের মনে এসব উপলব্ধি ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। ২০ দলীয় জোট বর্তমান সরকারকে ‘জবরদখলকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছে। অবশ্য কোনো বিবেচনায় কারো দ্বারা জানমালের ক্ষতিসাধন সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো : সরকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না কেন? আন্দোলন তো দূরের কথা, ন্যূনতম কর্মসূচি পালন, অর্থাৎ মিটিং-মিছিল পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। ফলে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ও সহিংসতা অনিবার্য হয়ে পড়ে যা আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে তাদের আন্দোলনের সময়েও হয়েছে। স্মর্তব্য, বিএনপির ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের আমলে ট্রেনের ফিশ প্লেট উঠিয়ে ফেলা হয়েছিল, বাসে গানপাউডার দিয়ে আগুন দেয়া হয়েছিল, পল্টনে লগি-বৈঠা দিয়ে কয়েকজন জামায়াত-শিবিরকর্মীকে মারা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের আগে সারা দেশে অবরোধ করে জনগণকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছিল।
বর্তমান আন্দোলনে অনেক সহিংস ও অমানবিক ঘটনা ঘটলেও এ সমস্যা রাজনৈতিক। এসব কিছু আইনশৃঙ্খলাজনিত নয়। তাই বল প্রয়োগে এর সমাধান হবে না। এটা মূলত একটি রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ কিংবা পাইকারি হারে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং ঘরবাড়ি ছাড়া করায় জনমনে প্রচণ্ড আতঙ্ক বিরাজ করছে। শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতাদের মামলায় জড়ানো ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকেও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসনকেও গাড়ি পোড়ানো মামলায় আসামি করা হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত সঙ্কীর্ণতা ও প্রতিহিংসারই বহিঃপ্রকাশ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিরোধী বা রাজনীতিবিদদের ভিন্নমতের পক্ষে মানসম্মান নিয়ে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিরোধী জোট বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করায় তারা নিয়ন্ত্রণহীন ও জবাবদিহিতাহীন হয়ে গেছে, যা শুভ ফল বয়ে আনবে না কারো জন্যই। সরকারের নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। পুলিশ এবং র্যাব প্রধানের রাজনৈতিক বক্তব্যে সচেতন নাগরিক মাত্রই বিস্মিত ও উৎকণ্ঠিত। তাদের বক্তব্যে সার্ভিস ক্যাডার ও দলীয় ক্যাডারের সীমারেখা মুছে গেছে। তাদের বক্তব্য পেশাদারিত্বের পরিচায়ক নয়।
চলমান আন্দোলনে সহিংসতার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করে কোনো লাভ হবে না। আজকের এই রাজনৈতিক সঙ্কটের উত্তরণ ঘটাতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে, অন্য পন্থায় নয়। এ লক্ষ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে অবিলম্বে বৈঠকের আয়োজন করা একান্ত জরুরি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী অন্যান্য দলকেও আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। তা সংলাপে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়ক হবে। সব মান-অভিমান ভুলে এবং জেদ পরিহার করে সরকারকেই এই বৈঠকের আয়োজন করতে হবে। এতে দ্বিধা বা লজ্জার কিছু নেই। রাজনীতিতে জেদাজিদি কখনো শুভ ফল বয়ে আনে না। উল্লেখ্য লৌহমানব আইয়ুব খানও ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের একপর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমানকে (তখনো ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত হননি) প্যারোলে মুক্তি দিয়ে অন্যদের সাথে ও তার সাথে গোলটেবিল বৈঠকে বসেছিলেন। দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো একটি সত্য মামলা (এর সত্যতা) এখন প্রশ্নাতীত তুলেও নিয়েছিলেন এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে আইয়ুব খান এক ভাষণেÑ I cannot preside over the destruction of my country এই কথা বলে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। সুতরাং সব কয়টি সিটি করপোরেশনে বিজয়ী এবং তিন তিনবার ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপিকে শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘জঙ্গি’ দল আখ্যায়িত করে সংলাপ এড়িয়ে যাওয়া যুক্তির কথা হতে পারে না। উল্লেখ্য যে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনী, যাদের হাতে সেনা সদস্যসহ বহু বাঙালির জীবন গিয়েছে, তাদের সাথেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে সংলাপ এবং শান্তি চুক্তি করেছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর দরকার নেই, দরকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি প্রদর্শনের। কালবিলম্ব না করে সংলাপের আয়োজন করে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন, এই প্রত্যাশা করছে জনগণ। তাতে একটি সমাধান বের হয়ে আসবে, এই বিশ্বাসে স্থিত হওয়া যায়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণ হলো, এবার সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে বাধ্য করা। কেননা গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচন যেখানে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে অধিকাংশ নির্বাচনী এলাকায় ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর ১৪৭টি আসনের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পরও ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। এটাকে সরকারের মুখ রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন ৪০ শতাংশ বানিয়েছে বলে বিরোধী জোটের দাবি। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এ যাবৎ দু’টি নির্বাচন হয়েছেÑ একটি ১৯৭৩ সালে, আরেকটি ২০১৪ সালে। এ দুটো নির্বাচনের প্রথমটিতে অনেককে নমিনেশন পেপার দাখিল করতে দেয়া হয়নি, অন্যটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের অভিধা পেয়েছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলেছিলেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, নির্বাচনের পর একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে আলাপ হতে পারে, তখন অনেকেই তার কথায় আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েই তিনি বললেন যে, ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। এটা ওয়াদাভঙ্গের শামিল বলে অনেকের অভিমত। তিনি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে ‘সীমিত গণতন্ত্রের’ তত্ত্ব দিচ্ছেন। সামরিক শাসকেরাও কিন্তু স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তাদের অবৈধ শাসন বৈধ করার প্রয়াস পেতেন। প্রকৃতপক্ষে একটি সরকারের ক্ষমতার ভিত হলো জনসমর্থন যা অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচনের মানদণ্ডে নির্ণীত হতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন উল্লিখিত কোনো মানদণ্ডে টেকে না। দেশ-বিদেশেও এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পুনর্নির্বাচনের জন্য এক বছর অপেক্ষার পালা শেষ করে ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসংবলিত সাত দফা দাবি পেশ করেন। সরকার এ ব্যাপারে কোনো আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে। জন এফ কেনেডির একটি বিখ্যাত উক্তি হলো : Do not negotiate out of fear but do not fear to negotiate. সাত দফা নিয়ে আলোচনা করলে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান বেরিয়ে না এলেও বিরোধী দলীয় জোট বিশেষ করে বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান কিছুটা হলেও ঘুচত। পরবর্তী সময়ে হয়তো সমাধান বের হয়ে আসত। আলোচনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেলে আন্দোলন ছাড়া বিরোধী দলীয় জোটের জন্য কী বিকল্প থাকে? আর ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটকে কর্মসূচি পালন করতে না দিয়ে এবং বেগম খালেদা জিয়াকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে রেখে সরকার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। বিরোধী জোট অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করলে সরকার এ জোটের বড় অংশীদার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেফতার করা শুরু করে দিয়েছে। আর বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশী-বিদেশী সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবুও তা অব্যাহত রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িতে দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যাকে অনেকেই বলছেন ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’। দমন পীড়নের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য নাশকতা চালানো হচ্ছে বলে ২০ দলীয় জোটের অভিযোগ। একটি বিড়ালকে পর্যন্ত ঘরের মধ্যে আটকে ফেলে পেটাতে গেলে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। অনুরূপভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করতে না পেরে জোর-জুলুম, দমন-পীড়ন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হলে বিরোধী কর্মী-সমর্থকদের সহিংস হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। অতীতেও এমন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে On Civil Disobedience রচনায় হেনরি থোরের একটি উক্তি স্মর্তব্য : To be right is more honourable than to be law-abiding. আর বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভলতেয়ারের মত হলো- It is dangerous to be right when the government is wrong. আন্দোলনরত বিরোধী নেতাকর্মীদের মনে এসব উপলব্ধি ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। ২০ দলীয় জোট বর্তমান সরকারকে ‘জবরদখলকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছে। অবশ্য কোনো বিবেচনায় কারো দ্বারা জানমালের ক্ষতিসাধন সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো : সরকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না কেন? আন্দোলন তো দূরের কথা, ন্যূনতম কর্মসূচি পালন, অর্থাৎ মিটিং-মিছিল পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। ফলে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ও সহিংসতা অনিবার্য হয়ে পড়ে যা আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে তাদের আন্দোলনের সময়েও হয়েছে। স্মর্তব্য, বিএনপির ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের আমলে ট্রেনের ফিশ প্লেট উঠিয়ে ফেলা হয়েছিল, বাসে গানপাউডার দিয়ে আগুন দেয়া হয়েছিল, পল্টনে লগি-বৈঠা দিয়ে কয়েকজন জামায়াত-শিবিরকর্মীকে মারা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের আগে সারা দেশে অবরোধ করে জনগণকে জিম্মি করে ফেলা হয়েছিল।
বর্তমান আন্দোলনে অনেক সহিংস ও অমানবিক ঘটনা ঘটলেও এ সমস্যা রাজনৈতিক। এসব কিছু আইনশৃঙ্খলাজনিত নয়। তাই বল প্রয়োগে এর সমাধান হবে না। এটা মূলত একটি রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ কিংবা পাইকারি হারে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং ঘরবাড়ি ছাড়া করায় জনমনে প্রচণ্ড আতঙ্ক বিরাজ করছে। শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতাদের মামলায় জড়ানো ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকেও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসনকেও গাড়ি পোড়ানো মামলায় আসামি করা হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত সঙ্কীর্ণতা ও প্রতিহিংসারই বহিঃপ্রকাশ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিরোধী বা রাজনীতিবিদদের ভিন্নমতের পক্ষে মানসম্মান নিয়ে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিরোধী জোট বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করায় তারা নিয়ন্ত্রণহীন ও জবাবদিহিতাহীন হয়ে গেছে, যা শুভ ফল বয়ে আনবে না কারো জন্যই। সরকারের নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। পুলিশ এবং র্যাব প্রধানের রাজনৈতিক বক্তব্যে সচেতন নাগরিক মাত্রই বিস্মিত ও উৎকণ্ঠিত। তাদের বক্তব্যে সার্ভিস ক্যাডার ও দলীয় ক্যাডারের সীমারেখা মুছে গেছে। তাদের বক্তব্য পেশাদারিত্বের পরিচায়ক নয়।
চলমান আন্দোলনে সহিংসতার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করে কোনো লাভ হবে না। আজকের এই রাজনৈতিক সঙ্কটের উত্তরণ ঘটাতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে, অন্য পন্থায় নয়। এ লক্ষ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে অবিলম্বে বৈঠকের আয়োজন করা একান্ত জরুরি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী অন্যান্য দলকেও আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। তা সংলাপে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়ক হবে। সব মান-অভিমান ভুলে এবং জেদ পরিহার করে সরকারকেই এই বৈঠকের আয়োজন করতে হবে। এতে দ্বিধা বা লজ্জার কিছু নেই। রাজনীতিতে জেদাজিদি কখনো শুভ ফল বয়ে আনে না। উল্লেখ্য লৌহমানব আইয়ুব খানও ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের একপর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমানকে (তখনো ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত হননি) প্যারোলে মুক্তি দিয়ে অন্যদের সাথে ও তার সাথে গোলটেবিল বৈঠকে বসেছিলেন। দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো একটি সত্য মামলা (এর সত্যতা) এখন প্রশ্নাতীত তুলেও নিয়েছিলেন এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে আইয়ুব খান এক ভাষণেÑ I cannot preside over the destruction of my country এই কথা বলে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। সুতরাং সব কয়টি সিটি করপোরেশনে বিজয়ী এবং তিন তিনবার ক্ষমতায় যাওয়া বিএনপিকে শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘জঙ্গি’ দল আখ্যায়িত করে সংলাপ এড়িয়ে যাওয়া যুক্তির কথা হতে পারে না। উল্লেখ্য যে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত থাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনী, যাদের হাতে সেনা সদস্যসহ বহু বাঙালির জীবন গিয়েছে, তাদের সাথেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে সংলাপ এবং শান্তি চুক্তি করেছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর দরকার নেই, দরকার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি প্রদর্শনের। কালবিলম্ব না করে সংলাপের আয়োজন করে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন, এই প্রত্যাশা করছে জনগণ। তাতে একটি সমাধান বের হয়ে আসবে, এই বিশ্বাসে স্থিত হওয়া যায়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
No comments