মোদির মধুচন্দ্রিমা শেষ by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
গত
মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখে সকাল থেকেই আমি হাজির পশ্চিম
দিল্লির প্যাটেল নগরের মধ্যবিত্ত মহল্লায়। এখানেই কিছুদিন আগে আম আদমি
পার্টি তাদের অফিস খুলেছে। সকাল আটটা। দিল্লি বিধানসভার ভোট গণনা শুরু হব
হব করছে। চারতলা বাড়ির ওপরের দুটি তলার সামনেরটায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের
একটা পেল্লাই হাসিমুখ ছবি। জনতার মাঝে তিনি মিশে রয়েছেন। পাশে বড় বড় করে
লেখা ‘জনতা কা সিএম’। ছবিটার চারপাশে সবুজ–সাদা বেলুনের সারি। সবুজ মানে
সজীবতা ও প্রাণের স্পন্দন, সাদা হলো স্বচ্ছতা ও সততার প্রতীক। সেই সকাল
থেকেই কেমন একটা উৎসবের পরিবেশ। দুটি বিশাল স্ক্রিনে অবিরাম ভেসে উঠছে
গণনার গতি-প্রকৃতি। একেকটি কেন্দ্রে আম আদমি প্রার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার খবর
সেই জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠছে আর জনতার উল্লাসে ফেটে পড়ছে তল্লাট।
সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অতি আধুনিক মানুষজনও একে অন্যকে
আলিঙ্গন করছে। মাইকে বাজছে দেশাত্মবোধক গান। চারতলা অফিসের ছাদ থেকে
অবিরাম ঝরে পড়ছে লাল গোলাপের পাপড়ি। চারদিকে পতপত করে উড়ছে জাতীয়
পতাকা। গোটা রাস্তা অগুনতি দলীয় প্রতীক চিহ্ন ঝাড়ুতে ছয়লাব। প্রত্যেকের
মাথায় সাদা টুপি। তাতে কালো কালিতে লেখা, ‘৫ সাল, কেজরিওয়াল’।
আমি দেখছি আর ভাবছি, ওই যে বিশাল বড় ছবিটার পাশে লেখা ‘জনতা কা সিএম’, এই যে হাজার হাজার টুপিতে ‘৫ সাল, কেজিওয়াল’ ঘোষণা, এসবের প্রস্তুতিতেও তো সময় লাগে! অন্তত একটা দিন! জয় সম্পর্কে কতটা নিশ্চিত হলে এই বিপুল আয়োজন সম্ভব! তার মানে, ক্ষমতায় তাঁরা যে আসছেনই, কেজরিওয়াল ও তাঁর সঙ্গীরা ভোট গ্রহণের দিন থেকেই শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত ছিলেন? কী করে? বুথফেরত জরিপে অবশ্যই তাঁদের জয় ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু সব কটি সংস্থার হিসাব নিলেও সেই জয়ের গড় সংখ্যাটা হয় ৩৯। তাতেই এমন প্রস্তুতি?
অবিরাম চলমান জনস্রোতের মধ্য থেকে এক-একজনকে একধারে ডেকে আমি জয়ের কারণগুলো ওদের জায়গা থেকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করলাম। নানা জাতের নানা ভাষাভাষি মানুষ। প্রথমজন বললেন, মসুরের ডাল ৬০ টাকা কিলো ছিল। তিন মাসে তার দাম বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। কোনো লাগাম নেই। তাঁর পাশের জন বললেন, ‘আমাদের হাউজিংয়ে প্রতিদিন ট্যাংকারের জল কিনতে হয়। দিল্লি জল বোর্ড ও লোকাল ট্যাংকার মাফিয়াদের যোগসাজশের দরুন এই বাড়তি গুনাগারি। আমাদের ৪৯ দিনের সরকার এ জিনিস বন্ধ করেছিল। তার পর থেকে আবার যে কে সেই।’
দেখতে দেখতে আমাকে ঘিরে একটি মাঝারি মাপের বৃত্ত রচিত হলো। নানাজনে নানা মন্তব্য করতে থাকলেন। অধিকাংশই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার বারোমাস্যা। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া, জলের আকাল, পুলিশের দৌরাত্ম্য, সরকারি পর্যায়ে ঘুষের রমরমা, নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল ইত্যাদি। একজন বললেন, নরেন্দ্র মোদি কত কথাই তো বলেছিলেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার ডাক দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু একটা জিনিসেরও দাম কমাতে পেরেছেন? দুধের দাম ৫০ টাকা লিটার হতে চলেছে। আর একজন বললেন, উনি একটা সময় চাওয়ালার ছেলে ছিলেন ঠিকই। এখন আর নেই। এখন ডিজাইনার ড্রেস পরেন। দিনে তিনবার পোশাক বদলান। দশ লাখি সুট পরে ওবামার সঙ্গে চা খান। এখন উনি খাস আদমি। পাশের জন বললেন, মিডিয়াই বা কী করছে? ভোটের আগে কত লেখালেখি। ভোট চুকে গেলে মিডিয়ারও মুখে কুলুপ। দাম বাড়া নিয়ে কারও গরজ নেই। দুর্নীতি নিয়েও মিডিয়ার মাথাব্যথা নেই। সবাই মোদির ‘আচ্ছে দিনের’ তালে তাল মেলাচ্ছে।
ক্রমেই মিডিয়া সেই ভিড়ের টার্গেট হয়ে গেল। মিডিয়া মোদির টাকা খাচ্ছে, মিডিয়া একপেশে—এসব কথা শুনতে হলো। মিডিয়া নাকি সাধারণ মানুষের কথা আজকাল আর লেখে না। তারাও সরকারকে তেল দিচ্ছে আখের গোছাতে। আমি পাশ কাটাতে জানতে চাইলাম, তাহলে মোদির বিজেপি হারছে কেন? বিজেপির এমন দশা কেন হলো?
কী আশ্চর্য! প্রথমেই সমস্বরে একটি নাম উচ্চারিত হলো, কিরণ বেদী।
কিরণ বেদীর আমদানিই যে বিজেপির বিপর্যয়ের প্রধান কারণ, আজ তা স্বতঃসিদ্ধ। রাজ্যস্তরের নেতাদের প্রতি আস্থা না রেখে রাজনৈতিক দিক থেকে অজ্ঞাতকুলশীল কিরণকে টেনে আনা যে মারাত্মক ভুল, ফল প্রকাশের আগেই হয়তো বিজেপির তা বোধগম্য হয়েছিল। না হলে যে হর্ষবর্ধন টানা পাঁচবার কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে জিতেছেন, সেই নিরাপদ আসনে কিরণকে হারতে হয়? সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই বিপর্যয় রাজ্য বিজেপি নেতাদের নিঃশব্দ বিদ্রোহেরই ফল। ৪০ বছর ধরে যাঁরা রাজনীতির মাটি কামড়ে রয়েছেন, তাঁরা কেনই বা এক অরাজনৈতিক অজ্ঞাতকুলশীলকে স্বেচ্ছায় কুর্সি ছেড়ে দেবেন? বিশেষত, তিনি যখন কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেননি?
পাশাপাশি, ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে কেজরিওয়াল আরও একবার সুযোগ পেতে হাতজোড় করে নেমে পড়েছিলেন রাজধানীর আঙিনায়। এক বছর আগের ভোটের প্রচারে তিনি প্রতিপক্ষকে বিঁধেছিলেন যে ঢঙে (বিজেপি ও কংগ্রেস নেতাদের প্রকাশ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছিলেন), এবারের ভোট-প্রচারে সেই তিনি অনেক বেশি শালীন। এতটাই যে মোদি-অমিত শাহ জুটির ঔদ্ধত্য বড় বেশি চোখ টাটিয়েছে। কেজরিওয়ালরা এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হবেন
না। দিল্লিবাসীর বেছে নিতে হবে অচেনা কিরণ বেদী, অশক্ত অজয় মাকেন অথবা চেনা অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের মধ্যে একজনকে। দিল্লিবাসী এবার আর ভুল করেননি। প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট দিয়ে তাঁরা আম আদমিদেরই বরণ করে নিয়েছেন। ত্রিশঙ্কু বিধানসভার ঝুঁকি এড়াতে তাঁরা সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন কংগ্রেসকে।
যে ৬ শতাংশ ভোট কংগ্রেসের কমেছে, তা জমা পড়েছে আম আদমির ঝোলায়। এই দিল্লিতে পিরামিডের নিচের তলার বাসিন্দাদের মধ্যে কংগ্রেসের একটা জায়গা এক বছর আগেও ছিল। সেই ঝুপড়িবাসী, অটো ও রিকশাচালক, দলিত, ভিন রাজ্যের মানুষজন, মুসলমান, তফসিল, শিল্প-শ্রমিকেরা তাঁদের কোল পেতে দিয়েছেন কেজরিওয়ালকে। রাজধানীর গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও তিনি থাবা বসিয়েছেন জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্সের দৌলতে। কেজরিওয়াল বোঝাতে পেরেছেন, এটা এক অসম লড়াই। কিন্তু সেই লড়াইয়ে তাঁদের জয়ই প্রথাগত রাজনীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে। আরও একবার সুযোগ দিতে তাঁরা কার্পণ্য করেননি। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
দিল্লির এই রায়ের প্রভাব কী ও কতখানি, তা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই রায় মোদির বিরুদ্ধে গণভোট কি না। একটা বিধানসভার রায় দেখে সর্বভারতীয় সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তৎক্ষণাৎ ভবিষ্যদ্বাণী করতে যাঁরা ভালোবাসেন, আমি সেই দলভুক্ত নই। এই ভোট মোদির বিরুদ্ধে গণভোট যেমন নয়, তেমনি এটাও ঠিক, মোদির মধুচন্দ্রিমার অবসানও এই রায়ের সঙ্গে ঘোষিত হয়ে গেল। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও কিছুটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ছাড়া মোদি আর কারও সঙ্গে সরকারের নীতিবিষয়ক বা সিদ্ধান্তগত কোনো আলোচনা করেন না। পররাষ্ট্রসচিব পদ থেকে সুজাতা সিংকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও তাঁর নিজস্ব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে উচিত-অনুচিত নিয়ে আলোচনাও করেননি। সংগঠনে এক থেকে দশ পর্যন্ত শুধুই অমিত শাহ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) পর্যন্ত তাঁর কাছে ব্রাত্য হয়ে রয়েছে। এই যে কিরণ বেদীকে আমদানির পরিকল্পনা তিনি ও অমিত শাহ নিলেন, কাকপক্ষীকেও তাঁরা তা টের পেতে দেননি। সরকার বা দলের সম্মিলিত দায়িত্ব বলে যে কথাটি বহুল প্রচলিত রয়েছে, মোদি-শাহ জমানায় তা স্রেফ কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভোটে হারার দায়দায়িত্ব যা কিছু, তা তাঁদেরই। কাজের এই স্টাইল অতঃপর তাঁরা বদলান কি না তা দেখার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন দিল্লির রায়ে টলমল নিশ্চয় নয়। কিন্তু এটাও ঠিক, প্রতিশ্রুতি পূরণে মোদিকে এবার অনেক বেশি সচেষ্ট
হতে হবে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নয় মাস কেটে গেছে। তেলের দাম কমার দরুন তাঁর হাতে বাড়তি এক লাখ কোটি টাকারও বেশি এসে গেছে। বাজেট তৈরির এমন চমৎকার সুযোগ গত ১০ বছরে কোনো প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী পাননি। দেশবাসী খুব বেশি সময়
কিন্তু মোদিকে আর দেবে না। তাঁর গদি যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই ঠিকই, কিন্তু জনপ্রিয়তা ধরে রাখার একটা চ্যালেঞ্জ তিনি নিজেই খাড়া করে দিলেন। কারণ, দিল্লির হার যতটা বিজেপির, তার চেয়েও বেশি তাঁর ও অমিত শাহর।
এই ভয়ংকর হার বিজেপিবিরোধী শক্তিদের একজোট হতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনই উৎসাহিত করবে সংগঠনে মোদি-শাহর বিরোধীদেরও। এর ফলে তাঁদের একলা ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ হতে পারে। বিহারে ইতিমধ্যে জোটবদ্ধতার সলতে পাকানো শুরু হয়ে গেছে। এই বছরের অক্টোবরে সেখানে ভোট। বিজেপি যদি জেতে, দলের গ্রাফ তাহলে উত্তরগামী হবে। না হলে মোদির কপালে চিন্তার ভাঁজ অবশ্যই গাঢ় হবে।
আর কেজরিওয়াল? তাঁর চ্যালেঞ্জ তিনি নিজেই। গত বছর মোদির ওপর দেশবাসীর প্রত্যাশা যতখানি ছিল, তাঁর ওপরেও দিল্লিবাসীর প্রত্যাশা ততটাই। কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েই তাঁকে আগামী পাঁচ বছর দিল্লি সামলাতে হবে। ঝগড়া নয়, হঠকারিতা নয়। একদা তাঁর গুরু প্রবীণ গান্ধীবাদী আন্না হাজারে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, অতীতের ভুল আর কোরো না। সেই উপলব্ধি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নিশ্চয় হয়েছে। না হলে তিনি এই এক বছরে এতটা বদলাবেন কেন? গত মঙ্গলবার একের পর এক কেন্দ্র থেকে জয়ের খবর আসার সময় তাঁর মুখ থেকে আচমকাই বেরিয়ে আসে একটি ইংরেজি শব্দ। ‘স্কেয়ারিং’। অবশ্যই এই জয় আতঙ্কেরই নামান্তর। কারণ, এই বিপুল প্রত্যাশার প্রতিদান তাঁকেই দিতে হবে। না হলে এই মানুষই তাঁকে পরিত্যাগ করবে। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
আমি দেখছি আর ভাবছি, ওই যে বিশাল বড় ছবিটার পাশে লেখা ‘জনতা কা সিএম’, এই যে হাজার হাজার টুপিতে ‘৫ সাল, কেজিওয়াল’ ঘোষণা, এসবের প্রস্তুতিতেও তো সময় লাগে! অন্তত একটা দিন! জয় সম্পর্কে কতটা নিশ্চিত হলে এই বিপুল আয়োজন সম্ভব! তার মানে, ক্ষমতায় তাঁরা যে আসছেনই, কেজরিওয়াল ও তাঁর সঙ্গীরা ভোট গ্রহণের দিন থেকেই শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত ছিলেন? কী করে? বুথফেরত জরিপে অবশ্যই তাঁদের জয় ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু সব কটি সংস্থার হিসাব নিলেও সেই জয়ের গড় সংখ্যাটা হয় ৩৯। তাতেই এমন প্রস্তুতি?
অবিরাম চলমান জনস্রোতের মধ্য থেকে এক-একজনকে একধারে ডেকে আমি জয়ের কারণগুলো ওদের জায়গা থেকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করলাম। নানা জাতের নানা ভাষাভাষি মানুষ। প্রথমজন বললেন, মসুরের ডাল ৬০ টাকা কিলো ছিল। তিন মাসে তার দাম বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। কোনো লাগাম নেই। তাঁর পাশের জন বললেন, ‘আমাদের হাউজিংয়ে প্রতিদিন ট্যাংকারের জল কিনতে হয়। দিল্লি জল বোর্ড ও লোকাল ট্যাংকার মাফিয়াদের যোগসাজশের দরুন এই বাড়তি গুনাগারি। আমাদের ৪৯ দিনের সরকার এ জিনিস বন্ধ করেছিল। তার পর থেকে আবার যে কে সেই।’
দেখতে দেখতে আমাকে ঘিরে একটি মাঝারি মাপের বৃত্ত রচিত হলো। নানাজনে নানা মন্তব্য করতে থাকলেন। অধিকাংশই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার বারোমাস্যা। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া, জলের আকাল, পুলিশের দৌরাত্ম্য, সরকারি পর্যায়ে ঘুষের রমরমা, নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল ইত্যাদি। একজন বললেন, নরেন্দ্র মোদি কত কথাই তো বলেছিলেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার ডাক দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু একটা জিনিসেরও দাম কমাতে পেরেছেন? দুধের দাম ৫০ টাকা লিটার হতে চলেছে। আর একজন বললেন, উনি একটা সময় চাওয়ালার ছেলে ছিলেন ঠিকই। এখন আর নেই। এখন ডিজাইনার ড্রেস পরেন। দিনে তিনবার পোশাক বদলান। দশ লাখি সুট পরে ওবামার সঙ্গে চা খান। এখন উনি খাস আদমি। পাশের জন বললেন, মিডিয়াই বা কী করছে? ভোটের আগে কত লেখালেখি। ভোট চুকে গেলে মিডিয়ারও মুখে কুলুপ। দাম বাড়া নিয়ে কারও গরজ নেই। দুর্নীতি নিয়েও মিডিয়ার মাথাব্যথা নেই। সবাই মোদির ‘আচ্ছে দিনের’ তালে তাল মেলাচ্ছে।
ক্রমেই মিডিয়া সেই ভিড়ের টার্গেট হয়ে গেল। মিডিয়া মোদির টাকা খাচ্ছে, মিডিয়া একপেশে—এসব কথা শুনতে হলো। মিডিয়া নাকি সাধারণ মানুষের কথা আজকাল আর লেখে না। তারাও সরকারকে তেল দিচ্ছে আখের গোছাতে। আমি পাশ কাটাতে জানতে চাইলাম, তাহলে মোদির বিজেপি হারছে কেন? বিজেপির এমন দশা কেন হলো?
কী আশ্চর্য! প্রথমেই সমস্বরে একটি নাম উচ্চারিত হলো, কিরণ বেদী।
কিরণ বেদীর আমদানিই যে বিজেপির বিপর্যয়ের প্রধান কারণ, আজ তা স্বতঃসিদ্ধ। রাজ্যস্তরের নেতাদের প্রতি আস্থা না রেখে রাজনৈতিক দিক থেকে অজ্ঞাতকুলশীল কিরণকে টেনে আনা যে মারাত্মক ভুল, ফল প্রকাশের আগেই হয়তো বিজেপির তা বোধগম্য হয়েছিল। না হলে যে হর্ষবর্ধন টানা পাঁচবার কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে জিতেছেন, সেই নিরাপদ আসনে কিরণকে হারতে হয়? সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই বিপর্যয় রাজ্য বিজেপি নেতাদের নিঃশব্দ বিদ্রোহেরই ফল। ৪০ বছর ধরে যাঁরা রাজনীতির মাটি কামড়ে রয়েছেন, তাঁরা কেনই বা এক অরাজনৈতিক অজ্ঞাতকুলশীলকে স্বেচ্ছায় কুর্সি ছেড়ে দেবেন? বিশেষত, তিনি যখন কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেননি?
পাশাপাশি, ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে কেজরিওয়াল আরও একবার সুযোগ পেতে হাতজোড় করে নেমে পড়েছিলেন রাজধানীর আঙিনায়। এক বছর আগের ভোটের প্রচারে তিনি প্রতিপক্ষকে বিঁধেছিলেন যে ঢঙে (বিজেপি ও কংগ্রেস নেতাদের প্রকাশ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছিলেন), এবারের ভোট-প্রচারে সেই তিনি অনেক বেশি শালীন। এতটাই যে মোদি-অমিত শাহ জুটির ঔদ্ধত্য বড় বেশি চোখ টাটিয়েছে। কেজরিওয়ালরা এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হবেন
না। দিল্লিবাসীর বেছে নিতে হবে অচেনা কিরণ বেদী, অশক্ত অজয় মাকেন অথবা চেনা অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের মধ্যে একজনকে। দিল্লিবাসী এবার আর ভুল করেননি। প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোট দিয়ে তাঁরা আম আদমিদেরই বরণ করে নিয়েছেন। ত্রিশঙ্কু বিধানসভার ঝুঁকি এড়াতে তাঁরা সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন কংগ্রেসকে।
যে ৬ শতাংশ ভোট কংগ্রেসের কমেছে, তা জমা পড়েছে আম আদমির ঝোলায়। এই দিল্লিতে পিরামিডের নিচের তলার বাসিন্দাদের মধ্যে কংগ্রেসের একটা জায়গা এক বছর আগেও ছিল। সেই ঝুপড়িবাসী, অটো ও রিকশাচালক, দলিত, ভিন রাজ্যের মানুষজন, মুসলমান, তফসিল, শিল্প-শ্রমিকেরা তাঁদের কোল পেতে দিয়েছেন কেজরিওয়ালকে। রাজধানীর গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও তিনি থাবা বসিয়েছেন জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্সের দৌলতে। কেজরিওয়াল বোঝাতে পেরেছেন, এটা এক অসম লড়াই। কিন্তু সেই লড়াইয়ে তাঁদের জয়ই প্রথাগত রাজনীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছে। আরও একবার সুযোগ দিতে তাঁরা কার্পণ্য করেননি। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
দিল্লির এই রায়ের প্রভাব কী ও কতখানি, তা নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই রায় মোদির বিরুদ্ধে গণভোট কি না। একটা বিধানসভার রায় দেখে সর্বভারতীয় সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তৎক্ষণাৎ ভবিষ্যদ্বাণী করতে যাঁরা ভালোবাসেন, আমি সেই দলভুক্ত নই। এই ভোট মোদির বিরুদ্ধে গণভোট যেমন নয়, তেমনি এটাও ঠিক, মোদির মধুচন্দ্রিমার অবসানও এই রায়ের সঙ্গে ঘোষিত হয়ে গেল। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও কিছুটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ছাড়া মোদি আর কারও সঙ্গে সরকারের নীতিবিষয়ক বা সিদ্ধান্তগত কোনো আলোচনা করেন না। পররাষ্ট্রসচিব পদ থেকে সুজাতা সিংকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও তাঁর নিজস্ব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে উচিত-অনুচিত নিয়ে আলোচনাও করেননি। সংগঠনে এক থেকে দশ পর্যন্ত শুধুই অমিত শাহ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) পর্যন্ত তাঁর কাছে ব্রাত্য হয়ে রয়েছে। এই যে কিরণ বেদীকে আমদানির পরিকল্পনা তিনি ও অমিত শাহ নিলেন, কাকপক্ষীকেও তাঁরা তা টের পেতে দেননি। সরকার বা দলের সম্মিলিত দায়িত্ব বলে যে কথাটি বহুল প্রচলিত রয়েছে, মোদি-শাহ জমানায় তা স্রেফ কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভোটে হারার দায়দায়িত্ব যা কিছু, তা তাঁদেরই। কাজের এই স্টাইল অতঃপর তাঁরা বদলান কি না তা দেখার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন দিল্লির রায়ে টলমল নিশ্চয় নয়। কিন্তু এটাও ঠিক, প্রতিশ্রুতি পূরণে মোদিকে এবার অনেক বেশি সচেষ্ট
হতে হবে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নয় মাস কেটে গেছে। তেলের দাম কমার দরুন তাঁর হাতে বাড়তি এক লাখ কোটি টাকারও বেশি এসে গেছে। বাজেট তৈরির এমন চমৎকার সুযোগ গত ১০ বছরে কোনো প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী পাননি। দেশবাসী খুব বেশি সময়
কিন্তু মোদিকে আর দেবে না। তাঁর গদি যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই ঠিকই, কিন্তু জনপ্রিয়তা ধরে রাখার একটা চ্যালেঞ্জ তিনি নিজেই খাড়া করে দিলেন। কারণ, দিল্লির হার যতটা বিজেপির, তার চেয়েও বেশি তাঁর ও অমিত শাহর।
এই ভয়ংকর হার বিজেপিবিরোধী শক্তিদের একজোট হতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনই উৎসাহিত করবে সংগঠনে মোদি-শাহর বিরোধীদেরও। এর ফলে তাঁদের একলা ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ হতে পারে। বিহারে ইতিমধ্যে জোটবদ্ধতার সলতে পাকানো শুরু হয়ে গেছে। এই বছরের অক্টোবরে সেখানে ভোট। বিজেপি যদি জেতে, দলের গ্রাফ তাহলে উত্তরগামী হবে। না হলে মোদির কপালে চিন্তার ভাঁজ অবশ্যই গাঢ় হবে।
আর কেজরিওয়াল? তাঁর চ্যালেঞ্জ তিনি নিজেই। গত বছর মোদির ওপর দেশবাসীর প্রত্যাশা যতখানি ছিল, তাঁর ওপরেও দিল্লিবাসীর প্রত্যাশা ততটাই। কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েই তাঁকে আগামী পাঁচ বছর দিল্লি সামলাতে হবে। ঝগড়া নয়, হঠকারিতা নয়। একদা তাঁর গুরু প্রবীণ গান্ধীবাদী আন্না হাজারে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, অতীতের ভুল আর কোরো না। সেই উপলব্ধি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নিশ্চয় হয়েছে। না হলে তিনি এই এক বছরে এতটা বদলাবেন কেন? গত মঙ্গলবার একের পর এক কেন্দ্র থেকে জয়ের খবর আসার সময় তাঁর মুখ থেকে আচমকাই বেরিয়ে আসে একটি ইংরেজি শব্দ। ‘স্কেয়ারিং’। অবশ্যই এই জয় আতঙ্কেরই নামান্তর। কারণ, এই বিপুল প্রত্যাশার প্রতিদান তাঁকেই দিতে হবে। না হলে এই মানুষই তাঁকে পরিত্যাগ করবে। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments