রাষ্ট্র ব্যবস্থা- রাজনীতি কি জনগণের ভাষায় কথা বলছে? by দেবপ্রসাদ দেবু
যদি প্রশ্ন করা হয় আমাদের রাষ্ট্রের ভাষা কী? সাধারণ অর্থে জবাবটা বাংলা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যাবে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রের ভাষা নয়। রাষ্ট্রের ভাষা ভিন্নার্থ বহন করে। অন্তর্নিহিত অর্থানুসারে রাষ্ট্রের ভাষা নিয়ে দৈনন্দিন আলোচনা সীমিত হলেও ংঁন-পড়হংপরড়ঁংষু রাষ্ট্রের ভাষা নিয়ে সব নাগরিকের মনেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিদ্যমান। প্রশ্ন হতে পারে_ রাষ্ট্র একটি ভৌগোলিক সত্তা কিংবা ধারণা মাত্র। এটির ভাষা আবার কী? ভাষাকে প্রতীকী অর্থে ধরে ভাষার স্থানে আচরণ কিংবা ভূমিকা বসিয়ে নিলেই ভাবনার ক্ষেত্র পরিষ্কার হবে। এটা অনেকটা ইংরেজির বডি ল্যাংগুয়েজের মতোই ভাবতে হবে। পাঠকের বিরক্তির উদ্বেগ হতে পারে_ এভাবে ভাবার প্রয়োজনটা কী? প্রয়োজনটা এখানেই যে, ৫২'র ভাষা আন্দোলন কেবল মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে বিস্তৃতি লাভ করেনি, গুরুত্ব পায়নি। এটি নেহাত উর্দুর প্রতি প্রবল বিদ্বেষ থেকে কিংবা বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে সৃষ্ট নয়। এর পেছনে রাজনীতি ছিল। ছিল বাঙালির মুক্তিকামিতা, ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে কলমের খোঁচায় রচিত আরোপিত পাকিস্তান নামক নিপীড়ক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যেই রাষ্ট্রের ভাষা ছিল নিপীড়কের, আগ্রাসীর, সামন্ত প্রভুর মতো নিষ্ঠুর, একচোখা এবং বাঙালির ঘাড়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের মতো। বাঙালি চেপে বসা বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে চেয়েছিল, বাঙালি মুক্তি চেয়েছিল। ভাষাগত মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি।
এই মুক্তির লড়াইটার সফল এবং সুন্দর পরিণতি ঘটেছিল '৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে। স্বাধীনতা মিলেছে। মুক্তি মিলেছে কি? মেলেনি। না রাজনৈতিক মুক্তি, না সাংস্কৃতিক মুক্তি। সমাজের উপরিকাঠামোতে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয় হলেও অবকাঠামোগত মুক্তি সুদূরপরাহতই থেকে গেছে স্বাধীনতা-উত্তর এই বাংলায়। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এখানে তৈরি হয়নি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও, কিংবা তৈরি হতে দেওয়া হয়নি। ফলে সংবিধান, গণতন্ত্র, আইনের শাসন_ এগুলো কেতাবি বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে। যতদিন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠিত না হবে; যতদিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্বাধীনভাবে, স্বকীয়ভাবে না দাঁড়াবে; ততদিন কেতাবি গণতন্ত্রের ভোটাভুটির কামড়াকামড়ি ইতর প্রাণীর হাড়্-মাংসের কামড়াকামড়ির মতোই অর্থহীন যুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হবে দিনান্তে।
বর্তমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সংকটের মূলেও কিন্তু সেই ক্ষমতার হাড়-মাংসের লড়াই। রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা এখানে কণ্ঠরোধের, নিপীড়কের। এক পক্ষ যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যেতে চাইছে, অন্য পক্ষ ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। রাজনীতি এখানে নীতিগত লক্ষ্যের বদলে পরিচালিত হচ্ছে মুনাফার লক্ষ্যে। যেই রাষ্ট্র বা সমাজের নিয়ন্ত্রকরা মুনাফার লক্ষ্যে কদম ফেলে, প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী হতে দেয় না, সেই রাষ্ট্রের ভাষা, সেই রাষ্ট্রের অর্থনীতি মানবিক হতে পারে না। আর অর্থনীতি মানবিক না হলে রাজনীতি অবধারিতভাবেই অমানবিক হবে। ফলে রাষ্ট্রের ভাষায়, রাষ্ট্রের আচরণে অমানবিকতার প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করছি হরহামেশাই। হরহামেশাই সাধারণ মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে, শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না, কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আক্ষরিক অর্থেই পানির চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে (এক মণ মিনারেল ওয়াটার আর এক মণ কৃষিপণ্যের দাম হিসাব করে দেখুন)। সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই কম মূল্যে পণ্য পাচ্ছে না। রাষ্ট্র উৎপাদকের পুঁজির নিরাপত্তা দিতে পারছে না, শ্রমিকের ঘামের মূল্য দিতে পারছে না, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ফলে সর্বসাধারণ নিজেদের বঞ্চিত ভাবছে, রাষ্ট্রের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত কোনো দায় তারা অনুভব করছে না। রাষ্ট্র তাদের কাছে একটি ব্যর্থ প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে; মানবিক আশ্রয়স্থল হিসেবে দাঁড়ায়নি। রাষ্ট্রের ভাষা এখানে রূঢ়, নিষ্ঠুর।
রাষ্ট্রের এই উৎপাদন পদ্ধতি, কৃষিনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থা, সর্বোপরি অর্থনীতি_ এগুলো নিয়ে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাজে নেই; রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। ফলে রাজনীতির প্রতিও মানুষ আস্থা রাখে না এখন। সবকিছুর ওপর থেকে আস্থা হারানো মানুষের আচরণও ক্রমান্বয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। হয়ে উঠছে স্বার্থবাদী। কিন্তু মানুষ কতটা ভালো আচরণ করছে, সেটি বিবেচনা করার আগে আমাদের ভাবতে হবে তাকে ভালো আচরণ করার জন্য কতটুকু পরিবেশ রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি ক্রমে দুর্বল হয়ে আমলাতন্ত্র পরাক্রমশালী হয়েছে। কখনও সামরিক আমলাতন্ত্র, কখনও সিভিল আমলাতন্ত্র। কিন্তু উভয় আমলাতন্ত্রেরই ভাষা এক_ নিপীড়কের। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। বাস্তবে হয়েছে উল্টো। রাজনীতি আমলাতন্ত্রের অধীন হয়ে গেছে। আইনের খসড়া, যেটা আমলারা তৈরি করছে সেটিই সাড়ে উনিশ-বিশ করে জনপ্রতিনিধিরা সংসদে পাস করিয়ে নিচ্ছেন। ফলে তৃণমূল মানুষের আশার প্রতিফলন এই আইনে থাকছে খুব কমই। ফলে মার্কসের ভাষায় সংসদ হয়ে উঠেছে টকিং শপ; কথার বাজার।
আমলাতন্ত্রের কাছে রাজনীতির এই আত্মসমর্পণ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকির। ফলে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে সরু হয়ে মজে যাওয়া কতগুলো নদীতে। যেই নদীতে সাধারণত বান আসে না। সমাজের কোনো জায়গাতেই আজ সৃষ্টিশীলতার চর্চা হয় না, কিংবা হতে দেওয়া হয় না। মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, ছাত্র সংসদ নেই। ফলে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চাও নেই। জনকল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা তৃণমূলে হতে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্রে প্রগতির রাস্তা বন্ধ হলে প্রতিক্রিয়াশীলতার রাস্তাই ক্রমে প্রশস্ত হবে, যেটি দিনান্তে ভোগাবে সাধারণকেই।
এই মুক্তির লড়াইটার সফল এবং সুন্দর পরিণতি ঘটেছিল '৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে। স্বাধীনতা মিলেছে। মুক্তি মিলেছে কি? মেলেনি। না রাজনৈতিক মুক্তি, না সাংস্কৃতিক মুক্তি। সমাজের উপরিকাঠামোতে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয় হলেও অবকাঠামোগত মুক্তি সুদূরপরাহতই থেকে গেছে স্বাধীনতা-উত্তর এই বাংলায়। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এখানে তৈরি হয়নি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও, কিংবা তৈরি হতে দেওয়া হয়নি। ফলে সংবিধান, গণতন্ত্র, আইনের শাসন_ এগুলো কেতাবি বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে। যতদিন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠিত না হবে; যতদিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্বাধীনভাবে, স্বকীয়ভাবে না দাঁড়াবে; ততদিন কেতাবি গণতন্ত্রের ভোটাভুটির কামড়াকামড়ি ইতর প্রাণীর হাড়্-মাংসের কামড়াকামড়ির মতোই অর্থহীন যুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হবে দিনান্তে।
বর্তমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সংকটের মূলেও কিন্তু সেই ক্ষমতার হাড়-মাংসের লড়াই। রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা এখানে কণ্ঠরোধের, নিপীড়কের। এক পক্ষ যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যেতে চাইছে, অন্য পক্ষ ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। রাজনীতি এখানে নীতিগত লক্ষ্যের বদলে পরিচালিত হচ্ছে মুনাফার লক্ষ্যে। যেই রাষ্ট্র বা সমাজের নিয়ন্ত্রকরা মুনাফার লক্ষ্যে কদম ফেলে, প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী হতে দেয় না, সেই রাষ্ট্রের ভাষা, সেই রাষ্ট্রের অর্থনীতি মানবিক হতে পারে না। আর অর্থনীতি মানবিক না হলে রাজনীতি অবধারিতভাবেই অমানবিক হবে। ফলে রাষ্ট্রের ভাষায়, রাষ্ট্রের আচরণে অমানবিকতার প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করছি হরহামেশাই। হরহামেশাই সাধারণ মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে, শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না, কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আক্ষরিক অর্থেই পানির চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে (এক মণ মিনারেল ওয়াটার আর এক মণ কৃষিপণ্যের দাম হিসাব করে দেখুন)। সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই কম মূল্যে পণ্য পাচ্ছে না। রাষ্ট্র উৎপাদকের পুঁজির নিরাপত্তা দিতে পারছে না, শ্রমিকের ঘামের মূল্য দিতে পারছে না, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ফলে সর্বসাধারণ নিজেদের বঞ্চিত ভাবছে, রাষ্ট্রের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত কোনো দায় তারা অনুভব করছে না। রাষ্ট্র তাদের কাছে একটি ব্যর্থ প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে; মানবিক আশ্রয়স্থল হিসেবে দাঁড়ায়নি। রাষ্ট্রের ভাষা এখানে রূঢ়, নিষ্ঠুর।
রাষ্ট্রের এই উৎপাদন পদ্ধতি, কৃষিনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থা, সর্বোপরি অর্থনীতি_ এগুলো নিয়ে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাজে নেই; রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। ফলে রাজনীতির প্রতিও মানুষ আস্থা রাখে না এখন। সবকিছুর ওপর থেকে আস্থা হারানো মানুষের আচরণও ক্রমান্বয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। হয়ে উঠছে স্বার্থবাদী। কিন্তু মানুষ কতটা ভালো আচরণ করছে, সেটি বিবেচনা করার আগে আমাদের ভাবতে হবে তাকে ভালো আচরণ করার জন্য কতটুকু পরিবেশ রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি ক্রমে দুর্বল হয়ে আমলাতন্ত্র পরাক্রমশালী হয়েছে। কখনও সামরিক আমলাতন্ত্র, কখনও সিভিল আমলাতন্ত্র। কিন্তু উভয় আমলাতন্ত্রেরই ভাষা এক_ নিপীড়কের। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। বাস্তবে হয়েছে উল্টো। রাজনীতি আমলাতন্ত্রের অধীন হয়ে গেছে। আইনের খসড়া, যেটা আমলারা তৈরি করছে সেটিই সাড়ে উনিশ-বিশ করে জনপ্রতিনিধিরা সংসদে পাস করিয়ে নিচ্ছেন। ফলে তৃণমূল মানুষের আশার প্রতিফলন এই আইনে থাকছে খুব কমই। ফলে মার্কসের ভাষায় সংসদ হয়ে উঠেছে টকিং শপ; কথার বাজার।
আমলাতন্ত্রের কাছে রাজনীতির এই আত্মসমর্পণ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকির। ফলে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে সরু হয়ে মজে যাওয়া কতগুলো নদীতে। যেই নদীতে সাধারণত বান আসে না। সমাজের কোনো জায়গাতেই আজ সৃষ্টিশীলতার চর্চা হয় না, কিংবা হতে দেওয়া হয় না। মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, ছাত্র সংসদ নেই। ফলে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চাও নেই। জনকল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা তৃণমূলে হতে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্রে প্রগতির রাস্তা বন্ধ হলে প্রতিক্রিয়াশীলতার রাস্তাই ক্রমে প্রশস্ত হবে, যেটি দিনান্তে ভোগাবে সাধারণকেই।
No comments