জর্জ ডাব্লিউ হাসিনা by জাফর সোবহান
আমরা
এমনটা এর আগেও শুনেছি। বর্তমান সরকার আর সরকারপন্থী গণমাধ্যমের ভাষাগত
সাদৃশ্য আমাদের নাইন/ইলেভেনের সময়কার মার্কিন বুশ প্রশাসন আর ফক্স নিউজের
কথা মনে করিয়ে দেয়।
একই রকম বুকে ধাক্কা মারার মতন মারমুখী আচরণ, ব্যাঙ্গাত্মক বাহাস, নৈতিকতার বাছবিচার আর উভয় বিরোধী পক্ষের মধ্যে সমানতালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি আপোষহীন অবস্থান এবং তা দিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার উদাহরণ দেখা যাচ্ছে এ দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে।
একই রকমভাবে বর্তমান সংকট সম্পর্কে সাদা-কালো আর ভালো-মন্দের সোজাসাপটা বয়ানের বাইরে গিয়ে কেউ কথা বললে অথবা সরকারের অন্তর্মুখিতার দিকে ইঙ্গিত করলে, কিংবা সংলাপ বা সমঝোতার পরামর্শ দিলেই কলঙ্ক লেপন করা হচ্ছে তাদের গায়ে।
আমাদের বলা হচ্ছে, তারা সন্ত্রাসীদের মতই ভয়ঙ্কর খারাপ। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমি সন্ত্রাসবাদ ও নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারার পুরোপুরি বিপক্ষে। এই ধরনের নাশকতাকে কোনও যুক্তিতেই ন্যায্যতা দেওয়া যায় না।
সুতরাং, এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, কিছু বলার আগে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চরম অভিশাপ বর্ষণ না করলে সহিংসতায় যোগদানকারী বা প্ররোচক না হলেও, আমাকে নাশকতাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখা হতে পারে।
আমি আবারও বলছি, বাস পোড়ানো আর নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলার পুরোপুরি বিপক্ষে আমার অবস্থান। এ বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনও অবকাশ নেই।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের সরকারের দেওয়া বুশ প্রশাসনের মত হয় আপনি আমাদের পক্ষে নয়তো আপনি সন্ত্রাসীদের পক্ষের মত যুক্তিও কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্যও হচ্ছে।
অথচ বুশ যখন এহেন যুক্তি দিয়েছিলে, খুব কম মানুষের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এক অর্থে বেশিরভাগ বাংলাদেশিই ছিলেন এই যুক্তির বিপক্ষে।
আওয়ামী লীগ যে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধই বলা যেতে পারে। যেমনটা ২০০১ সালে মোকাবেলা করেছিলেন জর্জ বুশ। কিন্তু তার যুক্তি মুসলিম বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারেনি। বাংলাদেশের মত দেশেও, সরাসরি ব্যাঙ্গ না করলেও, সন্দেহের চোখেই দেখা হয়েছে তার বক্তব্যকে।
প্রথমত, আমরা জানি সন্ত্রাসভীতি কী করে শত্রুর বিরুদ্ধে উইচ হান্টের (মধ্যযুগের ইউরোপে ডাইনি নাম দিয়ে পুড়িয়ে মারার প্রবণতা) মতো বিধ্বংসী কার্যকলাপকেও প্রতি-সন্ত্রাসবাদ নাম দিয়ে জায়েজ করতে পারে।
আমরা এও জানি যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে এবং যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে তাদের মধ্যে নৈতিক পার্থক্য ততটা বিস্তর ও সোজাসাপটা নয়, যতটা ক্ষমতাসীনরা আমাদের দিয়ে বিশ্বাস করাতে চান। সব সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এজেন্ডাই যে শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে, তার মতই অশুভ।
আমরা সবাই অবগত আছি, নিরীহ মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর মত নির্বোধ কার্যকলাপ অতীত বা বর্তমানের কোনও অন্যায়কে যৌক্তিকতা দেয় না। সহিংসতার মূল কারণটা বুঝতে চায় না।
দালানের মধ্যে দিয়ে বিমান চালিয়ে দিয়ে ৩ হাজার নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলাও কেউ সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণকারীদের উদ্ভাবিত এই যুক্তি পশ্চিমের বিশেষজ্ঞদের মত বাংলাদেশের মানুষও জানে।
তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মানবাধিকার লঙ্ঘনও কেউ সমর্থন করে না। সবাই জানে, যারা এই নিন্দনীয় কাজগুলো করে। তারা ছাড়াও এগুলোর পেছনে অন্য কারো হাত আছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আইএস যে জর্জ বুশের ভুলের ফলাফল তা সবাই জানে।
তিনি ইরাক আক্রমণ না করলে দেশটি আজ এই অবস্থানে থাকতো না। এই সত্য স্বীকার করেও বলা যায়, তাতে আইএসের জঙ্গি কর্মকাণ্ড ও সহিংসতার দায় কিছুমাত্র কমে যায় না। তবে তা নিজেদের কৌশল ও তার পরিণতি অনুমান করার মত প্রয়োজনীয় দূরদৃষ্টি যোগান দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
তার মানে এই নয়, জর্জ বুশ আইএসের আবু বকর আল-বাগদাদির মতই অপরাধী। বরং এই যে, তিনি পুরোপুরি নির্দোষও নন।
যুদ্ধ আর সন্ত্রাসকে আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সরকারের জানা প্রয়োজন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ধরনের যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যাবে না। তারা এ সম্পর্কে উদাসীন ও সন্দেহপ্রবণ। তাই বলে সরকার যদি ধরে নেয় দেশের জনগণ সন্ত্রাসের পক্ষে তাহলেও ভুল করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সংকটকালে মানুষের সহ্য ক্ষমতাকে নৈতিকতার অভাব বা সমস্যার কারণ হিসেবে দেখাটা সরকারের ভাষ্যে বা কৌশলে উঠে আসলে তা খুব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যে যুক্তি বহু আগেই বাংলাদেশের মানুষ নিন্দা করেছে, খারিজ করেছে, তা দিয়েই তাদের মন জয় করা যাবে না।
লেখক: সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
একই রকম বুকে ধাক্কা মারার মতন মারমুখী আচরণ, ব্যাঙ্গাত্মক বাহাস, নৈতিকতার বাছবিচার আর উভয় বিরোধী পক্ষের মধ্যে সমানতালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি আপোষহীন অবস্থান এবং তা দিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার উদাহরণ দেখা যাচ্ছে এ দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে।
একই রকমভাবে বর্তমান সংকট সম্পর্কে সাদা-কালো আর ভালো-মন্দের সোজাসাপটা বয়ানের বাইরে গিয়ে কেউ কথা বললে অথবা সরকারের অন্তর্মুখিতার দিকে ইঙ্গিত করলে, কিংবা সংলাপ বা সমঝোতার পরামর্শ দিলেই কলঙ্ক লেপন করা হচ্ছে তাদের গায়ে।
আমাদের বলা হচ্ছে, তারা সন্ত্রাসীদের মতই ভয়ঙ্কর খারাপ। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমি সন্ত্রাসবাদ ও নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে মারার পুরোপুরি বিপক্ষে। এই ধরনের নাশকতাকে কোনও যুক্তিতেই ন্যায্যতা দেওয়া যায় না।
সুতরাং, এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, কিছু বলার আগে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চরম অভিশাপ বর্ষণ না করলে সহিংসতায় যোগদানকারী বা প্ররোচক না হলেও, আমাকে নাশকতাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে দেখা হতে পারে।
আমি আবারও বলছি, বাস পোড়ানো আর নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলার পুরোপুরি বিপক্ষে আমার অবস্থান। এ বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনও অবকাশ নেই।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের সরকারের দেওয়া বুশ প্রশাসনের মত হয় আপনি আমাদের পক্ষে নয়তো আপনি সন্ত্রাসীদের পক্ষের মত যুক্তিও কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্যও হচ্ছে।
অথচ বুশ যখন এহেন যুক্তি দিয়েছিলে, খুব কম মানুষের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এক অর্থে বেশিরভাগ বাংলাদেশিই ছিলেন এই যুক্তির বিপক্ষে।
আওয়ামী লীগ যে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধই বলা যেতে পারে। যেমনটা ২০০১ সালে মোকাবেলা করেছিলেন জর্জ বুশ। কিন্তু তার যুক্তি মুসলিম বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারেনি। বাংলাদেশের মত দেশেও, সরাসরি ব্যাঙ্গ না করলেও, সন্দেহের চোখেই দেখা হয়েছে তার বক্তব্যকে।
প্রথমত, আমরা জানি সন্ত্রাসভীতি কী করে শত্রুর বিরুদ্ধে উইচ হান্টের (মধ্যযুগের ইউরোপে ডাইনি নাম দিয়ে পুড়িয়ে মারার প্রবণতা) মতো বিধ্বংসী কার্যকলাপকেও প্রতি-সন্ত্রাসবাদ নাম দিয়ে জায়েজ করতে পারে।
আমরা এও জানি যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে এবং যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে তাদের মধ্যে নৈতিক পার্থক্য ততটা বিস্তর ও সোজাসাপটা নয়, যতটা ক্ষমতাসীনরা আমাদের দিয়ে বিশ্বাস করাতে চান। সব সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এজেন্ডাই যে শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে, তার মতই অশুভ।
আমরা সবাই অবগত আছি, নিরীহ মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর মত নির্বোধ কার্যকলাপ অতীত বা বর্তমানের কোনও অন্যায়কে যৌক্তিকতা দেয় না। সহিংসতার মূল কারণটা বুঝতে চায় না।
দালানের মধ্যে দিয়ে বিমান চালিয়ে দিয়ে ৩ হাজার নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলাও কেউ সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণকারীদের উদ্ভাবিত এই যুক্তি পশ্চিমের বিশেষজ্ঞদের মত বাংলাদেশের মানুষও জানে।
তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মানবাধিকার লঙ্ঘনও কেউ সমর্থন করে না। সবাই জানে, যারা এই নিন্দনীয় কাজগুলো করে। তারা ছাড়াও এগুলোর পেছনে অন্য কারো হাত আছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আইএস যে জর্জ বুশের ভুলের ফলাফল তা সবাই জানে।
তিনি ইরাক আক্রমণ না করলে দেশটি আজ এই অবস্থানে থাকতো না। এই সত্য স্বীকার করেও বলা যায়, তাতে আইএসের জঙ্গি কর্মকাণ্ড ও সহিংসতার দায় কিছুমাত্র কমে যায় না। তবে তা নিজেদের কৌশল ও তার পরিণতি অনুমান করার মত প্রয়োজনীয় দূরদৃষ্টি যোগান দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
তার মানে এই নয়, জর্জ বুশ আইএসের আবু বকর আল-বাগদাদির মতই অপরাধী। বরং এই যে, তিনি পুরোপুরি নির্দোষও নন।
যুদ্ধ আর সন্ত্রাসকে আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সরকারের জানা প্রয়োজন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ধরনের যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যাবে না। তারা এ সম্পর্কে উদাসীন ও সন্দেহপ্রবণ। তাই বলে সরকার যদি ধরে নেয় দেশের জনগণ সন্ত্রাসের পক্ষে তাহলেও ভুল করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সংকটকালে মানুষের সহ্য ক্ষমতাকে নৈতিকতার অভাব বা সমস্যার কারণ হিসেবে দেখাটা সরকারের ভাষ্যে বা কৌশলে উঠে আসলে তা খুব কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যে যুক্তি বহু আগেই বাংলাদেশের মানুষ নিন্দা করেছে, খারিজ করেছে, তা দিয়েই তাদের মন জয় করা যাবে না।
লেখক: সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
No comments