হরতালের পালে হাওয়া by সাযযাদ কাদির
রাজনীতির আকাশে আবার দেখা যাচ্ছে হরতালের ঘনঘটা। দীর্ঘ বিরতির পর এই ক’দিন আগে একটা হরতাল এসেছিল আমাদের আরজু ভাই (সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী)-এর বিরুদ্ধে। বয়সে তিনি বছর দশেকের বড় আমার, তবে বড় হয়েছি একই পাড়ায়, শৈশবে ও বাল্যে দূরত্ব থাকলেও কলেজ-জীবনে ছিলাম কাছাকাছি। পরে রাজনৈতিক জীবনে সুদূর হয়ে গেলেও এত বছর ধরে চেনা মানুষটি এখন খুব অচেনা হয়ে গিয়েছেন এমন মনে করি না। নিউ ইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির অনুষ্ঠানে হজ, তাবলীগ জামাত, মহানবী (সা.) সম্পর্কে তাঁর যে বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে তা প্রায় অবিশ্বাস্য ঠেকেছে আমার কাছে। যিনি নিজে হজ করে এসেছেন, প্রতি বছর এলাকার কয়েকজনকে হজে পাঠান নিজ খরচে, এবারও পাঠিয়েছেন, গাঁয়ের বাড়িতে নির্মাণ করেছেন এলাকার বৃহত্তম মসজিদ, তিনি হঠাৎ করে বলতে গেলেন কেন এসব কথা, এমন স্ববিরোধিতায় ভোগার মতো মানুষ তো নন তিনি! তখন থেকে এ পর্যন্ত এ নিয়ে একটা ধন্দ রয়েই গেছে আমার মধ্যে। ভিডিওতে দেখেছি তাঁর বক্তব্য রাখার সময় পাশে বসা ছিলেন আমাদের সামসময়িকদের একজন আতিকুর রহমান খান ইউসুফজয়ী সালু। আরজু ভাই যখন টাঙ্গাইল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখন সালু ছিলেন টাঙ্গাইল ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ইচ্ছা আছে সালুর কাছ থেকে ঘটনাটি বিশদ ভাবে জানার। এ কৌতূহলের বিশেষ কারণও আছে। বিবিসি’র সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে আরজু ভাই বলেছিলেন তিনি যা বলেছেন তার একটি অক্ষরও প্রত্যাহার করবেন না, কিন্তু পরের সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন অপ্রাসঙ্গিক ভাবে উদ্ধৃত করে বিকৃত করা হয়েছে তাঁর বক্তব্য। এজন্যই মনে হয় কোনও ঘোরতর রহস্য আছে এর পেছনে। যাহোক, হরতাল এবার এসেছে ইসলামি দলগুলোর হাত ধরে। এখনও চলছে তাদের সাথে-সাথে। সামনে যে আরও হরতাল আসবে তা প্রায় নিশ্চিত। অবশ্য হরতালে আগের ধার নেই আর। এরশাদের আমলেই লাগাতার হরতাল দিয়ে-দিয়ে ভোঁতা করা হয়েছে এর ধার। এখন এর কার্যকরিতাও নেই কেমন। মশার নানারকম ওষুধ সহ্য করে-করে মশা যেমন ওষুধ-সহা হয়ে গেছে, তেমনই আমরা হরতালে অভ্যস্ত হয়ে পুরোপুরি হরতাল-সহা হয়ে পড়েছি অনেক আগেই। আর যাদের ঘা দিতে হরতাল ডাকা সেই সরকার-প্রশাসন এর জন্য আলাদা প্রস্তুতি ও বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখে আগেভাগে। ফলে তাদের কাজেকর্মে যদি ব্যাঘাত কিছু ঘটেই তবে তা অতি সামান্য। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মকর্তারা ঠিকই কাজ চালিয়ে যান, কাজের ক্ষতিও পুষিয়ে নেন ঠিকমতো। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা যতই যা বলুন তাঁরাও হরতাল মোকাবিলা করেন যার-যার মতো করে। আর হরতালের ঘা গিয়ে পড়ে তাদের ওপর যাদের কথা বলে বা দোহাই দিয়ে ডাকা হয় হরতাল। সাধারণ মানুষদের মধ্যে যাদের দিন এনে দিন খেতে হয়- লাথি পড়ে তাদের পেটে। দিনান্তে খাবার জোটানো এ সব মানুষের একটি বিবরণ আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিদের একজন তারাপদ রায় দিয়েছেন তাঁর ‘দিন আনি, দিন খাই’ কবিতায় “...বৃষ্টির দিন, মেঘলা দিন, কুয়াশা ঘেরা দিন, / স্টেশনের প্লাটফর্মে অধীর প্রতীক্ষারত দিন, / অপমানে মাথা নিচু করে চোরের মতো চলে যাওয়া দিন, / খালি পেট, ছেঁড়া চটি, ঘামে ভেজা দিন, / নীল পাহাড়ের ওপারে সবুজ বনের মাথায় দিন, / নদীর জলের আয়নায়, বড় সাহেবের ফুলের বাগানে দিন, / নৌকোর সাদা জালে ঢেউয়ের চূড়ায় ভেসে যাওয়া দিন, / রোদে পোড়া, আগুনে জ্বলা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা দিন...”। হরতালের আরও এক শিকার অল্প আয়ের ছাপোষা মানুষ। সারা মাস তাদের সংসার চলে যোগ-বিয়োগের কড়া হিসাব কষে। হরতাল এসে হঠাৎ খরচ বেড়ে গিয়ে ভণ্ডুল করে দেয় তাদের সব হিসাবের অঙ্ক। কারণ সেদিন আর বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে চলা যায় না, চড়তে হয় রিকশায়, তা-ও ডাবল ভাড়ায়। তারপর উপলক্ষের জন্য ওত পেতে থাকে যারা তাদের তো পোয়া বারো হরতালের গন্ধ পেলে। জিনিসপত্রের, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের, দাম বাড়িয়ে তারা পকেট কাটে সব কিছুতে মুখ বুজে থাকা এই মানুষগুলোরই। তাহলে লাভ কি হরতালে? লাভ সর্বগ্রাসী মিডিয়ার, আর প্রচার পেয়ে লাভ ‘যা নয় তা-ই’ দলগুলোর। সরকারের ক্ষতি ভাবমূর্তিতে, যার প্রভাব পড়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আর্থিক আনুকূল্যে। আন্তর্জাতিক জনমতে। ৫ই জানুয়ারির খেসারত হিসেবে এ সব ক্ষতি এখন দেখা দিতে পারে আরও ভারি হয়ে। কারণ দেখেশুনে মনে হয় বেশ হাওয়া লাগছে হরতালের পালে!
৩০.১০.২০১৪
৩০.১০.২০১৪
No comments