তরুণদের কেন আমরা পথ দেখাতে পারছি না? by মহিউদ্দিন আহমদ
তারুণ্য নিয়ে উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ আমাদের সমাজে প্রবলভাবে উপস্থিত। তরুণেরাই সমাজের বল-ভরসা। বাংলা ভাষার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা.../ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তাঁর লেখা সেই চরণগুলো এখনো আমাদের উদ্দীপনা জোগায়: ‘আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল, মোদের চরণতলে মূর্ছে তুফান/ ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল’। তরুণেরা স্বভাবতই প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী। রাজনীতির ভাঙা-গড়ার চিরন্তন প্রবাহে তরুণেরা সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেয়। এর অনেক উদাহরণ আছে পৃথিবীতে। সাম্প্রতিককালে যতগুলো বড় ঘটনা ঘটেছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে তরুণসমাজ। শুধু এই সময়ের কথা বলছি কেন, প্রাচীনকালেও এর ব্যত্যয় হয়নি। মেসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার অর্ধেক পৃথিবী জয় করে যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স যখন বিশের কোঠায়, তখন তিনি হিলফুল ফুজুল নামের একটি সংগঠন তৈরি করে কুরাইশ বংশের বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংহতি ও সমন্বয়ের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। হিলফুল ফুজুলকে আধুনিক নাগরিক সংগঠনের আদিরূপ বলা যেতে পারে। তৃতীয় মোগল সম্রাট আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং ১৯ বছর বয়সে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু করেছিলেন। তাঁর কূটনৈতিক ও সামরিক দূরদর্শিতার ফলেই ভারতবর্ষে একটি আধুনিক বৃহৎ রাষ্ট্রের প্রথম সিঁড়িটি তৈরি হয়েছিল।
একুশ শতকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে তারুণ্যের সেই দীপ্তি খুঁজে পাই না। এখানে যে বয়সে ছাত্রসংগঠনের কমিটিগুলোতে ঢোকার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়, তার চেয়ে কম বয়সী অনেক বড় বড় রাষ্ট্রনায়ককে আমরা দেখেছি বিশ শতকে। লিড ট্রটস্কি ১৯১৭ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। মিসরে গামাল আবদেল নাসের একই বয়সে রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন। কিউবায় যখন বিপ্লব সংগঠিত হয়, তখন এর নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বয়স ছিল ৩২। তাঁর অন্যতম সহযোগী চে’ গুয়েভারার মাত্র ৩০ চলছে তখন। এ সবই ঘটেছে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে। একই বছর লিবিয়ায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে আদিম যাযাবর সমাজের পালাবদল ঘটিয়েছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি মাত্র ২৩ বছর বয়সে। এ রকম উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়।
আমাদের দেশে তরুণসমাজ কোনো অবিমিশ্র ও অবিভাজ্য সামাজিক শক্তি নয়। একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে তরুণসমাজের একটি অংশ সক্রিয় হয়েছিল। এদের সংখ্যা বড়জোর এক লাখ বা তার চেয়ে কিছু বেশি। বিরাটসংখ্যক তরুণ এদের সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছে, তা স্বীকার করতেই হবে। এর পাশাপাশি তরুণসমাজের একটি অংশ ছিল পুরোপুরি নির্লিপ্ত, এমনকি দখলদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহযোগী। দেশের অবস্থা যে পুরোপুরি ‘স্বাভাবিক’ এবং দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও অন্যান্য নৃশংস ঘটনাবলি যে ‘ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা’, এটা দেখানোর জন্য তখন সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়েছিল। আমাদের অনেক সতীর্থ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছিল এবং পরীক্ষা দিয়েছিল। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই ‘গণ্ডগোল’ যদি মিটে যেত, তাহলে কী হতো? হয়তো শেখ মুজিবের ফাঁসি হতো আর আমাদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ পরিচয় নিয়ে দালাই লামার সহযাত্রীদের মতো ভারতের কোনো আশ্রয়শিবিরে অথবা রাস্তাঘাটে ভবঘুরের জীবন যাপন করতে হতো। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই আমরা এ দেশে তারুণ্যের বিভক্তি ও অবক্ষয়ের শুরু দেখতে পেয়েছি। জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদের রাজনীতি, অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া তখন থেকেই চলে আসছে। ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ‘সাত খুন’, লাল সন্ত্রাসের নামে আতঙ্ক ছড়ানো—এ সবই ছিল তরুণদের কাজ। নেতৃত্বেও ছিল প্রধানত তরুণেরাই। এর মূল্যও দিতে হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণদেরই।
আমরা অনেক সময় গর্ব করে বলে থাকি, এ দেশের ছাত্রসমাজ জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল একটা সময় পর্যন্ত। উদাহরণ হিসেবে ভাষা আন্দোলন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কথা আমরা অহংকারের সঙ্গে উচ্চারণ করি। এ ধারাটির অবসান হয় পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৭৬ সালের একটি সামরিক ফরমানের মাধ্যমে, যেখানে রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী ছাত্রসংগঠন ও অন্যান্য গণসংগঠনকে মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এখনো। একটি রাজনৈতিক দল এখন ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’। তার একটি মূল সংগঠন আছে, আছে একটি করে ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন। এ ছাড়া এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাজারো নামসর্বস্ব সংগঠন, যেমন তাঁতী দল বা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক দল বা লীগ, প্রজন্ম দল বা লীগ ইত্যাদি। ‘দল’-এর মালিক হলো বিএনপি, আর লীগ মানেই আওয়ামী লীগ। তরুণদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সবাই নেতা হতে চায়। দলের কোনো একটা কমিটিতে থাকতে পারলে আখের গোছাতে সুবিধা হয় অনেক। তাই একটার পর একটা সংগঠন তৈরি হচ্ছে। দেশরত্ন প্রজন্ম লীগ, দেশনেত্রী সমর্থক দল, আমরা জিয়ার সৈনিক, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ—এ রকম আরও অনেক সংগঠন মাটি ফুঁড়ে উঠছে প্রায় প্রতিনিয়ত।
জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতলায় কয়েকটা কামরা ভাড়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারির নেতারা একটি সংগঠনের ব্যানার লাগিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। আশপাশে ১৪-২০ জন তরুণ নিশ্চুপ বসে থাকে। এদের নানা উপায়ে জড়ো করা হয়। এই সভার পর আর হয়তো ওই সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে প্রেসক্লাবের লাভ হয়, ঘরভাড়া পাওয়া যায়। আর টেলিভিশনের পর্দায় আমরা এই একঘেয়ে ও বিরক্তিকর নাটকে মঞ্চায়ন দেখি দিনের পর দিন। এসব তরুণের কি কোনো কাজ নেই?
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হয়। তখন একটা কথা চাউর হয়েছিল, তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কেননা, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে এটা বলা হয়েছিল। হয়তো কথাটা সত্য। গত কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আমরা দেখলাম তারুণ্যের জয়জয়কার। শাহবাগে তারুণ্যের জোয়ার লক্ষ করি। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, যারা পুলিশ পেটাচ্ছে, গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, লাঠি, সড়কি কিংবা রামদা নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়া করছে, তারাও সবাই তরুণ। তাদের পরনে জিনস, হাতে হাতে ‘ককটেল’।
দেশে চরমপন্থার বিস্তৃতি ঘটছে। ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছে অনেকেই। হিজবুত তাহ্রীর এবং এ–জাতীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারা সবাই তরুণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, তাদের ধরা হচ্ছে অস্ত্র, জিহাদি বইসহ। যাদের ধরা হচ্ছে, তারা প্রায় সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এরা ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদলের ক্যাডারদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বয়সী এবং অধিকতর মেধাবী। এসব তরুণ কেন চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছে?
রাজনীতিতে চরমপন্থা নতুন বিষয় নয়। একসময় এ দেশের তরুণদের একটা বড় অংশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল। তারা শ্রেণি-সংগ্রামের নামে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাকে জায়েজ মনে করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় অনেকেই পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ও জাসদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী গণবাহিনীর ঝান্ডা উঁচিয়ে রাজনীতিতে চরমপন্থা অবলম্বন করেছিল। এখন কমিউনিস্ট বা বাম ঘরানার চরমপন্থী রাজনীতির অবসান হয়েছে। তার জায়গায় দেখা যাচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী চরমপন্থা। শুধু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আউড়ে এই সমস্যার মীমাংসা হবে না। নিরাপত্তার নামে বাহিনীগুলোকে আরও নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিয়েও এই তরুণদের দমানো যাবে বলে মনে হয় না। যেতে হবে আরও গভীরে। তরুণদের আহত মনস্তত্ত্ব পুলিশি অ্যাকশন দিয়ে সমাধান করা যাবে না।
দেশে অনুসরণযোগ্য নেতৃত্ব নেই। সব ক্ষেত্রেই গালাগাল, চিৎকার। তরুণেরা প্রেরণা পাবে কোথা থেকে? অর্থনীতির চাকা ঘুরছে মন্থর গতিতে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের অরণ্যে খুঁজে পাওয়া হতভাগ্য বাংলাদেশি তরুণদের দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, কত অনন্যোপায় হলে রুটিরুজির জন্য মানুষ এ রকম অনিশ্চয়তা ও বিপদের পথে পা বাড়ায়।
মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত দালাল চক্রের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। আমাদের রাষ্ট্র তরুণদের জন্য তেমন কোনো ‘স্পেস’ তৈরি করে দিচ্ছে না। আমরা শুধু বাগাড়ম্বর শুনি। সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো আয়োজন দেখি না। এসব তরুণ কোথায় যাবে? যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের দেশের বাইরে নিরাপদ পরিবেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সন্তানদের জন্য কী ব্যবস্থা করবে? পাচার হওয়া, মাদকের কাছে সমর্পিত হওয়া অথবা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো গ্রহণযোগ্য পথ কি আমরা দেখাতে পারছি? নাকি সবাই আমরা আঁধারের যাত্রী?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক। প্রথমা থেকে প্রকাশিত হলো তাঁর জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি।
mohi2005@gmail.com
একুশ শতকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে তারুণ্যের সেই দীপ্তি খুঁজে পাই না। এখানে যে বয়সে ছাত্রসংগঠনের কমিটিগুলোতে ঢোকার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়, তার চেয়ে কম বয়সী অনেক বড় বড় রাষ্ট্রনায়ককে আমরা দেখেছি বিশ শতকে। লিড ট্রটস্কি ১৯১৭ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। মিসরে গামাল আবদেল নাসের একই বয়সে রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন। কিউবায় যখন বিপ্লব সংগঠিত হয়, তখন এর নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বয়স ছিল ৩২। তাঁর অন্যতম সহযোগী চে’ গুয়েভারার মাত্র ৩০ চলছে তখন। এ সবই ঘটেছে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে। একই বছর লিবিয়ায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে আদিম যাযাবর সমাজের পালাবদল ঘটিয়েছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি মাত্র ২৩ বছর বয়সে। এ রকম উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়।
আমাদের দেশে তরুণসমাজ কোনো অবিমিশ্র ও অবিভাজ্য সামাজিক শক্তি নয়। একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে তরুণসমাজের একটি অংশ সক্রিয় হয়েছিল। এদের সংখ্যা বড়জোর এক লাখ বা তার চেয়ে কিছু বেশি। বিরাটসংখ্যক তরুণ এদের সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছে, তা স্বীকার করতেই হবে। এর পাশাপাশি তরুণসমাজের একটি অংশ ছিল পুরোপুরি নির্লিপ্ত, এমনকি দখলদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহযোগী। দেশের অবস্থা যে পুরোপুরি ‘স্বাভাবিক’ এবং দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও অন্যান্য নৃশংস ঘটনাবলি যে ‘ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা’, এটা দেখানোর জন্য তখন সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়েছিল। আমাদের অনেক সতীর্থ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছিল এবং পরীক্ষা দিয়েছিল। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই ‘গণ্ডগোল’ যদি মিটে যেত, তাহলে কী হতো? হয়তো শেখ মুজিবের ফাঁসি হতো আর আমাদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ পরিচয় নিয়ে দালাই লামার সহযাত্রীদের মতো ভারতের কোনো আশ্রয়শিবিরে অথবা রাস্তাঘাটে ভবঘুরের জীবন যাপন করতে হতো। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই আমরা এ দেশে তারুণ্যের বিভক্তি ও অবক্ষয়ের শুরু দেখতে পেয়েছি। জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদের রাজনীতি, অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া তখন থেকেই চলে আসছে। ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ‘সাত খুন’, লাল সন্ত্রাসের নামে আতঙ্ক ছড়ানো—এ সবই ছিল তরুণদের কাজ। নেতৃত্বেও ছিল প্রধানত তরুণেরাই। এর মূল্যও দিতে হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণদেরই।
আমরা অনেক সময় গর্ব করে বলে থাকি, এ দেশের ছাত্রসমাজ জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল একটা সময় পর্যন্ত। উদাহরণ হিসেবে ভাষা আন্দোলন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কথা আমরা অহংকারের সঙ্গে উচ্চারণ করি। এ ধারাটির অবসান হয় পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৭৬ সালের একটি সামরিক ফরমানের মাধ্যমে, যেখানে রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী ছাত্রসংগঠন ও অন্যান্য গণসংগঠনকে মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এখনো। একটি রাজনৈতিক দল এখন ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’। তার একটি মূল সংগঠন আছে, আছে একটি করে ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন। এ ছাড়া এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাজারো নামসর্বস্ব সংগঠন, যেমন তাঁতী দল বা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক দল বা লীগ, প্রজন্ম দল বা লীগ ইত্যাদি। ‘দল’-এর মালিক হলো বিএনপি, আর লীগ মানেই আওয়ামী লীগ। তরুণদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সবাই নেতা হতে চায়। দলের কোনো একটা কমিটিতে থাকতে পারলে আখের গোছাতে সুবিধা হয় অনেক। তাই একটার পর একটা সংগঠন তৈরি হচ্ছে। দেশরত্ন প্রজন্ম লীগ, দেশনেত্রী সমর্থক দল, আমরা জিয়ার সৈনিক, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ—এ রকম আরও অনেক সংগঠন মাটি ফুঁড়ে উঠছে প্রায় প্রতিনিয়ত।
জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতলায় কয়েকটা কামরা ভাড়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারির নেতারা একটি সংগঠনের ব্যানার লাগিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। আশপাশে ১৪-২০ জন তরুণ নিশ্চুপ বসে থাকে। এদের নানা উপায়ে জড়ো করা হয়। এই সভার পর আর হয়তো ওই সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে প্রেসক্লাবের লাভ হয়, ঘরভাড়া পাওয়া যায়। আর টেলিভিশনের পর্দায় আমরা এই একঘেয়ে ও বিরক্তিকর নাটকে মঞ্চায়ন দেখি দিনের পর দিন। এসব তরুণের কি কোনো কাজ নেই?
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হয়। তখন একটা কথা চাউর হয়েছিল, তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কেননা, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে এটা বলা হয়েছিল। হয়তো কথাটা সত্য। গত কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আমরা দেখলাম তারুণ্যের জয়জয়কার। শাহবাগে তারুণ্যের জোয়ার লক্ষ করি। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, যারা পুলিশ পেটাচ্ছে, গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, লাঠি, সড়কি কিংবা রামদা নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়া করছে, তারাও সবাই তরুণ। তাদের পরনে জিনস, হাতে হাতে ‘ককটেল’।
দেশে চরমপন্থার বিস্তৃতি ঘটছে। ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছে অনেকেই। হিজবুত তাহ্রীর এবং এ–জাতীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারা সবাই তরুণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, তাদের ধরা হচ্ছে অস্ত্র, জিহাদি বইসহ। যাদের ধরা হচ্ছে, তারা প্রায় সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এরা ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদলের ক্যাডারদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বয়সী এবং অধিকতর মেধাবী। এসব তরুণ কেন চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছে?
রাজনীতিতে চরমপন্থা নতুন বিষয় নয়। একসময় এ দেশের তরুণদের একটা বড় অংশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল। তারা শ্রেণি-সংগ্রামের নামে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাকে জায়েজ মনে করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় অনেকেই পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ও জাসদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী গণবাহিনীর ঝান্ডা উঁচিয়ে রাজনীতিতে চরমপন্থা অবলম্বন করেছিল। এখন কমিউনিস্ট বা বাম ঘরানার চরমপন্থী রাজনীতির অবসান হয়েছে। তার জায়গায় দেখা যাচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী চরমপন্থা। শুধু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আউড়ে এই সমস্যার মীমাংসা হবে না। নিরাপত্তার নামে বাহিনীগুলোকে আরও নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিয়েও এই তরুণদের দমানো যাবে বলে মনে হয় না। যেতে হবে আরও গভীরে। তরুণদের আহত মনস্তত্ত্ব পুলিশি অ্যাকশন দিয়ে সমাধান করা যাবে না।
দেশে অনুসরণযোগ্য নেতৃত্ব নেই। সব ক্ষেত্রেই গালাগাল, চিৎকার। তরুণেরা প্রেরণা পাবে কোথা থেকে? অর্থনীতির চাকা ঘুরছে মন্থর গতিতে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের অরণ্যে খুঁজে পাওয়া হতভাগ্য বাংলাদেশি তরুণদের দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, কত অনন্যোপায় হলে রুটিরুজির জন্য মানুষ এ রকম অনিশ্চয়তা ও বিপদের পথে পা বাড়ায়।
মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত দালাল চক্রের ওপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। আমাদের রাষ্ট্র তরুণদের জন্য তেমন কোনো ‘স্পেস’ তৈরি করে দিচ্ছে না। আমরা শুধু বাগাড়ম্বর শুনি। সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো আয়োজন দেখি না। এসব তরুণ কোথায় যাবে? যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের দেশের বাইরে নিরাপদ পরিবেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সন্তানদের জন্য কী ব্যবস্থা করবে? পাচার হওয়া, মাদকের কাছে সমর্পিত হওয়া অথবা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো গ্রহণযোগ্য পথ কি আমরা দেখাতে পারছি? নাকি সবাই আমরা আঁধারের যাত্রী?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক। প্রথমা থেকে প্রকাশিত হলো তাঁর জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি।
mohi2005@gmail.com
No comments