একাত্তর by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
.এই গল্পটার নাম হতে পারত ‘বাঘ’, শুধুই ‘বাঘ’, যেহেতু একাত্তরের কয়টা দিন একটি বাঘই ছিল আমাদের কাছে বড় বিভীষিকা; বাবার বর্ণনায় শোনা দূরের বন্দুক-বোমার শব্দ, অথবা রাতে পুবের আকাশের হাঁটু পেঁচিয়ে উঠতে থাকা আগুনের শিখা আর মানুষের কান্না-কোলাহল থেকেও। বাবা বলতেন, এবং আমরা শুনতাম, এবং জানতাম, কোথাও মানুষ মরছে, কোনো গ্রামে আগুন লেগেছে। জানতাম আর কল্পনা করতাম, এরপর এই মানুষগুলোর জীবনের জায়গাটাতে থাকবে একটা বড় শূন্য, অথবা তারা যেন একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়বে অন্য একটা জীবনে, যে জীবন তাদের নয়; যে জীবন সন্তান, স্বজন কিংবা সম্ভ্রম হারানো মানুষ অথবা উদ্বাস্তুর। যেন তাদের কালকের আর আজকের জীবনের মাঝখান দিয়ে ইতিহাস একটা রক্তাক্ত রেখা টেনে দিয়ে বলেছে, এখন থেকে এই তোমার জীবন অথবা জীবনের ছিটেফোঁটা; এই জীবনটা কান্নার, কষ্টের, দীর্ঘশ্বাসের এবং গর্বের—যেভাবে এ জীবন তোমাকে এখন চালাবে। তার পরও গল্পের নামটা ‘একাত্তর’, যেহেতু ওই বাঘটাও একসময় ঢুকে পড়েছিল একাত্তরের অদ্ভুত রসায়নে। সেখান থেকে সে আর বেরোয়নি।
সম্ভ্রম হারানোর কথাটা বলেছি, যেহেতু একাত্তরের মার্চ শেষ হতে না-হতেই এটি আমাদের মাথায় চেপে বসেছিল আরব্য রজনীর গল্পের একটা দানবের মতো। আমরা মানে বাবা-মা, ভাইয়া আর আমি। আমার বড় আপুরও, যদিও তার পুরোনো ঢাকার শ্বশুর বাড়িতে ওই দানবটা ছিল একটা ছায়ার মতোই। আপুর কথা থাক, তাকে সম্ভ্রম নিয়ে ভাবতে হয়নি, কিন্তু যেদিন শুনলাম, সাতক্ষীরায় পাকিস্তানি সেনারা ঢুকছে, সেদিন থেকেই আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। একাত্তরে আমার বয়স ছিল ১৪। আমাকে দেখতে লাগত সুচিত্রা সেনের মতো, মা বলতেন। বাবা আমাকে ডাকতেন পরি, যদিও ভাইয়া বলত পেঁচি, যেহেতু আমার নাকটা নাকি দেখতে ছিল প্যাঁচার মতো। আমি সামনাসামনি কোনো প্যাঁচা দেখিনি, তাই ভাইয়ার কথাটা ঠিক না বেঠিক, সেটি বলতে পারব না। কিন্তু ডাকটা শুনলে রেগে যেতাম। কাঁদতাম। অথচ মার্চের শেষ থেকে ভাইয়া পেঁচি বলে ডাকা বন্ধ করে দিল। সাতক্ষীরার বাসায় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে কাঁপতাম, মা নামাজ পড়ে চোখ ভাসাতেন, সেই চোখের জলের অনেকটাই ছিল আমার সম্ভ্রম নিয়ে। কিছুটা ছিল বাবাকে নিয়েও, যেহেতু তিনি তখন জঙ্গলে, মুন্সিগঞ্জ অথবা বুড়িগোয়ালিনী নাকি অন্য কোনো জায়গায়। বাবা ছিলেন বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার। সাতক্ষীরায় ভাড়া বাসায় আমাদের রেখে বাবা তাঁর জঙ্গলের কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে মা ঘুরতে গেছেন তিনবার, ভাইয়া দুবার। আমি বাঘের গল্প শুনে ভয় পেতাম, কুমিরের কথা শুনে আতঙ্কে থাকতাম। সুন্দরবন সুন্দর থাকুক, আমি ভাবতাম, তার ভেতরের অসুন্দর দেখতে চাই না আমি। ফলে জঙ্গলের ভেতরে আমার যাওয়া হয়নি।
দুদিনের মধ্যেই বাবা অবশ্য এলেন। তাঁকে দেখে চেনা মুশকিল, যেন এ কদিন তাঁকে ভূত তাড়া করেছে, নয়তো বাঘ আর কুমির। মাকে একটা মাত্র দিন সময় দিলেন গোছগাছ করতে। পরদিন ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম কালীগঞ্জ, তারপর শ্যামনগর, তারপর খোলপেটুয়া নদী হয়ে দক্ষিণে। যতক্ষণ পর্যন্ত না বুড়িগোয়ালিনীতে নামলাম আমরা, বাবার আতঙ্কটা তরল হলো না। কিন্তু বাবার আতঙ্ক কাটলেও আমার ভেতরে জুড়ে বসল জঙ্গলের নামহীন সব ভয়। বাবার বিশ্বস্ত চার বনকর্মী মিলে একটা উঁচু পাটাতনের ওপর ছনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে একটা ঘর করে দিয়েছে। ঘর দেখে বাবা খুব খুশি। হেসে মাকে বললেন, ঘরটা নিরাপদ, যদি না একে তোমরা অনিরাপদ বানাও।
সেটা কীভাবে? মা জিজ্ঞেস করলেন।
তোমরা যদি ওই ঘরটাতেই থাকো, নিচে না নামো, যদি বাঘের সঙ্গে খাতির করার শখ না হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই।
সেটি তোমার মেয়েকে বলো, মা একটু খোঁচা দিয়ে বললেন। মা বুঝতে পারছিলেন না, এই মাচানে কীভাবে তিনি থাকবেন, রান্নাবান্না করবেন, কত দিন এই জঙ্গলবাস চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের হাত থেকে যে আপাতত নিরাপদে থাকা গেল, সেই স্বস্তিটা বাবার কাছে বড় হয়ে উঠল। বাবাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। জঙ্গলটা তিনি চেনেন তাঁর হাতের তালুর মতো। জঙ্গল নিয়ে তাঁর কোনো ভয় নেই। তা ছাড়া আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্য আছে চারজন মানুষ। তারা খাট-তোশক জোগাড় করেছে, হাঁড়ি-পাতিল কিনে এনেছে, প্রতিদিন কলসি ভরে পানি দিয়ে যাচ্ছে। সবজি-আনাজ, মসলাপাতি আর মাছ-মাংস দিয়ে যাচ্ছে। রাতে জেগে থাকছে। বাবা মাঝেমধ্যে নৌকা নিয়ে তাঁর অফিসে যান। ফিরে এসে মানুষ খুন আর গ্রামের পর গ্রাম পোড়ানোর গল্প করেন। একদিন ভাইয়ার সঙ্গে বসে একটা হিসাব কষলেন—নদীর আর পথের আর দূরত্বের। একই সঙ্গে সংগতিরও। আমাদের আদিবাড়ি বশিরহাট। এক চাচা আছেন সেখানে। বাবার হিসাবটা বুড়িগোয়ালিনী আর বশিরহাটের মাঝখানের ভূগোল নিয়ে। সংগতিটা বশিরহাটে থাকার নয়, রাহা খরচের। বাবার বিশ্বাস, তাঁর চাচাতো ভাই দুহাত মেলে আমাদের বরণ করে নেবেন।
বাবার এই হিসাব-নিকাশে মা একটু স্বস্তি পেলেন। একদিন বাবার পাহারাদারদের একজন, নজু, মাকে বাঘ-বিধবাদের গল্প বললেন। বুড়িগোয়ালিনী থেকে বেরিয়ে গেলে পুবে বা উত্তরে প্রথম যেসব লোকালয় পড়বে, সেগুলোতে মাঝেমধ্যে বাঘ ঢোকে। তাতে ক্বচিৎ মানুষ মারা পড়ে, কিন্তু মানুষ মরে জঙ্গলে এসে। মা বললেন, জঙ্গলে তাদের আসতেই হয়, মাছ-মধু ছাড়া শুধু কাঠের জন্য হলেও। কেউ কেউ আর ফেরে না।
শুনে আমার গা দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সর্বনাশ! বাবাকে বললাম, কালই গেলে হয় না?
বাবা হাসলেন। ভাইয়া বলল, পেঁচি, আর কটা দিন অপেক্ষা কর। আমি দেখছি।
ভাইয়ার মুখে পেঁচি ডাকটা শুনে আমার ভারি আনন্দ হলো। মনে হলো, কোনো ভয় নেই। এর দুদিন পর নজুকে নিয়ে ভাইয়া যখন শ্যামনগরের দিকে গেল, মনে হলো, এই তো, মাত্র কটা দিন। পথে নামলে একসময় বশিরহাট পৌঁছতে আর দেরি লাগবে না।
বশিরহাট নামটার মধ্যে যেন দুনিয়ার সব স্বস্তি।
বুড়িগোয়ালিনীতে এসে জঙ্গল কী জিনিস বুঝলাম। দিনগুলো নিঝুম, রাতগুলো নিঃশ্বাস বন্ধ করা। কত যে পাখির কলকাকলি শুনেছি, হিসাব করা মুশকিল। মাঝেমধ্যে হরিণের ডাক, বাঁদরের চেঁচামেচি। কিন্তু যে আওয়াজের জন্য উৎকর্ণ থাকতাম, যা না শুনতে পারলেই মনে হতো যেন জগতের ভালো, সেই বাঘের হুংকার কানে এসেছে কদাচিৎ। বাবা শুনে বলতেন, একটা শিকার ফেলেছে; অথবা মহারাজের ক্ষুধা লেগেছে; অথবা তিন শ গজের মধ্যেই এসে পড়ল? তিন শ গজের ভেতরে কেন আসবে না বাঘটি, এমনকি তিন গজের ভেতরেও, সে প্রশ্ন বাবাকে করার ইচ্ছা হতো, কিন্তু বাবাই আমাকে একদিন বলেছিলেন, বাঘরা ভেবেচিন্তে কাজ করে। নিশ্চয় সে আমাদের নিয়ে ভাবছে। একদিন সকাল থেকে বৃষ্টি হলো, জঙ্গলটা যেন হঠাৎ ভেজা বাতাসে দম হারিয়ে ফেলল। গুমোট গরম, প্রচুর ঘাম হচ্ছে। পাটাতনের একটুখানি খোলা অংশে পা রাখতেই দূরে আমার চোখ আটকে গেল—মহারাজ! কালো হলুদে উজ্জ্বল একটা মুখ, তীক্ষ্ণ চোখ, ছুরির মতো দৃষ্টি। আমার সঙ্গে কি চোখাচোখি হলো? আমি যে পড়ে যাচ্ছিলাম সংজ্ঞা প্রায় হারিয়ে, সেটি বুঝতে পারলাম মা এসে আমাকে ধরার পর। মা ডাকলেন মুনা নামের এক পাহারাদারকে। তিনি এসে পাটাতনে উঠতে উঠতে বাঘটা বিদায় নিল।
সেই থেকে শুরু। বাবা বললেন, পরিকে দেখে বাঘটা এমনি মুগ্ধ যে এখন আর এখান থেকে নড়বে না। আমার ভয়টা তাড়ানোর জন্যই বললেন, কিন্তু আমার হঠাৎ মনে হলো, বাঘটা আর যাই হোক পাকিস্তানিদের মতো বর্বর নয়। ভদ্রগোছের বরং। দেখা দিল, চলে গেল। এখন যদি মাচানে থাকি, সমস্যা নেই, ঘরে এসে হামলা করবে না। বাবা জানতেন, বাঘ শব্দ পছন্দ করে না। আশপাশের গাছগুলোতে অনেক খালি কেরোসিনের টিন রশি দিয়ে বেঁধে মাঝেমধ্যে মুনা অথবা ইন্দ্র রশিতে ঘন ঘন টান দেন। প্রচণ্ড শব্দ হয়। আমাকেও এই নাকাড়া বাজানো শেখানো হলো। বাঘটা তাতেও দূরে থাকে না। মাঝেমধ্যেই তাকে দেখা যেতে লাগল। বাবা এবার একটু ভয় পেলেন। তাঁর এক পাহারাদার রুমান মিয়া বন্দুক চালাতে জানেন। কিন্তু কাতুর্জ আছে হাতে গোনা কয়েকটা। পাকিস্তানিরা সব কাতুর্জ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে গেছে। বাবা আরও শুনেছেন, শিগগিরই সুন্দরবনে অপারেশনে নামবে পাকিস্তানিরা, যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নৌ-কমান্ডো দল তৎপর হচ্ছে। মুশকিল হলো, রুমান মিয়ার হাতের আন্দাজ কাঁচা। বাবারও।
সবচেয়ে বড় সমস্যা, বাঘটার কারণে বাবাও আটকা পড়েছেন, যদিও চাকরি ছেড়ে বশিরহাট পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তিনি নিয়েই রেখেছেন। পাহারাদারেরা পানিটানি আনতে, আনাজপাতি জোগাড় করতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। খোলপেটুয়ার ধারে ধারে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। নদীটা এমন কোনো বড় নয় যে মাঝখান দিয়ে গেলে বাঘটার সীমানার বাইরে যাওয়া যাবে। ফলে আমাদের রসদপত্রে টান পড়ল, রান্নাবান্না কমল। আর যত এসবে সময় কম দিতে হলো মাকে, তত আমাদের নানা রকম ভয়ের ছবি মনে আসার সময় বাড়তে থাকল। একদিন অনেক কাছ থেকে বাঘটার গর্জন শুনে আমি বললাম, আমরা আর কোনো দিন ফিরে যেতে পারব না মা। বাঘটা আমাদের নিয়তি। বৃষ্টিতে ছনের চাল ফাঁক হয়েছে, মাচানটায় বিপদ জমেছে। আমরা বৃষ্টির পানি ধরে রাখি, কিন্তু রান্নার জন্য একটা জায়গা শুকনো রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বাঘটা আমাদের দেখে, পড়ে, আর খুশি হয়। ভাবে, আর কটা দিন। আমরাও বাঘটাকে শুনি, তার গায়ের গন্ধটাও যেন নাকে এসে লাগে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই তার উজ্জ্বল মহিমা, আর ক্ষমাহীন দুই চোখ। মা বলেন, খোকাটা তো জানে না, বাঘটা আমাদের চোখে চোখে রাখছে। সে যদি এসে পড়ে? এর মধ্যে এক সকালে ইন্দ্র এসে বললেন, মাচানের খুব কাছে এসেছিল বাঘটা, কাল রাতে। আমাকে নিতে এসেছে বাঘটা, আমি সুচিত্রা সেন। কিন্তু সে আমার সম্ভ্রম নেবে না। শুধু প্রাণ নেবে। একটা ভয় অন্তত নেই। কিন্তু সকালটা তেতে ওঠার আগেই দূর থেকে দ্রিমি দ্রিমি শুনলাম। বাবা বললেন, পাকিস্তানিরা এসে পড়েছে। ইন্দ্র বলল, বাঘটা আজ অস্থির। আমাদের মনে হলো, হয় পাকিস্তানিদের গুলি, না হয় বাঘের থাবা। প্রাণ যাওয়ার দুই বিকল্পের একটি—অথবা দুটিই—এখন আমাদের নিয়তি। কিন্তু বুড়িগোয়ালিনী পর্যন্ত পাকিস্তানিদের বোট এল না। কেন, কে জানে। বাঘটাও তার গর্জন থামিয়ে দিল। সে রাতে সারাটা সময় আমরা অন্ধকারে জেগে থাকলাম। টের পেলাম, বাঘটাও যেন কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু আওয়াজ করল না। হয়তো নিজেকে বলল, আর একটা দিন।
পরদিন দ্রিমি দ্রিমিটা খুব কাছে থেকে শুনলাম। ইন্দ্র বলল, গ্রাম জ্বালিয়েছে। এই পথ দিয়ে হয়তো মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত যাবে।
কিন্তু বেলা ১১টার দিকে এক আশ্চর্য হইচই শোনা গেল, কিছুটা দূর থেকে। অনেকক্ষণ। হইচইয়ের শব্দগুলো আতঙ্কের। ক্রোধের। ভয়ার্ত সব কণ্ঠের। গুলির শব্দও শুনলাম। তারপর একসময় হইচই থেমে গেল। কিছু মানুষের কথাবার্তা কানে এল। মুনা দৌড়ে এলেন। বাবা মাচানোর ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে ডাকলেন। বাবা নেমে দ্রুত উত্তরের দিকে চলে গেলেন। একটা ভয়ানক সময় গেল। আমি আর মা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। একসময় বাবা ফিরলেন। বললেন, একটা ছোট গানবোটে সাত-আট পাকিস্তানি সেনা এসেছিল। দুটো গ্রাম জ্বালিয়েছে, গোটা দশ মানুষ মেরেছে। খোলপেটুয়ায় তাদের ওপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি বাঘ। বাঘের আঘাতে পাকিস্তানিগুলো বিপর্যস্ত হয়েছে, ঝাঁপিয়ে পড়েছে পানিতে। বাঘটা কারও ঘাড় মটকেছে, কাউকে মেরেছ থাবার আঘাতে। যারা পানিতে পড়েছিল, তাদের কেউ কেউ ডুবে মরেছে। বাকিদের লাঠি আর দা দিয়ে মেরেছে পুড়ে যাওয়া গ্রামের বেঁচে যাওয়া মানুষেরা। বাবার গলাটা ধরে এল। ধরা গলায় তিনি বললেন, মহারাজও হয়তো মারা গেছে। তার গায়ে গুলি লেগেছে। বাবা আর পাহারাদারেরা আর গ্রামের কিছু মানুষ দুপুরের আগেই বাঘটাকে খুঁজে পেল। গুলিতে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। একটি নয়, দুটি গুলি। বিশাল বাঘটার শরীর, বিশাল তার সৌন্দর্য। বাঁশে বেঁধে বুড়িগোয়ালিনীতে নিয়ে আসা হলো বাঘটাকে। বাবা বললেন, এ আমাদের পরম বন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা। একে কবরে শুইয়ে স্যালুট জানাতে হবে। কবরে শোয়ানোর পর নীলমণিধন একটা কার্তুজ মরচে পড়া বন্দুকে ঠেসে আকাশের দিকে গুলি ছোড়া হলো। বাবা বললেন, এটি গান স্যালুট। তারপর মাকে ১৫ মিনিট সময় দিলেন। বেরিয়ে পড়তে হবে।
২. অনেক বছর পর আমাদের নিয়ে বুড়িগোয়ালিনী এসেছিলেন বাবা। বাঘটাকে যেখানে গোর দেওয়া হয়েছিল, তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কী এক অবাক কাণ্ড সেদিন করেছিল মহারাজ, তাই না পরি? আমার তো মনে হয়, আমাদের দেখে রাখতেই জঙ্গলের গভীর থেকে সে বেরিয়েছিল। কে শত্রু, কে মিত্র, কারা দেশটাকে শ্মশান বানাতে চায় মহারাজ তা বুঝেছিল। অবাক, কারও ডাক, কোনো ট্রেনিংয়ের জন্য সে বসে থাকেনি, কোনো প্রস্তুতিরও প্রয়োজন হয়নি তার। শুধু নিজের মতো একটা যুদ্ধ করে গেল। এত বিশাল একটা প্রাণ, এমন অকাতরে দিয়ে দিল! বাবার কথা শুনে অবাক হলাম না। বুড়ো হয়েছেন, কী ভাবেন, কী বলেন, ঠিক নেই। বুড়ো হলে এ রকম কথা মানুষ বলতেই পারে, নাকি?
সম্ভ্রম হারানোর কথাটা বলেছি, যেহেতু একাত্তরের মার্চ শেষ হতে না-হতেই এটি আমাদের মাথায় চেপে বসেছিল আরব্য রজনীর গল্পের একটা দানবের মতো। আমরা মানে বাবা-মা, ভাইয়া আর আমি। আমার বড় আপুরও, যদিও তার পুরোনো ঢাকার শ্বশুর বাড়িতে ওই দানবটা ছিল একটা ছায়ার মতোই। আপুর কথা থাক, তাকে সম্ভ্রম নিয়ে ভাবতে হয়নি, কিন্তু যেদিন শুনলাম, সাতক্ষীরায় পাকিস্তানি সেনারা ঢুকছে, সেদিন থেকেই আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। একাত্তরে আমার বয়স ছিল ১৪। আমাকে দেখতে লাগত সুচিত্রা সেনের মতো, মা বলতেন। বাবা আমাকে ডাকতেন পরি, যদিও ভাইয়া বলত পেঁচি, যেহেতু আমার নাকটা নাকি দেখতে ছিল প্যাঁচার মতো। আমি সামনাসামনি কোনো প্যাঁচা দেখিনি, তাই ভাইয়ার কথাটা ঠিক না বেঠিক, সেটি বলতে পারব না। কিন্তু ডাকটা শুনলে রেগে যেতাম। কাঁদতাম। অথচ মার্চের শেষ থেকে ভাইয়া পেঁচি বলে ডাকা বন্ধ করে দিল। সাতক্ষীরার বাসায় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে কাঁপতাম, মা নামাজ পড়ে চোখ ভাসাতেন, সেই চোখের জলের অনেকটাই ছিল আমার সম্ভ্রম নিয়ে। কিছুটা ছিল বাবাকে নিয়েও, যেহেতু তিনি তখন জঙ্গলে, মুন্সিগঞ্জ অথবা বুড়িগোয়ালিনী নাকি অন্য কোনো জায়গায়। বাবা ছিলেন বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসার। সাতক্ষীরায় ভাড়া বাসায় আমাদের রেখে বাবা তাঁর জঙ্গলের কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে মা ঘুরতে গেছেন তিনবার, ভাইয়া দুবার। আমি বাঘের গল্প শুনে ভয় পেতাম, কুমিরের কথা শুনে আতঙ্কে থাকতাম। সুন্দরবন সুন্দর থাকুক, আমি ভাবতাম, তার ভেতরের অসুন্দর দেখতে চাই না আমি। ফলে জঙ্গলের ভেতরে আমার যাওয়া হয়নি।
দুদিনের মধ্যেই বাবা অবশ্য এলেন। তাঁকে দেখে চেনা মুশকিল, যেন এ কদিন তাঁকে ভূত তাড়া করেছে, নয়তো বাঘ আর কুমির। মাকে একটা মাত্র দিন সময় দিলেন গোছগাছ করতে। পরদিন ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম কালীগঞ্জ, তারপর শ্যামনগর, তারপর খোলপেটুয়া নদী হয়ে দক্ষিণে। যতক্ষণ পর্যন্ত না বুড়িগোয়ালিনীতে নামলাম আমরা, বাবার আতঙ্কটা তরল হলো না। কিন্তু বাবার আতঙ্ক কাটলেও আমার ভেতরে জুড়ে বসল জঙ্গলের নামহীন সব ভয়। বাবার বিশ্বস্ত চার বনকর্মী মিলে একটা উঁচু পাটাতনের ওপর ছনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে একটা ঘর করে দিয়েছে। ঘর দেখে বাবা খুব খুশি। হেসে মাকে বললেন, ঘরটা নিরাপদ, যদি না একে তোমরা অনিরাপদ বানাও।
সেটা কীভাবে? মা জিজ্ঞেস করলেন।
তোমরা যদি ওই ঘরটাতেই থাকো, নিচে না নামো, যদি বাঘের সঙ্গে খাতির করার শখ না হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই।
সেটি তোমার মেয়েকে বলো, মা একটু খোঁচা দিয়ে বললেন। মা বুঝতে পারছিলেন না, এই মাচানে কীভাবে তিনি থাকবেন, রান্নাবান্না করবেন, কত দিন এই জঙ্গলবাস চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের হাত থেকে যে আপাতত নিরাপদে থাকা গেল, সেই স্বস্তিটা বাবার কাছে বড় হয়ে উঠল। বাবাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। জঙ্গলটা তিনি চেনেন তাঁর হাতের তালুর মতো। জঙ্গল নিয়ে তাঁর কোনো ভয় নেই। তা ছাড়া আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্য আছে চারজন মানুষ। তারা খাট-তোশক জোগাড় করেছে, হাঁড়ি-পাতিল কিনে এনেছে, প্রতিদিন কলসি ভরে পানি দিয়ে যাচ্ছে। সবজি-আনাজ, মসলাপাতি আর মাছ-মাংস দিয়ে যাচ্ছে। রাতে জেগে থাকছে। বাবা মাঝেমধ্যে নৌকা নিয়ে তাঁর অফিসে যান। ফিরে এসে মানুষ খুন আর গ্রামের পর গ্রাম পোড়ানোর গল্প করেন। একদিন ভাইয়ার সঙ্গে বসে একটা হিসাব কষলেন—নদীর আর পথের আর দূরত্বের। একই সঙ্গে সংগতিরও। আমাদের আদিবাড়ি বশিরহাট। এক চাচা আছেন সেখানে। বাবার হিসাবটা বুড়িগোয়ালিনী আর বশিরহাটের মাঝখানের ভূগোল নিয়ে। সংগতিটা বশিরহাটে থাকার নয়, রাহা খরচের। বাবার বিশ্বাস, তাঁর চাচাতো ভাই দুহাত মেলে আমাদের বরণ করে নেবেন।
বাবার এই হিসাব-নিকাশে মা একটু স্বস্তি পেলেন। একদিন বাবার পাহারাদারদের একজন, নজু, মাকে বাঘ-বিধবাদের গল্প বললেন। বুড়িগোয়ালিনী থেকে বেরিয়ে গেলে পুবে বা উত্তরে প্রথম যেসব লোকালয় পড়বে, সেগুলোতে মাঝেমধ্যে বাঘ ঢোকে। তাতে ক্বচিৎ মানুষ মারা পড়ে, কিন্তু মানুষ মরে জঙ্গলে এসে। মা বললেন, জঙ্গলে তাদের আসতেই হয়, মাছ-মধু ছাড়া শুধু কাঠের জন্য হলেও। কেউ কেউ আর ফেরে না।
শুনে আমার গা দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সর্বনাশ! বাবাকে বললাম, কালই গেলে হয় না?
বাবা হাসলেন। ভাইয়া বলল, পেঁচি, আর কটা দিন অপেক্ষা কর। আমি দেখছি।
ভাইয়ার মুখে পেঁচি ডাকটা শুনে আমার ভারি আনন্দ হলো। মনে হলো, কোনো ভয় নেই। এর দুদিন পর নজুকে নিয়ে ভাইয়া যখন শ্যামনগরের দিকে গেল, মনে হলো, এই তো, মাত্র কটা দিন। পথে নামলে একসময় বশিরহাট পৌঁছতে আর দেরি লাগবে না।
বশিরহাট নামটার মধ্যে যেন দুনিয়ার সব স্বস্তি।
বুড়িগোয়ালিনীতে এসে জঙ্গল কী জিনিস বুঝলাম। দিনগুলো নিঝুম, রাতগুলো নিঃশ্বাস বন্ধ করা। কত যে পাখির কলকাকলি শুনেছি, হিসাব করা মুশকিল। মাঝেমধ্যে হরিণের ডাক, বাঁদরের চেঁচামেচি। কিন্তু যে আওয়াজের জন্য উৎকর্ণ থাকতাম, যা না শুনতে পারলেই মনে হতো যেন জগতের ভালো, সেই বাঘের হুংকার কানে এসেছে কদাচিৎ। বাবা শুনে বলতেন, একটা শিকার ফেলেছে; অথবা মহারাজের ক্ষুধা লেগেছে; অথবা তিন শ গজের মধ্যেই এসে পড়ল? তিন শ গজের ভেতরে কেন আসবে না বাঘটি, এমনকি তিন গজের ভেতরেও, সে প্রশ্ন বাবাকে করার ইচ্ছা হতো, কিন্তু বাবাই আমাকে একদিন বলেছিলেন, বাঘরা ভেবেচিন্তে কাজ করে। নিশ্চয় সে আমাদের নিয়ে ভাবছে। একদিন সকাল থেকে বৃষ্টি হলো, জঙ্গলটা যেন হঠাৎ ভেজা বাতাসে দম হারিয়ে ফেলল। গুমোট গরম, প্রচুর ঘাম হচ্ছে। পাটাতনের একটুখানি খোলা অংশে পা রাখতেই দূরে আমার চোখ আটকে গেল—মহারাজ! কালো হলুদে উজ্জ্বল একটা মুখ, তীক্ষ্ণ চোখ, ছুরির মতো দৃষ্টি। আমার সঙ্গে কি চোখাচোখি হলো? আমি যে পড়ে যাচ্ছিলাম সংজ্ঞা প্রায় হারিয়ে, সেটি বুঝতে পারলাম মা এসে আমাকে ধরার পর। মা ডাকলেন মুনা নামের এক পাহারাদারকে। তিনি এসে পাটাতনে উঠতে উঠতে বাঘটা বিদায় নিল।
সেই থেকে শুরু। বাবা বললেন, পরিকে দেখে বাঘটা এমনি মুগ্ধ যে এখন আর এখান থেকে নড়বে না। আমার ভয়টা তাড়ানোর জন্যই বললেন, কিন্তু আমার হঠাৎ মনে হলো, বাঘটা আর যাই হোক পাকিস্তানিদের মতো বর্বর নয়। ভদ্রগোছের বরং। দেখা দিল, চলে গেল। এখন যদি মাচানে থাকি, সমস্যা নেই, ঘরে এসে হামলা করবে না। বাবা জানতেন, বাঘ শব্দ পছন্দ করে না। আশপাশের গাছগুলোতে অনেক খালি কেরোসিনের টিন রশি দিয়ে বেঁধে মাঝেমধ্যে মুনা অথবা ইন্দ্র রশিতে ঘন ঘন টান দেন। প্রচণ্ড শব্দ হয়। আমাকেও এই নাকাড়া বাজানো শেখানো হলো। বাঘটা তাতেও দূরে থাকে না। মাঝেমধ্যেই তাকে দেখা যেতে লাগল। বাবা এবার একটু ভয় পেলেন। তাঁর এক পাহারাদার রুমান মিয়া বন্দুক চালাতে জানেন। কিন্তু কাতুর্জ আছে হাতে গোনা কয়েকটা। পাকিস্তানিরা সব কাতুর্জ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে গেছে। বাবা আরও শুনেছেন, শিগগিরই সুন্দরবনে অপারেশনে নামবে পাকিস্তানিরা, যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নৌ-কমান্ডো দল তৎপর হচ্ছে। মুশকিল হলো, রুমান মিয়ার হাতের আন্দাজ কাঁচা। বাবারও।
সবচেয়ে বড় সমস্যা, বাঘটার কারণে বাবাও আটকা পড়েছেন, যদিও চাকরি ছেড়ে বশিরহাট পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তিনি নিয়েই রেখেছেন। পাহারাদারেরা পানিটানি আনতে, আনাজপাতি জোগাড় করতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। খোলপেটুয়ার ধারে ধারে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। নদীটা এমন কোনো বড় নয় যে মাঝখান দিয়ে গেলে বাঘটার সীমানার বাইরে যাওয়া যাবে। ফলে আমাদের রসদপত্রে টান পড়ল, রান্নাবান্না কমল। আর যত এসবে সময় কম দিতে হলো মাকে, তত আমাদের নানা রকম ভয়ের ছবি মনে আসার সময় বাড়তে থাকল। একদিন অনেক কাছ থেকে বাঘটার গর্জন শুনে আমি বললাম, আমরা আর কোনো দিন ফিরে যেতে পারব না মা। বাঘটা আমাদের নিয়তি। বৃষ্টিতে ছনের চাল ফাঁক হয়েছে, মাচানটায় বিপদ জমেছে। আমরা বৃষ্টির পানি ধরে রাখি, কিন্তু রান্নার জন্য একটা জায়গা শুকনো রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বাঘটা আমাদের দেখে, পড়ে, আর খুশি হয়। ভাবে, আর কটা দিন। আমরাও বাঘটাকে শুনি, তার গায়ের গন্ধটাও যেন নাকে এসে লাগে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই তার উজ্জ্বল মহিমা, আর ক্ষমাহীন দুই চোখ। মা বলেন, খোকাটা তো জানে না, বাঘটা আমাদের চোখে চোখে রাখছে। সে যদি এসে পড়ে? এর মধ্যে এক সকালে ইন্দ্র এসে বললেন, মাচানের খুব কাছে এসেছিল বাঘটা, কাল রাতে। আমাকে নিতে এসেছে বাঘটা, আমি সুচিত্রা সেন। কিন্তু সে আমার সম্ভ্রম নেবে না। শুধু প্রাণ নেবে। একটা ভয় অন্তত নেই। কিন্তু সকালটা তেতে ওঠার আগেই দূর থেকে দ্রিমি দ্রিমি শুনলাম। বাবা বললেন, পাকিস্তানিরা এসে পড়েছে। ইন্দ্র বলল, বাঘটা আজ অস্থির। আমাদের মনে হলো, হয় পাকিস্তানিদের গুলি, না হয় বাঘের থাবা। প্রাণ যাওয়ার দুই বিকল্পের একটি—অথবা দুটিই—এখন আমাদের নিয়তি। কিন্তু বুড়িগোয়ালিনী পর্যন্ত পাকিস্তানিদের বোট এল না। কেন, কে জানে। বাঘটাও তার গর্জন থামিয়ে দিল। সে রাতে সারাটা সময় আমরা অন্ধকারে জেগে থাকলাম। টের পেলাম, বাঘটাও যেন কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু আওয়াজ করল না। হয়তো নিজেকে বলল, আর একটা দিন।
পরদিন দ্রিমি দ্রিমিটা খুব কাছে থেকে শুনলাম। ইন্দ্র বলল, গ্রাম জ্বালিয়েছে। এই পথ দিয়ে হয়তো মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত যাবে।
কিন্তু বেলা ১১টার দিকে এক আশ্চর্য হইচই শোনা গেল, কিছুটা দূর থেকে। অনেকক্ষণ। হইচইয়ের শব্দগুলো আতঙ্কের। ক্রোধের। ভয়ার্ত সব কণ্ঠের। গুলির শব্দও শুনলাম। তারপর একসময় হইচই থেমে গেল। কিছু মানুষের কথাবার্তা কানে এল। মুনা দৌড়ে এলেন। বাবা মাচানোর ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে ডাকলেন। বাবা নেমে দ্রুত উত্তরের দিকে চলে গেলেন। একটা ভয়ানক সময় গেল। আমি আর মা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। একসময় বাবা ফিরলেন। বললেন, একটা ছোট গানবোটে সাত-আট পাকিস্তানি সেনা এসেছিল। দুটো গ্রাম জ্বালিয়েছে, গোটা দশ মানুষ মেরেছে। খোলপেটুয়ায় তাদের ওপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি বাঘ। বাঘের আঘাতে পাকিস্তানিগুলো বিপর্যস্ত হয়েছে, ঝাঁপিয়ে পড়েছে পানিতে। বাঘটা কারও ঘাড় মটকেছে, কাউকে মেরেছ থাবার আঘাতে। যারা পানিতে পড়েছিল, তাদের কেউ কেউ ডুবে মরেছে। বাকিদের লাঠি আর দা দিয়ে মেরেছে পুড়ে যাওয়া গ্রামের বেঁচে যাওয়া মানুষেরা। বাবার গলাটা ধরে এল। ধরা গলায় তিনি বললেন, মহারাজও হয়তো মারা গেছে। তার গায়ে গুলি লেগেছে। বাবা আর পাহারাদারেরা আর গ্রামের কিছু মানুষ দুপুরের আগেই বাঘটাকে খুঁজে পেল। গুলিতে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। একটি নয়, দুটি গুলি। বিশাল বাঘটার শরীর, বিশাল তার সৌন্দর্য। বাঁশে বেঁধে বুড়িগোয়ালিনীতে নিয়ে আসা হলো বাঘটাকে। বাবা বললেন, এ আমাদের পরম বন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা। একে কবরে শুইয়ে স্যালুট জানাতে হবে। কবরে শোয়ানোর পর নীলমণিধন একটা কার্তুজ মরচে পড়া বন্দুকে ঠেসে আকাশের দিকে গুলি ছোড়া হলো। বাবা বললেন, এটি গান স্যালুট। তারপর মাকে ১৫ মিনিট সময় দিলেন। বেরিয়ে পড়তে হবে।
২. অনেক বছর পর আমাদের নিয়ে বুড়িগোয়ালিনী এসেছিলেন বাবা। বাঘটাকে যেখানে গোর দেওয়া হয়েছিল, তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, কী এক অবাক কাণ্ড সেদিন করেছিল মহারাজ, তাই না পরি? আমার তো মনে হয়, আমাদের দেখে রাখতেই জঙ্গলের গভীর থেকে সে বেরিয়েছিল। কে শত্রু, কে মিত্র, কারা দেশটাকে শ্মশান বানাতে চায় মহারাজ তা বুঝেছিল। অবাক, কারও ডাক, কোনো ট্রেনিংয়ের জন্য সে বসে থাকেনি, কোনো প্রস্তুতিরও প্রয়োজন হয়নি তার। শুধু নিজের মতো একটা যুদ্ধ করে গেল। এত বিশাল একটা প্রাণ, এমন অকাতরে দিয়ে দিল! বাবার কথা শুনে অবাক হলাম না। বুড়ো হয়েছেন, কী ভাবেন, কী বলেন, ঠিক নেই। বুড়ো হলে এ রকম কথা মানুষ বলতেই পারে, নাকি?
No comments