জাদুর কাঠি আর প্রতারিত বাংলাদেশ by সিরাজুর রহমান

দুই হাজার নয় সালের কথা সবার মনে আছে কি? তখনকার যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে, সেটা হচ্ছে প্রশাসনে, বিশেষ করে সচিবালয়ে, নৈরাজ্য। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘চীনামাটির তৈজসের দোকানে মত্তহস্তীর’ তাণ্ডব। প্রশাসনের প্রায় ৭০০ শীর্ষ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে এক পাশে ‘গুদামজাত’ করে রাখা হলো। তাদের স্থলে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত এবং অপেক্ষাকৃত অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের ডবল প্রমোশন দিয়ে সেসব শূন্য পদে নিয়োগ করা হয়েছে। তখন খবর পাওয়া গিয়েছিল, শেখ হাসিনার ভোটব্যাংক হিসেবে সুপরিচিত একটি গোষ্ঠীর কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদে স্থাপন করার লক্ষ্যে কাউকে কাউকে ট্রিপল প্রমোশনও দেয়া হয়েছিল। সে সময় একাধিক কলামে বলেছিলাম, ওএসডি করে সরিয়ে দেয়া কর্মকর্তাদের অনেকেই বিভিন্ন স্তরে ২০ কিংবা ২৫ বছর কাজ করে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
রাষ্ট্রের কর্মকর্তা হিসেবে তাদের অর্জিত এসব অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রের সম্পদÑ যেমন করে কলকারখানাকে সম্পদ বিবেচনা করা হয়। সেসব অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছিলেন রাষ্ট্রের ব্যয়ে এবং রাষ্ট্রের আয়োজনে। আর এ কারণে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সর্বাধিক যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচন করে এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির উঁচু ক্যাডারগুলোতে নিয়োগ দিতে চায়। সে সম্পদ অপচয় হতে দিয়ে অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সেসব পদে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা তাদের থাকার কথা নয়। থাকলে আগেই তারা পদোন্নতি পেতেন। অনেক পড়েছি, অনেক শুনেছি এবং নিজের চোখে দেখেছি, কম যোগ্যতার কাউকে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তির মাথার ওপরে বসিয়ে দেয়া হলে অথবা নিজের যোগ্যতার সীমার ঊর্ধ্বে কোনো পদে নিয়োগ দেয়া হলে তাদের মাথা মোটা হয়ে যায়, ভুলভ্রান্তি তারা অনেক বেশি করে। অবশ্যি দু-একটি ক্ষেত্রে যে এর ব্যতিক্রম হয় না, তা নয়।
দুই হাজার নয় সালে যে সরকার গদি পেয়েছিল, তাদের ক্ষমতাপ্রাপ্তির রহস্য এখন আমরা জানি। দু’টি বিদেশী শক্তি দেশজ কয়েকজন মীরজাফরের যোগসাজশে একটা সাজানো মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে গদি দিয়েছিল। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক রায়ে ক্ষমতা পাওয়া অসম্ভব জেনে তারা অসাধু উপায়ে গদি চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে তখন থেকেই আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সিভিল সার্ভিসের দলীয়করণ সমাধা করে তারা রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা ও শেকড়ের দিকে নজর দেয়। সংবিধানের বিবরণ অনুযায়ী, পুলিশ দেশে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা, হত্যা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি প্রতিহত করা, কোথাও তেমন ঘটনা ঘটলে দুষ্কৃতকারীকে ধরে তার উপযুক্ত শাস্তি বিধান ইত্যাদি কর্তব্য পালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু তাদের দৈনন্দিন কর্তব্য পরিচালনার দায়িত্ব যেহেতু প্রতিষ্ঠিত সরকারের ওপর ন্যস্ত, সেহেতু পুলিশের কোনো কোনো অংশ মনে করতে পারে যে তাদের প্রকৃত প্রভু গণভবনের বাসিন্দারা।
সরকারি চাকরির চার্টার ও দুরভিসন্ধি
রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা বর্তমানে এসব ভুল ধারণার পুরোপুরি সুযোগ নিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বলে দেশে বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই। কারণ পুলিশকে পুরোপুরি নিজেদের গদি রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের মানুষের ওপর ভরসা নেই বলে সর্বক্ষণ নিজেদের দুর্গকে শক্তিশালী করার চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয়। বারে বারে হাজার হাজার নতুন লোক নিয়োগ করে পুলিশ বাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এসব নিয়োগের বেলায় নিজেদের দলের কর্মী ও ক্যাডারগুলোকেই বেছে নেয়া হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সংবাদে দেখেছি যে, দুটো গোয়েন্দা সংস্থাতেও ছাত্রলীগ-যুবলীগের বহু ক্যাডারকে উচ্চপদে স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ছয় বছর ধরে শাসক দলের প্রতি ষোলোআনা অনুগত কর্মীদের পদোন্নতি দিয়ে দিয়ে শীর্ষ পদগুলোতে উন্নীত করা হয়েছে। বছর দুই আগে প্রাপ্ত কিছু পরিসংখ্যানে দেখেছিলাম, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪২টিতেই জেলা প্রশাসক একটি সম্প্রদায়ের। সহকারী সচিব, উপসচিব প্রভৃতি নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পুলিশের ওসি থেকে সুপারিনটেনডেন্ট পর্যন্ত কর্মকর্তাদেরও বেশির ভাগ সেসব পরিসংখ্যানে একই গোষ্ঠীর লোক বলে দেখেছি।
প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অন্যায়-অবিচারের প্রতিবিধানের দায়িত্ব সংবিধান দিয়েছে বিচার বিভাগকে। কিন্তু প্রায় ছয় বছর আগে ক্ষমতা পেয়েই বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা বিচার বিভাগে দলীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নিয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে বিচারকেরা বিদ্রোহ করে সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো রায় দিতে না পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়েছে সম্প্রতি। বিচারকদের চাকরিতে বহাল রাখা-না-রাখার অধিকার দেয়া হয়েছে বর্তমানের অনির্বাচিত ও অবৈধ সংসদকে। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার এবং অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার সব পথই এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে দেশের ও বিদেশের জনমতের সামনে সরকারের কোনো অন্যায় অবিচারের কথা প্রকাশ পাওয়ার পথও রুদ্ধ করা হয়েছে মিডিয়ার স্বাধীনতার ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে। অবস্থাটা যেন এ রকম : বাড়ির দরোজা-জানালা বন্ধ করে পরিবারের সদস্যদের হাত পা বেঁধে তাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের কাঁদবার কিংবা প্রতিবাদ করার অধিকারও রহিত করা হয়েছে।
আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি, দলের প্রতি নয়
সচিবালয়ে হোক আর জেলা-উপজেলাতেই হোক, যারা প্রশাসনের কাজে নিয়োজিত, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার পরিবর্তে যারা বিরোধী দলকে ঠ্যাঙাতে ব্যস্ত, আর ন্যায়বিচারের পরিবর্তে যারা সরকারের ইচ্ছা পূরণ করছেনÑ রাষ্ট্রীয় উচ্চপদের পটভূমিটাই তারা ভুলে যাচ্ছেন। সিভিল সার্ভিসের সনদ সব দেশেই আছে। হিটলার-মুসোলিনির মতো জঘন্য ও নিকৃষ্ট প্রশাসন ছাড়া সব দেশেই ধরে নেয়া হয় যে, কোনো বিশেষ দল ও সরকার নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতি আমলাদের দায়িত্ব এবং তাদের চূড়ান্ত জবাবদিহিতাও রাষ্ট্রের প্রতি, কোনো সাময়িক সরকারের প্রতি নয়। সে জন্যই আমলাদের চাকরির নিরাপত্তা দিয়ে তাদের নিরপেক্ষ থাকার অনুপ্রেরণা দানের লক্ষ্যে সিভিল সার্ভিসে চাকরির একটা চার্টার কিংবা সনদ সব দেশেই থাকে।
ন্যায়নীতি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে কোনো দলীয় সরকারের বিরক্তি উৎপাদন করলেও তাদের বরখাস্ত করা অথবা অন্য কোনো শাস্তি থেকে সংরক্ষণ দেয়াই এই চার্টারের উদ্দেশ্য। তেমনি, পরবর্তী কোনো দলীয় সরকার যদি মনে করে যে, আমলারা পূর্ববর্তী সরকারের প্রতি আনুকূল্যের কারণে তাদের প্রতি অবাধ্যতা দেখাচ্ছেন, তাহলেও তারা সিভিল সার্ভিস চার্টারের সংরক্ষণ পেতে পারেন। তেমনি আমলাদেরও সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবেÑ তাদের চাকরি, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা দিচ্ছে রাষ্ট্র, জনসাধারণের প্রদত্ত রাজস্ব থেকে। সুতরাং তারা যদি নিরপেক্ষতা ভুলে গিয়ে দলীয় কোনো সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখান, তাহলে সেটাও হবে চার্টারের অবমাননা। একই সাথে, নিজেদের বিবেকের এবং স্রষ্টার কাছেও তারা দায়ী হবেন।
সিভিল সার্ভিসের চার্টার বর্তমান সরকার সংশোধন করতে চায়। কিন্তু মিডিয়ার খবরে দেখা যাচ্ছে, তার আগে তারা দলীয় কিংবা দলের প্রতি অনুগত আরো একঝাঁক কর্মচারী-কর্মকর্তার নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি দিতে চায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রশাসনের ষোলোআনা এবং নিñিদ্র দলীয়করণের সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ব্যয়ে তারা গোটা দেশটাকে দলীয় ক্যাডারে পরিণত করতে চায়। গদি চিরস্থায়ী করতে সরকার কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এটা হচ্ছে তার প্রমাণ। কিন্তু একটা ব্যাপার তারা ভুলে যাচ্ছেন। দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হতে গিয়ে আমলারাও প্রতারিত হচ্ছেন। বর্তমান সরকার ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করছে, সিভিল সার্ভিসের চার্টার ও নিয়মাবলি সংশোধন করছে। তারা ভুলে যাচ্ছে যে, পরবর্তী কোনো সরকারও তাদের নজির অনুসরণ করে এখনকার সংবিধান এবং এই সরকারের তৈরি সিভিল সার্ভিস চার্টার বদলে দিতে পারবে। তেমন অবস্থায় ডবল-ট্রিপল প্রমোশন পাওয়া আমলারা হয়তো পথে বসবেন।
সরকার বাস্তববিমুখ, আত্মপ্রতারক
দূরদৃষ্টির অপবাদ এই সরকারকে কেউ কখনো দেয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে, তারা এখন বাস্তববিমুখ হয়ে পড়েছেন, আত্মপ্রতারণায় ভুগছেন। প্রধানমন্ত্রীর উক্তিগুলো বিবেচনা করলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেছেন ‘খালেদা জিয়ার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেছে’। বাস্তবে আমরা কী দেখছি? খালেদার জনসভায় জনসমাগম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নীলফামারীর সভায় এমন বিশাল সমাগম হবে বলে কি ক্ষমতাসীনেরা কল্পনা করতে পারতেন আগে? সরকারের মন্ত্রীরা, আওয়ামী লীগের নেতারা সকাল-সন্ধ্যা বিএনপির মৃত্যু ঘোষণা প্রচার করে চলেছেন। সত্যি বটে, বিএনপির ভেতরে কিছু কাঠামোগত সমস্যা আছে। মিডিয়ার খবর থেকেই আমরা বুঝতে পারি, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আরো বেশি। এমন দিন কমই যায় যেদিন আওয়ামী লীগ ও শাখা-প্রশাখাগুলোর ‘গৃহযুদ্ধে’ কারো-না-কারো হতাহত হওয়ার খবর পত্রিকার পাতায় দেখা যায় না। সরকারপক্ষের লোকেরা যত প্রতিবাদই করুক, যতই তারা গায়ের জোরে বিদ্রƒপ করুক, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।
 পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে আরো একটি সত্য বেরিয়ে আসবে। সরকার এবং শাসক দল ও গোষ্ঠী যাদেরই সমালোচনা করছে, তাদের জনপ্রিয়তা ততই বেড়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক পিয়াস করিমকে নিয়ে ইতরামির কথা ভুলে গেছেন কেউ? শহীদ মিনারকে বাপের সম্পত্তি দাবি করে তার লাশ ভক্ত ও অনুসারীদের শ্রদ্ধানিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে রাখতে দেয়নি ওরা। কিন্তু মানুষের উদ্বেলিত শোক ও শ্রদ্ধানিবেদনের দৃশ্য কি মন্ত্রীদের এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের চোখে পড়েনি? দেশের মানুষ শাসকগোষ্ঠীর ক্ষুদ্রতায় ছি ছি করেছে। জানতে পেরেছি আওয়ামী লীগের এবং সেকুলারিজমের বহু সমর্থকও মৃতদের নিয়ে রাজনীতি করার, তাদের স্মৃতিকে অশ্রদ্ধা দেখানোর এই প্রবণতায় খুবই ব্যথিত হয়েছেন।
এর আরেকটা জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত দেখা গেছে গোলাম আযমের বেলায়। তার জানাজার নামাজ পরিচালনার বেলায় সরকার ভেটো প্রয়োগ করেছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের এবং মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ দাবি করেছেন, গোলাম আযমকে যেন বাংলাদেশের মাটিতে কবর দিতে দেয়া না হয়। বাংলাদেশের মাটিকেও তারা পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেন। এর কী জবাব বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে, সেটা লক্ষ করার দূরদৃষ্টি কি তাদের আছে? গোলাম আযমের জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য দেশের দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ ঢাকায় এসেছে। বায়তুল মোকাররমে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ হয়েছে এ জানাজায়। দেশের আরো বহু স্থানে, ইউরোপ-আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার বহু শহর-নগরেও হয়েছে গায়েবানা জানাজা। বহু স্থানে মানুষ দীর্ঘ সারি দিয়ে শোকগ্রন্থে স্বাক্ষর করেছে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ এখন একটা নীরব প্রতিবাদ শুরু করেছে। শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা যা বলবেন, তার বিরুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যেন মানুষ নিয়ে ফেলেছে।
এরা হারুনুর রশিদ নন
ভবিষ্যতে যখন নির্বাচন হবে, তখন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্যও মানুষ খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে ভোট দেবে। সরকারও সেটা জানে এবং জানে বলেই বিএনপি নেতাদের ভবিষ্যৎ নির্বাচন থেকে বঞ্চিত রাখার কোনো চেষ্টারই তারা ত্রুটি রাখছেন না। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির পাঁচ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ১৭২টি ভুয়া মামলা সে চেষ্টারই অংশমাত্র। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ পাগল নয় যে, এসব ভুয়া অভিযোগ তারা বিশ্বাস করবে। শীর্ষ নেতারা বাংলামোটরে গিয়ে গাড়িতে আগুন লাগাচ্ছেন, এয়ারপোর্ট রোডে গাড়ি ভাঙচুর করছেন কিংবা সচিবালয়ে পটকা ছুড়ছেনÑ এমন কথা বদ্ধ পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশের কিছু মানুষেরও মনে আছে, শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলায় গিয়েছিলেন, পাকিস্তানিরা তাকে কয়েদ করেছিল, নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুজিবকে নিয়েই ১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যেকোনো মনস্তত্ত্ববিদ আপনাকে বলে দেবে, মিথ্যা বলতে বলতে মিথ্যাবাদী এতই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, নিজেকেও সে মিথ্যা বলতে শুরু করে; অন্যকে প্রতারণা করার একপর্যায়ে প্রতারক নিজেকেও প্রতারণা করতে শুরু করে। বর্তমান সরকারেরও হয়েছে সেই দশা। তারা মনে করেন, তাদের নেত্রী একজন পরীÑ তিনি দেশে-বিদেশে উড়ে গিয়ে জাদুর কাঠি ছু্ইঁয়ে দিয়ে আসবেন আর সেসব দেশই বাংলাদেশের প্রেমে আবিষ্ট হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী যে দেশে যাচ্ছেন, যে নেতার সাথে কথা বলছেন কিংবা ফটোসেশন করছেন, তারা তাকে পরামর্শ দিচ্ছেন দ্রুত ‘সংলাপের মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন দিতে। কিন্তু দেশে ফিরে তারা দাবি করেন, সবাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী রঙ্গ-তামাশাকে মেনে নিয়েছে, উপভোগ করেছে।
সরকার বলছে, বহু দেশ বাংলাদেশকে অর্থ সাহায্য করবে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে এবং লাখে লাখে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ করবে বলে ‘আভাস পাওয়া গেছে’। কিন্তু আভাসে মানুষের পেট ভরে না। বেকার শ্রমিক আর আশ্বাস পায় না। দেশে রেমিট্যান্স আসে না। এ সরকার খলিফা হারুনুর রশিদের সেই কাহিনীর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। এক রাতে খলিফা তার অমাত্যকে নিয়ে ছদ্মবেশে বাগদাদ নগরীর প্রকৃত অবস্থা দেখতে বেরিয়েছিলেন। এক জায়গায় দেখেন এক মা হাঁড়িতে পাথর সেদ্ধ করছেন আর ক্ষুধার্ত সন্তানদের বলছেন, শিগগিরই রান্না হয়ে গেলে তারা পেট ভরে খেতে পারবে। শিশুরা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়বে বলে আশা করছিলেন সে মা। খলিফা ও অমাত্য গিয়ে দ্রুত কিছু খাবার নিয়ে এলেন, পেটপুরে খেয়েছিল পরিবারটি। হায়! আজকের বাংলাদেশ রূপকথার দেশ নয়, আর শাসকও হারুনুর রশিদ নন।
লন্ডন, ২৮.১০.১৪
serajurrahman34@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.