এখন বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার পালা by এ কে এম জাকারিয়া

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি তো দূরে থাক, দুর্নীতির ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েছিল বলে যে অভিযোগ উঠেছিল, সেটাও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা বা এ মামলায় অভিযুক্ত বলে এখন আর কেউ নেই। দুদক চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সবাইকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানালে আদালত তা গ্রহণ করে সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেন।
দুদককে অনেকেই এখন আর দুর্নীতি দমন কমিশন হিসেবে দেখেন না। কোনো কোনো সমালোচক এর নতুন নাম দিয়েছেন ‘দায়মুক্তি কমিশন’। কারণ, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের যে লোকজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, তদন্ত করে দুদক খুবই দ্রুততার সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগের দায় থেকে তাঁদের মুক্তি দিচ্ছে। তবে দুদক শুধুই দায়মুক্তির কাজ করছে, এমনটি কি বলা যায়? বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকজন, যাঁরা আগে কোনো না কোনো সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা তো ঠিক আটকে যাচ্ছেন। সমালোচকেরা যা-ই বলুক, দুদক বা ‘দায়মুক্তি কমিশন’ তাদের কাজ করে যাচ্ছে। আর দুর্নীতির প্রমাণ যদি না পাওয়া যায়, তবে তারা করবেই বা কী!
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলায় দুদক সবাইকে দায়মুক্তি দিল কেন? দুদকের যুক্তি খুবই সহজ, দেড় বছরেরও বেশি সময়ের তদন্তে মামলাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য পাওয়া না যাওয়ায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া যায়নি। অভিযুক্তদের বিষয়ে কোনো তথ্য–প্রমাণ না পেলে তাঁদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তবে দুদক এটাও বলেছে, যদি কানাডা থেকে রমেশ শাহর ‘কথিত ডায়েরি’ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, তাহলে নতুন করে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিন পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শকের কাজ পেতে বাংলাদেশের যে কর্তাব্যক্তিদের ঘুষ দিতে চেয়েছিল, তাঁদের নাম ওই ডায়েরিতে রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দুদকের দুই কর্মকর্তা এ নিয়ে খোঁজখবর করতে গত বছর কানাডা ঘুরে এসেছেন, কিন্তু তাঁরা কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি।

দুদক যত সহজে কাজটি সেরে ফেলল, বিষয়টি কি আসলে তত সহজ! দুদক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের যতই দায়মুক্তি দিক না কেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে কিন্তু নিজেরই দায়মুক্তি ঘটছে না। দুদক এখন বলছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ দুদক একসময় আনুষ্ঠানিকভাবেই স্বীকার করেছিল যে তাদের নিজস্ব তদন্তে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিলেছে। আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য ও তথ্য–প্রমাণ জোগাড় করতে আরও অপেক্ষা করতে অসুবিধা ছিল কোথায়?
পাঠকদের অনেকেই জানেন যে রমেশ শাহের যে ‘কথিত ডায়েরি’র কথা বলা হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে কানাডার আদালতে মামলা চলছে। এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত ও কয়েক দফা শুনানি শেষে গত বছরের এপ্রিলে কানাডার আদালত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করেছেন। কানাডার অন্টারিওর কোর্ট অব জাস্টিস আগামী বছরের (২০১৫) ১৩ এপ্রিল পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরুর দিন ঠিক করেছেন। তদন্ত ও বিচারপূর্ব শুনানিতে বিচারযোগ্য বিবেচিত না হলে মামলটি গ্রহণ ও শুনানির তারিখ ঠিক হতো না। দুদকের তদন্তের সবকিছু যখন রমেশ শাহের ডায়েরিতে এসে ঠেকেছে, তখন মামলা শেষ করে না দিয়ে বা সবাইকে দায়মুক্তি না দিয়ে কানাডার মামলা শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই তো হতো!
কিন্তু ক্ষমতাসীনদের দায়মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া দুদক তা করবে কেন? যত তাড়াতাড়ি পারো মামলা গোটাও, দায়মুক্তি দাও। পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম শেষ করে দিয়ে যে সাতজনকে দায়মুক্তি দেওয়া হলো, তাঁদের মধ্যে এসএনসি-লাভালিনেরও তিনজন রয়েছেন। আগামী বছরের এপ্রিলে কানাডার আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শুরু হবে। যাঁরা ঘুষ দিতে চাইলেন, কাকে কত ঘুষ দিতে হবে, সেই হিসাব ডায়েরিতে লিখে রাখলেন, সেই বেচারারা এখনো বাঁচতে পারলেন না। আর যাঁদের ঘুষ নেওয়ার কথা, তাঁরা এখন পুরোই মুক্ত।
দুর্নীতি দমন কমিশন পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাক বা না পাক, বিশ্বব্যাংক যে কারণগুলো বিবেচনায় নিয়ে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে নিষিদ্ধ করেছে, তার মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ রয়েছে। কম্বোডিয়ায় বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট একটি প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টিকেও নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী এসএনসি-লাভালিন ইনকরপোরেটের শতাধিক প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত হবে, এমন কোনো প্রকল্পে কোনোভাবেই জড়িত থাকতে পারবে না। (বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩)। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘অসদাচরণ’ এবং কম্বোডিয়ায় বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে লাভালিনের ওপর বিশ্বব্যাংকের এই শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা লাভালিন মেনে নিয়েছে। বিবৃতি দিয়ে দুর্নীতির কথা স্বীকারও করেছে। কানাডায় আগামী এপ্রিলে বিচার শুরু হলে সবকিছু আরও পরিষ্কার হতে শুরু করবে। কানাডায় যা হওয়ার তা হোক, আমরা আপাতত দেশের দিকে মনোযোগী হই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক করছে, বাংলাদেশ সরকার ও এর কর্তাব্যক্তিরা শুরু থেকেই তা অস্বীকার করে আসছেন। বরং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে উল্টো অভিযোগ করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন। ‘স্বাধীন’ দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ মেলেনি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই এখন দায়মুক্ত আর এ নিয়ে করা মামলাটিও শেষ হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের ‘মিথ্যা’ অভিযোগের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হলো, তার কী হবে? বিশ্বব্যাংকের একটি সদস্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে দেশ ও সরকারকে এভাবে নাজেহাল করার প্রতিকার চাওয়ার। ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ করে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় বাংলাদেশ যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে, তার একটি হিসাব-নিকাশ করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সে অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া এখন সরকারের দায়িত্ব।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কারণে শুধু দেশ বা সরকার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক ব্যক্তিও। মন্ত্রী ও সচিবেরা তাঁদের পদ খুইয়েছেন। মান-সম্মানের যে ক্ষতি হয়েছে, তা তো অপূরণীয়! সরকারকে তা কিছুটা হলেও পূরণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সসম্মানে তাঁদের পদ ও চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া। আশা করি সরকার তা করতে দ্বিধা করবে না। আর ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এই অভিযুক্তদেরও উচিত বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাওয়া। আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব গেছে তো কার্যত বিশ্বব্যাংকের চাপ আর শর্তের কারণে।‘জবাবদিহি’ করার জন্য মোটা মোটা বই লেখার চেয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করাটা তাঁর জন্য এখন বেশি জরুরি।
সরকার বা দায়মুক্তি পাওয়া অভিযুক্তরা কি বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার পথ ধরবেন? তেমন নৈতিক মনের জোর কি তাঁদের আছে? নাকি দুদকের দায়মুক্তি ও সেই সূত্রে মামলা শেষ হয়ে যাওয়া নিয়েই বগল বাজাতে থাকবেন? দুদক পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মামলাটি শেষ করে দেওয়ার পর দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসিকে বলেছেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিতর্ক এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এই বিতর্ক চলতেই থাকবে এবং সেটার দায়ভার দুদকের ওপর থাকবে।
কানাডায় এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই বিতর্ক আসলেই থামবে না। আপাতত সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে খোদা না করুন, সেই মামলায় যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তখন ঘুষ দিতে আগ্রহীদের শাস্তিই হয়তো নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বসে যাঁরা ঘুষ পেতে যাচ্ছিলেন, তাঁরা কি দায়মুক্তই থেকে যাবেন? দুদক তখন নিজেকে দায়মুক্ত করবে কীভাবে?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.