শ্রদ্ধাঞ্জলি- অনন্য মাওলা বখশ চাচা by আসজাদুল কিবরিয়া
আবুল ফয়েজ সালাহ্উদ্দীন আহমদ। পারিবারিকভাবে আমাদের বাবা-চাচাদের মাওলা বখশ ভাইয়া। সেই সুবাদে আমাদের মাওলা বখশ চাচা, কারও মাওলা বখশ মামা। এমন একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে এই পারিবারিক সূত্রেই। ছোটবেলায় স্কুলের ছাত্রাবস্থায় তাঁকে প্রথম যখন দেখি, তখন তাঁকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না। আমার পিতার আপন চাচাতো ভাই এবং এই ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড়, এটাই ছিল প্রাথমিক জানাবোঝা।
মাওলা বখশ চাচার খুব কাছাকাছি প্রথম আসি ১৯৮৭ সালে। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ফখরুদ্দীন আহমদ তখন পররাষ্ট্রসচিব। সম্ভবত ওই সময় সরকারের একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে সচিব ও জ্যেষ্ঠ আমলারা নিজ নিজ গ্রাম ও এলাকা পরিদর্শনে যাবেন। তারই অংশ হিসেবে ফখরু চাচা তাঁর আরও কয়েক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের আদি নিবাসে যাওয়ার আয়োজন করেন। তিন দিনের সেই সফরে মাওলা বখশ চাচার সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। আরও ছিলেন আমার আব্বার দুই বড় ভাই ফজলে রাব্বি (জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক) এবং বজলে রাব্বি (সাবেক ব্যাংকার) ও তাঁর দুই ছেলে। সম্ভবত সেটাই মাওলা বখশ চাচার নিজ গ্রামে শেষবারের মতো যাওয়া। ফখরুদ্দীন আহমদ আবার বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। তিনি ইন্তেকাল করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তাঁদের আরেক ভাই মহিউদ্দীন আহমদ বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী। বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে।
আদি নিবাসের কথা যখন এল, তখন সালাহ্উদ্দীন আহমদের পূর্বপুরুষের পরিচয়সূত্রটা স্পষ্টভাবে বলা দরকার। নিজে সারা জীবন নির্মোহভাবে কাটিয়েছেন বলেই বোধ হয় এ বিষয়ে তেমন কথা বলেননি। হয়তো ভেবেছিলেন, ব্যক্তির পারিবারিক বংশ-পরিচয়ের চেয়ে সমাজ–জাতির বৃহত্তর পরিচয়টা বেশি তাৎপর্যবাহী। এই ঔদার্যের ফলে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের শুভানুধ্যায়ী, গুণগ্রাহী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই জানেন না যে তাঁর পিতামহ মৌলভি আহমদ অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েটদের একজন। আহমদের পিতা মুন্সি ফইজুদ্দীন এখন থেকে দেড় শ বছরের বেশি সময় আগে আজকের গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রাম থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। উপলব্ধি করেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে পিছিয়েই থাকতে হবে। সে কারণেই পুত্র আহমদকে কলকাতায় পড়ালেখা করিয়েছিলেন।
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ ও এমএ পাস করে মৌলভি আহমদ হয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। অবশ্য তার আগে কিছুকাল শিক্ষকতা ও স্কুল পরিদর্শকের কাজ করেছিলেন। মেদিনীপুর, ফেনী ও ময়মনসিংহে কর্মজীবন কেটেছে। ফেনীতে এসডিও অবস্থায় একটি স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। আর ময়মনসিংহে সম্ভবত এসডিও অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় অকালমৃত্যু হয় মৌলভি আহমদের। সেটা ১৯১৩ সালে। তাঁর তখন এক কন্যা ও তিন পুত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্র আবু আহমেদ ফয়জুল মহীই হলেন সালাহ্উদ্দীন আহমদের বাবা। অন্যদিকে তাঁর মাতামহ বিহারের মতিহারি নিবাসী কাজী আজিজুল হক ছিলেন ফিঙ্গারপ্রিন্টের অন্যতম আবিষ্কারক, যা কিনা শত বছর ধরে অস্বীকৃত ছিল। ঘটনাচক্রে পিতামহ মৌলভি আহমদের মৃত্যুর ১০১ বছর পর এ বছরের ১৯ অক্টোবর তাঁরই জ্যেষ্ঠ পৌত্র সালাহ্উদ্দীন আহমদ চিরবিদায় নিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২২ সালে ফরিদপুরে। তাঁর বাবা-চাচারা তখন ফরিদপুর শহরে বসবাস করতেন। তবে বাঁশবাড়িয়া গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। পরবর্তীকালে চাচার ভাইবোনেরা অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান।
স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন বনানীতে মাওলা বখশ চাচার বাসায় গিয়ে সারা দিন তাঁর সঙ্গে কাটালাম, সেদিন তিনি আমার হাতে তাঁর বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইটি তুলে দেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা বোঝার জন্য এটি আসলেই একটি অসাধারণ গ্রন্থ। ১২টি প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংকলন এই বইতে সালাহ্উদ্দীন আহমদ তত্ত্ব-তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতার একটি চূড়ান্ত রূপ। তার মৃত্যুর পর বাসায় বইটি খুলে দেখলাম তাঁর স্বাক্ষরটি ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসের। অর্থাৎ আজ থেকে ২০ বছর আগে আমি মাওলা বখশ চাচার সান্নিধ্যে আসতে শুরু করি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেদিন দুপুরে চাচা-চাচির সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি। চাচি হামিদা খানমের কথাও একটু বলা দরকার। কলকাতার বেথুন কলেজের প্রথম দিককার মুসলমান ছাত্রীদের একজন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে ব্রিটিশ আমলেই বিলেত গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার্থে। প্রখর ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন চাচিও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গেছেন। সর্বশেষ ছিলেন ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষ। চাচার আগেই চাচি বিদায় নিয়েছেন। সেটা ২০১২ সালে। তাঁর বড় ভাই মরহুম আবদুল আহাদ হলেন বিখ্যাত সুরকার ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ।
মাওলা বখশ চাচার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল মাঝখানে কয়েক বছর। তবে পারিবারিক বিভিন্ন আয়োজনে যেখানেই আমাকে দেখতেন, সস্নেহে কাছে টেনে নিতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন নানা বিষয়ে। পড়তে বলতেন বিভিন্ন বইপত্র। আর তাঁর বাসায় গেলে আলাপচারিতায় সব সময়ই বলতেন মুক্তমনে চিন্তা করতে। তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন ধর্মনিরপেক্ষতায়। শুধু মুখের কথায় নয়, জীবনজুড়ে তিনি ও চাচি এই বিশ্বাসের লালন ও চর্চা করেছেন। ধর্মপরিচয়ের চেয়ে মানুষের পরিচয় তাঁদের কাছে সব সময়ই অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর তাই ধর্মানুরাগ বা ধর্মের অনুশাসন যাঁরা অনুসরণ করতেন, কোনো রকম বিরাগের বাইরে থেকে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখতেন। আর স্পষ্টতই ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করতেন।
বস্তুত, মাওলা বখশ চাচা আমাদের শিখিয়েছিলেন ও বুঝিয়েছিলেন যে বাঙালির ইতিহাসে ইসলামের যে প্রভাব, তার মধ্যে সমন্বয়বাদী ধারাটিই মানবমুখী ধারা। অর্থাৎ মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়েও মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিলে জীবন যাপন করা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার চর্চা করার মাধ্যমেই শত শত বছর ধরে এই ভূখণ্ডে বাঙালি মুসলমানের আলোকিত মানসলোক গড়ে উঠেছে। এর বিপরীতে রক্ষণশীল গোঁড়াপন্থী ধারায় বিশ্বাসী মুসলমানরা বরাবরই গোটা সম্প্রদায়কে পেছনে টেনে রেখেছে, কূপমণ্ডূকতায় নিমজ্জিত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িকতার শিকলে বেঁধে রাখতে চেয়েছে। মাওলা বখশ চাচা এ বিষয়েও সব সময় আমাদের সতর্ক করেছেন। ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতায় সচেষ্ট থেকেছেন সব সময়। জগন্নাথ কলেজ থেকে অধ্যাপনা শুরু করে পরবর্তী সময়ে ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের মূল পরিকল্পক তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ক্যাসেটবন্দী করে তা পরবর্তী সময়ে লিখিত রূপ দেওয়ার একটি কাজে তিনি আমাকেও সম্পৃক্ত করেছিলেন। আমি কয়েকটি ক্যাসেটের শ্রুতিলিখন করেছিলাম।
মাওলা বখশ চাচার সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাৎ এ বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর। ওই তারিখে সন্ধ্যার পর আমরা বেশ কয়েকজন তাঁর বাসায় জড়ো হয়েছিলাম। অনেক খানাদানার আয়োজন ছিল। চাচার দীর্ঘদিনের সহকারী অমল ও শিল্পী যাবতীয় রান্নাবান্না ও আপ্যায়নের সবকিছু করত। অমলের ছেলে আশীষ চাচার আত্মজীবনীর শ্রুতিলিখন করেছে। চাচার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের সময় এরা তিনজনই পাশে ছিল। এই তিনজন চাচার পরম আত্মীয় বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশেষত, অমলকে চেনে না, চাচার এমন কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গুণগ্রাহী বা ছাত্রছাত্রী নেই বললেই চলে।
ওই দিন চাচা বারবার করে সবার খাওয়া ঠিকমতো হয়েছে কি না, তার খোঁজ নিচ্ছেলেন। চলে আসার আগে আমার সহধর্মিণীর মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দেন। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য যেন এভাবেই সবাইকে আশ্বস্ত করতেন, ভরসা দিতেন। সেই হাতটি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
মাওলা বখশ চাচার খুব কাছাকাছি প্রথম আসি ১৯৮৭ সালে। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ফখরুদ্দীন আহমদ তখন পররাষ্ট্রসচিব। সম্ভবত ওই সময় সরকারের একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে সচিব ও জ্যেষ্ঠ আমলারা নিজ নিজ গ্রাম ও এলাকা পরিদর্শনে যাবেন। তারই অংশ হিসেবে ফখরু চাচা তাঁর আরও কয়েক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের আদি নিবাসে যাওয়ার আয়োজন করেন। তিন দিনের সেই সফরে মাওলা বখশ চাচার সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। আরও ছিলেন আমার আব্বার দুই বড় ভাই ফজলে রাব্বি (জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক) এবং বজলে রাব্বি (সাবেক ব্যাংকার) ও তাঁর দুই ছেলে। সম্ভবত সেটাই মাওলা বখশ চাচার নিজ গ্রামে শেষবারের মতো যাওয়া। ফখরুদ্দীন আহমদ আবার বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। তিনি ইন্তেকাল করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তাঁদের আরেক ভাই মহিউদ্দীন আহমদ বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী। বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে।
আদি নিবাসের কথা যখন এল, তখন সালাহ্উদ্দীন আহমদের পূর্বপুরুষের পরিচয়সূত্রটা স্পষ্টভাবে বলা দরকার। নিজে সারা জীবন নির্মোহভাবে কাটিয়েছেন বলেই বোধ হয় এ বিষয়ে তেমন কথা বলেননি। হয়তো ভেবেছিলেন, ব্যক্তির পারিবারিক বংশ-পরিচয়ের চেয়ে সমাজ–জাতির বৃহত্তর পরিচয়টা বেশি তাৎপর্যবাহী। এই ঔদার্যের ফলে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের শুভানুধ্যায়ী, গুণগ্রাহী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই জানেন না যে তাঁর পিতামহ মৌলভি আহমদ অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েটদের একজন। আহমদের পিতা মুন্সি ফইজুদ্দীন এখন থেকে দেড় শ বছরের বেশি সময় আগে আজকের গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রাম থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। উপলব্ধি করেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে পিছিয়েই থাকতে হবে। সে কারণেই পুত্র আহমদকে কলকাতায় পড়ালেখা করিয়েছিলেন।
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ ও এমএ পাস করে মৌলভি আহমদ হয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। অবশ্য তার আগে কিছুকাল শিক্ষকতা ও স্কুল পরিদর্শকের কাজ করেছিলেন। মেদিনীপুর, ফেনী ও ময়মনসিংহে কর্মজীবন কেটেছে। ফেনীতে এসডিও অবস্থায় একটি স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। আর ময়মনসিংহে সম্ভবত এসডিও অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় অকালমৃত্যু হয় মৌলভি আহমদের। সেটা ১৯১৩ সালে। তাঁর তখন এক কন্যা ও তিন পুত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্র আবু আহমেদ ফয়জুল মহীই হলেন সালাহ্উদ্দীন আহমদের বাবা। অন্যদিকে তাঁর মাতামহ বিহারের মতিহারি নিবাসী কাজী আজিজুল হক ছিলেন ফিঙ্গারপ্রিন্টের অন্যতম আবিষ্কারক, যা কিনা শত বছর ধরে অস্বীকৃত ছিল। ঘটনাচক্রে পিতামহ মৌলভি আহমদের মৃত্যুর ১০১ বছর পর এ বছরের ১৯ অক্টোবর তাঁরই জ্যেষ্ঠ পৌত্র সালাহ্উদ্দীন আহমদ চিরবিদায় নিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২২ সালে ফরিদপুরে। তাঁর বাবা-চাচারা তখন ফরিদপুর শহরে বসবাস করতেন। তবে বাঁশবাড়িয়া গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। পরবর্তীকালে চাচার ভাইবোনেরা অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমান।
স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন বনানীতে মাওলা বখশ চাচার বাসায় গিয়ে সারা দিন তাঁর সঙ্গে কাটালাম, সেদিন তিনি আমার হাতে তাঁর বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বইটি তুলে দেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা বোঝার জন্য এটি আসলেই একটি অসাধারণ গ্রন্থ। ১২টি প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংকলন এই বইতে সালাহ্উদ্দীন আহমদ তত্ত্ব-তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতার একটি চূড়ান্ত রূপ। তার মৃত্যুর পর বাসায় বইটি খুলে দেখলাম তাঁর স্বাক্ষরটি ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসের। অর্থাৎ আজ থেকে ২০ বছর আগে আমি মাওলা বখশ চাচার সান্নিধ্যে আসতে শুরু করি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেদিন দুপুরে চাচা-চাচির সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি। চাচি হামিদা খানমের কথাও একটু বলা দরকার। কলকাতার বেথুন কলেজের প্রথম দিককার মুসলমান ছাত্রীদের একজন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে ব্রিটিশ আমলেই বিলেত গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার্থে। প্রখর ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন চাচিও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গেছেন। সর্বশেষ ছিলেন ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষ। চাচার আগেই চাচি বিদায় নিয়েছেন। সেটা ২০১২ সালে। তাঁর বড় ভাই মরহুম আবদুল আহাদ হলেন বিখ্যাত সুরকার ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ।
মাওলা বখশ চাচার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল মাঝখানে কয়েক বছর। তবে পারিবারিক বিভিন্ন আয়োজনে যেখানেই আমাকে দেখতেন, সস্নেহে কাছে টেনে নিতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন নানা বিষয়ে। পড়তে বলতেন বিভিন্ন বইপত্র। আর তাঁর বাসায় গেলে আলাপচারিতায় সব সময়ই বলতেন মুক্তমনে চিন্তা করতে। তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন ধর্মনিরপেক্ষতায়। শুধু মুখের কথায় নয়, জীবনজুড়ে তিনি ও চাচি এই বিশ্বাসের লালন ও চর্চা করেছেন। ধর্মপরিচয়ের চেয়ে মানুষের পরিচয় তাঁদের কাছে সব সময়ই অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর তাই ধর্মানুরাগ বা ধর্মের অনুশাসন যাঁরা অনুসরণ করতেন, কোনো রকম বিরাগের বাইরে থেকে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখতেন। আর স্পষ্টতই ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করতেন।
বস্তুত, মাওলা বখশ চাচা আমাদের শিখিয়েছিলেন ও বুঝিয়েছিলেন যে বাঙালির ইতিহাসে ইসলামের যে প্রভাব, তার মধ্যে সমন্বয়বাদী ধারাটিই মানবমুখী ধারা। অর্থাৎ মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়েও মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিলে জীবন যাপন করা, সহিষ্ণুতা ও উদারতার চর্চা করার মাধ্যমেই শত শত বছর ধরে এই ভূখণ্ডে বাঙালি মুসলমানের আলোকিত মানসলোক গড়ে উঠেছে। এর বিপরীতে রক্ষণশীল গোঁড়াপন্থী ধারায় বিশ্বাসী মুসলমানরা বরাবরই গোটা সম্প্রদায়কে পেছনে টেনে রেখেছে, কূপমণ্ডূকতায় নিমজ্জিত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িকতার শিকলে বেঁধে রাখতে চেয়েছে। মাওলা বখশ চাচা এ বিষয়েও সব সময় আমাদের সতর্ক করেছেন। ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতায় সচেষ্ট থেকেছেন সব সময়। জগন্নাথ কলেজ থেকে অধ্যাপনা শুরু করে পরবর্তী সময়ে ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের মূল পরিকল্পক তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার ক্যাসেটবন্দী করে তা পরবর্তী সময়ে লিখিত রূপ দেওয়ার একটি কাজে তিনি আমাকেও সম্পৃক্ত করেছিলেন। আমি কয়েকটি ক্যাসেটের শ্রুতিলিখন করেছিলাম।
মাওলা বখশ চাচার সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাৎ এ বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর। ওই তারিখে সন্ধ্যার পর আমরা বেশ কয়েকজন তাঁর বাসায় জড়ো হয়েছিলাম। অনেক খানাদানার আয়োজন ছিল। চাচার দীর্ঘদিনের সহকারী অমল ও শিল্পী যাবতীয় রান্নাবান্না ও আপ্যায়নের সবকিছু করত। অমলের ছেলে আশীষ চাচার আত্মজীবনীর শ্রুতিলিখন করেছে। চাচার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের সময় এরা তিনজনই পাশে ছিল। এই তিনজন চাচার পরম আত্মীয় বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশেষত, অমলকে চেনে না, চাচার এমন কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গুণগ্রাহী বা ছাত্রছাত্রী নেই বললেই চলে।
ওই দিন চাচা বারবার করে সবার খাওয়া ঠিকমতো হয়েছে কি না, তার খোঁজ নিচ্ছেলেন। চলে আসার আগে আমার সহধর্মিণীর মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দেন। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য যেন এভাবেই সবাইকে আশ্বস্ত করতেন, ভরসা দিতেন। সেই হাতটি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments