হরতালে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ৬০০
বিক্ষিপ্ত মিছিল সমাবেশ, সড়ক অবরোধ, গাড়ি
ভাঙচুর, আগুন, পুলিশের হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন ঘটনার
মধ্য দিয়ে জামায়াতের ডাকা ৭২ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিন শেষ হয়েছে। দলের আমীর
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের প্রতিবাদে বুধবার জামায়াত
এই হরতালের ডাক দেয়। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার ভোর থেকে হরতাল
শুরু হয়। হরতাল চলাকালে রাজধানীর জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক ছিল। সরকারি-
বেসরকারি অফিস-আদালত খোলা ছিল। রাজধানীতে সকালে বিভিন্ন সড়কে বিপুল সংখ্যক
গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে। ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারে গাড়ির চাপে
যানজটও সৃষ্টি হয়েছে। তবে রাজধানীর বাইরে হরতাল পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন দেখ
গেছে। রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ,
মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, পঞ্চগড়, নোয়াখালী, নওগাঁসহ সারা দেশে হরতালের পক্ষে
ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে। এসব এলাকায় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার
হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। খিলগাঁও ও চকবাজারে শিবিরকর্মীরা ঝটিকা
মিছিল করেছেন। এ সময় দু’টি ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে রাজধানীর
বাসস্ট্যান্ডগুলো থেকে দূরপাল্লার কোন যানবাহন ছেড়ে যায়নি। দেশের বিভিন্ন
স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের
ছয় শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা
হয়। এছাড়া বিভিন্নস্থানে পুলিশের হামলায় দেয় শতাধিক আহত হয়েছে বলেও দাবি
করা হয়। দিনের শুরুতে রাজধানীর উত্তরায় মিছিল করেছে শিবির। এ সময় শিবির
কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ১০ শিবির কর্মী
আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ শিবির কর্মীকে আটক করে। সকাল ১১টায়
রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখান এলাকা থেকে শিবির ঢাকা মহানগরী উত্তরের
সেক্রেটারি তারিক হাসানের নেতৃত্বে মিছিলটি শুরু হয়ে উত্তরা জসীমউদ্দীন
এলাকার দিকে যাওয়ার মুখে এ ঘটনা ঘটে। সকাল আটটায় রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায়
মিছিল করেছে শিবির। এ সময় শিবির কর্মীরা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ
করে। সকাল সাড়ে ছয়টায় পুরান ঢাকার বকশীবাজার এলাকায় চকবাজার থানা সভাপতি
হেলাল উদ্দিন ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার সভাপতি রেদওয়ান উল্লাহ্র নেতৃত্বে
হরতালের সমর্থনে মিছিল করে শিবির। ৭২ ঘণ্টা হরতালের ১ম দিন রাজধানীর ৩২টি
স্পটে শিবির ঝটিকা মিছিল করে বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়। এ সময় ৯৯
নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করে শিবির। আমাদের প্রতিনিধিদের
পাঠানো রিপোর্টে দেখা যায়, গতকাল লক্ষ্মীপুরে ২৩, বগুড়ায় ৮৭, পাবনায় ৫৮,
মানিকগঞ্জে ৮, সুনামগঞ্জে ৫, ফরিদপুরে ১১, চাঁপাই নবাবগঞ্জে ১১,
মুন্সীগঞ্জে ৬, রাজশাহীতে ২৬, সাভারে ৮, বিশ্বনাথে ১, নোয়াখালীতে ৯,
আমতলীতে ৩, পঞ্চগড়ে ১১, নওগাঁয় ৪, খুলনায় ৩৯ জামায়াত- শিবির নেতা-কর্মী
গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদিকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা.
শফিকুর রহমান গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, সরকারের এই মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড ও
ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ
কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালনকালে দেশের
বিভিন্ন স্থান থেকে জামায়াত-শিবিরের ৬ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা
হয়েছে। পুলিশ রাজশাহীর জনপ্রিয় নেতা আতাউর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। হরতাল
চলাকালে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নওগাঁ, পাবনা, নীলফামারী, নেত্রকোনা, রংপুর, যশোর, চাঁপাই
নবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা,
ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুরসহ সারা দেশে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা ও আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে হামলা চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে সারা
দেশে দেড় শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। গতকাল চাঁপাই নবাবগঞ্জে
জামায়াত-শিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি
চালিয়ে প্রায় ২৫ জনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। আহতদের শিবগঞ্জ উপজেলার
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য
কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবদুর রহমান, মেডিকেল অফিসার ডা.
আসিয়া ফেরদৌসী ও সিনিয়র সহকারী শরিফুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে
যায়। স্বৈরাচারী সরকার আহতদের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে ও কর্তব্যরত
ডাক্তারকে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দিয়ে চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ
করেছে। এ সরকার আহতদেরকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে যে অপরাধ করেছে তার জন্য
জনতার আদালতে তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিল ও সমাবেশ
জামায়াতের ডাকা ৭২ ঘণ্টা হরতালের প্রথমদিনে সরব ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে হরতাল বিরোধী মিছিল নিয়ে আসেন নেতা-কর্মীরা। পরে তারা মানববন্ধন ও সমাবেশে অংশ নেন। প্রায় সারাদিনই এ চিত্র দেখা গেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সকাল ১০ টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের মিছিল নিয়ে আসার চিত্র। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক জোট, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফ্রন্ট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদ, আওয়ামী হকার্স লীগের ব্যানারে পৃথক সমাবেশ হয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন প্রমুখ। যুবলীগের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন- যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাঈনুদ্দিন রানা, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা প্রমুখ। এদিকে সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক জোটের মানববন্ধনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিচার দাবি করেছেন দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে হরতাল বিরোধী মিছিলপূর্ব সমাবেশে তিনি এ দাবি জানান। মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে মায়া বলেন, নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গালে চপেটাঘাত করার দায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ারও বিচার হবে। চুরি যে করে আর চুরির মাল যে রাখে দু’জনকেই চোর হিসেবে শাস্তি ভোগ করতে হয়। সারা দেশে হরতাল পালিত হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, নিজামীর ফাঁসির রায় হওয়ায় খালেদা জিয়া জামায়াতের হরতালে নীরব সমর্থনও দিয়েছেন। এজন্য একসময় বাংলাদেশের মানুষ তাকে চপেটাঘাত করবে। খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, নিজামীর রায় ও জামায়াতের হরতালে মুখে কুলুপ এঁটেছেন বিএনপি নেত্রী ও দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তাদের এ নীরবতায় প্রমাণ করে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে তারাই হরতাল দিয়েছে। এরপর মায়ার নেতৃত্বে একটি মিছিল গুলিস্তান, জিরো পয়েন্ট, সচিবালয়, প্রেস ক্লাব এলাকা প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে শেষ হয়।
No comments