মহররম ও আশুরা by মুসলিহুদ্দীন আহমাদ রূমী
মহররম মাস, ইসলামি বছর শুরু হয় এই মাস
দ্বারা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে চারটি মাসকে বিশেষভাবে সম্মান দান করেছেন
মহররম মাস তার অন্যতম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর
বিধান ও গণনায় মাস বারোটি আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে
চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এতে তোমরা নিজেদের প্রতি
অত্যাচার করো না’ (সূরা তাওবা : ৩৬)।
ওপরে উল্লিখিত আয়াতে সম্মানিত মাসগুলো কী তা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস শরিফে বলে দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব (সহিহ বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড, ৬৭২)।
মহররম শব্দের অর্থ হচ্ছে যাকে ‘হুরমত’ প্রদান করা হয়েছে। আরবি ভাষায় হুরমত বলা হয় সম্মান, মর্যাদা, মাহাত্ম ও পবিত্রতাকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই মাসকে বিশেষ সম্মান দান করেছেন।
হজরত ইবরাহিম আ:-এর শরিয়তেও অন্যান্য নবীগণের মতো এই মাসগুলোর সম্মান-মর্যাদা স্বীকৃত ছিল এবং এগুলোতে জায়েজ উদ্দেশ্যও যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম ছিল। মক্কার মুশরিকরা নিজেদের হজরত ইবরাহিম আলাইহিসসালামের অনুসারী দাবি করত, এবং তাদের মধ্যে হজরত ইবরাহিম আ:-এর অনেক কথার প্রচলন ছিল। যদিও বাস্তবতা ছিল এর ভিন্ন, যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের এই অসার দাবি খণ্ডন করেছেন এই বলে, ‘তিনি (হজরত ইবরাহিম আ:) মুশরিক ছিলেন না’ (সূরা বাকারা : ১৩৫)।
তথাপি তারা এই মাসগুলোকে সম্মান করত এবং যুদ্ববিগ্রহকে হারাম মনে করত। তাই কুরআনে কারিমে হুকুম করা হয়েছে এই মাসগুলোকে সম্মান করতে। আর এগুলোর মধ্যে মহররম মাস অন্যতম।
হাদিস শরিফে নবী করিম সা: মহররমের দশ তারিখে রোজা রাখার আদেশ দিয়েছেন। শুরুতে যখন রমজানের রোজা ফরজ ছিল না তখন আশুরার রোজা ফরজ ছিল। পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ হয় তখন আশুরার রোজা ফরজ থাকেনি (সুনানে আবু দাউদ : ২৪৪৪)।
তবে এই রোজা অনেক ফজিলতপূর্ণ এবং এর মহা সাওয়াবের কথা নবী করিম সা: হাদিস শরিফে ব্যক্ত করেছেন। নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মহররম মাসের রোজা’ (মুসলিম শরীফ)।
হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সা:- কে আশুরার দিন এবং রমজান মাসে যেরূপ যতেœর সাথে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য কোনো সময় দেখিনি’ (বুখারি, মুসলিম)।
হজরত আবু কাতাদাহ আল-আনসারী রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: আশুরার রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন, এই রোজার দ্বারা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ হয় (ইবনে মাজাহ, মুসলিম শরীফ)।
ওপরে উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসগুলো দ্বারা এই মাসে, বিশেষভাবে আশুরার দিনে যা করণীয় ও বর্জনীয় সাব্যস্ত হয়, সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।
করনীয় কাজগুলো : আগেই উল্লেখ হয়েছে, রমজান মাসের পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মহররম মাসের রোজা, তাই সাধ্য অনুযায়ী পুরো মহররম মাসজুড়ে বেশি বেশি রোজা রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষভাবে আশুরা দিবসের রোজা রাখা। এর অনেক ফজিলত ও গুরুত্ব এসেছে হাদিস শরিফে। এর দ্বারা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
আগেই উল্লেখ হয়েছে যে, আশুরার রোজা একসময় ফরজ ছিল, পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ হয় তখন এই রোজা রাখা আর ফরজ থাকেনি। তবে যেহেতু এই দিন ইহুদিরাও রোজা রাখে, তাই নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা এর সাথে আগে বা পরে একটি রোজা মিলিয়ে রাখো যেন ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।’ তাই ওলামায়ে কিরাম বলেন, আশুরার সাথে আগে অথবা পরে অর্থাৎ ৯-১০ বা ১০-১১ তারিখে একসাথে দু’টি রোজা রাখা উত্তম।
এ দিনে আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী উম্মতের তওবা কবুল করেছেন এবং এ উম্মতকেও ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি হাদিস শরিফে এসেছে। তাই এ দিনে আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি ইসতেগফার করা এবং খালেস দিলে তওবা করা।
বর্জনীয় কাজগুলো : যে আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন যে, চারটি মাস সম্মানিত, সে আয়াতেরই শেষ অংশে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অতএব তোমরা এই মাসগুলোতে নিজেদের ওপর জুলুম কোরো না’ (সূরা তাওবা : ৩৬)।
বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে জান আমাদের দান করেছেন এটার হিফাজত করা। একে কষ্ট না দেয়া, অকারণে একে বিপদে না ফেলা। সব ক্ষতিকারক জিনিস থেকে এর হিফাজত করা। তাই এই মাসে অনেকে হজরত হুসাইন রা:-এর শাহাদতের ওপর শোকের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ যে বুক চাপড়ায়, নিজের শরীরকে জখম করে, রক্তাক্ত করে, কুরআন মজিদ এই কাজকে কঠিনভাবে নিষেধ করছে।
নিজের জানকে কষ্টে ফেলে শোক প্রকাশ করার ওপর হাদিস শরীফেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘ওই ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয় যে তার গাল চাপড়ায়, জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং জামানায় জাহিলিয়াতের মতো ক্রন্দন করে (শোক প্রকাশ করে)’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল জানায়েজ)।
আজকাল আশুরা উপলক্ষে যে মাতম করা হয়, ইসলাম তার অনুমতি দেয় না, এবং যার শাহাদতে শোক প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তিনি নিজেও এরূপ করতে পরিষ্কারভাকে বারণ করে গেছেন।
এই মাসে নেক আমলের যেমন বিশাল সওয়াব রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে এ দিনগুলোয় গুনাহেরও ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে। তাই এমন কোনো কাজে লিপ্ত না হওয়া একান্ত কাম্য যার দ্বারা এ মাসের পবিত্রতা নষ্ট হয় অথবা এর মর্যাদাহানি হয়।
আমাদের সমাজে অনেকের একটা ভুল ধারণা রয়েছে, অনেকে মনে করেন, আশুরা বা দশই মহররমের ফজিলত এই জন্য যে, এই দিনে নবী দৌহিত্র হজরত হুসাইন রা: কারবালার ময়দানে শাহাদতবরণ করেছেন। অথচ এই মাসের, বিশেষ করে আশুরার ফজিলত নবী করিম সা:-এর দুনিয়াতে আগমনের আগে থেকেই সাব্যস্ত। যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হুকুম ছিল, তাই সব নবী আ:-এর ফজিলতের কথা উম্মতকে জানিয়ে গিয়েছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: ও এটাকে আল্লাহর হুকুমে অবশিষ্ট রেখেছেন। যখন তিনি এর ফজিলত উম্মতের সামনে পেশ করেন, তখন হজরত হুসাইন রা: ছিলেন শিশু। আর বাস্তবতাও হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আর তা হচ্ছে হজরত হুসাইন রা:-এর ফজিলত ও মহত্ত্বের বহিঃপ্রকাশের উদ্দেশ্যেই হয়তো আল্লাহ তায়ালা তাঁর শাহাদতের জন্য এই মহান দিনকে বেঁছে নিয়েছেন, যার ফজিলত পূর্ববর্তী আম্বিয়া আলাইহিমুসসালামের যুগ থেকে স্বীকৃত।
আমাদের সমাজে একটা প্রথা প্রচলিত রয়েছে, আর তা হচ্ছে এই দিনে অন্যান্য দিনের তুলনায় ঘরে ভালো রান্না করা। আর পেছনে বিভিন্ন ফজিলতও বর্ণনা করা হয়। যদিও কেউ কেউ এ বিষয়ক রেওয়াত এনেছেন, যেমন বাইহাকি ও ইবনে হিব্বান প্রমুখ; কিন্তু তা কোনো সূত্র দ্বারা সমর্থিত নয়।
লেখক : প্রবন্ধকার
No comments