গল্প- লুলা পেট্রল by রিপনচন্দ্র মল্লিক
আমি কি কখনো ভেবেছিলাম এভাবেই আমি শেষ হয়ে যাবো? না, এ কথা আমি কোনো দিনও ভাবিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি কেন ভাবিনি? এভাবে আমি শেষ হয়ে যাবো সেই বোধ, আমার ইন্দ্রিয়গুলো আগে কেন প্রয়োগ করেনি। আমি তো ভালোই ছিলাম। ছিলাম বেশ সুখে।
ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম, আমি নাকি জন্মের পরে কাঁদিনি। মা মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ‘বাদশা, তুই বড় পাষাণ হইছিস। তোর বুকে কোনো দয়ামায়া নাই। জন্মের পরে যার চোখ দিয়া দুই ফোঁডা পানি পড়ে নাই। তোর ভিতরে আবার কিসের দয়ামায়া। দয়ামায়া তো তুই দুনিয়ায় নিয়া আহোস নাই।’
মায়ের কথাই ঠিক। আমার চোখ দুটো পাথর দিয়ে বানানো। পাথরে চোখ চকচক করে। সেই চকচকা পাথরের সাথে সূর্যের আলোর বিকিরণে যতটুকু দেখা যায় আমি আসলে ততটুকুই দেখি। বাকিটা আমার কেবলই অন্ধকার। তবে আমি কিন্তু চোখে একেবারে কম দেখি না। চোখে যতটুকু দেখি তাতে এখনো নাকের ওপরে চশমা বসিয়ে তার দুই হাত দিয়ে নিজের কান দুটোকে ধরিয়ে রাখতে হচ্ছে না। বয়স তো কম হলো না। এই অক্টোবরে ত্রিশের ঘরে ঢুকে পড়ব। ডান হাতটা অকেজো হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাম হাত দিয়েই সব কিছু করি।
আমার একটি মাত্র হাত। তাতে কোনো দুঃখ নেই। আখের রস বানানো মেশিনের চাপে ডান হাতটি যে বছর শেষ হয়ে গেল তারপর থেকেই মূলত আমি এক হাতবিশিষ্ট মানুষ। আমি দেখি আমার হাত আছে। কিন্তু অন্যরা দেখে না। তারা মনে করে মানুষের হাতের কব্জি, আঙুল না থাকলে সেই অঙ্গকে আর হাত বলা যায় না। আমি সেটা বিশ্বাস করি না। আমার কব্জি নেই, আঙুল নেই। তার পরও আমার অবশিষ্ট ডান হাতটিতে যে শক্তি পাই, আমার মনে হয় অনেকেরই সেই শক্তিটুকু ডান হাতে নেই। তেজগাঁও রেলগেটের আশপাশেই কাটিয়ে দিলাম জীবনের দশটি বছর। রেললাইনের পাশ ঘেঁষে একটি খুপরিঘরে আমার রসের জীবন। যেদিন থেকে রসের জীবন শেষ হলো, তারপর থেকে আমি আর কোনো কাজকর্মে মন দিতে পারি নাই। তেজগাঁও রেলগেটের পাশের ট্রাকস্ট্যান্ডের কাছে যে মসজিদটা, ওখানেই ভিা করে খাই। ভালোই আয়রোজগার হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে ভিা করি। কোনো দিন খুপরিতে এসে গুনে দেখি পাঁচ শ’ টাকা। আবার কোনো দিন গুনে দেখি সাত শ’ টাকা। তবে এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। ভিুক দেখলেই সহজে ভিা দেয় না। আগে ভিুকের চোখ, মুখ, হাত, পা দেখে তার পরে দুই টাকা পকেট থেকে বের করে দেয়। অবশ্য একটি হাত না থাকায় অনেকেই দুই টাকা, পাঁচ টাকা পকেট থেকে বের করে দেয় আমাকে।
যখন গ্রামে ছিলাম, কোনো রকমে টেনেটুনে কাস নাইন পাস করেছি। জীবনে কোনো কিছুতেই সফল হতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছেড়েছুড়ে ভেবেছিলাম ধনী হবো। দামি দামি গাড়িতে চড়ব। লাইনটা পেয়েও গিয়েছিলাম। আমাকে যে এই লাইনে ঢুকে পড়ার টিকিট কেটে দিলো, বেচারা আমি লাইনে ওঠার আগেই একদিন সকালে ধপাস করে বুকে ব্যথা ওঠায় মরে গেল। আমি কোনো কষ্ট পাইনি। কাউকে মরতে দেখলে ছোটবেলা থেকেই আমার কোনো ব্যথা লাগে না। যে মানুষ জন্মের পরে কাঁদেনি তার আবার কিসের দুঃখ-ব্যথা!
এত ঝামেলাময় জীবন নিয়েও আমি কিন্তু খুব সুখীই ছিলাম। আমাকে সত্যিকারের ধনী হওয়ার স্বপ্ন একজনই দেখিয়েছিল, তার নাম মায়া। আমি তাকে আদর করে ডাকতাম ‘মায়াবি মায়া’। মায়ার চোখে তাকালেই আমি সব কিছু ভুলে যেতাম। আমার খুপরিঘরেই এসে মায়া দেখা দিত। মঙ্গার এলাকা থেকে পেটের জ্বালায় মায়া ঢাকা এসেছে। কারওয়ানবাজারের একটি হোটেলে রান্না করে। ঢাকায় আসার আগে একবার বিয়েও হয়েছিল বলে জেনেছি। তাতে কী, আমার তো মায়ার জন্য খুব মায়া লাগে। মায়াই আমাকে একদিন বলেছিল, ‘তুমি অনেক টাকা কামাও, টাকা না থাকলে কোনো সুখ নাই। তুমি টাকা কামাইলে আমরা ঘর বানমু।’ আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘কত টাকা কামাইতে হইবে মায়া?’
মায়ার মুখে কোনো কথা নেই। মায়া চুপ হয়ে যায়। আমিও মায়াকে বলি, ‘যাও শিগগিরই আমি ধনী হয়ে যাবো। যেভাবেই হোক আমাকে ধনী হইতেই হবে। লোকে আমাকে লুলা বাদশা বলে। আমাকে যারা লুলা বাদশা বলে আমি তাদের দেখিয়ে দিতে চাই, লুলা হইলেও আমি সত্যিকারের বাদশা।’ আমি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমি আরো স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, আমি আর মায়া বাবুইপাখির মতো ঘর বুনছি। আমার এ স্বপ্নগুলো বাস্তবতায় রূপ দেয়ার পথেই আমি আস্তে করে হাঁটছিলাম। একদিন মায়াকে ডেকে বললাম, ‘শোনো মায়া, আমি শিগগিরই ধনী হয়ে যাবো। তারপর তোমাকে নিয়ে বাবুইপাখির বাসার মতো করে একটি ঘর বানামু।’ আমার কথা শুনে মায়া শুধু হাসে। মায়ার সেই মায়াবী হাসির মধ্যে আমি আটকে যাই। শুধু আটকে যাই বললে ভুল হবে, আসলে মায়ার মুখে হাসি দেখলে আমি বিদিক হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ার জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি।
দেশে আন্দোলন এলেই আমার ডাক পড়ে যায়। দেশে যত দল আছে, দলের ওপরমহলে যত নেতা আছে, সবাই আমাকে খোঁজে। আমি নাকি তাদের আন্দোলনের হাতিয়ার। আমাকে খুঁজে না পেলে নাকি তেজগাঁও থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে মতিঝিলে তাদের কোনো আন্দোলন হয় না। আমি মাঝে মাঝে নেতাদের বলি, ‘আমি লুলা মানুষ, আমাকে নিয়ে এত টানাটানি করেন ক্যান? এই ঢাকা শহরে কি আমি একাই আছি, আমি ছাড়া আপনাদের আর কোনো মানুষ নাই? আমি আপনাদের এত কাজ করে দিতে পারব না।’ Ñএই কথা বলে আমি আমার কাজের রেট বাড়ানোর চেষ্টা করি।
ইদানীং সব দলের ওপরমহলের নেতারা আমার কথা শুনে চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। তারা ভাবতে পারে না আমি মুখফুটে খই ফোটার মতো করে কিভাবে এ কথা বলে ফেলছি। আমার কথা শুনে এই লাইনের পুরান মাল শ্যামলা বাবু বলে, ‘আরে কচ কী, বাদশা। তুই দেখি বদলাইয়া যাইতেছোস!’ ‘হ। এখন থেকে আমার বদলাইয়া যাইতে হবে। আপনেরা সুযোগ সুবিধা নিয়ে দল পাল্টে ফেলেন। আমিও এখন থেকে নিজেকে পাল্টে ফেলব।’
শ্যামলা বাবু আগে আমার মতোই কাজ করত। এখন কাজ করতে করতে অনেক টাকা আয় করে ফেলছে। এখন সে এই এলাকায় সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরে সরকারি দল আর বিরোধী দলের নেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সুবিধাবাদী আন্দোলনের ব্যবসা করছে। আমার কথা শুনে শ্যামলা বাবু বলে, ‘আ রে, দেশের সব নেতার কাছে তোর নামটি মুখস্থ হয়ে গেছে। আন্দোলনের আদর্শ হাতিয়ার হিসেবে সবাই তোকে এক নামেই চেনে। এই লাইনে তোর ক্যারিয়ারের জন্য এটা কম কিসের, বল।’
আমার চোখে শুধু মায়ার কথা ভাসে। মায়াকে নিয়ে ঘর বানাব। ভাই নেতারা আমাকে হাতিয়ার বলুক আর মতিয়ারই বলুক, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাকে দিয়ে যদি আপনি কাজ করাতে চান তাহলে এখন থেকে রেট বাড়াতে হবে। প্রতি ্যাপে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে।
আপনার কাজ সেরেই আমি ভিা করতে বসে পড়ব, মিডিয়ার লোকজন এসে আমার ছবি তুলবে না। তারা তুলবে পোড়া গাড়ি, পোড়া মানুষের ছবি। আপনিই বলেন ভাই, অনেক হরতাল-অবরোধেই তো আপনি আমাকে সরকারি দলের নেতাদের গাড়িও পোড়াতে বললেন আবার বিরোধী দলের নেতাদের গাড়িও পোড়াতে বললেন। একটি অপারেশনও কি মিস করেছি আমি?
ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস রেট বাড়াতে হবে, তোকে রেট বাড়িয়ে দেবো। তবে অন্য সিস্টেমে।
আচ্ছা বলেন, কী সিস্টেমে?
আগামীকাল থেকে ১০ দিনের অবরোধ হবে দেশে। অফার আছে পেট্রলবোমার আগুন জ্বালাতে হবে। এই আগুন নিয়ে চুল টানাটানি। মানে বুঝছোস তো, টিভিতে নেতারা বুদ্ধিজীবীরা এই পেট্রল আগুন নিয়া চুলচেরা বিশ্লেষণ, টকশো, মিষ্টিশো ইত্যাদি করবে।
ভালো কথা। মাল ছাড়েন। কাজ ঠিক সময়মতো করে দেবো।
আমার কথামতো তোকে আগামী ১০ দিনে মোট ১৫টা বাস ও ট্রাকে পেট্রলবোমা মারতে হবে। তবে কথা আছে, আমরা যে গাড়িগুলোর নাম তোকে লিখে দেবো, ঠিকভাবে শুধু ওইসব গাড়িতেই বোমাগুলো মেরে দিতে হবে।
মেরে দেবো। কিন্তু টাকা?
প্রতিদিন কাজ শেষ করে রাতে ১০ হাজার করে টাকা নিয়ে যাবি।
আমি বাদশা। যে কিনা গত এক বছরে নেতাদের কাছে লুলা পেট্রল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছি। আগামী ১০ দিন পরে আমার হাতে অনেক টাকা চলে আসবে। জীবনপ্রবাহে আমার সুদিন হাতছানি দিচ্ছে। মায়াকে খবর দিতে হবে, সামনের ১০ দিন পরে মায়াকে বিয়ে করে আমরা সুখী সংসার গড়ে তুলব। ঠিক করেছি। বিয়ের পরে এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো। প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে গিয়ে আমরা একটা বাড়ি বানাব। বর্ষার দিনে বাড়ির চার পাশে থাকবে পানি আর পানি। পানিতে চার দিক থৈ থৈ করবে। সেই বাড়িতে আমি আর মায়া থাকব। যেদিন রাতের আকাশ ফুটে জোছনা ঝরে পড়বে, সেদিন আমি আর মায়া বাড়ির উঠানে সারা রাত জোছনায় ভিজে জবুথবু হবো। মায়াকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমার একেকটি দিন।
দেশজুড়ে চলছে টানা অবরোধ। ‘....’ পরিবহনে পেট্রল মারতে হবে। বাবু ভাই সকালে নির্দেশ দিয়েছে। আমার আর কোনো কিছুই সইছে না। আজ রাতেই অপারেশনটা শেষ হলে আমি লাখপতি হয়ে যাবো। মায়াকে কাল বিয়ে করে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাবো। দূরে চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো। এই পোড়া শহরে আর কোনো দিন আসব না। বাবু ভাইয়ের কথামতো রাতেই বাসে পেট্রলবোমা মেরেছিলাম। কিন্তু এরপর এমন ঘটনা ঘটবে আমি কোনো দিন ভাবিনি। এত পেট্রলবোমা মারলাম কোনো দিন তো এ রকম হয়নি।
গাড়িটিতে পেট্রল ছোড়ার সময় কে যেন আমাকে গুলি করল। সাথে সাথে শাহবাগের এই সড়কে আমি ধপাস করে পড়ে যাই। কিছুণের মধ্যেই দেখি, আমার মাথার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ তুলে মানুষটির দিকে তাকাতে চেষ্টা করছিলাম। আমার চোখ দুটোকে মেলতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টা করে কিছুটা চোখ মেলে চেয়ে দেখি, আমার মাথার পাশে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, সে শ্যামলা বাবু। অদ্ভুত রকমের শব্দ করে হাসছেন আর বলছেন, ‘তুই নাকি তোর রেট বাড়াইছোস? এখন থেকে তোর যত খুশি রেট দরকার বাড়িয়ে ফ্যাল শালার লুলা পেট্রল, কেউ তোকে মানা করবে না।’
আমার দম বের হয়ে আসছে। কোনো কথা বলতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি। আমি কি কখনো ভেবেছিলাম এভাবেই আমি শেষ হয়ে যাবো? না, এ কথা আমি কোনো দিনও ভাবিনি। মায়ার কী হবে? মায়া তো আমার জন্য পায়জামা, পাঞ্জাবি আর পাগড়ি কিনেছে। নিজের জন্য কিনেছে শাড়ি, আলতা, কাচের চুড়ি, মেহেদি আর লাল রঙের টিপ। আমার মনে হচ্ছিল, এই আমি কত মানুষের জীবন এই সড়কে নিভিয়ে দিয়েছি। আজ আমি নিজেই এই সড়কেই নিভে যাচ্ছি। চার দিকে থৈ থৈ করা পানির মাঝে বাড়ি বানিয়ে আমার ও মায়ার কোনো দিন থাকা হলো না। কোনো দিন আর হলো না বাড়ির উঠানে চাটাই বিছিয়ে দু’জনে সারা রাত জোছনায় ভিজে জবুথবু হয়ে ঘুমিয়ে থাকা।
ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম, আমি নাকি জন্মের পরে কাঁদিনি। মা মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ‘বাদশা, তুই বড় পাষাণ হইছিস। তোর বুকে কোনো দয়ামায়া নাই। জন্মের পরে যার চোখ দিয়া দুই ফোঁডা পানি পড়ে নাই। তোর ভিতরে আবার কিসের দয়ামায়া। দয়ামায়া তো তুই দুনিয়ায় নিয়া আহোস নাই।’
মায়ের কথাই ঠিক। আমার চোখ দুটো পাথর দিয়ে বানানো। পাথরে চোখ চকচক করে। সেই চকচকা পাথরের সাথে সূর্যের আলোর বিকিরণে যতটুকু দেখা যায় আমি আসলে ততটুকুই দেখি। বাকিটা আমার কেবলই অন্ধকার। তবে আমি কিন্তু চোখে একেবারে কম দেখি না। চোখে যতটুকু দেখি তাতে এখনো নাকের ওপরে চশমা বসিয়ে তার দুই হাত দিয়ে নিজের কান দুটোকে ধরিয়ে রাখতে হচ্ছে না। বয়স তো কম হলো না। এই অক্টোবরে ত্রিশের ঘরে ঢুকে পড়ব। ডান হাতটা অকেজো হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাম হাত দিয়েই সব কিছু করি।
আমার একটি মাত্র হাত। তাতে কোনো দুঃখ নেই। আখের রস বানানো মেশিনের চাপে ডান হাতটি যে বছর শেষ হয়ে গেল তারপর থেকেই মূলত আমি এক হাতবিশিষ্ট মানুষ। আমি দেখি আমার হাত আছে। কিন্তু অন্যরা দেখে না। তারা মনে করে মানুষের হাতের কব্জি, আঙুল না থাকলে সেই অঙ্গকে আর হাত বলা যায় না। আমি সেটা বিশ্বাস করি না। আমার কব্জি নেই, আঙুল নেই। তার পরও আমার অবশিষ্ট ডান হাতটিতে যে শক্তি পাই, আমার মনে হয় অনেকেরই সেই শক্তিটুকু ডান হাতে নেই। তেজগাঁও রেলগেটের আশপাশেই কাটিয়ে দিলাম জীবনের দশটি বছর। রেললাইনের পাশ ঘেঁষে একটি খুপরিঘরে আমার রসের জীবন। যেদিন থেকে রসের জীবন শেষ হলো, তারপর থেকে আমি আর কোনো কাজকর্মে মন দিতে পারি নাই। তেজগাঁও রেলগেটের পাশের ট্রাকস্ট্যান্ডের কাছে যে মসজিদটা, ওখানেই ভিা করে খাই। ভালোই আয়রোজগার হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে ভিা করি। কোনো দিন খুপরিতে এসে গুনে দেখি পাঁচ শ’ টাকা। আবার কোনো দিন গুনে দেখি সাত শ’ টাকা। তবে এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। ভিুক দেখলেই সহজে ভিা দেয় না। আগে ভিুকের চোখ, মুখ, হাত, পা দেখে তার পরে দুই টাকা পকেট থেকে বের করে দেয়। অবশ্য একটি হাত না থাকায় অনেকেই দুই টাকা, পাঁচ টাকা পকেট থেকে বের করে দেয় আমাকে।
যখন গ্রামে ছিলাম, কোনো রকমে টেনেটুনে কাস নাইন পাস করেছি। জীবনে কোনো কিছুতেই সফল হতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত সব কিছু ছেড়েছুড়ে ভেবেছিলাম ধনী হবো। দামি দামি গাড়িতে চড়ব। লাইনটা পেয়েও গিয়েছিলাম। আমাকে যে এই লাইনে ঢুকে পড়ার টিকিট কেটে দিলো, বেচারা আমি লাইনে ওঠার আগেই একদিন সকালে ধপাস করে বুকে ব্যথা ওঠায় মরে গেল। আমি কোনো কষ্ট পাইনি। কাউকে মরতে দেখলে ছোটবেলা থেকেই আমার কোনো ব্যথা লাগে না। যে মানুষ জন্মের পরে কাঁদেনি তার আবার কিসের দুঃখ-ব্যথা!
এত ঝামেলাময় জীবন নিয়েও আমি কিন্তু খুব সুখীই ছিলাম। আমাকে সত্যিকারের ধনী হওয়ার স্বপ্ন একজনই দেখিয়েছিল, তার নাম মায়া। আমি তাকে আদর করে ডাকতাম ‘মায়াবি মায়া’। মায়ার চোখে তাকালেই আমি সব কিছু ভুলে যেতাম। আমার খুপরিঘরেই এসে মায়া দেখা দিত। মঙ্গার এলাকা থেকে পেটের জ্বালায় মায়া ঢাকা এসেছে। কারওয়ানবাজারের একটি হোটেলে রান্না করে। ঢাকায় আসার আগে একবার বিয়েও হয়েছিল বলে জেনেছি। তাতে কী, আমার তো মায়ার জন্য খুব মায়া লাগে। মায়াই আমাকে একদিন বলেছিল, ‘তুমি অনেক টাকা কামাও, টাকা না থাকলে কোনো সুখ নাই। তুমি টাকা কামাইলে আমরা ঘর বানমু।’ আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘কত টাকা কামাইতে হইবে মায়া?’
মায়ার মুখে কোনো কথা নেই। মায়া চুপ হয়ে যায়। আমিও মায়াকে বলি, ‘যাও শিগগিরই আমি ধনী হয়ে যাবো। যেভাবেই হোক আমাকে ধনী হইতেই হবে। লোকে আমাকে লুলা বাদশা বলে। আমাকে যারা লুলা বাদশা বলে আমি তাদের দেখিয়ে দিতে চাই, লুলা হইলেও আমি সত্যিকারের বাদশা।’ আমি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমি আরো স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, আমি আর মায়া বাবুইপাখির মতো ঘর বুনছি। আমার এ স্বপ্নগুলো বাস্তবতায় রূপ দেয়ার পথেই আমি আস্তে করে হাঁটছিলাম। একদিন মায়াকে ডেকে বললাম, ‘শোনো মায়া, আমি শিগগিরই ধনী হয়ে যাবো। তারপর তোমাকে নিয়ে বাবুইপাখির বাসার মতো করে একটি ঘর বানামু।’ আমার কথা শুনে মায়া শুধু হাসে। মায়ার সেই মায়াবী হাসির মধ্যে আমি আটকে যাই। শুধু আটকে যাই বললে ভুল হবে, আসলে মায়ার মুখে হাসি দেখলে আমি বিদিক হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ার জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি।
দেশে আন্দোলন এলেই আমার ডাক পড়ে যায়। দেশে যত দল আছে, দলের ওপরমহলে যত নেতা আছে, সবাই আমাকে খোঁজে। আমি নাকি তাদের আন্দোলনের হাতিয়ার। আমাকে খুঁজে না পেলে নাকি তেজগাঁও থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে মতিঝিলে তাদের কোনো আন্দোলন হয় না। আমি মাঝে মাঝে নেতাদের বলি, ‘আমি লুলা মানুষ, আমাকে নিয়ে এত টানাটানি করেন ক্যান? এই ঢাকা শহরে কি আমি একাই আছি, আমি ছাড়া আপনাদের আর কোনো মানুষ নাই? আমি আপনাদের এত কাজ করে দিতে পারব না।’ Ñএই কথা বলে আমি আমার কাজের রেট বাড়ানোর চেষ্টা করি।
ইদানীং সব দলের ওপরমহলের নেতারা আমার কথা শুনে চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। তারা ভাবতে পারে না আমি মুখফুটে খই ফোটার মতো করে কিভাবে এ কথা বলে ফেলছি। আমার কথা শুনে এই লাইনের পুরান মাল শ্যামলা বাবু বলে, ‘আরে কচ কী, বাদশা। তুই দেখি বদলাইয়া যাইতেছোস!’ ‘হ। এখন থেকে আমার বদলাইয়া যাইতে হবে। আপনেরা সুযোগ সুবিধা নিয়ে দল পাল্টে ফেলেন। আমিও এখন থেকে নিজেকে পাল্টে ফেলব।’
শ্যামলা বাবু আগে আমার মতোই কাজ করত। এখন কাজ করতে করতে অনেক টাকা আয় করে ফেলছে। এখন সে এই এলাকায় সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরে সরকারি দল আর বিরোধী দলের নেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সুবিধাবাদী আন্দোলনের ব্যবসা করছে। আমার কথা শুনে শ্যামলা বাবু বলে, ‘আ রে, দেশের সব নেতার কাছে তোর নামটি মুখস্থ হয়ে গেছে। আন্দোলনের আদর্শ হাতিয়ার হিসেবে সবাই তোকে এক নামেই চেনে। এই লাইনে তোর ক্যারিয়ারের জন্য এটা কম কিসের, বল।’
আমার চোখে শুধু মায়ার কথা ভাসে। মায়াকে নিয়ে ঘর বানাব। ভাই নেতারা আমাকে হাতিয়ার বলুক আর মতিয়ারই বলুক, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাকে দিয়ে যদি আপনি কাজ করাতে চান তাহলে এখন থেকে রেট বাড়াতে হবে। প্রতি ্যাপে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে।
আপনার কাজ সেরেই আমি ভিা করতে বসে পড়ব, মিডিয়ার লোকজন এসে আমার ছবি তুলবে না। তারা তুলবে পোড়া গাড়ি, পোড়া মানুষের ছবি। আপনিই বলেন ভাই, অনেক হরতাল-অবরোধেই তো আপনি আমাকে সরকারি দলের নেতাদের গাড়িও পোড়াতে বললেন আবার বিরোধী দলের নেতাদের গাড়িও পোড়াতে বললেন। একটি অপারেশনও কি মিস করেছি আমি?
ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস রেট বাড়াতে হবে, তোকে রেট বাড়িয়ে দেবো। তবে অন্য সিস্টেমে।
আচ্ছা বলেন, কী সিস্টেমে?
আগামীকাল থেকে ১০ দিনের অবরোধ হবে দেশে। অফার আছে পেট্রলবোমার আগুন জ্বালাতে হবে। এই আগুন নিয়ে চুল টানাটানি। মানে বুঝছোস তো, টিভিতে নেতারা বুদ্ধিজীবীরা এই পেট্রল আগুন নিয়া চুলচেরা বিশ্লেষণ, টকশো, মিষ্টিশো ইত্যাদি করবে।
ভালো কথা। মাল ছাড়েন। কাজ ঠিক সময়মতো করে দেবো।
আমার কথামতো তোকে আগামী ১০ দিনে মোট ১৫টা বাস ও ট্রাকে পেট্রলবোমা মারতে হবে। তবে কথা আছে, আমরা যে গাড়িগুলোর নাম তোকে লিখে দেবো, ঠিকভাবে শুধু ওইসব গাড়িতেই বোমাগুলো মেরে দিতে হবে।
মেরে দেবো। কিন্তু টাকা?
প্রতিদিন কাজ শেষ করে রাতে ১০ হাজার করে টাকা নিয়ে যাবি।
আমি বাদশা। যে কিনা গত এক বছরে নেতাদের কাছে লুলা পেট্রল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছি। আগামী ১০ দিন পরে আমার হাতে অনেক টাকা চলে আসবে। জীবনপ্রবাহে আমার সুদিন হাতছানি দিচ্ছে। মায়াকে খবর দিতে হবে, সামনের ১০ দিন পরে মায়াকে বিয়ে করে আমরা সুখী সংসার গড়ে তুলব। ঠিক করেছি। বিয়ের পরে এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো। প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে গিয়ে আমরা একটা বাড়ি বানাব। বর্ষার দিনে বাড়ির চার পাশে থাকবে পানি আর পানি। পানিতে চার দিক থৈ থৈ করবে। সেই বাড়িতে আমি আর মায়া থাকব। যেদিন রাতের আকাশ ফুটে জোছনা ঝরে পড়বে, সেদিন আমি আর মায়া বাড়ির উঠানে সারা রাত জোছনায় ভিজে জবুথবু হবো। মায়াকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমার একেকটি দিন।
দেশজুড়ে চলছে টানা অবরোধ। ‘....’ পরিবহনে পেট্রল মারতে হবে। বাবু ভাই সকালে নির্দেশ দিয়েছে। আমার আর কোনো কিছুই সইছে না। আজ রাতেই অপারেশনটা শেষ হলে আমি লাখপতি হয়ে যাবো। মায়াকে কাল বিয়ে করে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাবো। দূরে চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো। এই পোড়া শহরে আর কোনো দিন আসব না। বাবু ভাইয়ের কথামতো রাতেই বাসে পেট্রলবোমা মেরেছিলাম। কিন্তু এরপর এমন ঘটনা ঘটবে আমি কোনো দিন ভাবিনি। এত পেট্রলবোমা মারলাম কোনো দিন তো এ রকম হয়নি।
গাড়িটিতে পেট্রল ছোড়ার সময় কে যেন আমাকে গুলি করল। সাথে সাথে শাহবাগের এই সড়কে আমি ধপাস করে পড়ে যাই। কিছুণের মধ্যেই দেখি, আমার মাথার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমি চোখ তুলে মানুষটির দিকে তাকাতে চেষ্টা করছিলাম। আমার চোখ দুটোকে মেলতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টা করে কিছুটা চোখ মেলে চেয়ে দেখি, আমার মাথার পাশে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, সে শ্যামলা বাবু। অদ্ভুত রকমের শব্দ করে হাসছেন আর বলছেন, ‘তুই নাকি তোর রেট বাড়াইছোস? এখন থেকে তোর যত খুশি রেট দরকার বাড়িয়ে ফ্যাল শালার লুলা পেট্রল, কেউ তোকে মানা করবে না।’
আমার দম বের হয়ে আসছে। কোনো কথা বলতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি। আমি কি কখনো ভেবেছিলাম এভাবেই আমি শেষ হয়ে যাবো? না, এ কথা আমি কোনো দিনও ভাবিনি। মায়ার কী হবে? মায়া তো আমার জন্য পায়জামা, পাঞ্জাবি আর পাগড়ি কিনেছে। নিজের জন্য কিনেছে শাড়ি, আলতা, কাচের চুড়ি, মেহেদি আর লাল রঙের টিপ। আমার মনে হচ্ছিল, এই আমি কত মানুষের জীবন এই সড়কে নিভিয়ে দিয়েছি। আজ আমি নিজেই এই সড়কেই নিভে যাচ্ছি। চার দিকে থৈ থৈ করা পানির মাঝে বাড়ি বানিয়ে আমার ও মায়ার কোনো দিন থাকা হলো না। কোনো দিন আর হলো না বাড়ির উঠানে চাটাই বিছিয়ে দু’জনে সারা রাত জোছনায় ভিজে জবুথবু হয়ে ঘুমিয়ে থাকা।
No comments