হিজরি সনের প্রচলন ও তাৎপর্য by নইম কাদের
হিজরি সন সরাসরি চাঁদের সাথে সম্পর্কিত বিধায় এটাকে চন্দ্রবর্ষও বলা হয়। চাঁদ দেখা এবং চাঁদের তারিখের সাথে হিসাব মিলিয়ে ইসলামের অনেক মৌলিক বিধান পালন করা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক বিধায় হিজরি সন মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ কারণে সাধারণভাবে হিজরি সন ইসলামী সন নামেও পরিচিত। হিজরি শব্দটি হিজরত থেকে এসেছে। এর মূল শব্দ ‘হাজরা’ অর্থ পরিত্যাগ করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা, বর্জন করা, স্বদেশ ত্যাগ করা ইত্যাদি। তবে ইসলামী জীবনব্যবস্থায় হিজরত এক বিশেষ পরিভাষার নাম। আল্লাহ সুবহানুহু তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ও বিশেষ নির্দেশনা পেয়ে আল্লাহর সর্বশেষ পয়গাম্বর হজরত মুহাম্মদ সা: ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা পরিত্যাগ করে মদিনায় চলে যান। ইসলামের ইতিহাসে এটাই হিজরত নামে পরিচিত। হজরতের মদিনায় হিজরত ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হজরত সা: নববী ত্রয়োদশ সালে, রবিউল আউয়ালের শুরু অথবা সফর মাসের শেষ দিন সোমবার মক্কা ত্যাগ করেন। এ সময় হজরতের বয়স ছিল ৫৩ বছর।
হজরত মুহাম্মদ সা: এবং প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা:-এর শাসনকালে মুসলিম সমাজে হিজরি সন গণনা এবং সরকারি নথিপত্রে হিজরি সন-তারিখ ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। তবে প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে কিছু বিখ্যাত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনার প্রথা প্রচলিত ছিল। যেমন পাপিষ্ঠ বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক পবিত্র কাবাঘর ধ্বংসের জন্য আগমনের সালকে ‘হাতির বছর’ হিসেবে গণনা করা হতো। মুসলমানদের মাঝেও এ রকম কিছু সন গণনার প্রচলন ছিল। যেমন আল্লাহর রাসূল সা:-এর চাচা আবু তালিব ও উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজাতুল কোবরা রা:-এর ইন্তেকালের বছর ‘পেরেশানির বছর’, হিজরতের বছর ‘অনমুতির বছর’, হিজরতের দ্বিতীয় বছর ‘যুদ্ধের আদেশের বছর’ ইত্যাদি আরো কিছু সন গণনা করা হতো। তবে একটি স্বতন্ত্র কোনো ইসলামী ক্যালেন্ডার ছিল না।
হিজরি সন আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা শুরু হয় হিজরতের ১৭ বছর পর, হজরত ওমর রা:-এর সময়ে, তার খিলাফতের চতুর্থ বছরে। অপর এক মত অনুযায়ী সর্বপ্রথম হিজরি সন গণনার প্রচলন করেন প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা: কর্তৃক নিযুক্ত ইয়েমেনের শাসনকর্তা হজরত ইয়ালা ইবনে উমাইয়া রা:। তবে এই মতটি খুবই দুর্বল। তা ছাড়া যুক্তিও এ মতকে পুরোপুরি গ্রহণ করে না। হজরত ইয়ালা ইবনে উমাইয়া রা: ছিলেন হজরত আবু বকর রা: কর্তৃক নিযুক্ত একটি প্রদেশের শাসনকর্তা। হজরত আবু বকর রা: কর্তৃক হিজরি সন গণনার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তা খলিফার অগোচরে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন তা হতে পারে না। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা: কর্তৃক তারই খেলাফতকালে সর্বপ্রথম হিজরি সন গণনা শুরু হয়। এটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত।
হিজরি সন গণনা শুরু হয় যেভাবে : স্বতন্ত্র ইসলামী সন গণনা বিষয়ে সর্বপ্রথম হজরত ওমর রা: সিদ্ধান্ত নেন। হজরত ওমর রা:-এর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। রাষ্ট্র পরিচলনা, কর, খাজনা, জাকাত আদায়, সরকারি চিঠিপত্র আদান-প্রদান ইত্যাদিতে সন-তারিখের উল্লেখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এ সময় প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআ’রি রা: খলিফার কাছে এক চিঠিতে খলিফার পক্ষ থেকে প্রেরিত সরকারি চিঠিপত্রে সন-তারিখ উল্লেখ না থাকায় এর বিভিন্ন অসুবিধার কথা জানান। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে খলিফা সবার সাথে আলোচনা করেন এবং একটি আলাদা ইসলামী ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব রা: ইসলামী সনের শুরু কী হবে, ইসলামী সনের প্রথম বছর কোন জায়গা থেকে আরম্ভ করা হবে তা নিয়ে বিভিন্ন জনের সাথে পরামর্শ করলেন। কারো পরামর্শ ছিল ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু করা হোক প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জন্মের তারিখ থেকে। আবার কেউ পরামর্শ দিলেন হজরতের ইন্তেকাল থেকেই ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু করার জন্য। হজরত আলী রা: ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরুর পরামর্শ দিলেন হজরতের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের তারিখ থেকে। অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর হজরত আলী রা:-এর পরামর্শই গৃহীত হয়। এরপর আবার প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, কোন মাস থেকে ইসলামী ক্যালেন্ডার গণনা শুরু হবে? অর্থাৎ হিজরি সনের প্রথম মাস হবে কোনটি? এ প্রশ্নেও বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেন। কারো পরামর্শ ছিল রজব মাস হোক ইসলামী সন গণনার প্রথম মাস। তাদের যুক্তি ছিল প্রাক-ইসলামী যুগেও রজব মাসকে সবাই পবিত্র মাস হিসেবে মানত। আবার কেউ পরামর্শ দিলেন রমজান মাস দিয়ে ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু করতে। কারণ মাহে রমজান মুসলমানদের কাছে পবিত্র মাস। পবিত্র হজের মাস হিসেবে জিলহজ মাসকে ইসলামী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস গণনার পরামর্শ ছিল কারো কারো। কিন্তু হজরত ওসমান রা: পরামর্শ দিলেন মহররম মাস দিয়েই ইসলামী সন গণনার। তার যুক্তি ছিল সমগ্র আরব অঞ্চলে নুতন সন গণনা শুরু হয় মহররম মাস দিয়েই। সুতরাং নতুন ইসলামী ক্যালেন্ডারও মহররম মাস দিয়ে শুরু করা হোক। অবশেষে হজরত ওসমান রা:-এর পরামর্শই গৃহীত হয়। বাকি মাসগুলো আরব অঞ্চলে প্রচলিত আগের নিয়ম মতোই রাখা হলো। ইসলামী ক্যালেন্ডারের নামকরণ হয় হিজরি সন।
হজরত মুহাম্মদ সা: নববী ত্রয়োদশ সাল, বরিউল আউয়ালের শুরু অথবা সফর মাসের শেষ দিন সোমবার মদিনার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে ৮ রবিউল আউয়াল, কারো কারো মতে ১২ রবিউল আউয়াল, নববী ১৩ সাল, মোতাবেক ২০ সেপ্টেম্বর, ৬২২ সাল তিনি মদিনায় পৌঁছেন। হিজরতের এ হিসাব অনুযায়ী হিজরি সন গণনা দুই মাস আট দিন বা ১২ দিন পিছিয়ে নিয়ে ১ মহররম থেকে শুরু করা হয়েছে।
মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনে হিজরি সন গণনার গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মুসলমান সন তারিখ হিসাবের জন্য যেকোনো ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে পারেন, ইসলামী শরিয়ায় তাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু তা হাদিসের ওপর আমল হবে না। হাদিসের ওপর আমল হবে যদি তা হিজরি সন হয়। হিজরি সন হচ্ছে ইসলামী ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আল্লাহর রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামদের। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, একদা আল্লাহর রাসূল সা:-কে প্রশ্ন করা হলো তিনি কী কারণে সোমবারকে বিশেষভাবে পালন করেন? উত্তরে তিনি ইরশাদ করলেন, ‘ওই দিন আমি জন্মগ্রহণ করি, ওই দিন আমি নুবুওয়াত লাভ করি এবং ওই দিন আমি স্বদেশ পরিত্যাগ করে মদিনাভিমুখে যাত্রা করি।’
একসময় মুসলমানদের দৈনন্দিন কাজে সন তারিখ গণনায় হিজরি সন ব্যবহার করা হতো। এমনকি বিয়ের তারিখ লেখায় প্রথমেই হিজরি সনের উল্লেখ থাকত, তারপর থাকত বাংলা ও ইংরেজি। বর্তমানে তা কমে গেছে। এটাকে কোনো মতেই আধুনিকতা বলা যাবে না। বরং নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এটাকে হীনম্মন্যতা বলা চলে। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও হিজরি সন গণনার রেওয়াজ উঠে গেছে। এমনকি সরকারি মাদরাসাগুলোতেও হিজরি সনের প্রচলন নেই। অবশ্য কওমি মাদরাসাগুলো এখনো ইসলামের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। হাদিসের ওপর আমল এবং মুসলিম জাতিসত্তা হিসেবে নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ ও সংরক্ষণ করার জন্য আমাদের উচিত দৈনন্দিন হিসাবে হিজরি সন, অর্থাৎ ইসলামী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক
হজরত মুহাম্মদ সা: এবং প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা:-এর শাসনকালে মুসলিম সমাজে হিজরি সন গণনা এবং সরকারি নথিপত্রে হিজরি সন-তারিখ ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। তবে প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে কিছু বিখ্যাত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনার প্রথা প্রচলিত ছিল। যেমন পাপিষ্ঠ বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক পবিত্র কাবাঘর ধ্বংসের জন্য আগমনের সালকে ‘হাতির বছর’ হিসেবে গণনা করা হতো। মুসলমানদের মাঝেও এ রকম কিছু সন গণনার প্রচলন ছিল। যেমন আল্লাহর রাসূল সা:-এর চাচা আবু তালিব ও উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজাতুল কোবরা রা:-এর ইন্তেকালের বছর ‘পেরেশানির বছর’, হিজরতের বছর ‘অনমুতির বছর’, হিজরতের দ্বিতীয় বছর ‘যুদ্ধের আদেশের বছর’ ইত্যাদি আরো কিছু সন গণনা করা হতো। তবে একটি স্বতন্ত্র কোনো ইসলামী ক্যালেন্ডার ছিল না।
হিজরি সন আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা শুরু হয় হিজরতের ১৭ বছর পর, হজরত ওমর রা:-এর সময়ে, তার খিলাফতের চতুর্থ বছরে। অপর এক মত অনুযায়ী সর্বপ্রথম হিজরি সন গণনার প্রচলন করেন প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা: কর্তৃক নিযুক্ত ইয়েমেনের শাসনকর্তা হজরত ইয়ালা ইবনে উমাইয়া রা:। তবে এই মতটি খুবই দুর্বল। তা ছাড়া যুক্তিও এ মতকে পুরোপুরি গ্রহণ করে না। হজরত ইয়ালা ইবনে উমাইয়া রা: ছিলেন হজরত আবু বকর রা: কর্তৃক নিযুক্ত একটি প্রদেশের শাসনকর্তা। হজরত আবু বকর রা: কর্তৃক হিজরি সন গণনার কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তা খলিফার অগোচরে এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন তা হতে পারে না। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা: কর্তৃক তারই খেলাফতকালে সর্বপ্রথম হিজরি সন গণনা শুরু হয়। এটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত।
হিজরি সন গণনা শুরু হয় যেভাবে : স্বতন্ত্র ইসলামী সন গণনা বিষয়ে সর্বপ্রথম হজরত ওমর রা: সিদ্ধান্ত নেন। হজরত ওমর রা:-এর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। রাষ্ট্র পরিচলনা, কর, খাজনা, জাকাত আদায়, সরকারি চিঠিপত্র আদান-প্রদান ইত্যাদিতে সন-তারিখের উল্লেখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, এ সময় প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআ’রি রা: খলিফার কাছে এক চিঠিতে খলিফার পক্ষ থেকে প্রেরিত সরকারি চিঠিপত্রে সন-তারিখ উল্লেখ না থাকায় এর বিভিন্ন অসুবিধার কথা জানান। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে খলিফা সবার সাথে আলোচনা করেন এবং একটি আলাদা ইসলামী ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব রা: ইসলামী সনের শুরু কী হবে, ইসলামী সনের প্রথম বছর কোন জায়গা থেকে আরম্ভ করা হবে তা নিয়ে বিভিন্ন জনের সাথে পরামর্শ করলেন। কারো পরামর্শ ছিল ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু করা হোক প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জন্মের তারিখ থেকে। আবার কেউ পরামর্শ দিলেন হজরতের ইন্তেকাল থেকেই ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু করার জন্য। হজরত আলী রা: ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরুর পরামর্শ দিলেন হজরতের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের তারিখ থেকে। অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর হজরত আলী রা:-এর পরামর্শই গৃহীত হয়। এরপর আবার প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, কোন মাস থেকে ইসলামী ক্যালেন্ডার গণনা শুরু হবে? অর্থাৎ হিজরি সনের প্রথম মাস হবে কোনটি? এ প্রশ্নেও বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেন। কারো পরামর্শ ছিল রজব মাস হোক ইসলামী সন গণনার প্রথম মাস। তাদের যুক্তি ছিল প্রাক-ইসলামী যুগেও রজব মাসকে সবাই পবিত্র মাস হিসেবে মানত। আবার কেউ পরামর্শ দিলেন রমজান মাস দিয়ে ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু করতে। কারণ মাহে রমজান মুসলমানদের কাছে পবিত্র মাস। পবিত্র হজের মাস হিসেবে জিলহজ মাসকে ইসলামী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস গণনার পরামর্শ ছিল কারো কারো। কিন্তু হজরত ওসমান রা: পরামর্শ দিলেন মহররম মাস দিয়েই ইসলামী সন গণনার। তার যুক্তি ছিল সমগ্র আরব অঞ্চলে নুতন সন গণনা শুরু হয় মহররম মাস দিয়েই। সুতরাং নতুন ইসলামী ক্যালেন্ডারও মহররম মাস দিয়ে শুরু করা হোক। অবশেষে হজরত ওসমান রা:-এর পরামর্শই গৃহীত হয়। বাকি মাসগুলো আরব অঞ্চলে প্রচলিত আগের নিয়ম মতোই রাখা হলো। ইসলামী ক্যালেন্ডারের নামকরণ হয় হিজরি সন।
হজরত মুহাম্মদ সা: নববী ত্রয়োদশ সাল, বরিউল আউয়ালের শুরু অথবা সফর মাসের শেষ দিন সোমবার মদিনার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে ৮ রবিউল আউয়াল, কারো কারো মতে ১২ রবিউল আউয়াল, নববী ১৩ সাল, মোতাবেক ২০ সেপ্টেম্বর, ৬২২ সাল তিনি মদিনায় পৌঁছেন। হিজরতের এ হিসাব অনুযায়ী হিজরি সন গণনা দুই মাস আট দিন বা ১২ দিন পিছিয়ে নিয়ে ১ মহররম থেকে শুরু করা হয়েছে।
মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনে হিজরি সন গণনার গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মুসলমান সন তারিখ হিসাবের জন্য যেকোনো ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে পারেন, ইসলামী শরিয়ায় তাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু তা হাদিসের ওপর আমল হবে না। হাদিসের ওপর আমল হবে যদি তা হিজরি সন হয়। হিজরি সন হচ্ছে ইসলামী ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আল্লাহর রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামদের। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, একদা আল্লাহর রাসূল সা:-কে প্রশ্ন করা হলো তিনি কী কারণে সোমবারকে বিশেষভাবে পালন করেন? উত্তরে তিনি ইরশাদ করলেন, ‘ওই দিন আমি জন্মগ্রহণ করি, ওই দিন আমি নুবুওয়াত লাভ করি এবং ওই দিন আমি স্বদেশ পরিত্যাগ করে মদিনাভিমুখে যাত্রা করি।’
একসময় মুসলমানদের দৈনন্দিন কাজে সন তারিখ গণনায় হিজরি সন ব্যবহার করা হতো। এমনকি বিয়ের তারিখ লেখায় প্রথমেই হিজরি সনের উল্লেখ থাকত, তারপর থাকত বাংলা ও ইংরেজি। বর্তমানে তা কমে গেছে। এটাকে কোনো মতেই আধুনিকতা বলা যাবে না। বরং নিজ ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এটাকে হীনম্মন্যতা বলা চলে। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও হিজরি সন গণনার রেওয়াজ উঠে গেছে। এমনকি সরকারি মাদরাসাগুলোতেও হিজরি সনের প্রচলন নেই। অবশ্য কওমি মাদরাসাগুলো এখনো ইসলামের এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। হাদিসের ওপর আমল এবং মুসলিম জাতিসত্তা হিসেবে নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ ও সংরক্ষণ করার জন্য আমাদের উচিত দৈনন্দিন হিসাবে হিজরি সন, অর্থাৎ ইসলামী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক
No comments