ঋণ যুগে যুগে by কাজী আশরাফ আলী
অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক বাণিজ্য, আমদানি রফতানি, শিল্প-প্রকল্প, সার্ভিস ও বিবিধ খাতে যথার্থ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ আমানত অনুপাত সীমায় খাতভিত্তিক তহবিলসাপেক্ষে পুঁজির পর্যাপ্ততা ও আমানত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিবিধান নীতিমালার মধ্য থেকেই নিজ নিজ ব্যাংকের সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়মের ভিত্তিতে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করে। ব্যাংকার গ্রাহক-আমানতকারীদের তথ্য ব্যাংকের আস্থার স্বার্থেই গোপনীয়তা রক্ষার নিয়ম। বর্তমানে জাতীয় স্বার্থেই ঋণ আদায়, সতর্কতা ও সংশোধন এবং সাবধানতার জন্য গণমাধ্যমগুলোতে বিস্তারিতভাবে ঋণতথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ঋণ বিতরণ পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণে ঋণ অনাদায়ী হয়। বাজার অবস্থা, দুর্যোগ, ভোক্তার চাহিদার পরিবর্তন, বিরূপ অর্থনৈতিক অবস্থা, বাজারজাতকরণ, আন্তর্জাতিক বাজারে দামস্তর পতন, শিল্পের কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাতকরণে, উৎপাদন ব্যাহত হলে, একই পণ্যের অধিক প্রতিযোগী থাকলে, সীমাতিরিক্ত আমদানি হলে, রফতানি ব্যাহত হলে, অন্য কোনো জটিল পরিস্থিতির প্রভাবে, ঋণ পরিশোধে বিলম্ব হলে, ঋণ সীমা পরিশোধে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে ঋণ অনাদায়ী হয়, পর্যায়ক্রমে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়।
ঋণ শুধু যে বর্তমান সময়ে খেলাপি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। ঋণ সব সময় খেলাপি হয়ে আসছে। ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ১০০ শতাংশ প্রদত্ত ঋণ আদায় হবে এমনটি ভাবা অমূলক। ঋণখেলাপি হবে এবং আবার আদায় প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকবে। ঋণখেলাপি হতো আগে ছয় মাসে। এখন খেলাপির সীমা তিন মাস। তাই গ্রাহকের পক্ষে পরিশোধের স্বল্পসীমা বিধায় খেলাপি ঋণের কলেবর বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে এর হার ২ থেকে ৩ শতাংশ আর বাংলাদেশে ১০ শতাংশ। তাই খেলাপি ঋণ আদায়ের বিকল্প নেই।
বর্তমানে লোপাট, হরিলুট, ওলটপালট, ডাকাতি ইত্যাদি শব্দালঙ্কারে ব্যাংকঋণের অবস্থা প্রকাশ করে। শীর্ষ আলোচনায় হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, আগের ডেসটিনি হাল সময়ে বিশ্বাসের ঋণ (এলটিআর) বৃহৎ অঙ্কের খেলাপি ঋণের ধারক।
২০১৪ সালের জুন মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৫১ হাজার ৩৪৪ কোটি, এর মধ্যে ৩৯ হাজার ৪১১ কোটি মন্দঋণ (বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন)। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার কোটি টাকা, এ ছাড়া ১৫ হাজার কোটি অবলোপন হয়েছে। গত ছয় বছর বেসিক ব্যাংকের চার হাজার ৫০০ কোটি টাকাসহ আত্মসাৎ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।
অন্যান্য ঋণের পাশাপাশি বিশ্বাসের ঋণখেলাপি হয়েছে বেশি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর এলটিআর হিসেবে খেলাপি ৪৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা, যা বাণিজ্যিক-ঋণের ৩২.৮২ শতাংশ পুনঃতফসিল, মেয়াদি ঋণে পরিবর্তন, সুদের হার কমানো প্রভৃতি সুবিধা দিলেও আদায় আশানুরূপ নয়। ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে না পারলে বিপুল ঋণ মন্দ হয়ে পড়বে, লাভ না হয়ে পুঁজি হারাবে। আর এ জন্য খেসারত দিতে হবে জনগণের পক্ষে সরকারকে। পুঁজি খোয়ালে পুনর্র্ভরণ অর্থাৎ পুঁজির পর্যাপ্ততার জন্য জনগণের কল্যাণে যে অর্থ খরচ হতে পারত তা রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দের সময় চার হাজার ১০০ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন করতে হচ্ছে। ১৯৯০-৯১ সালে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোকে পুনর্ভরণ করতে বন্ডের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। খেলাপি ঋণের চার ভাগের তিন ভাগ মন্দ বা লোকসান যার শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের জন্য লাভ হারাতে হয়। কর থেকে সরকার বঞ্চিত হয় এবং জনস্বার্থে কল্যাণে ব্যয় ও জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা নিতে পারে না এ ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টোটা। জনগণের টাকায় পুঁজিতে পুনর্ভরণের কাজটা সরকারকেই নিতে হয়। তাই ঋণ মঞ্জুরি ও বিতরণ এবং আদায় কার্যক্রম গতিশীল ও যুগোপযোগী করা জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। জনগণের আমানত যারা রক্ষা করতে পারে না, যারা অনৈতিকভাবে ব্যাংকের অর্থলুণ্ঠনে সহায়তা করে জনকল্যাণে বাধা সৃষ্টিতে উৎসাহী, তাদের ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সিন্ডিকেট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াও অনুচিত হবে না। এরা সীমার ঊর্ধ্বে ঋণ দেয়ায় পুলিশের বিচারে।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে আসা প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা এবং ঋণ পারফরম্যান্স উন্নত করার ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর জোর দিয়েছেন। অবশ্য প্রতিটি ঋণ প্রস্তাব প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের খাতওয়ারি তহবিল, ঋণ আমানত অনুপাত, গ্রাহক সম্পর্ক, ঋণগ্রহীতা নির্বাচন, ব্যবসায় প্রকৃৃতি, উৎপাদন, আন্তর্জাতিক বাজার, প্রতিযোগী পণ্যের চাহিদা, একই গ্রাহকের একই ধরনের প্রস্তাব, ইউনিট ও গ্রুপের দায়দেনা বিশ্লেষণ, অন্য ব্যাংক থেকে গ্রাহক এলে আগের ব্যাংকের দায়দেনা, শিল্প প্রকল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদনক্ষমতা, বাজারজাতকরণ সময়, দায় পরিশোধের সামঞ্জস্যপূর্ণ সময়সীমা নির্ধারণে যুক্তিযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। শাখাপর্যায়ে উচ্চবিলাসী লক্ষ্যমাত্রাÑ টার্গেট আরোপ খেলাপি ঋণের কলেবর বাড়ায়। সে ক্ষেত্রে শাখা থেকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সক্ষমতার পক্ষে মতামত নেয়া আবশ্যক।
বিশ্বাসের ঋণ লিসিট মঞ্জুরিতে খুবই সতর্কতা অবলম্বন একান্ত অপরিহার্য। বড় অঙ্কের ঋণ মঞ্জুরিতে অন্য জি একটি ব্যাংক এক সাথে করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলায় উচ্চ মার্জিন, জামানত ও এলটিআর করার সময় অধিক হারে মার্জিন রাখা দরকার, যাতে করে ঋণের পরিমাণ কমে জামানত সীমায় থাকে। ঝুঁকিমুক্ত সহায়ক সম্পদ থাকলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যতামূলক ইচ্ছা সৃষ্টি হবে। হঠাৎ করে টার্গেট পূর্ণ করতে অন্য ব্যাংকের গ্রাহক এনে ঋণ দেয়া সঠিক নয়। স্থানীয় ঋণপত্র যাতে কাগুজে লেনদেনের জন্য না হয়, সে জন্য শতভাগ সহায়ক জামানত এবং স্বীকৃত বিলের ক্ষেত্রেও গ্যারান্টি (দায়দেনা বিশ্লেষণসহ) নেয়া প্রয়োজন। ঋণপ্রস্তাব প্রক্রিয়ার সময় অনেক কর্মকর্তাই ভয়ভীতি, ট্রান্সফার, হেনস্তার মুখোমুখি হন। এনটিআর, শিল্পের মধ্যবর্তী ঋণ, আমদানি অর্থায়ন ইত্যাদি প্রস্তাব মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট কোনো চাপে, অনুরোধে কাজ না করা উচিত। অধিকন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ইশতেহারের বিধিবিধান অনুসরণ করে নৈতিকতা, দক্ষতা সাহসিকতার সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে হয়রানিমূলক হস্তান্তর করা, নৈতিক মান ুণœ করা, তিরস্কার এবং হেনস্তা করা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখতে ঊর্ধ্বতন নির্বাহীকে সচেষ্ট থাকার বিষয়টি বিবেচনায় আনা দরকার।
বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদ ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। ঋণগ্রহীতাদের বন্ধের দিনগুলোতেও সুদ দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের লাভ ও অতি সুদহার ভোক্তাদের ওপর পড়ে। দ্রব্যমূল্য অতি বেড়ে যাওয়া মুদ্রাস্ফীতি ও আয়-ব্যয়ে বিরূপ অবস্থা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকঋণ আদায়ে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুদ মওকুফ, সুদহার কমানো, পুনঃতফসিল পাঁচ বছর মেয়াদে ঋণ ইত্যাদি। এতে করে ঋণ নিয়মিত হচ্ছে, আদায় বাড়বে ও ব্যাংকের ওপর আস্থা বেড়েছে আমানতও বাড়ছে। আমানতের সুদের হার কমছে এবং ঋণের সুদহার কমলে বিনিয়োগও বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেসব সুবিধা পায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সেসব সুযোগ দিলে দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগ বাড়বে, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
বাংলাদেশের ২৫.৬ শতাংশ মানুষ গরিব। এদের জনপ্রতি দৈনিক গড় আয় ১.২৫ ডলার। আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক কল্যাণ সম্ভব নয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাহসী, দক্ষ, উন্নত নৈতিক মান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে পরিচালনা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহিতা, নজরদারির মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যাংকের বিধিবিধান নিয়ম আচার প্রয়োগ করে সুশাসনের দিকে এগোতে পারে। দেশের জনস্বার্থে, গরিবতা অবসানের সেবার মান বাড়াতে, প্রবৃদ্ধি অর্জনে, ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় গতিশীল ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এ বিশ্বাস জনগণের।
লেখক : রূপালী ব্যাংকের অব: নির্বাহী কর্মকর্তা
ঋণ শুধু যে বর্তমান সময়ে খেলাপি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। ঋণ সব সময় খেলাপি হয়ে আসছে। ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ১০০ শতাংশ প্রদত্ত ঋণ আদায় হবে এমনটি ভাবা অমূলক। ঋণখেলাপি হবে এবং আবার আদায় প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকবে। ঋণখেলাপি হতো আগে ছয় মাসে। এখন খেলাপির সীমা তিন মাস। তাই গ্রাহকের পক্ষে পরিশোধের স্বল্পসীমা বিধায় খেলাপি ঋণের কলেবর বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে এর হার ২ থেকে ৩ শতাংশ আর বাংলাদেশে ১০ শতাংশ। তাই খেলাপি ঋণ আদায়ের বিকল্প নেই।
বর্তমানে লোপাট, হরিলুট, ওলটপালট, ডাকাতি ইত্যাদি শব্দালঙ্কারে ব্যাংকঋণের অবস্থা প্রকাশ করে। শীর্ষ আলোচনায় হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, আগের ডেসটিনি হাল সময়ে বিশ্বাসের ঋণ (এলটিআর) বৃহৎ অঙ্কের খেলাপি ঋণের ধারক।
২০১৪ সালের জুন মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৫১ হাজার ৩৪৪ কোটি, এর মধ্যে ৩৯ হাজার ৪১১ কোটি মন্দঋণ (বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন)। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার কোটি টাকা, এ ছাড়া ১৫ হাজার কোটি অবলোপন হয়েছে। গত ছয় বছর বেসিক ব্যাংকের চার হাজার ৫০০ কোটি টাকাসহ আত্মসাৎ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।
অন্যান্য ঋণের পাশাপাশি বিশ্বাসের ঋণখেলাপি হয়েছে বেশি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর এলটিআর হিসেবে খেলাপি ৪৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা, যা বাণিজ্যিক-ঋণের ৩২.৮২ শতাংশ পুনঃতফসিল, মেয়াদি ঋণে পরিবর্তন, সুদের হার কমানো প্রভৃতি সুবিধা দিলেও আদায় আশানুরূপ নয়। ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে না পারলে বিপুল ঋণ মন্দ হয়ে পড়বে, লাভ না হয়ে পুঁজি হারাবে। আর এ জন্য খেসারত দিতে হবে জনগণের পক্ষে সরকারকে। পুঁজি খোয়ালে পুনর্র্ভরণ অর্থাৎ পুঁজির পর্যাপ্ততার জন্য জনগণের কল্যাণে যে অর্থ খরচ হতে পারত তা রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দের সময় চার হাজার ১০০ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন করতে হচ্ছে। ১৯৯০-৯১ সালে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোকে পুনর্ভরণ করতে বন্ডের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। খেলাপি ঋণের চার ভাগের তিন ভাগ মন্দ বা লোকসান যার শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের জন্য লাভ হারাতে হয়। কর থেকে সরকার বঞ্চিত হয় এবং জনস্বার্থে কল্যাণে ব্যয় ও জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা নিতে পারে না এ ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টোটা। জনগণের টাকায় পুঁজিতে পুনর্ভরণের কাজটা সরকারকেই নিতে হয়। তাই ঋণ মঞ্জুরি ও বিতরণ এবং আদায় কার্যক্রম গতিশীল ও যুগোপযোগী করা জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। জনগণের আমানত যারা রক্ষা করতে পারে না, যারা অনৈতিকভাবে ব্যাংকের অর্থলুণ্ঠনে সহায়তা করে জনকল্যাণে বাধা সৃষ্টিতে উৎসাহী, তাদের ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সিন্ডিকেট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াও অনুচিত হবে না। এরা সীমার ঊর্ধ্বে ঋণ দেয়ায় পুলিশের বিচারে।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে আসা প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা এবং ঋণ পারফরম্যান্স উন্নত করার ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর জোর দিয়েছেন। অবশ্য প্রতিটি ঋণ প্রস্তাব প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের খাতওয়ারি তহবিল, ঋণ আমানত অনুপাত, গ্রাহক সম্পর্ক, ঋণগ্রহীতা নির্বাচন, ব্যবসায় প্রকৃৃতি, উৎপাদন, আন্তর্জাতিক বাজার, প্রতিযোগী পণ্যের চাহিদা, একই গ্রাহকের একই ধরনের প্রস্তাব, ইউনিট ও গ্রুপের দায়দেনা বিশ্লেষণ, অন্য ব্যাংক থেকে গ্রাহক এলে আগের ব্যাংকের দায়দেনা, শিল্প প্রকল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদনক্ষমতা, বাজারজাতকরণ সময়, দায় পরিশোধের সামঞ্জস্যপূর্ণ সময়সীমা নির্ধারণে যুক্তিযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। শাখাপর্যায়ে উচ্চবিলাসী লক্ষ্যমাত্রাÑ টার্গেট আরোপ খেলাপি ঋণের কলেবর বাড়ায়। সে ক্ষেত্রে শাখা থেকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে সক্ষমতার পক্ষে মতামত নেয়া আবশ্যক।
বিশ্বাসের ঋণ লিসিট মঞ্জুরিতে খুবই সতর্কতা অবলম্বন একান্ত অপরিহার্য। বড় অঙ্কের ঋণ মঞ্জুরিতে অন্য জি একটি ব্যাংক এক সাথে করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলায় উচ্চ মার্জিন, জামানত ও এলটিআর করার সময় অধিক হারে মার্জিন রাখা দরকার, যাতে করে ঋণের পরিমাণ কমে জামানত সীমায় থাকে। ঝুঁকিমুক্ত সহায়ক সম্পদ থাকলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যতামূলক ইচ্ছা সৃষ্টি হবে। হঠাৎ করে টার্গেট পূর্ণ করতে অন্য ব্যাংকের গ্রাহক এনে ঋণ দেয়া সঠিক নয়। স্থানীয় ঋণপত্র যাতে কাগুজে লেনদেনের জন্য না হয়, সে জন্য শতভাগ সহায়ক জামানত এবং স্বীকৃত বিলের ক্ষেত্রেও গ্যারান্টি (দায়দেনা বিশ্লেষণসহ) নেয়া প্রয়োজন। ঋণপ্রস্তাব প্রক্রিয়ার সময় অনেক কর্মকর্তাই ভয়ভীতি, ট্রান্সফার, হেনস্তার মুখোমুখি হন। এনটিআর, শিল্পের মধ্যবর্তী ঋণ, আমদানি অর্থায়ন ইত্যাদি প্রস্তাব মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট কোনো চাপে, অনুরোধে কাজ না করা উচিত। অধিকন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ইশতেহারের বিধিবিধান অনুসরণ করে নৈতিকতা, দক্ষতা সাহসিকতার সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে হয়রানিমূলক হস্তান্তর করা, নৈতিক মান ুণœ করা, তিরস্কার এবং হেনস্তা করা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখতে ঊর্ধ্বতন নির্বাহীকে সচেষ্ট থাকার বিষয়টি বিবেচনায় আনা দরকার।
বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদ ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। ঋণগ্রহীতাদের বন্ধের দিনগুলোতেও সুদ দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের লাভ ও অতি সুদহার ভোক্তাদের ওপর পড়ে। দ্রব্যমূল্য অতি বেড়ে যাওয়া মুদ্রাস্ফীতি ও আয়-ব্যয়ে বিরূপ অবস্থা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকঋণ আদায়ে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুদ মওকুফ, সুদহার কমানো, পুনঃতফসিল পাঁচ বছর মেয়াদে ঋণ ইত্যাদি। এতে করে ঋণ নিয়মিত হচ্ছে, আদায় বাড়বে ও ব্যাংকের ওপর আস্থা বেড়েছে আমানতও বাড়ছে। আমানতের সুদের হার কমছে এবং ঋণের সুদহার কমলে বিনিয়োগও বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেসব সুবিধা পায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সেসব সুযোগ দিলে দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগ বাড়বে, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
বাংলাদেশের ২৫.৬ শতাংশ মানুষ গরিব। এদের জনপ্রতি দৈনিক গড় আয় ১.২৫ ডলার। আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক কল্যাণ সম্ভব নয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাহসী, দক্ষ, উন্নত নৈতিক মান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে পরিচালনা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহিতা, নজরদারির মাধ্যমে বিদ্যমান ব্যাংকের বিধিবিধান নিয়ম আচার প্রয়োগ করে সুশাসনের দিকে এগোতে পারে। দেশের জনস্বার্থে, গরিবতা অবসানের সেবার মান বাড়াতে, প্রবৃদ্ধি অর্জনে, ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় গতিশীল ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এ বিশ্বাস জনগণের।
লেখক : রূপালী ব্যাংকের অব: নির্বাহী কর্মকর্তা
No comments