আফ্রিকার সাহিত্য ও সংস্কৃতি by সৈয়দ লুৎফুল হক
আফ্রিকা দীর্ঘ দিন ইউরোপীয়দের কাছে কালো
মহাদেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। যেখানে কোনো সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। যেখানে
পশ্চিমা ও এশিয়ার কোনো সভ্যতা হাজার বছরেও স্পর্শ করেনি। এমনকি উত্তর
আফ্রিকা মুসলমানদের জয় করার পরও। সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের বাণিজ্যের কোনো
ছোঁয়া আফ্রিকানদের স্পর্শ করেনি। আফ্রিকা স্বাধীনভাবে থেকে যায়। কোনো
বিদেশী পণ্য ও ব্যবসায় তাদের কোনোভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তারা তাদের
নিজেদের স্থানীয় পণ্যের আদান-প্রদান ও বাণিজ্য চালিয়ে যায়। তাদের সংস্কৃতির
ক্ষেত্রেও এটি বলবৎ ছিল আফ্রিকার সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক চরিত্র বিশ্লেষণ
করলে দেখা যাবে সামগ্রিকভাবে এর ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র দৃশ্যমান। এদের
প্রায় ৮০০ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠন আফ্রিকার সীমানায় শত
শত বছর ধরে গ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ ছিল। বিস্তৃতভাবে
দেখতে গেলে আফ্রিকাকে একটি সাম্রাজ্য অথবা রাষ্ট্র বলা যায়।
সবকিছু বাদ দিয়ে ভৌগোলিকভাবে দেখতে গেলে ভাষা এবং রাজনীতিগত বৈচিত্র তো আছেই। যদিও আফ্রিকার একটি স্বচ্ছ সংস্কৃতি রয়েছে, যা অন্যাদের সাথে বিনিময় করা যায়। চরিত্রগতভাবে দেখতে গেলে একটি জাতিত্ববোধ লক্ষ করা যায়; যার মূলভিত্তি হলো পরিবার। অথবা একটি গ্রুপ যা পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে অথবা বেঁচে থাকার জন্য পরস্পরের প্রতি সম্পৃক্ত হয়েছে। আফ্রিকার গোত্রগুলো একত্রিত রয়েছে একটি ফেডারেশনের মতো অথবা এক্সটেন্ডেন্ট পরিবারের বা গোষ্ঠীর মতো; যা শাসিত হয় পরিবারের বয়োজেষ্ঠদের শাসনের মাধ্যমে অথবা নির্বাচিত কোনো ব্যক্তি যিনি আধ্যাত্মিক যোগ্যতাসম্পন্ন। তা ছাড়া মূল বিষয় হলো যিনি এ পরিবারকে ধারণ করেন অথবা গোত্রের সদস্য। যিনি জীবিত বা মৃত এ গোত্রের সদস্য ছিলেন, তিনিই কেবল নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচিত হতে পারতেন। যদিও এ সব নিয়ম আফ্রিকার সমাজে কোনো সুন্দর বিষয় নয়, এটিকে নির্দিষ্ট করা যায় পৃথিবীর কৃষক সমাজের গ্রামীণ সভ্যতার সাথে। এসব গোত্রীয় কাঠামো পদ্ধতি ঐতিহ্যগতভাবে আফ্রিকান সংস্কৃতি যা প্রাথমিকভাবে প্রকৃতির বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বাসের দিক নির্দেশনা প্রতীয়মান হয়। আফ্রিকার চরিত্রগত সম্পর্ক হলো পৃথিবীর সব প্রকৃতি যা প্রাকৃতিক ধ্যানধারণার অলৌকিক অধিক্ষমতার প্রতি নিজেকে নিবেদন করা। আফ্রিকানরা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন যিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী তার প্রতি নিজেকে নিবেদন করে। আফ্রিকানদের বিশ্বাস হলো তাদের পূর্বপুরুষ যারা মারা গেছেন তাদের আত্মা প্রাকৃতিক শক্তি হিসেবে জীবিতদের সহায়তা করে এবং তাদের পরিচালিত করে। তাদের সম্মান দেখালে এ ট্রাইবগুলো বেঁচে থাকবে এবং তাদের জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। যে কারণে আনুষ্ঠানিকতা, আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড এবং তাদের যাজকদের একটি উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তি ঘটে আফ্রিকান সমাজে।
কালো আফ্রিকানরা লেখার চেয়ে মৌখিকভাবে তাদের সাহিত্য নিজেদের মধ্যে প্রচার করত, যার ফলে তাদের সাহিত্যের কোনো রেকর্ডে বা মুদ্রিত কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবে তাদের সাহিত্য জনগণের কাছে শ্রুতির মাধ্যমে বেঁচে আছে। দশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আরব স্কলাররা আফ্রিকানদের মধ্যে তাদের রূপকথাগুলো প্রচার করে আসছে, যা আরবি ভাষায় ছিল। বর্তমান সময়ে আফ্রিকানরা আরবিতে রচিত বিখ্যাত রূপকথাগুলো লিখিত রূপ দিতে শুরু করেছে। তা ছাড়া বিভিন্ন আফ্রিকান ভাষায় এগুলো লিপিবদ্ধ হচ্ছে। বর্তমান সময়ে এসব আফ্রিকান রূপকথা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে। তা ছাড়া তাদের সংস্কৃতিতে এর প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রাচীন আফ্রিকানরা মৌখিক এই সাহিত্যকর্ম ‘গ্রাইওটিস’ এক ধরনের বিশেষ শ্রেণী যারা মূলত কবি অথবা ঐতিহাসিক এগুলো সংগ্রহ করত। অতীতের এসব সঙ্গীত তারা মন থেকে গাইত জংলিদের মতো করে, মধ্যযুগের মতো। এসব গ্রাইওটসরা তাদের ইতিহাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিত বংশ পরম্পরায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে সোন্দিতা রূপকথার ব্যাখ্যা বর্ণনা করত, যা মালির বিখ্যাত সাম্রাজ্যের কাহিনী। বিংশ শতাব্দীতে এগুলো ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এই গ্রয়েটটি মনে করিয়ে দেয় নিজস্ব চেতনার দুয়ারকে। এ রূপ কথাটি সুন্দিতা প্রতিষ্ঠাতা মালি সাম্রাজ্যের প্রচার ও স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই রূপকথাগুলো গাওয়া হয়ে থাকে। যেমন করে পশ্চিমা সম্রাট ও শাসকদের কাহিনীগুলো লিখা হয়ে থাকে। যেমন গিলগামেস, এচিলিজ, আলেকজান্ডার এবং রোলেন্ডের (লায়েন চাইল্ড)। সুন্দিতা বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয় মৃতদের নিয়ে তাদের সম্মান, গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় এবং তাদের জনগণের ঐতিহ্যকে নিয়ে। প্রথমে তাদের গ্রয়েট (কবিতার) মাধ্যমে পরিচিত করানো হয়। যেসব গল্পে যুদ্ধের বর্ণনা থাকে ‘টেবন’ সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয় যাতে করে সুন্দিতাগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। মালি চিত্রিত করা হয় শান্তির জায়গাকে, ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রা এবং শেষযাত্রার ইতিহাসকে।
আফ্রিকার সঙ্গীত অত্যন্ত কাব্যিক ও রিদমিক। এই সঙ্গীত একটি তালের ওপর ভিত্তি করে সুরের সমতায় গাওয়া হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় যার কোনো অর্থ থাকে নৃত্যের সাহায্যে সেটি মানুষদের বোঝানো হয়। এসব মিউজিক বা সঙ্গীতে কোনো বাদ্যযন্ত্রের প্রভাব না থাকলেও সুর সৃষ্টিতে কাঠের যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় বিষয় হলো জাতিগত ধ্যান-ধারণা এবং আফ্রিকার সংস্কৃতির প্রভাব ওই সঙ্গীত ও নৃত্যে প্রতিফলিত হতে হবে, যা আফ্রিকার কাব্যের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। যে বিষয়টি আফ্রিকান মিউজিকে দৃষ্টিগোচর হয় সেটি হলো পলিরিদমিক কাঠামো। একটি সঙ্গীতের পিসকে ৫ থেকে ১০ রকম বিভিন্ন রিদমে গাওয়া ও বাজানো হয়। কোনো কোনোটি বারবার একই সুর বাজানো হয়। এসব মিউজিক বাজানোর নিয়ম হলো বৈপরীত্যে অথবা বন্ধ করে মূল বিটের সাথে বাদ্যযন্ত্রটি গতানুগতিকভাবে বাজানো। পশ্চিম আফ্রিকার মিউজিক অনেকটা অফ বিটে বাজানো হয় আদিকালে বাজানো আধুনিক জাজ মিউজিশিয়ানদের মতো।
আফ্রিকানদের অনেক ধরনের পারকাশান রয়েছে যার মধ্যে অনেক রকম ড্রাম এবং রেটেল ব্যবহার করা হয় কবিতা ও নৃত্যশিল্পে উপস্থাপন করার সময়ে। বেলাফো বাদ্যযন্ত্রটি আফ্রিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি দেখতে জাইলোফোনের মতো। এই বোলন এবং কোরা বড় হাসের মতো দেখতে এবং সানসা কাঠের সাউন্ডবোর্ডের সাথে একটি মেনুবার, যার সাথে মেটেল টোঙ্গাস যুক্ত করতে হবে; যা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিত। যেগুলো পরবর্তীতে এই দুইটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় গল্পের বর্ণনা দেয়ার সময়ে। যখন তারা কোনো অলৌকিক শক্তিকে বিশ্বাস করত সেখানে বেআইনি যে কোনো ঘটনা তাদের গোত্রের ওপর তার প্রভাব ফেলত। আফ্রিকাই একমাত্র স্থান যেখানে তাদের নিজস্বতাকে ধরে রেখেছে তাদের সমাজব্যবস্থা, সাহিত্য সঙ্গীত ও নৃত্যকলায়। এমনকি তাদের বেনজো (বেলস, ড্রাম এবং অন্যান্য ইনস্ট্রুমেন্ট যেগুলো হারিয়ে গেছে) এর মধ্যে অনেক বাদ্যযন্ত্র আছে অতি প্রাচীন যা ক্রীতাদাসরা আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার সময় বাজানো হতো অঙ্গভঙ্গি করে। এর ফলে একটি নাটকীয়তা সৃষ্টি হতো অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। আফ্রিকার সংস্কৃতি ও সাহিত্য তাদের জাতিগত বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে ধারণ করে আছে। তাদের আনন্দ-বেদনার প্রকাশ হলো তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি। জীবনকে জাগিয়ে রাখার সাধনায় তারা সাহিত্যকে ধারণ করে আছে।
No comments