ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি by ড. মাহফুজ পারভেজ
ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য। একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল এবং সম্পর্কযুক্ত। মানুষ ধর্মের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে নিজের প্রাত্যহিক জীবনে। অতএব, মানুষের জীবনে ধর্মের, সমাজের, সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। রোজার সময় বাঙালি মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে বিশিষ্টতা ফুটে ওঠে, সেটা খুবই স্পষ্ট। আবার পূজার সময় বাঙালি হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে বিশিষ্টতা ফুটে ওঠে, সেটাও কম স্পষ্ট নয়। অতএব, মানুষের জীবন-যাপন প্রণালিতে ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বিধি আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনস্বীকার্য একটি বিষয়। এ বাস্তব সত্য কথাটি স্বীকার করেই বরং আমরা ধর্মের নৈতিক, মানবিক বোধ, পরহিত, কল্যাণময়তার দিকগুলোকে আমাদের জীবনে সার্থক করার চেষ্টা করতে পারি। অতীতে পীর, দরবেশ, অলি, বুজুর্গ, সুফিরা ইসলামের মানবিক দিকগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং বাংলার নির্যাতিত মানব-সমাজকে আলো-কল্যাণ-মুক্তির দিশা দিয়ে ছিলেন। ধর্মের এসব মানবিক, কল্যাণধর্মী দিকগুলোকে ব্যবহার করে মানবিক-সামাজিক সমপ্রীতি ও ঐক্য বিস্তারের প্রচেষ্টায় বর্তমান রমজানের শিক্ষাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা জানি অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও লোভ-লালসাসহ সব পাপকাজ থেকে বিরত থাকার এক মহান শিক্ষা দেয় মাহে রমজান। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমান রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আত্মার পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণে নিয়োজিত হয়। সারা দিন সব ধরনের পানাহার থেকে মুক্ত হয়ে মোমিন মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। অন্যায়, জুলুম, অবিচার এবং লোভ-লালসাসহ সব ধরনের পাপকাজ থেকে বিরত থাকার এক মহান শিক্ষা দেয় মাহে রমজান। এ শিক্ষাকে বুকে ধারণ করে নিজেদের পবিত্র মানুষ গড়ে তুলতে হবে। অনাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি পরিহার করে সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু রমজানের এ চিরায়ত আহ্বান বাংলাদেশে কতটুকু প্রতিপালিত হচ্ছে, বুকে হাত দিয়ে সবাইকে সে আত্ম-জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হওয়া দরকার। অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও লোভ-লালসা এখানে সাপের মতো লকলকে জিহ্বা দিয়ে সব কিছু চেটে খাচ্ছে। সুইস ব্যাঙ্কে টাকা পাচারের কথা আলোচিত হচ্ছে। গুম-খুন-হামলা-মামলার মতো নির্মম জুলুম-নির্যাতনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। মানুষের ছিনিয়ে নেয়া মৌলিক অধিকার, আইনের শাসন আর ভোটের রাজনৈতিক অধিকারের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে আসছে আলোচনার টেবিলে। অতীতের মতো এ রমজানেও এসব কথা আলোচিত হচ্ছে। অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও লোভ-লালসা-লুটপাটের বিরুদ্ধে রমজানের মহান আহ্বান সবাই শুনতে পায় কি-না, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। বিশেষত, যারা কর্তা ব্যক্তি তারা কিসব করছেন, সে তথ্য-প্রমাণ তো চোখের সামনেই রয়েছে। পরিস্থিতি কেমন নিয়ন্ত্রণহীন, সেটা বিলক্ষণ অনুধাবন করা যায় বাজার-দরের দিকে লক্ষ্য করলে। অর্থাৎ খুন করে বা গুম করে সাত-খুন-মাফের মতো দাম বাড়িয়ে বা ভেজাল দিয়েও বেশ বহাল তবিয়তে থাকা সম্ভব হচ্ছে। মানে হলো, ওপর থেকে নিচে সুবিধা মতো যেমন পারো করতে থাকো। জনগণ আর নীতি-নৈতিকতার দিকে তাকানোর দরকার নেই। সাংবাৎসরিক এহেন অবক্ষয় আদর্শিক রমজানের সময়েও দেখতে পাওয়া যাবে, সেটা ভাবতেও কষ্ট হয়। সরকার যে সারা বছরের মতো পবিত্র মাহে রমজানের উদাসীন থাকবে, সেটা কে জানতো! উদাসীন না হলে ঠিক রমজানের আগে আগে দামের এতো লাভ কেন? বন্যা নেই, খরা নেই, কোন উপযুক্ত কারণও নেই, তবুও দাম বাড়ছে কেন, তার উত্তরও অজানা। এসব উদাসীনতা ছাড়া আর কি! সরকারকে এ কারণে উদাসীন বলা হয়েছে জনগণের পক্ষ থেকে এবং যারা মজুতদারি, মুনাফাখোরি করে কৃত্রিম দাম বাড়িয়ে অগাত কালো টাকার মালিক হয়েছে, সেসব সরকারি-বেসরকারি দুর্নীতিবাজদের নিন্দাও করছে মানুষ। প্রকাশ্যে না পারলেও, গোপনে তো করছেই। বিশেষত কালো টাকার মালিক মজুতদার ও মুনাফাখোররা এক ঘৃণিত শ্রেণী। কিন্তু সরকারের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী কি বলছেন? তার সব কথা নিয়ে আলোচনা করলে ভিরমি খেতে হবে। তার সম্পর্কে প্রায়- সকলেই জানেন। শুধু এটুকুই উল্লেখ করা যথেষ্ট যে, তার উত্থাপিত ও প্রস্তাবিত আর্থিক বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে। তাহলে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে কালো টাকা বানানো আর সেগুলোকে সাদা করার ব্যবস্থা থাকলে কালো টাকার চক্কর কি আদৌ বন্ধ হবে? অথচ পবিত্র মাহে রমজান সব ধরনের অন্যায়, অপকর্ম, পাপাচার বন্ধ করার মাধ্যমে মানুষকে আত্মশুদ্ধির ডাক দেয়। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন রমজানের প্রথম রাত্রি আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর এর কোন দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অতঃপর এর কোন দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো।” বাংলাদেশে কালো টাকার মালিক, মজুতদার, মুনাফাখোর আর নানা রকমের মন্দের অন্বেষণকারীদেরকে যে থামানো যাচ্ছে না, তার প্রমাণ বাজারে, রাজনীতিতে, আইনশৃঙ্খলায় বিদ্যমান। অতএব ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক মেনে নিয়ে এ সম্পর্ককে ইতিবাচক ও ভালর দিকে নেয়ার জরুরি কাজ এখনো বাকি। রমজানের চেতনায় সে কাজটি করার দিকেও মনোযোগী হতে হবে সবাইকে।
No comments