দল নয়, বাণিজ্যে বিভোর আ.লীগের নেতা-কর্মীরা by আনোয়ার হোসেন
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এখন আর দলীয় কাজে খুব একটা মন নেই। তাঁদের বেশির ভাগের মূল মনোযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে। ক্ষমতাসীন দলটির সাংগঠনিক তৎপরতা এখন অনেকটা দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর বাইরে সাংগঠনিক অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটি।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতা-কর্মীদেরও এখন আর দলীয় কর্মকাণ্ডে আগ্রহ নেই। যার বড় উদাহরণ দলের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।
৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের জন্য আওয়ামী লীগ পাঁচটি উপকমিটি করে। প্রায় দুই মাস ধরে একাধিক বৈঠক করেন এসব কমিটির নেতারা। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগও একাধিকবার প্রস্তুতি সভা করেছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সফল করতে। এত আয়োজনের পরও ২৫ জুন প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীর সমাগম খুবই কম হওয়ায় প্রধান অতিথি সজীব ওয়াজেদ জয় অনুষ্ঠানে আসেননি। লতিফ সিদ্দিকী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ কয়েকজন নেতা অনুষ্ঠান চালালেও মঞ্চের সামনে কর্মী সমাগম ছিল বড়জোর এক শ। ২৬ জুন দ্বিতীয় দিন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কর্মসূচিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবদুল মান্নান, হাছান মাহমুদ, আবদুস সোবহানসহ সাতজন নেতা এলেও কোনো কর্মীর উপস্থিতি ছিল না। এমনকি প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাজেদা চৌধুরীও আসেননি। বিব্রত সাত নেতা কর্মীর অপেক্ষায় কিছুক্ষণ মঞ্চে বসে থাকেন। পরে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করে মলিন মুখে চলে যান, আলোচনা অনুষ্ঠান আর হয়নি। পরে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার থেকে আসা শিল্পীরা দর্শক ছাড়াই দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করেন।
এরপর একই স্থানে তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতেও জমায়েত আশানুরূপ ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, এসব কর্মসূচি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগই সফল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মসূচির ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয়ের অভাব ছিল। তবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অন্য কর্মসূচিগুলো সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুব কম লোকই নিজ উদ্যোগে আসে। সাংসদ বা নেতারা টাকা খরচ করে বড় জমায়েত নিশ্চিত করেন। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব অনুষ্ঠানে থাকেন, তাতে লোক জমায়েতের একটি প্রতিযোগিতা থাকে নেতাদের মধ্যে।
তবে এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাপনী দিনের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা থাকা সত্ত্বেও জমায়েত ভালো হয়নি। অথচ এর কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী চীন সফর শেষে ফিরলে বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত তাঁর যাত্রাপথে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ রাস্তায় ব্যাপক জনসমাগম করেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভাগুলোতে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
এ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে আসা একজন নেতা বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই সহ-সম্পাদক নিয়োগের হিড়িক পড়ে যায়। তিন দফায় প্রায় সাড়ে পাঁচ শ সহ-সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন এসব সহ-সম্পাদককে আর দলীয় কার্যালয়ে দেখা যায় না। তাঁদের অনেকে সচিবালয়, নগর ভবন, রাজউক, খাদ্য ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যুৎ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তদবিরে ব্যস্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবল ঢাকায়ই নয়, সারা দেশেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই অর্থ উপার্জনের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। ফলে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়ে ‘সময় নষ্ট’ করতে আগ্রহী নন কেউ।
তার ওপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মাঠপর্যায়ে নিষ্ক্রিয় থাকায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার চাপও বোধ করছেন না বলে একাধিক নেতা মন্তব্য করেছেন।
গত দুই দিনে আওয়ামী লীগের পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ের বাইরে বাকি কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা খুবই কম। এ জন্যই সবাই সরকার ও দলে নিজের অবস্থান তৈরি কিংবা ধরে রাখাকেই বড় কাজ বলে মনে করেন।
আর মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তদবির কিংবা টেন্ডারবাজিকেই বেশি লাভজনক মনে করেন। আর, এসব ‘বাণিজ্যের’ নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় হানাহানির ঘটনা ঘটছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা এবং কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় অভ্যন্তরীণ সংঘাত এর বড় উদাহরণ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক নেতা বলেন, অধিকাংশ মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন বিনা ভোটে। ফলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী কিংবা ভোটারের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। বিরোধী দলের দুর্বল অবস্থানের কারণে সরকার, সংসদ ও দল—যে যেখানে আছেন, সবাই মনে করছেন, আগামী পাঁচ বছর নিরাপদ। তাই সবাই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, টানা ক্ষমতায় থাকলে একটি দলের যেসব সমস্যা হয়, এর সব কটি উপসর্গই আওয়ামী লীগে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি, সরকারের বাজেট, গুম-খুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয় না। একক সিদ্ধান্ত দেন দলীয় ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তিনি বিষয়ভেদে কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করলেও ওই সব নেতা মতামত দিয়ে থাকেন নেত্রীর মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে।
দলীয় উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ, সভাপতিমণ্ডলী, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক কিংবা বর্ধিত সভাগুলোতে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, এর বেশির ভাগই ছিল দিবসভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দলের সম্মেলন করা। সময়-তারিখ ঠিক করে দেওয়ার পরও দেশের অধিকাংশ জেলা-উপজেলার সম্মেলন সম্পন্ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বর্তমান কমিটি হওয়ার পর গত দেড় বছরে সভাপতিমণ্ডলীর একটি সভা হয়েছে, সেটিও পরিচিতিমূলক। এরপর আর কোনো সভা হয়নি। ২০০৮ সালের পর কার্যনির্বাহী সংসদের যত বৈঠক হয়েছে, সেগুলোতে গালগপ্পই হয়েছে বেশি। দিবসভিত্তিক কর্মসূচির বাইরে কোনো কিছু হয়নি। দলের প্রধান আগে থেকে যা ভেবে রেখেছেন, সেই অনুযায়ী একটা সূচনা বক্তব্য দিয়েছেন। এরপর সেই বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ কিংবা বিতর্ক করার সাহসও দেখাননি কোনো নেতা।
সাত জেলা-মহানগর কমিটি সময়মতো হচ্ছে না: যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে পাঁচটি জেলা ও দুটি মহানগর কমিটির সম্মেলনের দিন-তারিখ ঠিক করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩০ জুনের মধ্যে কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরগুনা ও মুিন্সগঞ্জ জেলা কমিটির সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুধু মুিন্সগঞ্জের সম্মেলন হয়েছে এবং সেখানে পুরোনো নেতারাই ফিরে এসেছেন।
সৈয়দ আশরাফের নিজের জেলা কিশোরগঞ্জে ১৯৯৭ সালের পর সম্মেলন হয়নি। ১২ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ের সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে রমজান মাসের কারণ দেখিয়ে। বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা কমিটির সম্মেলন পেছানো হয়েছে। রাজশাহী ও খুলনা মহানগরে সম্মেলন হওয়ার কথা চলতি মাসের মাঝামাঝি। খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক ও সাংসদ মিজানুর রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে কয়েকবার মারামারি হয়েছে। সেখানে সম্মেলন নিরবচ্ছিন্ন করার বিষয়ে শঙ্কা আছে দলের হাই কমান্ডে।
নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরসহ নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত জেলাগুলোতে সম্মেলনের দিন-তারিখ ঠিক করারই সাহস পাচ্ছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে দেড় বছর আগে। কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে। এখনো এই কমিটি হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে সাংগঠনিক বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তার বেশির ভাগেরই বাস্তবায়ন হয়নি। বিভাগীয় মহাসমাবেশ, জেলা-উপজেলার কাউন্সিল, তৃণমূলে সাংগঠনিক সফর ও বর্ধিত সভা, সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন অভিযান, দলীয় কার্যালয় স্থাপনসহ এমন অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটি।
অবশ্য দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, রমজান আর সংসদ অধিবেশনের কারণে তৃণমূলের সম্মেলন একটু দেরি হচ্ছে। আর, যে সাতটা জেলা-মহানগরের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো ঈদের পর হয়ে যাবে।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতা-কর্মীদেরও এখন আর দলীয় কর্মকাণ্ডে আগ্রহ নেই। যার বড় উদাহরণ দলের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।
৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের জন্য আওয়ামী লীগ পাঁচটি উপকমিটি করে। প্রায় দুই মাস ধরে একাধিক বৈঠক করেন এসব কমিটির নেতারা। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগও একাধিকবার প্রস্তুতি সভা করেছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সফল করতে। এত আয়োজনের পরও ২৫ জুন প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীর সমাগম খুবই কম হওয়ায় প্রধান অতিথি সজীব ওয়াজেদ জয় অনুষ্ঠানে আসেননি। লতিফ সিদ্দিকী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ কয়েকজন নেতা অনুষ্ঠান চালালেও মঞ্চের সামনে কর্মী সমাগম ছিল বড়জোর এক শ। ২৬ জুন দ্বিতীয় দিন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কর্মসূচিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবদুল মান্নান, হাছান মাহমুদ, আবদুস সোবহানসহ সাতজন নেতা এলেও কোনো কর্মীর উপস্থিতি ছিল না। এমনকি প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাজেদা চৌধুরীও আসেননি। বিব্রত সাত নেতা কর্মীর অপেক্ষায় কিছুক্ষণ মঞ্চে বসে থাকেন। পরে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করে মলিন মুখে চলে যান, আলোচনা অনুষ্ঠান আর হয়নি। পরে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার থেকে আসা শিল্পীরা দর্শক ছাড়াই দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করেন।
এরপর একই স্থানে তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতেও জমায়েত আশানুরূপ ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, এসব কর্মসূচি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগই সফল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মসূচির ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয়ের অভাব ছিল। তবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অন্য কর্মসূচিগুলো সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুব কম লোকই নিজ উদ্যোগে আসে। সাংসদ বা নেতারা টাকা খরচ করে বড় জমায়েত নিশ্চিত করেন। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব অনুষ্ঠানে থাকেন, তাতে লোক জমায়েতের একটি প্রতিযোগিতা থাকে নেতাদের মধ্যে।
তবে এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাপনী দিনের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা থাকা সত্ত্বেও জমায়েত ভালো হয়নি। অথচ এর কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী চীন সফর শেষে ফিরলে বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত তাঁর যাত্রাপথে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ রাস্তায় ব্যাপক জনসমাগম করেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভাগুলোতে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি।
এ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে আসা একজন নেতা বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই সহ-সম্পাদক নিয়োগের হিড়িক পড়ে যায়। তিন দফায় প্রায় সাড়ে পাঁচ শ সহ-সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন এসব সহ-সম্পাদককে আর দলীয় কার্যালয়ে দেখা যায় না। তাঁদের অনেকে সচিবালয়, নগর ভবন, রাজউক, খাদ্য ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যুৎ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তদবিরে ব্যস্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেবল ঢাকায়ই নয়, সারা দেশেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই অর্থ উপার্জনের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছেন। ফলে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়ে ‘সময় নষ্ট’ করতে আগ্রহী নন কেউ।
তার ওপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মাঠপর্যায়ে নিষ্ক্রিয় থাকায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার চাপও বোধ করছেন না বলে একাধিক নেতা মন্তব্য করেছেন।
গত দুই দিনে আওয়ামী লীগের পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ের বাইরে বাকি কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা খুবই কম। এ জন্যই সবাই সরকার ও দলে নিজের অবস্থান তৈরি কিংবা ধরে রাখাকেই বড় কাজ বলে মনে করেন।
আর মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তদবির কিংবা টেন্ডারবাজিকেই বেশি লাভজনক মনে করেন। আর, এসব ‘বাণিজ্যের’ নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় হানাহানির ঘটনা ঘটছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা এবং কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় অভ্যন্তরীণ সংঘাত এর বড় উদাহরণ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক নেতা বলেন, অধিকাংশ মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন বিনা ভোটে। ফলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী কিংবা ভোটারের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। বিরোধী দলের দুর্বল অবস্থানের কারণে সরকার, সংসদ ও দল—যে যেখানে আছেন, সবাই মনে করছেন, আগামী পাঁচ বছর নিরাপদ। তাই সবাই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, টানা ক্ষমতায় থাকলে একটি দলের যেসব সমস্যা হয়, এর সব কটি উপসর্গই আওয়ামী লীগে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি, সরকারের বাজেট, গুম-খুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয় না। একক সিদ্ধান্ত দেন দলীয় ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তিনি বিষয়ভেদে কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করলেও ওই সব নেতা মতামত দিয়ে থাকেন নেত্রীর মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে।
দলীয় উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ, সভাপতিমণ্ডলী, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক কিংবা বর্ধিত সভাগুলোতে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, এর বেশির ভাগই ছিল দিবসভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দলের সম্মেলন করা। সময়-তারিখ ঠিক করে দেওয়ার পরও দেশের অধিকাংশ জেলা-উপজেলার সম্মেলন সম্পন্ন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বর্তমান কমিটি হওয়ার পর গত দেড় বছরে সভাপতিমণ্ডলীর একটি সভা হয়েছে, সেটিও পরিচিতিমূলক। এরপর আর কোনো সভা হয়নি। ২০০৮ সালের পর কার্যনির্বাহী সংসদের যত বৈঠক হয়েছে, সেগুলোতে গালগপ্পই হয়েছে বেশি। দিবসভিত্তিক কর্মসূচির বাইরে কোনো কিছু হয়নি। দলের প্রধান আগে থেকে যা ভেবে রেখেছেন, সেই অনুযায়ী একটা সূচনা বক্তব্য দিয়েছেন। এরপর সেই বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ কিংবা বিতর্ক করার সাহসও দেখাননি কোনো নেতা।
সাত জেলা-মহানগর কমিটি সময়মতো হচ্ছে না: যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে পাঁচটি জেলা ও দুটি মহানগর কমিটির সম্মেলনের দিন-তারিখ ঠিক করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩০ জুনের মধ্যে কিশোরগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরগুনা ও মুিন্সগঞ্জ জেলা কমিটির সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুধু মুিন্সগঞ্জের সম্মেলন হয়েছে এবং সেখানে পুরোনো নেতারাই ফিরে এসেছেন।
সৈয়দ আশরাফের নিজের জেলা কিশোরগঞ্জে ১৯৯৭ সালের পর সম্মেলন হয়নি। ১২ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ের সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে রমজান মাসের কারণ দেখিয়ে। বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা কমিটির সম্মেলন পেছানো হয়েছে। রাজশাহী ও খুলনা মহানগরে সম্মেলন হওয়ার কথা চলতি মাসের মাঝামাঝি। খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক ও সাংসদ মিজানুর রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে কয়েকবার মারামারি হয়েছে। সেখানে সম্মেলন নিরবচ্ছিন্ন করার বিষয়ে শঙ্কা আছে দলের হাই কমান্ডে।
নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরসহ নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত জেলাগুলোতে সম্মেলনের দিন-তারিখ ঠিক করারই সাহস পাচ্ছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে দেড় বছর আগে। কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে। এখনো এই কমিটি হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে সাংগঠনিক বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তার বেশির ভাগেরই বাস্তবায়ন হয়নি। বিভাগীয় মহাসমাবেশ, জেলা-উপজেলার কাউন্সিল, তৃণমূলে সাংগঠনিক সফর ও বর্ধিত সভা, সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন অভিযান, দলীয় কার্যালয় স্থাপনসহ এমন অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটি।
অবশ্য দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, রমজান আর সংসদ অধিবেশনের কারণে তৃণমূলের সম্মেলন একটু দেরি হচ্ছে। আর, যে সাতটা জেলা-মহানগরের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো ঈদের পর হয়ে যাবে।
No comments