আধুনিক কবিতা হচ্ছে কালোপযোগী নতুন কবিতা by আবুল হোসেন
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : বিমল গুহ ও নিতাই সেন
সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তির পরে এই অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন ও সাহিত্য শিল্পে শুরু হয় নতুন উদ্দীপনা। সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার কবিতায় দ্বিমুখী ধারার আর্বিভাব ঘটে। একটি ধারা পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনা প্রবর্তনের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। আর একটি ধারার কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও তিরিশোত্তর নতুন কবিতার লক্ষণ প্রত্যক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে। এই ধারার অগ্রগণ্য কবি ছিলেন আবুল হোসেন। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত। এই গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে নতুন ধারার কাব্যযাত্রা শুরু হয়। এই প্রগতিশীল ধারাটি দিন দিন বিকশিত হতে থাকে। আবুল হোসেনের গ্রন্থসংখ্যা ২৫। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ- বিরস সংলাপ (১৯৬৯), হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫), এখনো সময় আছে (১৯৯৬), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৭), আর কিসের অপেক্ষা (২০০০), কবিতা সংগ্রহ (২০০০), ছোটদের কাব্য-রাজ রাজরা (১৯৯৭) ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে- অনুবাদ কবিতা, গদ্য ও আÍজীবনীগ্রন্থ। এসব গ্রন্থে তিনি তার বলিষ্ঠতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য এই কবি ১৯৪৭-পরবর্তী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কবিতাকে প্রগতিশীল চিন্তার বাহন করে এগিয়ে গেছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৩ সালে লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। এছাড়াও তিনি পদাবলী পুরস্কার, মাযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদকসহ আরও সম্মাননা লাভ করেছেন। কবিতার শুদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তার কাব্য বিশ্বাসে কবিতার পরিমাণ মুখ্য ছিল না, কবিতার মানই ছিল আসল নিক্তি। ২৯ জুন ৯২ বছর বয়সে কবি মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট বৃহত্তর খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম-ইসমাইল হোসেন, মাতা মেহেরুন্নেসা। স্ত্রী সাহানা হোসেন, ১৯৯৪ সালে প্রয়াত হয়েছেন। তাদের দুই ছেলে-সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন ও সোহেল রেজা খালেদ হোসেন। দুজনই বাংলাদেশের দুই আর্থিক সংস্থার প্রধান নির্বাহী। দুই মেয়ে-ফারাহ্ হোসেন (প্রবাসী), নাজ হোসেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
দীর্ঘদিন আগে, ২০০৫ সালের ১৩ জানুয়ারি আমরা গিয়েছিলাম কবির ধানমণ্ডির বাড়ি-সাহানায়। তখন তিনি বেশ সচল, ধারাবাহিক আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম আত্মজীবনী আমার এই ছোট্ট ভুবন, ২০০৫ সালেই প্রকাশিত হয় আরেক ভুবন, এরপর ২০০৭ সালে দুঃস্বপ্নের কাল, ২০০৯ সালে স্বপ্নভঙ্গের পালা ও ২০১৩ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত হয় অপরাহ্নের স্মৃতি। আমাদের দীর্ঘ সময় দিয়েছিলেন। সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে। তবে আমাদের আলাপ সীমাবদ্ধ ছিল কবিতায়। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ সাহিত্যে পত্রিকা কবি সম্মেলন-এ প্রকাশ করা হয়েছিল। কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হল।
কবি বেশ প্রত্যয়ী কণ্ঠে শুরু করলেন তার জীবনকথা, কবিতার কথা। বললেন-আমি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কয়েকটা ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমার কবিতার পথে আসা। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কিছু বই উপহার পাই। বইগুলো পেয়ে কী-যে খুশি হয়েছিলাম- তা স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। একটার পর একটা বইগুলো পড়ে ফেলি। এর মধ্যে একটা বইয়ের নাম সোনার তরী, নিচে লেখকের নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বইটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। তখন ছবির বই হলে পছন্দ হতো খুব। তবুও বইটা পড়তে শুরু করি। দুটো লাইন পড়েই কিসের যেন শিহরণ জাগল মনে। ছন্দের দোলায় দুলে উঠলাম আমি- গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা...কবিতাটি পড়ে যে কিছু বুঝেছিলাম তা নয়, তবুও ভালো লাগল পড়তে। কবিতাটি পড়ে আমার মনে হল- কী করে মানুষ এমনভাবে লিখতে পারে? আমি কি কখনও এ রকম লিখতে পারব!
আমি পড়তাম খুব। পড়ার অভ্যাসটা কোত্থেকে পেয়েছিলাম জানি না। স্কুলপাঠ্য বইয়ের বাইরের বই স্কুল-লাইব্রেরি থেকে নিয়ে, বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে পড়তাম। গল্পের বা অ্যাডভেঞ্চারের বই নয়, কবিতার আবেদনটা সম্পূর্ণই আলাদা। সেই সময় আমার প্রিয় কাগজ ছিল-মৌচাক, মাস পয়লা, শিশুসাথী প্রভৃতি। এ থেকে আমি প্রথম সাহিত্যের প্রেরণা পাই। সেই সময় বিয়ের আসরে, বর-কনের উদ্দেশ্যে উপহার নামে কিছু একটা লিখে বিয়ের আসরে বিলি করা হতো। আমিও আমার বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে উপহার-এ একটি কবিতা লিখে ফেললাম। সেটি বিয়ের আসরে বিলিও করা হল। এটি লিখে আমার স্কুল-শিক্ষকসহ অনেকের প্রশংসা পেয়েছি। সেই উৎসাহে লেখা হতে লাগল, কবিতার পর কবিতা। তবে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় স্কুল ম্যাগাজিনে-চৌদ্দ অক্ষরের পয়ারে লেখা একটি কবিতা।
ষ বাংলা কবিতায় তিরিশের পালাবদলের পরে আপনার আগমন ঘটলেও এই অঞ্চলের কবিতায় তখনও রবীন্দ্রবলয় এবং ইসলামী পুনর্জাগরণের ভাবনাপুষ্ট আবহ বিরাজমান ছিল, আপনি এ থেকে বেরিয়ে এলেন কী করে?
আবুল হোসেন : আমি যখন ছেলেবেলায় প্রথম কবিতা লিখি, সেটা রবীন্দ্রনুসারী হয়ে যেত। তারপর যখন অন্যদের কবিতাও বেশি করে পড়া শুরু করলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে আমাকে ভিন্নরকম কবিতা লেখার চেষ্টা করতে হবে-যা রবীন্দ্র অনুসারী হবে না। করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায় কিংবা যতীন্দ্রমোহন বাগচী- কেউ রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে যেতে পারেননি; পেরেছিলেন-যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, আর পেরেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহীতে তিনি মাত্রাবৃত্তকে ভেঙে আলাদা সুর সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
আমার মনে হল যে, আমি রবীন্দ্র-নজরুলের দিকে যেতে পারি না। সে সময় জসীমউদ্দীনও আলাদা ধারায় লেখা শুরু করলেন। তিনি লোকগীতির ধারায় লোকগাথা রচনায় মনোযোগী হলেন। এভাবে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ, আমার মধ্যেও সে প্রচেষ্টা ছিল। আমি নিজের মতো লিখতে চেয়েছি।
আপনি শুরুতেই কি সচেতনভাবে আলাদা হতে চেয়েছিলেন?
আবুল হোসেন : আমার সবসময় মনে হতো কবিতার প্রচলিত যে ধারা-তা থেকে কিছু বর্জন করে এবং কিছু গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে। একজন কবিকে যদি সত্যিকার কবি হতে হয়, তাহলে তার নিজের ভাষা খুঁজে বের করতে হবে। কবিকে নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে হবে। নিজের একটা কাব্যভাষা তৈরি করতে হবে। যে কাজ সবাই করেছেন, সে কাজ করলে কোনো জায়গা হবে না কাব্যের ভুবনে।
আমি সমর সেনকে খুব পছন্দ করতাম। সমর সেনের কবিতা থেকেই আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি প্রকৃত গদ্য কবিতার পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথও গদ্য কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তা কাহিনীনির্ভর। সমর সেন সাম্যবাদী হলেও প্রকৃত রোমান্টিক গদ্য কবিতা লিখেছিলেন। আমি সমর সেনের কাছ থেকে এটুকু নিলাম যে-কবিতাকে গদ্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। আমিও চেয়েছিলাম কবিতার ভাষা মুখের ভাষার দিকে যাবে। আর একটি জিনিস মনে রাখতাম-কবিতাকে গদ্যের কাছাকাছি নিলেও কবিতায় ছন্দ রক্ষিত হবে। আমার প্রথম বই নববসন্ত-এ তা পুরোপুরি আমি করতে পারিনি। তা করতে আমার আরও ৩-৪ বছর সময় লেগে গিয়েছিল।
ষ চল্লিশের কবিদের মধ্যে একমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠ কবি হিসেবে আপনার
প্রতিক্রিয়া কী?
আবুল হোসেন : আমি এই বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব দিই না। কেউ যদি বলেন যে-উনি আমাদের জ্যেষ্ঠ কবি, তাতে কবিতার কিছু আসে যায় না। আমার মনে হয় যে, বিধাতা আমার প্রতি সদয়, আমি এখনও কর্মক্ষম আছি। আমি চাই-আমি যেন শেষদিন পর্যন্ত কর্মক্ষম থেকে যেতে পারি। আমি জীবনযাপন করি নিয়মমাফিক, খাওয়া-দাওয়াও স্বনিয়ন্ত্রিত। সারাজীবন নিয়ম মেনেই চলেছি, এখনও চলি।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]
সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তির পরে এই অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন ও সাহিত্য শিল্পে শুরু হয় নতুন উদ্দীপনা। সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার কবিতায় দ্বিমুখী ধারার আর্বিভাব ঘটে। একটি ধারা পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনা প্রবর্তনের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। আর একটি ধারার কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও তিরিশোত্তর নতুন কবিতার লক্ষণ প্রত্যক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে। এই ধারার অগ্রগণ্য কবি ছিলেন আবুল হোসেন। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত। এই গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে নতুন ধারার কাব্যযাত্রা শুরু হয়। এই প্রগতিশীল ধারাটি দিন দিন বিকশিত হতে থাকে। আবুল হোসেনের গ্রন্থসংখ্যা ২৫। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ- বিরস সংলাপ (১৯৬৯), হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫), এখনো সময় আছে (১৯৯৬), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৭), আর কিসের অপেক্ষা (২০০০), কবিতা সংগ্রহ (২০০০), ছোটদের কাব্য-রাজ রাজরা (১৯৯৭) ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে- অনুবাদ কবিতা, গদ্য ও আÍজীবনীগ্রন্থ। এসব গ্রন্থে তিনি তার বলিষ্ঠতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য এই কবি ১৯৪৭-পরবর্তী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কবিতাকে প্রগতিশীল চিন্তার বাহন করে এগিয়ে গেছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৩ সালে লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। এছাড়াও তিনি পদাবলী পুরস্কার, মাযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদকসহ আরও সম্মাননা লাভ করেছেন। কবিতার শুদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তার কাব্য বিশ্বাসে কবিতার পরিমাণ মুখ্য ছিল না, কবিতার মানই ছিল আসল নিক্তি। ২৯ জুন ৯২ বছর বয়সে কবি মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট বৃহত্তর খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম-ইসমাইল হোসেন, মাতা মেহেরুন্নেসা। স্ত্রী সাহানা হোসেন, ১৯৯৪ সালে প্রয়াত হয়েছেন। তাদের দুই ছেলে-সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন ও সোহেল রেজা খালেদ হোসেন। দুজনই বাংলাদেশের দুই আর্থিক সংস্থার প্রধান নির্বাহী। দুই মেয়ে-ফারাহ্ হোসেন (প্রবাসী), নাজ হোসেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
দীর্ঘদিন আগে, ২০০৫ সালের ১৩ জানুয়ারি আমরা গিয়েছিলাম কবির ধানমণ্ডির বাড়ি-সাহানায়। তখন তিনি বেশ সচল, ধারাবাহিক আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম আত্মজীবনী আমার এই ছোট্ট ভুবন, ২০০৫ সালেই প্রকাশিত হয় আরেক ভুবন, এরপর ২০০৭ সালে দুঃস্বপ্নের কাল, ২০০৯ সালে স্বপ্নভঙ্গের পালা ও ২০১৩ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত হয় অপরাহ্নের স্মৃতি। আমাদের দীর্ঘ সময় দিয়েছিলেন। সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে। তবে আমাদের আলাপ সীমাবদ্ধ ছিল কবিতায়। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ সাহিত্যে পত্রিকা কবি সম্মেলন-এ প্রকাশ করা হয়েছিল। কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হল।
কবি বেশ প্রত্যয়ী কণ্ঠে শুরু করলেন তার জীবনকথা, কবিতার কথা। বললেন-আমি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কয়েকটা ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমার কবিতার পথে আসা। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কিছু বই উপহার পাই। বইগুলো পেয়ে কী-যে খুশি হয়েছিলাম- তা স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। একটার পর একটা বইগুলো পড়ে ফেলি। এর মধ্যে একটা বইয়ের নাম সোনার তরী, নিচে লেখকের নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বইটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। তখন ছবির বই হলে পছন্দ হতো খুব। তবুও বইটা পড়তে শুরু করি। দুটো লাইন পড়েই কিসের যেন শিহরণ জাগল মনে। ছন্দের দোলায় দুলে উঠলাম আমি- গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা...কবিতাটি পড়ে যে কিছু বুঝেছিলাম তা নয়, তবুও ভালো লাগল পড়তে। কবিতাটি পড়ে আমার মনে হল- কী করে মানুষ এমনভাবে লিখতে পারে? আমি কি কখনও এ রকম লিখতে পারব!
আমি পড়তাম খুব। পড়ার অভ্যাসটা কোত্থেকে পেয়েছিলাম জানি না। স্কুলপাঠ্য বইয়ের বাইরের বই স্কুল-লাইব্রেরি থেকে নিয়ে, বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে পড়তাম। গল্পের বা অ্যাডভেঞ্চারের বই নয়, কবিতার আবেদনটা সম্পূর্ণই আলাদা। সেই সময় আমার প্রিয় কাগজ ছিল-মৌচাক, মাস পয়লা, শিশুসাথী প্রভৃতি। এ থেকে আমি প্রথম সাহিত্যের প্রেরণা পাই। সেই সময় বিয়ের আসরে, বর-কনের উদ্দেশ্যে উপহার নামে কিছু একটা লিখে বিয়ের আসরে বিলি করা হতো। আমিও আমার বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে উপহার-এ একটি কবিতা লিখে ফেললাম। সেটি বিয়ের আসরে বিলিও করা হল। এটি লিখে আমার স্কুল-শিক্ষকসহ অনেকের প্রশংসা পেয়েছি। সেই উৎসাহে লেখা হতে লাগল, কবিতার পর কবিতা। তবে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় স্কুল ম্যাগাজিনে-চৌদ্দ অক্ষরের পয়ারে লেখা একটি কবিতা।
ষ বাংলা কবিতায় তিরিশের পালাবদলের পরে আপনার আগমন ঘটলেও এই অঞ্চলের কবিতায় তখনও রবীন্দ্রবলয় এবং ইসলামী পুনর্জাগরণের ভাবনাপুষ্ট আবহ বিরাজমান ছিল, আপনি এ থেকে বেরিয়ে এলেন কী করে?
আবুল হোসেন : আমি যখন ছেলেবেলায় প্রথম কবিতা লিখি, সেটা রবীন্দ্রনুসারী হয়ে যেত। তারপর যখন অন্যদের কবিতাও বেশি করে পড়া শুরু করলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে আমাকে ভিন্নরকম কবিতা লেখার চেষ্টা করতে হবে-যা রবীন্দ্র অনুসারী হবে না। করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায় কিংবা যতীন্দ্রমোহন বাগচী- কেউ রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে যেতে পারেননি; পেরেছিলেন-যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, আর পেরেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহীতে তিনি মাত্রাবৃত্তকে ভেঙে আলাদা সুর সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
আমার মনে হল যে, আমি রবীন্দ্র-নজরুলের দিকে যেতে পারি না। সে সময় জসীমউদ্দীনও আলাদা ধারায় লেখা শুরু করলেন। তিনি লোকগীতির ধারায় লোকগাথা রচনায় মনোযোগী হলেন। এভাবে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ, আমার মধ্যেও সে প্রচেষ্টা ছিল। আমি নিজের মতো লিখতে চেয়েছি।
আপনি শুরুতেই কি সচেতনভাবে আলাদা হতে চেয়েছিলেন?
আবুল হোসেন : আমার সবসময় মনে হতো কবিতার প্রচলিত যে ধারা-তা থেকে কিছু বর্জন করে এবং কিছু গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে। একজন কবিকে যদি সত্যিকার কবি হতে হয়, তাহলে তার নিজের ভাষা খুঁজে বের করতে হবে। কবিকে নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে হবে। নিজের একটা কাব্যভাষা তৈরি করতে হবে। যে কাজ সবাই করেছেন, সে কাজ করলে কোনো জায়গা হবে না কাব্যের ভুবনে।
আমি সমর সেনকে খুব পছন্দ করতাম। সমর সেনের কবিতা থেকেই আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি প্রকৃত গদ্য কবিতার পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথও গদ্য কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তা কাহিনীনির্ভর। সমর সেন সাম্যবাদী হলেও প্রকৃত রোমান্টিক গদ্য কবিতা লিখেছিলেন। আমি সমর সেনের কাছ থেকে এটুকু নিলাম যে-কবিতাকে গদ্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। আমিও চেয়েছিলাম কবিতার ভাষা মুখের ভাষার দিকে যাবে। আর একটি জিনিস মনে রাখতাম-কবিতাকে গদ্যের কাছাকাছি নিলেও কবিতায় ছন্দ রক্ষিত হবে। আমার প্রথম বই নববসন্ত-এ তা পুরোপুরি আমি করতে পারিনি। তা করতে আমার আরও ৩-৪ বছর সময় লেগে গিয়েছিল।
ষ চল্লিশের কবিদের মধ্যে একমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠ কবি হিসেবে আপনার
প্রতিক্রিয়া কী?
আবুল হোসেন : আমি এই বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব দিই না। কেউ যদি বলেন যে-উনি আমাদের জ্যেষ্ঠ কবি, তাতে কবিতার কিছু আসে যায় না। আমার মনে হয় যে, বিধাতা আমার প্রতি সদয়, আমি এখনও কর্মক্ষম আছি। আমি চাই-আমি যেন শেষদিন পর্যন্ত কর্মক্ষম থেকে যেতে পারি। আমি জীবনযাপন করি নিয়মমাফিক, খাওয়া-দাওয়াও স্বনিয়ন্ত্রিত। সারাজীবন নিয়ম মেনেই চলেছি, এখনও চলি।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]
No comments